মুক্তিযোদ্ধা জহির রায়হান ও জাতীয় চেতনা
Published: 19th, August 2025 GMT
উপনিবেশের শিকার কোনো জাতি যখন সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই করে, তখন তাদের সচেতন মন ও সংগঠিত প্রয়াস অবধারিতভাবে সাংস্কৃতিক সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটায়; অর্থাৎ সংগ্রাম ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কোনো আলাদা বস্তু হিসেবে বিরাজ করে না। তারা মিলেমিশে, একে অপরের পরিপূরক হয়ে, আগের চেয়ে শাণিত চেহারায় ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত হয়। হুবহু না হলেও, কাছাকাছি এই কথাগুলোই ১৯৫৯ সালের এক বক্তৃতায় বলেছিলেন সংগ্রামী চিন্তাবিদ ফ্রানৎস ফানোঁ।
ফানোঁ যে রকম মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেছেন, সে রকম এক যুদ্ধের উজ্জ্বল যোদ্ধা ছিলেন জহির রায়হান। ১৯৭১ সালের সেই যুদ্ধে অনেকেই আত্মগোপন করেন অথবা সীমান্ত অতিক্রম করে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। জহির রায়হান এর কোনোটিই করেননি। আগরতলা হয়ে কলকাতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ শুধু নয়, গেরিলা কায়দায় যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করে দলিলচিত্র নির্মাণের কাজ করেছেন জহির রায়হান। নিজে পরিচলানা করেছেন ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘আ স্টেট ইজ বোর্ন’; আলমগীর কবির ও বাবুল চৌধুরীকে দিয়ে নির্মাণ করিয়েছেন যথাক্রমে ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ ও ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’। যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই পাকিস্তানি উপনিবেশের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গে বুদ্ধিজীবীরা সংঘবদ্ধ হয়ে ‘যুদ্ধ’ শুরু করেন। নির্দিষ্ট করে বললে, সেটা ১৯৫২ সাল থেকেই। দমননীতির প্রতিবাদে তখন বাংলা ভাষার চর্চা, রবীন্দ্রসংগীতের প্রসার ও লোককাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয় এখানে।
১৯৬৬ সালে মুক্তি পাওয়া বেহুলা ছবিটি ছিল লোককাহিনিনির্ভর। ছবিটি নিয়ে কলকাতার সাংবাদিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে জহির রায়হান বলেছিলেন, ‘(এটি) চাঁদ সদাগরের কাহিনি, বাংলার লৌকিক কাহিনি। এর একটি সাধারণ মানবিক আবেদন আছে। কিন্তু সেন্সর আর গোঁড়াপন্থীরা ক্ষেপে লাল। আমি নিশ্চয় কাফের। নয়তো হিন্দু পুরাণ নিয়ে ছবি তুলব কেন? অথচ বেহুলার মধ্যে আধুনিক যুগের বক্তব্য ছিল। দেবতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামের কথাই ছিল সেখানে বড়। জানেন, গোঁড়াদের বিক্ষোভের চোটে আমার ছবি ব্যান হয়ে যায় আরকি! অবশেষে অনেক টালবাহানার পর বেহুলা রিলিজ হলো বটে, তবে সেই থেকে ঢালাও নির্দেশ জারি হলো, পাকিস্তানে কোনো হিন্দু দেব–দেবীর ব্যাপার নিয়ে ছবি করা চলবে না।’
যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই পাকিস্তানি উপনিবেশের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গে বুদ্ধিজীবীরা সংঘবদ্ধ হয়ে ‘যুদ্ধ’ শুরু করেন। নির্দিষ্ট করে বললে, সেটা ১৯৫২ সাল থেকেই। দমননীতির প্রতিবাদে তখন বাংলা ভাষার চর্চা, রবীন্দ্রসংগীতের প্রসার ও লোককাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয় এখানে।মুক্তির সংগ্রামকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করতে ফ্রানৎস ফানোঁ বলেন, একটি উপনেবিশত জাতির ভেতর লড়াকু সাহিত্য গড়ে ওঠে এবং সেটাই জাতীয় সাহিত্য। জাতির অস্তিত্বের প্রশ্নে এই লড়াকু সাহিত্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেতনা দান করে। এর পাশাপাশি, ফানোঁ আরও বলছেন, কাজ করে লোককাহিনি। যে লোকহকাহিনিকে মানুষ পুরোনো বলে দূরে সরিয়ে রাখে, সেই পুরোনোকেই মুক্তিসংগ্রামের কালে নতুন করে হাজির করার কাজটি করেন গল্পকথক। লোককাহিনির যে পুরোনো দ্বন্দ্ব, সেটিকে চরিত্র ও ঘটনার বিনির্মাণের মাধ্যমে সমসাময়িক, আধুনিক ও লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়। ‘অনেক অনেক দিন আগের কথা’, লোককাহিনি এমন করে শুরুর পরিবর্তে শুরু হয় এভাবে, ‘যে ঘটনা আজ বলতে যাচ্ছি, সেটা অন্য এক সময়ে হলেও তা আজ অথবা কালও ঘটতে পারে’; অর্থাৎ ভালো ও মন্দের যে চিরায়ত দ্বন্দ্ব, সেটার দিকেই ইঙ্গিত দেন ফানোঁ।
জহির রায়হানের বক্তব্য ও কাজ যেন ফানোঁর বক্তৃতারই প্রতিধ্বনি। ফানোঁ বক্তৃতা করেন ১৯৫৯ সালে আর জহির রায়হানের ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬৬ সালে। আমি জহির রায়হানের ভেতর ফানোঁর ছায়া দেখতে পাই। জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ পাকিস্তান আমলের বাস্তবতায় শাসক ও শোষিতের রূপকাশ্রয়ী বয়ান হাজির করেছিল। এই পৌরাণিক কাহিনিকে জহির রায়হান মনে করতেন মানুষের কাব্য। যেখানে মানুষ মনসাদেবীর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া পূজা আর বল প্রয়োগ করে ভক্তি আদায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান করে, যেখানে অন্যায্য শাস্তির প্রতিবাদে জানবাজি রাখে এক নারী—বেহুলা। বেহুলার বিয়ের আগে শ্বশুর চাঁদ সওদাগর দেবী মনসার কোপানলে পড়ে সাতটি জাহাজ ও ছয় ছেলে হারায়। কিন্তু সে মাথা নত করতে নারাজ। সপ্তম ছেলেও যখন সাপের দংশনে মারা যায়, তখন স্ত্রী বেহুলা মর্ত্যের হয়েও স্বর্গলোকে পাড়ি জমায় এবং স্বামীকে ফিরিয়ে আনার জন্য জীবন বাজি রাখে। দেবীর অন্যায় অভিশাপ থেকে মুক্তি চায় বেহুলা এবং সেটা সে অর্জন করে ছাড়ে। এই কাহিনির নারীবাদী পাঠ থাকতে পারে, তবে এর মার্ক্সবাদী পাঠও রয়েছে। জহির রায়হান দ্বিতীয় পাঠ থেকেই ছবিটি নির্মাণ করেছেন।
জহির রায়হান বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারসহ আরও বুদ্ধিজীবীদের খুনিদের খোঁজ করছিলেন। সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেছিলেন, এ ব্যাপারে তিনি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবেন। অনেক তথ্য তাঁর কাছে ছিল। এটাই কাল হয়। ৩০ জানুয়ারি তাঁকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়।