লিপস্টিক ইফেক্ট: মন্দায় প্রসাধনীর চাহিদা কেন বাড়ে?
Published: 2nd, August 2025 GMT
চলতি অর্থবছরে আমদানি করা প্রসাধনী ও টয়লেট্রিজের ওপর কাস্টমস শুল্ক ও ভ্যাট বৃদ্ধির প্রস্তাব ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়েছে এবং তা কার্যকরের পথে। সরকারি নীতিনির্ধারকেরা হয়তো ভাবছেন এতে দেশীয় শিল্প সুরক্ষা পাবে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক গবেষণা ও বাজারপ্রবণতা বলছে, বাস্তবতা ভিন্ন। অর্থনৈতিক মন্দার সময়ও প্রসাধনসামগ্রীর চাহিদা কমে না, বরং অনেক ক্ষেত্রে বাড়ে। এ ঘটনাকে অর্থনীতিবিদেরা ‘লিপস্টিক ইফেক্ট’ নামে অভিহিত করেছেন।
লিপস্টিক ইফেক্ট একটি অর্থনৈতিক তত্ত্ব, যা ব্যাখ্যা করে, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় মানুষ কেন কম দামি বিলাসবহুল পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
২০০১ সালে এস্তে লডারের চেয়ারম্যান লিওনার্ড লডার ধারণাটি প্রথম সামনে আনেন। তিনি লক্ষ করেন, মন্দার সময়েও লিপস্টিকের বিক্রি বেড়েছে। জেপি মরগান প্রাইভেট ব্যাংকের আচরণগত বিজ্ঞানের প্রধান জেফ ক্রিসলার বলেন, ‘মানুষ ১০ ডলারের ১০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি সহ্য করতে পারে, কিন্তু বাড়ির ক্ষেত্রে তা অসম্ভব।’
২০০৮-১০ সালের বিশ্বমন্দার সময় ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষণায় দেখা যায়, ১৮-৪০ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে প্রসাধনীর ব্যয় গড়ে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। এই প্রবণতা বিবাহিত ও অবিবাহিত—সব নারীর মধ্যেই দেখা গেছে।
বাংলাদেশের সৌন্দর্য ও ব্যক্তিগত পরিচর্যা বাজার দ্রুত বাড়ছে।
২০২৩ সালে এর বাজার ছিল প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২৭ সালের মধ্যে ১ দশমিক ৫৫ বিলিয়নে পৌঁছাতে পারে। আধুনিক যুগে বিউটি ইনফ্লুয়েন্সারদের প্রভাব ক্রমবর্ধমান। ২০২৪ সালে ওরভেওন ব্র্যান্ডগুলোর ডিজিটাল বিক্রি ২০২২ সালের ১৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৩ শতাংশে পৌঁছেছে।
ইউটিউব ও টিকটকের নতুন ইনফ্লুয়েন্সাররা কোম্পানিগুলোর ২০ শতাংশ অনলাইনে বিক্রয় চালাচ্ছেন।
গবেষণায় লিপস্টিক ইফেক্টের তিনটি প্রধান তত্ত্ব পাওয়া গেছে। সবচেয়ে শক্তিশালী হলো মনোবৈজ্ঞানিক প্রতিস্থাপন তত্ত্ব, যেখানে মানুষ ব্যয় সংকোচন করে দামি পোশাক বা অলংকার না কিনে কম খরচে ‘নিজেকে ভালো রাখার’ উপায় খোঁজে।
বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত পরিবারে উৎসবে নতুন পোশাকের পরিবর্তে প্রসাধনী কেনার প্রবণতা এই তত্ত্বকে সমর্থন করে।
দ্বিতীয় তত্ত্ব অনুযায়ী, আর্থিক অনিশ্চয়তায় নারীরা নিজের সৌন্দর্য বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবনসঙ্গী খোঁজার সম্ভাবনা বাড়াতে চান। বাংলাদেশের সমাজেও এ প্রবণতা দেখা যায়। তবে গবেষণা বলছে, বিবাহিত নারীরাও একই কারণে প্রসাধনী কেনেন।
আরও পড়ুনপ্রসাধনীতে উচ্চ ভ্যাট বসালে আসলেই কি রাজস্ব বাড়বে০৩ জুন ২০২৫তৃতীয় তত্ত্ব অনুযায়ী, চাকরি পাওয়ার জন্য বা রক্ষার লক্ষ্যে প্রসাধনীর ব্যবহার বাড়ে। তবে এ বিষয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মজীবী ও বেকার উভয় নারীর প্রসাধনী ব্যয়ে তেমন পার্থক্য দেখা যায়নি।
সরকার যদি প্রস্তাবিত শুল্ক বৃদ্ধি বাস্তবায়ন করে, তাহলে কয়েকটি সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রথমত, অবৈধ আমদানি বাড়বে, সরকার রাজস্ব হারাবে এবং সাধারণ ভোক্তা নিম্নমানের পণ্যের ঝুঁকিতে পড়বে। অনেক অনলাইন উদ্যোক্তা আমদানি করা প্রসাধনী বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এই শুল্কবৃদ্ধি তাঁদের জন্য ক্ষতিকর হবে।
