চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ১৪৮ কিলোমিটার। এই গুরুত্বপূর্ণ সড়কের মোড়ে মোড়ে বাজার। নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও তিন চাকার যান চলে ইচ্ছেমতো। কোথাও সড়ক এত সরু যে দুটি গাড়ি পাশাপাশি চলা দায়। ফলে লেগে থাকে যানজট। এতে তিন ঘণ্টার পথ যেতে সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টা।
চট্টগ্রামের শাহ আমানত সেতুর দক্ষিণ প্রান্তের টোল বক্স থেকে এক শ মিটার পর মইজ্জারটেক গোলচত্বর। ওই গোলচত্বর থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক শুরু। এরপর পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, রামু হয়ে পর্যটন শহর কক্সবাজার। এক প্রান্তে সমুদ্রসৈকত হওয়ার কারণে এটি দেশের অন্যতম ব্যস্ততম মহাসড়কগুলোর একটি।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ গত ১৩ মার্চ জরিপ করে দেখেছে, এ মহাসড়কে দিনে গড়ে ২৬ হাজার ৬৮৪টি যানবাহন চলাচল করে। সবচেয়ে বেশি চলে তিন চাকার বিভিন্ন যানবাহন, ৪০ শতাংশ। তবে সরকারি ছুটি ও ঈদের আগে–পরে এ মোট যানবাহনের সংখ্যা ৩৫ থেকে ৪০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। যানবাহন চলাচল করে যেনতেনভাবে। ট্রাফিক আইন মানে না।
অনিয়মের কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা। গত দুই বছরে এ মহাসড়কে ছোট-বড় তিন শতাধিক দুর্ঘটনায় অন্তত ২০০ জন নিহত হয়েছেন। এরপরও মহাসড়কের উন্নতিতে কারও নজর নেই। মাহবুবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কক্সবাজার জেলা শাখাযানবাহনের চালক, স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে মহাসড়কের লোহাগাড়া, চুনতি, জাঙ্গালিয়া, চকরিয়ার হারবাং, ইসলামনগর, মালুমঘাটের ছগিরশাহকাটা ঢালা, ডুলাহাজারার পাগলিরবিল, নাপিতখালী, রামু রাবারবাগানসহ কয়েকটি অংশে ভেঙে গেছে। পুরো অংশে অন্তত ৩০টি বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে। শুধু কক্সবাজার অংশেই অন্তত ৫০ কিলোমিটার সরু সড়ক। অর্থাৎ সড়কের প্রস্থ ১৭ থেকে ২২ ফুটের মধ্যে। এ ছাড়া অবৈধ হাটবাজার ও পশুর হাটের সংখ্যা ৩০টির বেশি। এসব বাজার যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।
শাহাদাত হোসেন কক্সবাজারে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় চাকরি করেন। তিনি চট্টগ্রাম শহর থেকে কক্সবাজার যাতায়াত করেন। জানতে চাইলে শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যানজটের কারণে অতিরিক্ত দুই ঘণ্টা বাসেই কাটাতে হয়। অন্তত তিন চাকার যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে পারলে যানজট কমে যেত।
জানতে চাইলে চিরিংগা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরিফুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, হাইওয়ে পুলিশ একগুচ্ছ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। অনিয়ম বন্ধে সেনাবাহিনী, হাইওয়ে পুলিশ, থানা–পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন একসঙ্গে কাজ করছে। এর বাইরে নিয়মিত অভিযানও পরিচালনা করা হচ্ছে।
‘ভয়ানক’ ২৭ কিলোমিটার
মহাসড়কটির সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হলো কক্সবাজারের চকরিয়ার মালুমঘাট থেকে চট্টগ্রাম লোহাগাড়া পর্যন্ত। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৭ কিলোমিটার। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে যাওয়া এ অংশ যেমন সরু, তেমনি আঁকাবাঁকা।
দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানে চোখ রাখলেই অংশটি কেন ভয়ানক, তা বোঝা যায়। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা তদারকি সেলের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত মার্চ থেকে মে—এই তিন মাসে ২৭ কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ২৭টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৪২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন ৫৬ জন। এর আগের চার বছরে শতাধিক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন আরও ২২৪ জন।
