স্বাধীনতার পর বিগত পাঁচ দশকে দেশের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে টেকসই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। নব্বইয়ে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পতনের পর, পঞ্চম জাতীয় নির্বাচনের পর, দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে পুনরায় সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তিত হয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর জনবিরোধী কিছু সিদ্ধান্তের কারণে বিশেষ করে ২০১১ সালে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও গণভোট ছাড়া সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের কারণে দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা ও দলীয়করণের কারণে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকারিতা দেখাতে পারেনি এবং ক্ষমতার ভারসাম্য ও নজরদারিত্বের কাঠামো ভেঙে পড়েছিল। শেখ হাসিনা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসলেও বিদ্যমান আইনি কাঠামো, পদ্ধতি, প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠান স্বৈরতন্ত্র সৃষ্টির সহায়ক ছিল।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত ছাত্র-জনতার সফল গণঅভ্যুত্থান একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র পুনর্গঠনের ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি করে। জনমনে রাষ্ট্র সংস্কারের তীব্র আকাঙ্ক্ষা অনুভূত হয়, যাতে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা আর ফিরে না আসে এবং মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত হয়। আমরা জানি, এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে প্রথম গঠিত ছয়টি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ইতোমধ্যে কমিশনের উদ্যোগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ শেষে ১১টি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট-সহ ৮৪টি মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর খসড়ায় উল্লেখ রয়েছে। ইতোমধ্যে জুলাই সনদের খসড়ায় রাজনৈতিক দল তাদের মতামত প্রেরণ করেছে। অন্যদিকে সনদটি কীভাবে বাস্তবায়িত হবে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে দফায় দফায় বসে তাদের মতামত গ্রহণ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
দুই.
খসড়া জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ তিনটি ভাগ রয়েছে। প্রথম অংশে আছে এই সনদের পটভূমি। কোন কোন সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে তা উল্লেখ করা হয়েছে দ্বিতীয় অংশে। আর তৃতীয় অংশে রয়েছে সনদ বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট কিছু অঙ্গীকার।
সনদে উল্লেখিত গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশসমূহ হলো: সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশন গঠন করা; নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে কার্যকরভাবে পৃথকীকরণের লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন; সংবিধানের অধীনে সুপ্রিম কোর্ট ও জেলা ইউনিটের সমন্বয়ে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করা; আইনজীবীদের আচরণবিধি যুগোপযোগীকরণ করা এবং একজন বিচারকের অধীনে জেলা পর্যায়ে বার কাউন্সিল ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা; গণহত্যা ও ভোট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন; তথ্য অধিকার আইন পর্যালোচনা করে সংশোধন করা এবং রাজনৈতিক দলকে তথ্য অধিকার আইনের আওতায় আনা; দুর্নীতিবিরোধী কৌশলপত্র প্রণয়ন করে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিবিরোধী দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ; দুর্নীতি দমন কমিশনকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা; নির্বাচনী আইনে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও শুদ্ধাচার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা;
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন সংশোধন করা এবং দুর্নীতি দমন কমিশন বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা; নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের নির্বাচন আয়োজন করা; সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধন করা; জাতীয় সংসদের উভয় কক্ষের একজন করে ডেপুটি স্পিকার বিরোধী দল থেকে মনোনীত করা; সংবিধানের ৭৮(৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সংসদের কমিটিসমূহ ও সদস্যদের বিশেষ অধিকার নির্ধারণ করা; সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদে সংসদে আসনের সংখ্যানুপাতে বিরোধীদলের মধ্য থেকে নির্বাচন করা; বিশেষায়িত কমিটির মাধ্যমে সংসদীয় এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা; রাষ্ট্রপতির ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান (আইনের দ্বারা নির্ধারিত মানদণ্ড, নীতি ও পদ্ধতি অনুসরণক্রমে উক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করা);
বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ: (ক) সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ, (খ) উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালতের সম্প্রসারণ করা; জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান (ক. প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষরের পরিবর্তে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের বিধান যুক্ত করা; খ. জরুরি অবস্থাকালীন নাগরিকের দুটি অধিকার অলঙ্ঘনীয় করার লক্ষ্যে বিধান করা); প্রধান বিচারপতি নিয়োগ (আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগদান); সংবিধান সংশোধন (সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন হবে); একই ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী পদে সর্বোচ্চ ১০ বছর নির্ধারণ করা; আইনের দ্বারা গঠিত বাছাই কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগদান এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারগণের জবাবদিহিতার জন্য আইন ও আচরণবিধি প্রণয়ন; পুলিশ বাহিনীর পেশাদারিত্ব ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকরণ এবং পুলিশী সেবাকে জনবান্ধব করার লক্ষ্যে একটি ‘পুলিশ কমিশন’ গঠন করা;
সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহের তালিকা সংশোধন ও নাগরিকদের অধিকার সম্প্রসারণ করা; সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’ উল্লেখ করা; সংসদের উভয় কক্ষের সদস্যদের গোপন ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান করা; রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনয়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) সংশোধন করা; প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ব্যক্তি একইসঙ্গে দলীয় প্রধানের পদে না থাকা বিদ্যমান সংবিধানের ১২৩(৩) সংশোধন করে নির্ধারিত পদ্ধতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন করা; সংসদের নিম্নকক্ষের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের ১০০ জন নির্বাচিত করার বিধান করা; উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকা নির্বাচনের পূর্বে প্রকাশ, তালিকায় কমপক্ষে ১০ শতাংশ নারী প্রার্থী রাখা; জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব ক্রমান্বয়ে ১০০ আসনে উন্নীত করার লক্ষ্যে বিধান করা; ন্যায়পাল নিয়োগ, সরকারি কর্ম কমিশনে নিয়োগ, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক নিয়োগ ও দুর্নীতি দমন কমিশনে নিয়োগ, ওপেন গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপের পক্ষভুক্ত হওয়া, ইত্যাদি।
এর মধ্যে কতগুলো হলো মৌলিক সংস্কার, যার মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে, জনপ্রশাসন, পুলিশী ব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে এবং সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত হবে। যেমন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছরে সীমিত করা, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে না থাকার বিধান, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব বৃদ্ধি, সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা ও আনুপাতিক পদ্ধতিতে এর সদস্য নির্বাচিত করা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধন, বিরোধী দল থেকে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দেওয়া, বিচার বিভাগে নিয়োগ, সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ ও উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালতের সম্প্রসারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল ও গঠন পদ্ধতি, সংসদের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে সংবিধান সংশোধন করার বিধান, দুর্নীতি দমন কমিশনকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, জাতীয় সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব, পুলিশ কমিশন গঠন ইত্যাদি। এর মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে।
তিন.
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সব দলের অংশগ্রহণে রাষ্ট্রের কতগুলো মৌলিক সংস্কারের ব্যাপারে দীর্ঘ আলোচনা ও খোলামেলা বিতর্ক হয়েছে। আমাদের সম্মানিত রাজনীতিগণ একসঙ্গে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেশ পরিচালনার কাঠামো নিয়ে আলোচনা করেছেন। এর আগে এতগুলো রাজনৈতিক দলের একত্রে বসে মতবিনিময় বা যুক্তিতর্ক উত্থাপন করার নজির নেই। এবার দলগুলো ধৈর্য ধরে একটা ইতিবাচক পরিবেশে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখিয়ে যে আলোচনা করেছে, তা বিরল। বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) বৈঠকগুলো সরাসরি সম্প্রচার করার কারণে দেশের আপামর জনসাধারণ উক্ত বিতর্ক পর্যবেক্ষণ করেছে। এই উদ্যোগ দেশে এক ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে বলে আমরা মনে করি। রাজনৈতিক ভিন্নমত থাকলেও দ্বন্দ্ব ও হানাহানির পরিবর্তে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেও যে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক বিষয়গুলো সমাধান করা যায় তা আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে।
তবে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি) মাধ্যমে মাধ্যমে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ; ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ১০০ আসন সংরক্ষণ; বৃহত্তর নির্বাচকমণ্ডলীর গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন; স্থানীয় সরকারে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নারীর আসন সংরক্ষণ, ইত্যাদি ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় জুলাই জাতীয় সনদটি অপূর্ণ রয়ে গেল।
সংবিধান সংস্কার কমিশন রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) নামক একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিম্নলিখিত পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে নাম প্রেরণের সুপারিশ করেছিল: ১. নির্বাচন কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; ২. অ্যাটর্নি জেনারেল; ৩. সরকারি কর্ম কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; ৪. দুর্নীতি কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; ৫. মানবাধিকার কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; ৬. স্থানীয় সরকার কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; ৭. প্রতিরক্ষা বাহিনীসমূহের প্রধান; ৮. আইন দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোনো পদে নিয়োগ। এটি একটি যুগান্তকারী সুপারিশ হলেও রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে একমত হতে পারেনি। এর পরিবর্তে আইনের মাধ্যমে গঠিত বাছাই কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন-সহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ব্যাপারে দলগুলো একমত হয়েছে।
