নবীজি মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মের কয়েক মাস আগে বাদশাহ আবরাহা মক্কায় অবস্থিত কাবাঘর ধ্বংস করতে আসেন। তার সঙ্গে ছিল প্রায় ৬০ হাজার সৈন্য এবং অন্যূন ১০টি বৃহদাকার হাতি।

এ হাতিগুলো আবরাহার সেনাবাহিনীর সম্মুখভাগে ছিল এবং এগুলো দিয়েই কাবাঘর ধ্বংস করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার অভিপ্রায় ছিল তার। এ কারণে তার বাহিনীকে আসহাবে ফিল বা হস্তীবাহিনী বলা হয়। (সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২১৬)

আবরাহা যখন মক্কায় পৌঁছে হাতিগুলোকে কাবাঘরের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তখন হাতিগুলো সামনে না গিয়ে নিজেদের জায়গা বসে পড়ে। হাতির মাহুত এবং সৈন্যরা শত চেষ্টা করেও আর সেগুলোকে কাবাঘরের দিকে নিয়ে যেতে পারল না।

আবরাহা যখন মক্কায় পৌঁছে হাতিগুলোকে কাবাঘরের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তখন হাতিগুলো সামনে না গিয়ে নিজেদের জায়গা বসে পড়ে।

হাতিগুলোকে নিষ্ঠুরভাবে পেটানো হলো, সেগুলোর শুঁড়ের ভেতরে লাঠি ঢুকিয়ে উত্তেজিত করার চেষ্টা করা হলো। কিন্তু হাতিগুলো মক্কার দিক ছেড়ে ইয়েমেনের দিকে চলতে লাগল। (সিরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা ৩০)

আরও পড়ুনসুরা ফিলে আছে হাতির গল্প২০ অক্টোবর ২০২৪

আবরাহার সৈন্যরা যখন হাতিগুলো নিয়ে জেরবার হচ্ছিল, এমন সময় দেখা গেল, বিরাট বিরাট পাখির ঝাঁক কালো মেঘের মতো সমুদ্রের দিক থেকে উড়ে আসছে। চোখের পলকে পাখির ঝাঁকগুলো আবরাহার সেনাবাহিনীর মাথার ওপর এসে পড়ল এবং চতুর্দিক থেকে সেনাবাহিনীকে ঘিরে ফেলল।

দেখতে ক্ষুদ্র প্রতিটি পাখির চঞ্চুতে একটি এবং দু পায়ে দুটি কঙ্কর বা নুড়িপাথর ছিল। নুড়িপাথরের টুকরাগুলো ছিল মসুর ডাল বা মাষকলাইয়ের ডালের সমান। পাখিগুলো পাথরের টুকরোগুলো আবরাহার সৈন্যদের প্রতি নিক্ষেপ করতে লাগল।

পাথরের গতিবেগ এত তীব্র ছিল যে সৈন্যের মাথা বা বুক-পেটে পাথর আঘাত করছিল, শরীরের সেখানে ছিদ্র হয়ে অপরদিক দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল। ফলে সে সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মারা যাচ্ছিল। (তাফসীরে ইবনে কাসির, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৫৫০)

আবরাহার সৈন্যদলের দু’জন সৈন্যকে আমি ছোটবেলায় মক্কা শরিফে দেখেছি। তারা উভয়েই অন্ধ এবং চলাচলে অক্ষম হয়ে পড়েছিল। তারা বসে বসে ভিক্ষা করত।’ হজরত আয়েশা (রা.

), তাফসিরে ইবনে কাসির

এক বর্ণনায় রয়েছে, মাহমুদ নামে সবচেয়ে বড় হাতিটি যখন বসে পড়ল এবং সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও তাকে ওঠানো সম্ভব হলো না, তখন সৈন্যরা অন্য একটি হাতীকে সামনের দিকে নেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু সে পা বাড়াতেই তার মাথায় কঙ্করের টুকরো পড়ল এবং আর্তনাদ করে পেছনে সরে এল।

অন্যান্য হাতীও তখন এলোপাতাড়ি ছুটতে শুরু করল। হাতিগুলোর ওপর ক্রমাগত কঙ্কর আঘাতের ফলে তৎক্ষণাৎ ওগুলোও তড়পাতে তড়পাতে মারা গেল। (রউদুল উনুফ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২৬৯)

তবে ইবনে ইসহাকের সূত্রে তাফসিরে ইবনে কাসিরের আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, পাখির ঝাঁকের আক্রমণ শুরু হলে হাতিগুলো দৌড়ে ইয়েমেনের দিকে পলায়ন করে।

আরও পড়ুনবাদশা নাজ্জাশির উদারতার কাহিনি০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

পাখির ঝাঁকের নুড়িপাথরের আঘাতে আবরাহারর সেনাবাহিনীর প্রায় সকল সৈন্যই মক্কার নিকটবর্তী প্রান্তরে নিহত হয়। তবে কিছু সৈন্য আঘাতপ্রাপ্ত হলেও তখন পর্যন্ত প্রাণে বেঁচে যায়। তারা হাতে পায়ে পাখির ছুঁড়ে মারা পাথরের আঘাতে আহত হয়ে নিজেদের দেশ ইয়েমেনের দিকে ছুটে পালাচ্ছিল।

তবে তাদেরও রেহাই হলো না। ইয়েমেন মক্কা থেকে বেশ কয়েক দিনের পথ। পথিমধ্যে সৈন্যদের শরীরে পাথরের আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে দ্রুত ইনফেকশন দেখা দেয় এবং সেগুলোতে দগদগে ঘা হয়ে যায়। সেই ঘা থেকে রক্ত ও পুঁজ ঝরতে লাগল।