এই মহাসড়কে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটেছে ওই ২৭ কিলোমিটারের মধ্যে। ২০২২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে চকরিয়ার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাটের হাসিনাপাড়া এলাকায় পিকআপের চাপায় নিহত হন একই পরিবারের ছয়জন।
মহাসড়কে পদে পদে বিশৃঙ্খলা উল্লেখ করে কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মহাসড়কের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাটি অতিরিক্ত সরু। ট্রাকে লবণ পরিবহনের কারণে সড়কটি পিচ্ছিল হয়ে পড়ে। পর্যটকবাহী যানবাহনের চালকেরা পিচ্ছিল সড়ক অতিক্রমের সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।
চার লেন কবে হবে
কক্সবাজার সৈকতে হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে গত তিন দশকে গড়ে উঠেছে পাঁচ শতাধিক হোটেল–মোটেল। হোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির হিসাবে, প্রতিবছর কক্সবাজার ভ্রমণে আসেন অন্তত ৭০ লাখ পর্যটক। ঈদ ও সরকারি ছুটিতে বেশি পরিমাণে পর্যটক আসেন।
সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, তিন দশক ধরেই মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীতকরণের দাবি জানিয়ে আসছেন কক্সবাজারবাসী। প্রতিবছর দুর্ঘটনা বাড়ছে। বিশেষ করে ঈদ ও কয়েক দিনের টানা ছুটিতে যখন কক্সবাজারে পর্যটকের ঢল নামে, তখন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানিও বাড়তে থাকে। গত ঈদের ছুটিতে মহাসড়কের চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকায় মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় ৩টি দুর্ঘটনায় ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
সড়কটি চার লেন করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও আলোর মুখ দেখেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া সমীক্ষা কার্যক্রম চলতি বছরের আগস্টে শেষ হওয়ার কথা। তবে চকরিয়া-চুনতি এলাকায় বন বিভাগ ২৭ কিলোমিটার সংরক্ষিত বনে সড়ক সম্প্রসারণে ভূমি বরাদ্দ দিতে অনাগ্রহ দেখিয়েছে। এতে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিন যা দেখা গেল
গতকাল সোমবার দিনভর মহাসড়কের মইজ্জারটেক, পটিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া ও কক্সবাজারের প্রায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ঘুরে দেখেছেন প্রথম আলোর পাঁচ প্রতিবেদক। দেখা গেছে, মইজ্জারটেকে এলোমেলো দাঁড়িয়ে আছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা। কিছু যানবাহন চলছিল উল্টো পথে। পটিয়া বাসস্টেশন, থানা মোড়, মুনসেফ বাজারের প্রায় এক কিলোমিটারে যানজট লেগে থাকে। মহাসড়কের ওপরই রাখা ছিল যানবাহন। কোনো কোনো বাস যাত্রী তুলছিল নিজেদের ইচ্ছেমতো।
এদিকে সাতকানিয়ার কেরানীহাট ও লোহাগাড়ার পদুয়া, আমিরাবাদ ও আধুনগর ফুটপাত হকারদের দখলে চলে গেছে। এসব স্থানে তীব্র যানজট দেখা গেছে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের বাসচালক মোহাম্মদ আইয়ুব (৪৮) বলেন, বেলা ৩টার পর থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত তীব্র যানজট হয়।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অনিয়মের কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা। গত দুই বছরে এ মহাসড়কে ছোট-বড় তিন শতাধিক দুর্ঘটনায় অন্তত ২০০ জন নিহত হয়েছেন। এরপরও মহাসড়কের উন্নতিতে কারও নজর নেই।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার এবং প্রতিনিধি, চকরিয়া, লোহাগাড়া, পটিয়া ও আনোয়ারা)
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ২৭ ক ল ম ট র ক দ র ঘটন য় প রথম আল ক ন প রথম আল শত ধ ক চকর য় সবচ য় য নজট
এছাড়াও পড়ুন:
যে কারণে ফেনী এখন ভাঙাচোরা সড়কের শহর
শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়ক ফেনী শহরের ব্যস্ততম রাস্তা। এই সড়কের পাশেই শহরের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা। একটু ভারী বৃষ্টিতেই ডুবে যায় সড়কটি। গত বছরের আগস্টের ভয়াবহ বন্যায় সড়কের দুই কিলোমিটার অংশ কোমরপানিতে তলিয়ে ছিল পাঁচ দিন। এতে সড়কের বিভিন্ন স্থান ভেঙে খানাখন্দ তৈরি হয়। পানি নেমে যাওয়ার পর পাথর ও ইটের সুরকি দিয়ে অস্থায়ী মেরামত করা হলেও স্থায়ী সংস্কার হয়নি। এ বছর বর্ষায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় আরও বেহাল হয়েছে সড়কটির দশা। ছোট ছোট গর্তে ভরা এই সড়ক দিয়ে যানবাহন চলে ধীরগতিতে। ফলে সড়কে যানজট লেগেই থাকে।
পৌর শহরের এই প্রধান সড়কে তা–ও যানবাহন চলে কোনোরকমে। শহরের অলিগলি আর অভ্যন্তরীণ সড়কের দশা এর চেয়ে অনেক বেহাল। শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়ক থেকে একটু এগোলে হাসপাতাল মোড় থেকে সালাহ উদ্দিন মোড় পর্যন্ত যে সড়কটি রয়েছে, তাতে আগাগোড়াই বড় বড় খানাখন্দ। সড়কটির সাহেববাড়ি অংশে বড় গর্ত তৈরি হওয়ায় ইট দিয়ে সাময়িক মেরামত করলেও ছোট-বড় গাড়ির চাকা সেসবকে স্থায়ী হতে দেয়নি। এটিসহ পৌরসভার ছোট-বড় প্রায় ৩০টির বেশি সড়ক এখনো বন্যার ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে। ২০২৪ সালের বন্যার এক বছর পার হলেও ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোর দৃশ্যমান কোনো সংস্কার হয়নি। তবে পৌর কর্তৃপক্ষ বলছে, ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো দ্রুত মেরামতের কাজ অচিরেই শুরু হবে।
একসময়ের ছিমছাম ও সাজানো ফেনী এখন ভাঙাচোরা সড়কের শহর। খানাখন্দে ভরা সড়কগুলোতে গাড়ি চলে হেলেদুলে। হালকা বৃষ্টিতেও প্রায় সব সড়কে পানি জমে যায়। পানিনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় বৃষ্টি হলেই সড়কে পানি জমে। অধিকাংশ সড়কের পিচঢালাই উঠে যাচ্ছে। ক্ষতবিক্ষত সড়ক শহরকে যেমন শ্রীহীন করেছে, তেমনি বাড়িয়েছে জনদুর্ভোগ।
সরেজমিন ঘুরে শহরের পাঠানবাড়ি সড়ক, মাস্টারপাড়া মুন্সিবাড়ি সড়ক, কদল গাজী সড়ক, বিরিঞ্চি প্রাইমারি স্কুল সড়ক, বিরিঞ্চি রতন সড়ক, সুলতানপুর আমির উদ্দিন সড়ক, গাজী ক্রস রোড, সুফি সদর উদ্দিন সড়ক, আবু বক্কর সড়ক, শহীদ ওবায়দুল হক সড়ক, মহিপাল চৌধুরী বাড়ি সড়ক, চাড়িপুর মৌলভী আব্দুস সালাম সড়ক, উত্তর চারিপুর বাইতুশ শরিফ সড়ক, পূর্ব বিজয় সিং ছোট হুদা দিঘি সড়ক, মধুপুর মালেক মিয়া বাজার সড়কের বেহাল দশা দেখা গেছে। সব মিলিয়ে ৩০টি সড়কের সব কটিই এখন বেহাল।
একসময়ের ছিমছাম ও সাজানো ফেনী এখন ভাঙাচোরা সড়কের শহর। খানাখন্দে ভরা সড়কগুলোতে গাড়ি চলে হেলেদুলে। হালকা বৃষ্টিতেও প্রায় সব সড়কে পানি জমে যায়। পানিনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় বৃষ্টি হলেই সড়কে পানি জমে। অধিকাংশ সড়কের পিচঢালাই উঠে যাচ্ছে। ক্ষতবিক্ষত সড়ক শহরকে যেমন শ্রীহীন করেছে, তেমনি বাড়িয়েছে জনদুর্ভোগ।ফেনী পৌরসভায় ইজিবাইক চালান সুজাউদ্দিন। ভাঙাচোরা সড়কের কারণে অন্য অনেকের চেয়ে তাঁকে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয় বলে জানিয়েছেন। ফেনীর শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়কে সম্প্রতি সুজাউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়। কথায় কথায় তিনি বলেন, ছোট-বড় গর্ত থাকায় অতিরিক্ত ঝাঁকুনিতে প্রতিনিয়ত গাড়ির যন্ত্রাংশ নষ্ট হচ্ছে। অনেক সময় যাত্রীরা গাড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার দশা হয়। রাস্তা খারাপ হওয়ায় ভাড়াও কমেছে তাঁর।
শাহিন একাডেমি এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ ইব্রাহিম শহরের সড়কগুলোর ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিয়ে রীতিমতো ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সড়কের পাশে পর্যাপ্ত নালা নেই। এ কারণে একটু বৃষ্টি হলেই পানি জমে। বাড়ির সামনের সড়কের এই হাল হলে আর কাজকর্ম করতে ইচ্ছা হয় না।
ফেনী পৌরসভার বিসিক–মুক্তার বাড়ি সড়কের মাঝে এমন বড় বড় খানাখন্দ