জাতীয় সংসদে নারীদের নায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি, যা হতাশাব্যাঞ্জক। নারীদের জন্য ১০০টি আসন সংরক্ষণের বিষয়ে সকল দল একমত হলেও তা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে ঐকমত্য হয়নি। সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব তথা তাদের সরাসরি নির্বাচিত হয়ে আসার ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বিষয়টি ভিন্নভাবে পাঁচবার উত্থাপন করে এবং ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে ১০০ আসনে নারীদের সরাসরি নির্বাচনের ব্যাপারে জনমত থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলো উদারতার পরিচয় দেয়নি। বরং বিদ্যমান আলঙ্কারিক ৫০টি সংরক্ষিত আসনের বিধান বহাল রয়েছে এবং নারীদের সরাসরি জিতে আসার সুযোগ বাড়েনি।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশে ‘জাতীয় সংসদের উভয় কক্ষের সদস্য এবং স্থানীয় সরকারের সকল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত বৃহত্তর নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার বিধান করা’র সুপারিশ করলেও জুলাই সনদে সংসদের উভয় কক্ষের সদস্যদের গোপন ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে। রাষ্ট্রপতির অভিশংসনের প্রস্তাবটিও একই ধরনের।
আরেকটি হতাশার বিষয় হলো যে, অনেকগুলো মৌলিক বিষয়ে কয়েকটি রাজনৈতিক দল বারবার ডিসেন্ট দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোতে যে পরিমাণ নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে তাতে মনে হয় না কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গেলে এগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করবে। এবং নোট অব ডিসেন্ট-সহ সনদ স্বাক্ষর হলে ভবিষ্যতে যে দলই ক্ষমতায় আসবে তার স্বৈরাচারী ও আধিপত্যবাদী হওয়ার সুযোগ খুব একটা কমাবে না এই সনদ। তবে বিশেষজ্ঞরা এটাও বলছেন যে, ঐকমত্য কমিশন বিগত ছয় মাসে যা অর্জন করেছে অন্যান্য দেশে এসব অর্জন করতে সময় লেগেছে গড়ে আড়াই বছর।
আমরা আশা করি, অধিকাংশ দলের সম্মতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে ডিসেন্ট অব ডিসেন্টগুলো তুলে নেবে দলগুলো, যেমনিভাবে ১৯৭২ সালে গঠিত গণপরিষদে উত্থাপিত বেশকিছু বিষয়ে কোনো কোনো গণপরিষদ সদস্যের দ্বি-মত থাকলেও সেগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং সেগুলো তারা মেনে নিয়েছিলেন। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনই হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
আমরা মনে করি, জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন ইতিবাচক হলেও এর স্বার্থকর্তা নির্ভরতা করবে বাস্তবায়নের ওপর, যা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতভেদ রয়েছে। পূর্বেই বলা হয়েছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এখন সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আশা করি, এ বিষয়ে দ্রুতই একটি সমাধানে পৌঁছাবে ঐকমত্য কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলো।
লেখক ও কনটেন্ট ক্রিয়েটর
তারা//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জ ল ই জ ত য় সনদ ন ট অব ড স ন ট র ষ ট রপত র ক স থ ন য় সরক র ও র জন ত ক অন চ ছ দ ব ধ ন কর র লক ষ য র সদস য ব যবস থ র ক ষমত দলগ ল র ক ষমত য় ব চ রপত প রণয়ন গঠন কর ত র জন র জন য স রক ষ কম ট র চ ত কর উল ল খ ত হয় ছ ন র পর ত কর র র পর ব আইন র ই সনদ
এছাড়াও পড়ুন:
বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্য না হলে গণভোট ছাড়া উপায় নেই: এবি পার্টি
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে অংশ নিয়ে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারলে গণভোট ছাড়া উপায় নেই।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে আজ বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক হয়। বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এবি পার্টির চেয়ারম্যান এ কথা বলেন।
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে মজিবুর রহমান বলেছেন, ‘সংবিধান পরিবর্তন, সংস্কার, সংশোধন, নতুন করে লেখা বা বাতিলের চূড়ান্ত ক্ষমতা জনগণের। আমরা ঐক্যবদ্ধ মতামতের ভিত্তিতে জুলাই সনদ তৈরি করেছি, হয়তো কয়েকটি বিষয়ে কারও কারও “নোট অব ডিসেন্ট” (দ্বিমত) আছে। কিন্তু চূড়ান্ত কোনটা হবে, তা নির্ধারণের মূল ক্ষমতা জনগণের।’
কমিশনের আজকের প্রস্তাবে জুলাই ঘোষণাপত্রের ২২ নম্বর অনুচ্ছেদকে রেফারেন্স আকারে উল্লেখ করায় কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ও নেতা জুলাই ঘোষণাপত্রের বৈধতা নিয়ে মন্তব্য করেন। এ বিষয়ে এবি পার্টির চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে যাঁরা আজ প্রশ্ন তুলছেন, কাল তাঁরা সংসদে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবেন এবং এই সনদকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না, তার নিশ্চয়তা কী?
এবি পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সানী আবদুল হক বলেন, সংবিধানে এটা নেই, ওটা নেই বলে সংবিধান সংস্কার করা যাবে না—এই ধারণা অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাপরিপন্থী। রাজনৈতিক দলগুলো যদি জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতির প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান থেকে নমনীয় না হয়, তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পুরো প্রচেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়বে।
আশঙ্কা প্রকাশ করে এবি পার্টির এই নেতা বলেন, এমন পরিস্থিতি জাতিকে এক গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দেবে। সুতরাং জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি; অন্যথায় গণভোট ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
আরও পড়ুনবর্ধিত মেয়াদের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে চায় কমিশন: আলী রীয়াজ৪ ঘণ্টা আগে