উপনিবেশের শিকার কোনো জাতি যখন সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই করে, তখন তাদের সচেতন মন ও সংগঠিত প্রয়াস অবধারিতভাবে সাংস্কৃতিক সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটায়; অর্থাৎ সংগ্রাম ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কোনো আলাদা বস্তু হিসেবে বিরাজ করে না। তারা মিলেমিশে, একে অপরের পরিপূরক হয়ে, আগের চেয়ে শাণিত চেহারায় ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত হয়। হুবহু না হলেও, কাছাকাছি এই কথাগুলোই ১৯৫৯ সালের এক বক্তৃতায় বলেছিলেন সংগ্রামী চিন্তাবিদ ফ্রানৎস ফানোঁ।

ফানোঁ যে রকম মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেছেন, সে রকম এক যুদ্ধের উজ্জ্বল যোদ্ধা ছিলেন জহির রায়হান। ১৯৭১ সালের সেই যুদ্ধে অনেকেই আত্মগোপন করেন অথবা সীমান্ত অতিক্রম করে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। জহির রায়হান এর কোনোটিই করেননি। আগরতলা হয়ে কলকাতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ শুধু নয়, গেরিলা কায়দায় যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করে দলিলচিত্র নির্মাণের কাজ করেছেন জহির রায়হান। নিজে পরিচলানা করেছেন ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘আ স্টেট ইজ বোর্ন’; আলমগীর কবির ও বাবুল চৌধুরীকে দিয়ে নির্মাণ করিয়েছেন যথাক্রমে ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ ও ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’। যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই পাকিস্তানি উপনিবেশের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গে বুদ্ধিজীবীরা সংঘবদ্ধ হয়ে ‘যুদ্ধ’ শুরু করেন। নির্দিষ্ট করে বললে, সেটা ১৯৫২ সাল থেকেই। দমননীতির প্রতিবাদে তখন বাংলা ভাষার চর্চা, রবীন্দ্রসংগীতের প্রসার ও লোককাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয় এখানে।

১৯৬৬ সালে মুক্তি পাওয়া বেহুলা ছবিটি ছিল লোককাহিনিনির্ভর। ছবিটি নিয়ে কলকাতার সাংবাদিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে জহির রায়হান বলেছিলেন, ‘(এটি) চাঁদ সদাগরের কাহিনি, বাংলার লৌকিক কাহিনি। এর একটি সাধারণ মানবিক আবেদন আছে। কিন্তু সেন্সর আর গোঁড়াপন্থীরা ক্ষেপে লাল। আমি নিশ্চয় কাফের। নয়তো হিন্দু পুরাণ নিয়ে ছবি তুলব কেন? অথচ বেহুলার মধ্যে আধুনিক যুগের বক্তব্য ছিল। দেবতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামের কথাই ছিল সেখানে বড়। জানেন, গোঁড়াদের বিক্ষোভের চোটে আমার ছবি ব্যান হয়ে যায় আরকি! অবশেষে অনেক টালবাহানার পর বেহুলা রিলিজ হলো বটে, তবে সেই থেকে ঢালাও নির্দেশ জারি হলো, পাকিস্তানে কোনো হিন্দু দেব–দেবীর ব্যাপার নিয়ে ছবি করা চলবে না।’

যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই পাকিস্তানি উপনিবেশের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গে বুদ্ধিজীবীরা সংঘবদ্ধ হয়ে ‘যুদ্ধ’ শুরু করেন। নির্দিষ্ট করে বললে, সেটা ১৯৫২ সাল থেকেই। দমননীতির প্রতিবাদে তখন বাংলা ভাষার চর্চা, রবীন্দ্রসংগীতের প্রসার ও লোককাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয় এখানে।

মুক্তির সংগ্রামকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করতে ফ্রানৎস ফানোঁ বলেন, একটি উপনেবিশত জাতির ভেতর লড়াকু সাহিত্য গড়ে ওঠে এবং সেটাই জাতীয় সাহিত্য। জাতির অস্তিত্বের প্রশ্নে এই লড়াকু সাহিত্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেতনা দান করে। এর পাশাপাশি, ফানোঁ আরও বলছেন, কাজ করে লোককাহিনি। যে লোকহকাহিনিকে মানুষ পুরোনো বলে দূরে সরিয়ে রাখে, সেই পুরোনোকেই মুক্তিসংগ্রামের কালে নতুন করে হাজির করার কাজটি করেন গল্পকথক। লোককাহিনির যে পুরোনো দ্বন্দ্ব, সেটিকে চরিত্র ও ঘটনার বিনির্মাণের মাধ্যমে সমসাময়িক, আধুনিক ও লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়। ‘অনেক অনেক দিন আগের কথা’, লোককাহিনি এমন করে শুরুর পরিবর্তে শুরু হয় এভাবে, ‘যে ঘটনা আজ বলতে যাচ্ছি, সেটা অন্য এক সময়ে হলেও তা আজ অথবা কালও ঘটতে পারে’; অর্থাৎ ভালো ও মন্দের যে চিরায়ত দ্বন্দ্ব, সেটার দিকেই ইঙ্গিত দেন ফানোঁ।

