রাজনৈতিক পদক্ষেপের তাৎক্ষণিক প্রভাবের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবটাই বেশি। খুব কমসংখ্যক দল কিংবা রাজনীতিবিদ এ বাস্তবতাকে মাথায় নিয়ে তাঁদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলে যাঁরা থাকেন, তাঁরা কখনোই দূরবর্তী ভবিষ্যতের কথা ভাবেন না। নগদ পাওনার কারবার করতে গিয়ে তাঁরা নিজের ও দলের পতন ডেকে আনেন, সমর্থক গোষ্ঠীকেও সংকটের মধ্যে ফেলে দেন। অতীত থেকে যে কেউ শিক্ষা নেন না—এ আপ্তবাক্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যতিক্রমহীনভাবে সত্য।

সাম্প্রতিক ইতিহাস প্রমাণ দেয়, বাংলাদেশ গণ–অভ্যুত্থানের দেশ। প্রতিটি অভ্যুত্থানই এখানে বড় পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে। কিন্তু উদ্দীপনা ও উচ্ছ্বাস মিইয়ে যেতেও খুব বেশি দেরি হয় না। দেখা যায়, জনগণের ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মতো গেড়ে বসা প্রবল কোনো প্রতিপক্ষকে সরাতে পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও জনগণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে অনন্য ঐক্য তৈরি হয়। কিন্তু যে মুহূর্তে সেই প্রবল প্রতিপক্ষের পতন হয়, সে মুহূর্তেই রাজনৈতিক শক্তিগুলো নিজ নিজ দলীয় স্বার্থে পরস্পরের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতিতে বড় দলগুলোই নির্ধারক শক্তি। গণ–আন্দোলন, গণ–অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে ছোট অনেক দল ও তাদের নেতারা সামনের সারির মুখ হয়ে ওঠেন। কারও কারও ক্ষেত্রে বিকাশের প্রবল সম্ভাবনাও তৈরি হয়। কিন্তু সে সম্ভাবনাও অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতে পারে, তার বড় একটা দৃষ্টান্ত জাসদ।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সমাজে পরিবর্তনের যে প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে এসেছিল, তা থেকেই জন্ম হয়েছিল জাসদের। কিন্তু নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে পরিষ্কারভাবে সামনে আনার পরিবর্তে না জাতীয়তাবাদী, না সমাজতন্ত্রী—অস্পষ্ট একটা রাজনৈতিক অবস্থান নেয় জাসদ। বামপন্থী জোয়ারের সে সময়ে পরিবর্তনপ্রত্যাশী তরুণদের বড় একটি অংশকে ভিন্ন পথে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল জাসদ। মাতৃসংগঠন আওয়ামী লীগকেও দুর্বল করে দিয়ে শেখ মুজিবের শাসনের পতন ত্বরান্বিত করে দিয়েছিল তারা।

জাসদের এ ভূমিকা নেওয়ার কারণ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিব বাহিনীর জন্মের ইতিহাসের দিকে ফিরে যেতে হবে। একটি বহুল প্রচলিত মত হচ্ছে, একাত্তরে জনযুদ্ধের সময় এ ভূমিতে সশস্ত্র বামপন্থার উত্থান যাতে না হয় সেটা ঠেকাতে মুক্তিবাহিনীর সমান্তরাল বাহিনী হিসেবে মুজিব বাহিনী গড়ে তুলেছিল ভারত ও ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’। মুজিব বাহিনীর নেতৃত্বের বড় অংশটাই পরবর্তী সময়ে জাসদ গড়ে তোলে। জাসদের নেতা–কর্মীদের আত্মত্যাগ ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে ন্যূনতম প্রশ্নের অবকাশ নেই। কিন্তু জাসদের তৎপরতা শেষ বিচারে রাজনীতিতে সামরিক স্বৈরতন্ত্র ও ইসলামপন্থী শক্তির প্রত্যাবর্তনের পথ তৈরি করেছিল।