মনে রাখতে হবে, বেহুলা এমন সময়ে নির্মাণ ও মুক্তি (১৯৬৬, ২৮ অক্টোবর) পাচ্ছে, যখন ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব চরমে, যখন পূর্ববঙ্গে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করছেন। ছয় দফা আন্দোলনের পক্ষে–বিক্ষোভ সমাবেশ হচ্ছে, সেখানে গুলি চলছে, শহীদ হচ্ছেন আন্দোলনকারীরা। ইত্তেফাক পত্রিকাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বাক্স্বাধীনতাকে হরণ করা হচ্ছে। এমন রাজনৈতিক বাস্তবতায়, জাতীয় মুক্তির বাসনা যখন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তখন জহির রায়হান আশ্রয় নিলেন লোককাহিনির। যে কাহিনি প্রভুর বিরুদ্ধে ভৃত্যের বিপ্লবকে মহিমান্বিত করে।
পশ্চিম পাকিস্তানি প্রভু ও এ দেশীয় সেবকেরা সেটা বুঝতে পারে। তাই তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুসারেই এই ছবিকেও সাম্প্রদায়িক সিল মেরে কার্যত জাতীয় মুক্তির চেতনাকে মাটিচাপা দিতে চায়। পরে তো আমরা দেখেছি, মুক্তিযুদ্ধকেই তারা ইসলামবিরোধী বলে প্রচার করতে শুরু করে। যার ধারাবাহিকতা আজ পর্যন্ত আমাদের গোচরে আসে। সে সময় জাতির সঙ্গে ধর্ম মিশিয়ে হাঁসজারু জাতীয়তাবাদ খাড়া করতে চেয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ও তাদের সহযোগীরা। তাই তো দেখা যায়, সব ক্ষেত্রেই ধর্মের চিহ্ন খোঁজা হয়েছে তখন। তৎকালীন ফিল্ম সেন্সর বোর্ড ঘোষণা দিয়েছিল, ছবিতে কোনো চরিত্র সিঁদুর পরতে পারবে না, এমনকি কেউ নামের আগে শ্রীমতিও লিখতে পারবে না। জহির রায়হান বলছেন, ‘ওদের ধারণা ছিল, বাঙালি পরিচালকেরা ছায়াছবির মধ্যে হিন্দুয়ানি ঢুকিয়ে ইসলামের ইজ্জত নষ্ট করছেন।’
‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৬৯) ছবিতেও এমন সাম্প্রদায়িকতার শিকার হন জহির রায়হান। বলেছেন, ‘আমার “জীবন থেকে নেয়া” ছবিতে এক জায়গায় ছিল, কাঁসার বাসনে ভাত খাচ্ছে ছবির কয়েকটি চরিত্র। সেন্সর অমনি চেপে ধরল, ও চলবে না, কাঁসার বাসনে তো হিন্দুরা খায়, অতএব কাঁসা মিনস হিন্দু কালচার…।’
সাম্প্রদায়িকতাকে জাতির জন্য বড় শত্রু মনে করতেন জহির রায়হান। দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। রাজাকার ও আলবদররা তখনো গোপনে সাম্প্রদায়িক প্রচার–প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে লিফলেট বিলির মাধ্যমে। পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ঢাকায় বসে তখন জহির রায়হান ক্ষোভ নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের বড় শত্রু সাম্প্রদায়িকতা। ভয় হয়, ঘুরেফিরে আমরা আবার তার খপ্পরে না গিয়ে পড়ি।…ধর্মকে আমাদের রাষ্ট্রিক জীবন থেকে একেবারে মুছে ফেলতে হবে। ধর্ম হলো সম্পূর্ণ মনের জিনিস।’
রাষ্ট্র কোনো একটি ধর্মকে বিশেষ গুরুত্ব দেবে না, ধর্ম-বর্ণ-জাতি-লিঙ্গনির্বিশেষে সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখবে, বৈষম্য থাকবে না, সবাই সমান বিচার পাবে, এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। দুঃখজনক সত্যি হলো, সেই অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার চেতনা আর মাথা তুলেই দাঁড়াতে পারেনি। উল্টো ধর্মকে বেশি করে আঁকড়ে ধরেছে রাষ্ট্র। গরিব মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। বিচারহীনতাকে আমরা সংস্কৃতিতে পরিণত করেছি। এভাবে কি একটি দেশে অর্জিত স্বাধীনতাকে রক্ষা করা যায়?