জহির রায়হানের বক্তব্য ও কাজ যেন ফানোঁর বক্তৃতারই প্রতিধ্বনি। ফানোঁ বক্তৃতা করেন ১৯৫৯ সালে আর জহির রায়হানের ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬৬ সালে। আমি জহির রায়হানের ভেতর ফানোঁর ছায়া দেখতে পাই। জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ পাকিস্তান আমলের বাস্তবতায় শাসক ও শোষিতের রূপকাশ্রয়ী বয়ান হাজির করেছিল। এই পৌরাণিক কাহিনিকে জহির রায়হান মনে করতেন মানুষের কাব্য। যেখানে মানুষ মনসাদেবীর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া পূজা আর বল প্রয়োগ করে ভক্তি আদায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান করে, যেখানে অন্যায্য শাস্তির প্রতিবাদে জানবাজি রাখে এক নারী—বেহুলা। বেহুলার বিয়ের আগে শ্বশুর চাঁদ সওদাগর দেবী মনসার কোপানলে পড়ে সাতটি জাহাজ ও ছয় ছেলে হারায়। কিন্তু সে মাথা নত করতে নারাজ। সপ্তম ছেলেও যখন সাপের দংশনে মারা যায়, তখন স্ত্রী বেহুলা মর্ত্যের হয়েও স্বর্গলোকে পাড়ি জমায় এবং স্বামীকে ফিরিয়ে আনার জন্য জীবন বাজি রাখে। দেবীর অন্যায় অভিশাপ থেকে মুক্তি চায় বেহুলা এবং সেটা সে অর্জন করে ছাড়ে। এই কাহিনির নারীবাদী পাঠ থাকতে পারে, তবে এর মার্ক্সবাদী পাঠও রয়েছে। জহির রায়হান দ্বিতীয় পাঠ থেকেই ছবিটি নির্মাণ করেছেন।

জহির রায়হান বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারসহ আরও বুদ্ধিজীবীদের খুনিদের খোঁজ করছিলেন। সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেছিলেন, এ ব্যাপারে তিনি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবেন। অনেক তথ্য তাঁর কাছে ছিল। এটাই কাল হয়। ৩০ জানুয়ারি তাঁকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়।

মনে রাখতে হবে, বেহুলা এমন সময়ে নির্মাণ ও মুক্তি (১৯৬৬, ২৮ অক্টোবর) পাচ্ছে, যখন ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব চরমে, যখন পূর্ববঙ্গে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করছেন। ছয় দফা আন্দোলনের পক্ষে–বিক্ষোভ সমাবেশ হচ্ছে, সেখানে গুলি চলছে, শহীদ হচ্ছেন আন্দোলনকারীরা। ইত্তেফাক পত্রিকাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বাক্‌স্বাধীনতাকে হরণ করা হচ্ছে। এমন রাজনৈতিক বাস্তবতায়, জাতীয় মুক্তির বাসনা যখন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তখন জহির রায়হান আশ্রয় নিলেন লোককাহিনির। যে কাহিনি প্রভুর বিরুদ্ধে ভৃত্যের বিপ্লবকে মহিমান্বিত করে।

পশ্চিম পাকিস্তানি প্রভু ও এ দেশীয় সেবকেরা সেটা বুঝতে পারে। তাই তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুসারেই এই ছবিকেও সাম্প্রদায়িক সিল মেরে কার্যত জাতীয় মুক্তির চেতনাকে মাটিচাপা দিতে চায়। পরে তো আমরা দেখেছি, মুক্তিযুদ্ধকেই তারা ইসলামবিরোধী বলে প্রচার করতে শুরু করে। যার ধারাবাহিকতা আজ পর্যন্ত আমাদের গোচরে আসে। সে সময় জাতির সঙ্গে ধর্ম মিশিয়ে হাঁসজারু জাতীয়তাবাদ খাড়া করতে চেয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ও তাদের সহযোগীরা। তাই তো দেখা যায়, সব ক্ষেত্রেই ধর্মের চিহ্ন খোঁজা হয়েছে তখন। তৎকালীন ফিল্ম সেন্সর বোর্ড ঘোষণা দিয়েছিল, ছবিতে কোনো চরিত্র সিঁদুর পরতে পারবে না, এমনকি কেউ নামের আগে শ্রীমতিও লিখতে পারবে না। জহির রায়হান বলছেন, ‘ওদের ধারণা ছিল, বাঙালি পরিচালকেরা ছায়াছবির মধ্যে হিন্দুয়ানি ঢুকিয়ে ইসলামের ইজ্জত নষ্ট করছেন।’

‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৬৯) ছবিতেও এমন সাম্প্রদায়িকতার শিকার হন জহির রায়হান। বলেছেন, ‘আমার “জীবন থেকে নেয়া” ছবিতে এক জায়গায় ছিল, কাঁসার বাসনে ভাত খাচ্ছে ছবির কয়েকটি চরিত্র। সেন্সর অমনি চেপে ধরল, ও চলবে না, কাঁসার বাসনে তো হিন্দুরা খায়, অতএব কাঁসা মিনস হিন্দু কালচার…।’