উচ্চ শুল্ক দেশীয় উৎপাদকদের প্রতিযোগিতাহীন একটি স্বাচ্ছন্দ্যের পরিবেশ তৈরি করবে, যা মানোন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এই পটভূমিতে কিছু বাস্তবসম্মত বিকল্প ভাবা জরুরি। যেমন দেশীয় শিল্পের উন্নয়নে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি হস্তান্তরের সুযোগ তৈরি এবং কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক হ্রাস। পাশাপাশি হালাল সার্টিফিকেশন অর্জনের মাধ্যমে মুসলিম দেশগুলোয় রপ্তানি সম্ভাবনা বাড়ানো যেতে পারে।
আরও পড়ুনকর ফাঁকি না ধরে ভ্যাট বাড়ানোর সহজ রাস্তা কেন? ০৫ জানুয়ারি ২০২৫প্রসাধনীকে সাধারণভাবে একটি ‘নরমাল গুড’ ধরা হয়। আয় বাড়লে এর চাহিদা বাড়ে। কিন্তু মন্দার সময়ও এর চাহিদা কমে না। জেপি মরগানের দীপ্তি নাগুলাপল্লি বলেন, ‘যখন বড় কিছু আপনার নাগালের বাইরে চলে যায়, তখন আপনি ছোট কিছুতে সান্ত্বনা খুঁজে নেন।’
আন্তর্জাতিক বাজারে এর বাস্তব উদাহরণ রয়েছে। ২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে বিলাসবহুল ব্র্যান্ড এলভিএমএইচের পারফিউম ও প্রসাধনী বিভাগের মুনাফা ৩ শতাংশ বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে চার মাসেই বিউটি স্টোরে গ্রাহকসংখ্যা বেড়েছে। বাংলাদেশের বাজারেও প্রসাধনী খাতে ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ দেশীয় কোম্পানির হাতে। তাদের বার্ষিক কারবার প্রায় ১৫০ বিলিয়ন টাকা এবং এতে প্রায় ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। তবে এই খাতে কাঁচামালের ৯০ শতাংশ আমদানিনির্ভর, প্রযুক্তিগত দক্ষতা কম এবং ব্র্যান্ডিং দুর্বল।
লিপস্টিক ইফেক্ট একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা, যা বাংলাদেশেও প্রযোজ্য। মন্দার সময় মানুষ প্রসাধনী কেনার মাধ্যমে আত্মপ্রত্যয়ের একধরনের প্রতীক খোঁজে। এই বাস্তবতা উপেক্ষা করে শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সরকার, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা—তিন পক্ষের জন্যই ক্ষতির কারণ হতে পারে।সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আধিপত্য প্রসাধনী ব্যবহারে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ভার্চ্যুয়াল মেকআপ ট্রাই-অন অ্যাপ, ইউটিউব-ইনস্টাগ্রাম রিভিউ, রেটিং ও ‘সোশ্যাল শপিং’ এখন ক্রয়ের সিদ্ধান্তে বড় ভূমিকা রাখছে।
অর্থনৈতিক চাপে থাকা মার্কিনরা ৩০ ডলারের ডিওর লিপ প্লাম্পার কিনলেও বাড়ি বা গাড়ি কেনার কথা ভাবেন না। এই ক্ষুদ্র বিলাসিতা মানসিক চাপ প্রশমনে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
এবারের বাজেটে প্রসাধনী আমদানিকারকেরা এক গুরুতর বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। এনবিআর আমদানি করা কসমেটিকসে নতুন মিনিমাম ভ্যালু নির্ধারণের মাধ্যমে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বাড়িয়েছে, যেখানে আগেই এই পণ্যে মোট করভার (টিটিআই) ছিল ১৫৮ থেকে ১৮৩ শতাংশ। অথচ রোলস-রয়েসের (ইলেকট্রিক) ওপর টিটিআই মাত্র ৮৯ শতাংশ।
এমনকি স্যামন, টুনা মাছ, কাপড় ও জুতার ওপর কর হ্রাস করা হয়েছে এবারের বাজেটে। এসব তথ্যই প্রমাণ করে, আমদানি করা কসমেটিকস ব্যবসায়ীরা জাতীয় বাজেটে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।
লিপস্টিক ইফেক্ট একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা, যা বাংলাদেশেও প্রযোজ্য। মন্দার সময় মানুষ প্রসাধনী কেনার মাধ্যমে আত্মপ্রত্যয়ের একধরনের প্রতীক খোঁজে। এই বাস্তবতা উপেক্ষা করে শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সরকার, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা—তিন পক্ষের জন্যই ক্ষতির কারণ হতে পারে।
প্রতিযোগিতা উৎকর্ষের জন্ম দেয়। প্রতিযোগিতার অনুপস্থিতি মানে গুণগত উন্নয়নের অনুপস্থিতি। তাই সরকারের উচিত সুরক্ষাবাদী নীতির পরিবর্তে প্রতিযোগিতামূলক ও উদ্ভাবনী পরিবেশ সৃষ্টি করা, যা সত্যিকার অর্থেই দেশীয় শিল্পের টেকসই উন্নয়নে সহায়ক হবে।