রাজনৈতিক দলের মূল পরিচয় তার ঘোষণা ও কর্মসূচিই। নাগরিকদের সঙ্গে কোনো একটি দলের সংযোগ তৈরি করে দেয় কর্মসূচি। রাজনীতির দীর্ঘ রেসে টিকে থাকতে হলে নতুন, পুরোনো যেকোনো দলকেই নিজস্ব কর্মসূচি নিয়েই এগোতে হয়। রাজনীতির নগদ কারবারের চেয়ে বাকির লোভটা গুরুত্বপূর্ণ। ছোট দল, নতুন দল সেই ভুল করলে বড় দলের ছায়া বা প্রক্সি শক্তি হওয়ার নিয়তিই তাকে বরণ করতে হয়।

নব্বই পরবর্তী বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতি মূলত বিএনপি ও আওয়ামী লীগ—এই দুই ধারায় বিভক্ত। এর বাইরে মধ্যম মানের শক্তি জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী। এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টি মূলত রংপুরকেন্দ্রিক দলে পরিণত হয়েছে। গৃহপালিত বিরোধী দল কিংবা মিত্রের ভূমিকায় আওয়ামী লীগের শাসনের বৈধতা দেওয়ায় দলটির গ্রহণযোগ্যতাও কমেছে। দেবর-ভাবির গৃহবিবাদে দলটির সাংগঠনিক শক্তিও দুর্বল হয়ে গেছে।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের সময় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যেভাবে দমন ও তোষণ করা হয়েছে, তাতে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য ইসলামপন্থীদের ভোট ও সমর্থন কতটা বেড়েছে, তার পরিষ্কার কোনো চিত্র নেই। ডাকসু, জাকসু নির্বাচনে বড় বিজয়ই পরিষ্কার একটা বার্তা দিচ্ছে যে উঠতি মধ্যবিত্তের মধ্যে তাদের সমর্থন অনেকটা বেড়েছে। সব মিলিয়ে এটা ধারণা করা যায়, জনসমর্থন যা–ই থাক, সাংগঠনিক শক্তির বিচারে ধর্মভিত্তিক দলগুলো এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী।

বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতির দাবা খেলায় ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা অনেকটা বোড়ের মতো। অনেক সময় তারা এমন সব কর্মসূচি নেয়, যাতে প্রশ্ন জাগে—তারা কি বড় কোনো শক্তির দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে কি না।

বাংলাদেশের ভোটের মাঠের যে বাস্তবতা, সেখানে ছোট দলের পক্ষে নির্বাচনে ভালো ফল করাটা কঠিন। ফলে মাঠের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও ভোটের বৈতরণি পার হতে গেলে তাদের বড় দলের শরণাপন্ন হতে হয়। এ বাস্তবতা বড় দল ও ছোট দলের মধ্যে প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক তৈরি করে। তাৎক্ষণিক লাভের বিচারে বড় দলের ছেড়ে দেওয়া একটি–দুটি আসন পেলেও এতে দীর্ঘ মেয়াদে ছোট দলগুলোর রাজনীতিই চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একপর্যায়ে বিকাশের সম্ভাবনাটা শেষ হয়ে যায়।

নতুন দল বিকাশের বাস্তবতা ও জনচাহিদা থাকার পরও দুই ধারার বিপরীতে তৃতীয় বড় ধারা সৃষ্টি না হওয়ার পেছনে এটি বড় কারণ। এ দায় যেমন ছোট দলের, নতুন দলের, আবার বড় দলেরও। বড় দল সব সময়ই চায় প্রথাগত রাজনৈতিক বন্দোবস্ত যেন জারি থাকে। ফলে তাদের রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে, এমন রাজনৈতিক শক্তিকে তারা কৌশলেই নিষ্ক্রিয় করে দেয়। অভিজ্ঞতাহীন নতুন দল নগদ পাওনার স্বার্থে বড় দলের কৌশলের কাছে তাদের দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনাকে বিক্রি করে দেয়। শুধু বড় রাজনৈতিক দল নয়, পুরোনো ব্যবস্থার সঙ্গে স্বার্থের সম্পর্ক আছে, এমন গোষ্ঠীগুলোও চাইবে না নতুন রাজনীতি নিয়ে কেউ তাদের চ্যালেঞ্জ জানাক।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন। পরপর তিনটি পাতানো নির্বাচনের কারণে বিপুলসংখ্যক ভোটার ভোট দিতে না পারায় খুব স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক দলগুলোর ভোটের প্রস্তুতি নেওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা দেখছি, জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতভেদ, তা নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।