সাম্প্রদায়িকতাকে জাতির জন্য বড় শত্রু মনে করতেন জহির রায়হান। দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। রাজাকার ও আলবদররা তখনো গোপনে সাম্প্রদায়িক প্রচার–প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে লিফলেট বিলির মাধ্যমে। পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ঢাকায় বসে তখন জহির রায়হান ক্ষোভ নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের বড় শত্রু সাম্প্রদায়িকতা। ভয় হয়, ঘুরেফিরে আমরা আবার তার খপ্পরে না গিয়ে পড়ি।…ধর্মকে আমাদের রাষ্ট্রিক জীবন থেকে একেবারে মুছে ফেলতে হবে। ধর্ম হলো সম্পূর্ণ মনের জিনিস।’

রাষ্ট্র কোনো একটি ধর্মকে বিশেষ গুরুত্ব দেবে না, ধর্ম-বর্ণ-জাতি-লিঙ্গনির্বিশেষে সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখবে, বৈষম্য থাকবে না, সবাই সমান বিচার পাবে, এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। দুঃখজনক সত্যি হলো, সেই অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার চেতনা আর মাথা তুলেই দাঁড়াতে পারেনি। উল্টো ধর্মকে বেশি করে আঁকড়ে ধরেছে রাষ্ট্র। গরিব মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। বিচারহীনতাকে আমরা সংস্কৃতিতে পরিণত করেছি। এভাবে কি একটি দেশে অর্জিত স্বাধীনতাকে রক্ষা করা যায়?

জহির রায়হানকেও রক্ষা করা যায়নি। যায়নি কারণ, বুদ্ধিজীবী হত্যার পেছনে যারা জড়িত, তারা নিজেদের রক্ষা করতে চেয়েছিল। জহির রায়হান বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারসহ আরও বুদ্ধিজীবীদের খুনিদের খোঁজ করছিলেন। সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেছিলেন, এ ব্যাপারে তিনি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবেন। অনেক তথ্য তাঁর কাছে ছিল। এটাই কাল হয়। ৩০ জানুয়ারি তাঁকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় সাহিত্য, তথা জাতীয় চলচ্চিত্র গড়ে ওঠার সম্ভাবনাকেও। জহির রায়হান শুধু নির্মাতা ছিলেন না, গুণী সাহিত্যিকও ছিলেন। তাঁর সৃষ্টিকর্মে জাতীয় চেতনার যে উন্মেষ আমরা দেখেছিলাম, তিনি বেঁচে থাকলে তাঁর দৌলতে বাংলাদেশ আরও উজ্জ্বল হতো। ফ্রানৎস ফানোঁ যেমনটা বলতেন, জাতীয় চেতনাই পারে আমাদের আন্তর্জাতিক মাত্রা এনে দিতে, জাতীয় চেতনা মানে কিন্তু জাতীয়তাবাদ নয়। জাতীয় চেতনারও নানা খানাখন্দ আছে, সেই আলাপ ভিন্ন। শুধু এটুকু বলেই শেষ করি, জহির রায়হান রাজনৈতিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জাতীয় চেতনাকে ধারণ করা শিল্পী ছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, দেশের আরও অনেক সেরা সন্তানের মতো তাঁকেও খুন হতে হয়, স্বদেশিদের হাতেই।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: বল ছ ল ন উপন ব শ আম দ র ষ ট কর

এছাড়াও পড়ুন:

কেইনের জোড়া গোলে চেলসিকে হারাল বায়ার্ন, চ্যাম্পিয়ন পিএসজির গোল উৎসব

বায়ার্ন মিউনিখ ৩–১ চেলসি

২০১২ সালে আলিয়াঞ্জ অ্যারেনায় ইতিহাস গড়েছিল চেলসি। ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখকে টাইব্রেকারে হারিয়ে প্রথমবারের মতো পরেছিল ইউরোপসেরার মুকুট।

 তবে এরপর থেকে বায়ার্নের সঙ্গে মুখোমুখি সব ম্যাচেই হেরেছে চেলসি। লন্ডনের ক্লাবটি পারল না আজও। হ্যারি কেইনের জোড়া গোলে চেলসিকে ৩–১ ব্যবধানে হারিয়েছে বায়ার্ন।

আলিয়াঞ্জ অ্যারেনায় ম্যাচের ২০ মিনিটে বায়ার্ন প্রথম গোলটা পেয়েছে উপহারসূচক। চেলসির সেন্টার–ব্যাক ট্রেভোহ চালোবাহ নিজেদের জালে বল জড়ালে এগিয়ে যায় বাভারিয়ানরা।

কিছুক্ষণ পরেই ব্যবধান দ্বিগুণ করেন কেইন। এবার ভুল করে বসেন চেলসির মইসেস কাইসেদো। নিজেদের বক্সে কেইনকে কাইসেদো অযথা ট্যাকল করলে পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি।

নতুন মৌসুমে গোলের পর গোল করেই চলেছেন হ্যারি কেইন

সম্পর্কিত নিবন্ধ