জহির রায়হানকেও রক্ষা করা যায়নি। যায়নি কারণ, বুদ্ধিজীবী হত্যার পেছনে যারা জড়িত, তারা নিজেদের রক্ষা করতে চেয়েছিল। জহির রায়হান বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারসহ আরও বুদ্ধিজীবীদের খুনিদের খোঁজ করছিলেন। সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেছিলেন, এ ব্যাপারে তিনি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবেন। অনেক তথ্য তাঁর কাছে ছিল। এটাই কাল হয়। ৩০ জানুয়ারি তাঁকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় সাহিত্য, তথা জাতীয় চলচ্চিত্র গড়ে ওঠার সম্ভাবনাকেও। জহির রায়হান শুধু নির্মাতা ছিলেন না, গুণী সাহিত্যিকও ছিলেন। তাঁর সৃষ্টিকর্মে জাতীয় চেতনার যে উন্মেষ আমরা দেখেছিলাম, তিনি বেঁচে থাকলে তাঁর দৌলতে বাংলাদেশ আরও উজ্জ্বল হতো। ফ্রানৎস ফানোঁ যেমনটা বলতেন, জাতীয় চেতনাই পারে আমাদের আন্তর্জাতিক মাত্রা এনে দিতে, জাতীয় চেতনা মানে কিন্তু জাতীয়তাবাদ নয়। জাতীয় চেতনারও নানা খানাখন্দ আছে, সেই আলাপ ভিন্ন। শুধু এটুকু বলেই শেষ করি, জহির রায়হান রাজনৈতিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জাতীয় চেতনাকে ধারণ করা শিল্পী ছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, দেশের আরও অনেক সেরা সন্তানের মতো তাঁকেও খুন হতে হয়, স্বদেশিদের হাতেই।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বল ছ ল ন উপন ব শ আম দ র ষ ট কর
এছাড়াও পড়ুন:
শাহরুখের ব্যাপারে সাবধান করলেন জুহি চাওলা
বলিউড বাদশা শাহরুখ খান। অভিনয় গুণে কোটি কোটি ভক্তের হৃদয়ে দোলা দিয়েছেন তিনি। দীর্ঘ অভিনয় ক্যারিয়ারে যশ-খ্যাতি যেমন পেয়েছেন, তেমনি আয় করেছেন মোটা অঙ্কের অর্থও। রবিবার (২ নভেম্বর) ৬০ বছর পূর্ণ করে একষট্টিতে পা দেবেন এই তারকা।
অভিনয় ক্যারিয়ারে অনেক নায়িকার সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন শাহরুখ খান। তাদের মধ্যে অন্যতম জুহি চাওলা। ‘রাজু বান গায়া জেন্টলম্যান’, ‘রামজানে’, ‘ডর’, ‘ইয়েস বস’, ‘ডুপ্লিকেট’সহ আরো কিছু জনপ্রিয় সিনেমা উপহার দিয়েছেন এই জুটি। একসঙ্গে অভিনয় ছাড়াও, এই দুই তারকা বাস্তব জীবনে খুবই ভালো বন্ধু। কেবল তাই নয়, ব্যবসায়ীক অংশীদারও তারা।
আরো পড়ুন:
শাহরুখের অজানা এই সাত তথ্য জানেন?
পাকিস্তানের সন্ত্রাসী তালিকায় সালমান খান কেন?
বন্ধু শাহরুখের জন্মদিন উপলক্ষে হিন্দুস্তান টাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন জুহি। এ আলাপচারিতায় স্মৃতিচারণ তো করেছেনই, পাশাপাশি শাহরুখের বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছেন এই অভিনেত্রী।
শাহরুখের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের বিষয়ে জুহি চাওলা বলেন, “আমি যখন প্রথম ‘রাজু বান গায়া জেন্টলম্যান’ সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হই, তখন সহপ্রযোজক বিবেক ভাসওয়ানি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার নায়ক দেখতে আমির খানের মতো।’ আমি শাহরুখকে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। দেখি, শাহরুখের চুল চোখের ওপরে নেমে এসেছে। আর সে একেবারেই আমার কল্পনার সেই ‘চকলেট বয়’ নয়! যখন কাজ শুরু করি, তখন বুঝতে পারি, সে একদম নতুন অভিনেতাদের মতো নয়, সে পরিশ্রমী, দিনে তিন শিফটে কাজ করছে।”
একটি ঘটনা বর্ণনা করে জুহি চাওলা বলেন, “আমার মনে আছে, ‘ইয়েস বস’ সিনেমার শুটিংয়ের সময়, কোনো দৃশ্য ঠিকমতো লেখা না থাকলে পরিচালক আজিজজি (আজিজ মির্জা) বলতেন, ‘শাহরুখ আসুক, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ রোমান্স আর মজার মিশেলে থাকা দৃশ্যগুলো আমাদের সবচেয়ে ভালো ছিল। সেই সূত্রেই আমরা অনেকগুলো সিনেমায় একসঙ্গে কাজ করেছি।”