নির্মল রায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: মন দ র সময় ব স তবত প রবণত র জন য তত ত ব আমদ ন ন নয়ন ব যবস সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
১০০ কোটি টাকার পাচারের অভিযোগ, জাহাঙ্গীরের নামে মামলা
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দপ্তরের সাবেক পিয়ন জাহাঙ্গীর আলম ওরফে পানি জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে মামলা করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) নোয়াখালীর চাটখিল থানায় মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে এই মামলা করেছে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট।
আরো পড়ুন:
নাফিসা কামালসহ ৮ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের মামলা
সাজিদ হত্যার তদন্তে সিআইডিকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমোদন
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান জানান, প্রাথমিক অনুসন্ধানে উল্লেখযোগ্য প্রমাণ পাওয়ায় নোয়াখালীর চাটখিল থানায় জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান জাহাঙ্গীর আলম জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তিনি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে স্বল্প সময়ের জন্য ‘ব্যক্তিগত সহকারী’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই দায়িত্বই তাকে আর্থিকভাবে লাভবান করেছে মর্মে প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
জসীম উদ্দিন খান জানান, ২০১০ সালে জাহাঙ্গীর ‘স্কাই রি অ্যারেঞ্জ লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি গঠন করে বিকাশের ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবসা নেন। কিন্তু এর আড়ালে তিনি অসংখ্য সন্দেহজনক ব্যাংকিং কার্যক্রম করেন। কোম্পানির নামে একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক অঙ্কের টাকা জমা হয়, যার বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি ও ব্যবসার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
সিআইডির এই কর্মকর্তা জানান, প্রতিষ্ঠানটির অ্যাকাউন্টগুলোতে ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংকে মোট ৫৬৫ কোটিরও বেশি টাকা লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ নগদে জমা হয়েছে দেশের নানা স্থান থেকে। এসব অর্থের উৎস অজানা এবং হুন্ডি ও মানিলন্ডারিং কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত বলে প্রাথমিক প্রমাণ মেলে।
বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দীন জানান, জাহাঙ্গীর আলম তার স্ত্রী কামরুন নাহার ও ভাই মনির হোসেনের সহায়তায় দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ অর্থ লেনদেন করতেন। জাহাঙ্গীর আলম ও তার স্ত্রী ২০২৪ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এবং বর্তমানে ভার্জিনিয়ায় অবস্থান করছেন। বিদেশে তাদের বিনিয়োগ বা সম্পদ ক্রয়ের কোনো সরকারি অনুমোদন না পাওয়া গেলেও তারা যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রমাণ মেলে।
অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে, জাহাঙ্গীর আলম, তার স্ত্রী কামরুন নাহার, ভাই মনির হোসেন এবং প্রতিষ্ঠান স্কাই রি অ্যারেঞ্জ লিমিটেড যৌথভাবে ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ১০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। অপরাধের পূর্ণাঙ্গ তথ্য উদঘাটন, অপরাপর সদস্যদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করার স্বার্থে সিআইডির তদন্ত ও অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
ঢাকা/মাকসুদ/সাইফ