আবার এ মুহূর্তের ইস্যু নয়, এমন কিছু বিষয় নিয়ে যখন মাঠে হঠাৎই যে সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে, সেটা উদ্বেগজনকই। যেমন হঠাৎই জাতীয় পার্টি রাজনীতির ইস্যু হয়ে উঠল। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের গণ অধিকার পরিষদ জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবি নিয়ে হাজির হলো। সেই দাবি ঘিরে কর্মসূচি একসময় সংঘাতেও রূপ নিল। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত বাহিনীগুলোর লাঠিপেটায় মারাত্মকভাবে আহত হলেন নুর। সবারই প্রত্যাশা ছিল, গণ–অভ্যুত্থান নাগরিকের ওপর বাহিনীগুলোর বাড়াবাড়ি রকম বলপ্রয়োগের অবসান ঘটাবে। কিন্তু শ্রমিক আন্দোলনসহ কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ ও বাহিনীগুলোকে আচরণের ক্ষেত্রে আগের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে দেখছি।

নুরকে আহত করার পর স্বাভাবিকভাবেই তাঁর দলের নেতা–কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম হলো। তাঁরা জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। এ কর্মসূচিতে গণ অধিকার পরিষদের রাজনৈতিক অর্জন কতটা, সেটা একটা বড় প্রশ্নই থেকে যায়।

মে মাসে নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সময়ও হঠাৎই এ রকম একটা পরিস্থিতি তৈরি হতে আমরা দেখেছিলাম। চিকিৎসার জন্য সাবেক রাষ্ট্রপতি মো.

আবদুল হামিদের সিঙ্গাপুরে যাওয়ার ঘটনা ঘিরে এর সূত্রপাত। গাজীপুরে এনসিপির একজন নেতা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি ওঠে। শাহবাগ ও যমুনা ঘেরাওয়ের কর্মসূচি আসে। শেষে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাহী আদেশে চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানে সংঘটিত অপরাধের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে।

এনসিপির নেতাদের সামরিক বাহিনীর গাড়িতে গোপালগঞ্জ ছাড়তে হয়।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ র র জন ত ক ত ক দলগ ল ছ ট দল র র জন ত ত র জন ত র দলগ ল র বড় দল র ব স তবত র সময় আওয় ম ইসল ম মপন থ

এছাড়াও পড়ুন:

আবার ‘লাস্ট মিনিট শো’, জন্মদিনের রাতে স্লটকে জয় উপহার ফন ডাইকের

লিভারপুল ৩–২ আতলেতিকো মাদ্রিদ

জন্মদিনের রাতে এর চেয়ে ভালো উপহার আর কী হতে পারে!

রেফারি শেষ বাঁশি বাজাতেই মাঠে ঢুকে পড়লেন আর্নে স্লট। লিভারপুলের সমর্থকেরা তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে থাকলেন, দল জেতায় অভিনন্দনও জানালেন। মুখে চওড়া হাসি নিয়ে হাত নেড়ে স্লট সেই অভিবাদনের জবাব দিলেন।   

ভার্জিল ফন ডাইকের সঙ্গে আলিঙ্গনের সময় স্লটকে একটু বেশিই খুশি মনে হলো। কারণ, লিভারপুল অধিনায়ক ফন ডাইক ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূত না হলে তাঁর বিশেষ রাতটা যে অনেকটাই পানসে হয়ে যেত!

২০২৫–২৬ মৌসুমে শেষ মুহূর্তে জয়সূচক গোল করাকে অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছে লিভারপুল। যেটিকে বলা হচ্ছে লাস্ট মিনিট শো, কয়েকটি সংবাদমাধ্যম নাম দিয়েছে স্লট টাইম।

এবার সেই শো–এর নায়ক ফন ডাইক। যোগ করা সময়ের দ্বিতীয় মিনিটে তাঁর হেডারেই আতলেতিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে ড্রয়ের পথে থাকা ম্যাচটা ৩–২ গোলে জিতে চ্যাম্পিয়নস লিগে শুভসূচনা করল লিভারপুল।

এ নিয়ে এই মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে টানা পাঁচ ম্যাচ জিতল লিভারপুল। সবকটি ম্যাচে অলরেডরা জয়সূচক গোল করল ৮০ মিনিটের পর; এর তিনটিই যোগ করা সময়ে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