শাহরুখের পাশে অবস্থান করলে সাবধান থাকার কথার কথা বলেছেন জুহি। হাসতে হাসতে এ অভিনেত্রী বলেন, “শাহরুখের আশেপাশে থাকলে সাবধানে থাকবেন। কারণ সে কথা দিয়ে আপনাকে যেকোনো কিছু করাতে রাজি করিয়ে ফেলতে পারে। ওর কথাবলার ভঙ্গি এমন যে, আপনি ‘না’ বলতেই পারবে না। আমি ‘ডুপ্লিকেট’ সিনেমা করতে চাইছিলাম না, কারণ সেখানে আমার তেমন কিছু করার ছিল না। আমরা তখন আরেকটি সিনেমার শুটিং করছিলাম, আর শাহরুখ আমাকে সিঁড়িতে বসিয়ে দুই ঘণ্টা বোঝায় এবং আমি সিনেমাটিতে চুক্তিবদ্ধ হই। সে আপনাকে যেকোনো কিছু করতে রাজি করাতে পারে, তাই সাবধানে থাকবেন।”
শাহরুখ খানের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়ে জুহি চাওলা বলেন, “অফস্ক্রিনে আমাদের সম্পর্কেও উত্থান-পতন রয়েছে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা কোনো না কোনোভাবে আমাদের যুক্ত রেখেছেন, এমনকি আইপিএলের মাধ্যমেও। আমাদের বন্ধন কোনো পরিকল্পনার ফল নয়, এটা একেবারেই ভাগ্যের ব্যাপার।”
শাহরুখ খানের সঙ্গে আইপিএল দল কলকাতা নাইট রাইডার্সের (কেকেআর) সহ-মালিক জুহি ও তার স্বামী জয় মেহতা। এই দলের পেছনে জুহি বিনিয়োগ করেছেন ৬২৯ কোটি রুপি। বর্তমানে এই দলটির মূল্য আছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি রুপি। শাহরুখ খানের সঙ্গে ‘রেড চিলিস গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করেন জুহি।
১৯৬৫ সালে ২ নভেম্বর ভারতের নয়াদিল্লিতে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শাহরুখ খান। তার শৈশবের প্রথম পাঁচ বছর কেটেছে ম্যাঙ্গালুরুতে। শাহরুখের দাদা ইফতিখার আহমেদ স্থানীয় পোর্টের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। যার কারণে সেখানে বসবাস করেন তারা। শাহরুখের বাবার নাম তাজ মোহাম্মদ খান, মা লতিফ ফাতিমা।
দিল্লির হংসরাজ কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন শাহরুখ খান। তারপর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়াতে গণযোগাযোগ বিষয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হন। কিন্তু অভিনয় জীবন শুরু করার কারণে পড়াশোনা ছেড়ে দেন তিনি। তবে বলিউডে ক্যারিয়ার শুরুর দিকে দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা-তে ভর্তি হন এই শিল্পী।
১৯৯২ সালে ‘দিওয়ানা’ সিনেমার মাধ্যমে বলিউডে পা রাখেন শাহরুখ খান। রোমান্টিক ঘরানার এ সিনেমায় অভিনয় করে নজর কাড়েন তিনি। সিনেমাটিতে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে সেরা নবাগত অভিনেতা হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেন শাহরুখ।
একই বছর ‘চমৎকার’, ‘দিল আসনা হে’ ও ‘রাজু বান গায়া জেন্টলম্যান’ সিনেমায় অভিনয় করেন শাহরুখ। তার পরের বছর ‘ডর’ ও ‘বাজিগর’ সিনেমায় অভিনয় করে নিজের জাত চেনান শাহরুখ। তার অভিনয়ের জাদুতে মুগ্ধ হন কোটি ভক্ত; পৌঁছে যান সাফল্যের চূড়ায়। তার অভিনয়ের খ্যাতি আরো বাড়তে থাকে যশরাজ ফিল্মসের সিনেমায় ধারাবাহিকভাবে অভিনয় করে। একের পর এক হিট সিনেমা দিয়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করেন শাহরুখ। যদিও তার এই সফলতার জার্নির গল্প মোটেও সহজ ছিল। আর সে গল্প সবারই জানা।
অভিনয় ক্যারিয়ারে অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন শাহরুখ খান। তার মধ্যে মোট পনেরোবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। এর মধ্যে আটবার সেরা অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। হিন্দি সিনেমায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০০২ সালে তাকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করে ভারত সরকার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণ করেছেন মোট পাঁচবার। তবে শাহরুখ খানের ৩৩ বছরের অভিনয় ক্যারিয়ারে অধরা ছিল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। চলতি বছর ‘জওয়ান’ সিনেমার জন্য সেরা অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন শাহরুখ।
ঢাকা/শান্ত