বিভিন্ন বর্ণনায় আছে, এই দুরারোগ্য ঘায়ের কারণে তাদের সংক্রমিত অঙ্গগুলো খসে খসে পড়ছিল এবং সংক্রমিত সকলেই পরবর্তীতে মারা যায়। (রউদুল উনুফ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২৬৪)

বাদশাহ আবরাহা অবস্থাও এমন হয়েছিল। সে মক্কার প্রান্তরে নিহত হয়নি। পাথরের আঘাতে আহত হয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় ইয়েমেনের দিকে পালাতে থাকে। কিন্তু সংক্রমণের কারণে তার শরীরের মাংস খসে পড়তে থাকে।

বাদশাহ আবরাহা অবস্থাও এমন হয়েছিল। সে মক্কার প্রান্তরে নিহত হয়নি। পাথরের আঘাতে আহত হয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় ইয়েমেনের দিকে পালাতে থাকে। কিন্তু সংক্রমণের কারণে তার শরীরের মাংস খসে পড়তে থাকে। নিজ দেশ ইয়েমেনের রাজধানী সানআয় পৌঁছার পর সে নিথর মাংসপিণ্ডে পরিণত হয় এবং তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মারা যায়। (আর রউফুর রহিম, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৮৭)

বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, এই সংক্রমণের ফলে ওই বছর আরব উপকূলজুড়ে প্রথমবারের মতো মহামারি প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। (সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২২০)

আসহাবে ফিল বা হস্তীবাহিনীর সৈন্যদের দু-একজন পরবর্তীতে বিকলাঙ্গ হয়ে বেঁচে ছিল। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আবরাহার সৈন্যদলের দু’জন সৈন্যকে আমি ছোটবেলায় মক্কা শরিফে দেখেছি। তারা উভয়েই অন্ধ এবং চলাচলে অক্ষম হয়ে পড়েছিল। তারা বসে বসে ভিক্ষা করত।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৫৫২)

আয়েশার বোন আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) বলেন, ‘যে আসাফ ও নায়েলা নামক মূর্তিদ্বয়ের পার্শ্বে মক্কার মুশরিকরা কুরবানি করত, সেখানে বসে ওই লোক দুটি মানুষের কাছে ভিক্ষা চাইত। তাদের মধ্যে একজন ছিল হাতির চালক, যার নাম ছিল উনাইস।’

আরও পড়ুনকাবার সোনার দরজায় কোরআনের বাণী০৮ জুন ২০২৪

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আবর হ র স ন ক ব ঘর ক রমণ অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

ক্যারিবীয় জাহাজে আবারো যুক্তরাষ্ট্রের হামলা, নিহত ৩

ক্যারিবীয় সাগরে একটি জাহাজে আবারো হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী। এতে জাহাজটিতে থাকা অন্তত তিনজন নিহত হয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ। 

রবিবার (২ নভেম্বর) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে আল জাজিরা।

আরো পড়ুন:

নাইজেরিয়ায় হামলার হুমকি ট্রাম্পের

কানাডার সঙ্গে আলোচনায় না বসার ঘোষণা ট্রাম্পের

শনিবার গভীর রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে হেগসেথ বলেন, “মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে এই অভিযান পরিচালিত হয়েছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ওই জাহাজটিকে অবৈধ মাদক চোরাচালানে জড়িত হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছিল।”

তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক জলসীমায় পরিচালিত এই হামলার সময় জাহাজটিতে ‘তিনজন পুরুষ মাদক-সন্ত্রাসী’ ছিলেন। তিনজনই নিহত হয়েছেন।” 

শনিবারের এই হামলার আগে গত বুধবার ক্যারিবীয় সাগরে আরো একটি জাহাজে মার্কিন বাহিনীর হামলায় চারজন নিহত হন। গত সোমবার মার্কিন হামলায় নিহত হন ১৪ জন।

মাদক পাচারের অভিযোগ তুলে সেপ্টেম্বর মাস থেকে এই অঞ্চলে সামরিক অভিযান শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই অভিযানে এখন পর্যন্ত ভেনেজুয়েলা ও কলম্বিয়ার নাগরিকসহ ৬২ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। এছাড়া ১৪টি নৌযান এবং একটি সাবমেরিন ধ্বংস হয়েছে।

তবে নৌযানগুলো মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ যুক্তরাষ্ট্র এখনও দেয়নি।  ফলে হামলার বৈধতা নিয়ে ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে। কিছু আইনজীবী যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছেন। কলম্বিয়া এবং ভেনেজুয়েলার মতো প্রতিবেশী দেশগুলো এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে।

ভেনেজুয়েলা বলছে, যুক্তরাষ্ট্র দেশটির বিরুদ্ধে ‘অঘোষিত যুদ্ধ’ শুরু করেছে। ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, দেশটি মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের যেকোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াই করবে।

যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে ক্যারিবীয় অঞ্চলে সাতটি যুদ্ধজাহাজ, একটি সাবমেরিন, ড্রোন এবং যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে এবং মেক্সিকো উপসাগরে মোতায়েন করেছে আরেকটি যুদ্ধজাহাজ।

ট্রাম্প প্রশাসন মাদক চোরাচালানকারী নৌযানের ওপর তাদের হামলাকে ‘আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ’ হিসেবে অভিহিত করেছে। 

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের নৌযান সাধারণত আটক করা হয় ও ক্রুদের গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক মার্কিন অভিযানগুলোতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পুরো নৌকা ধ্বংস করা হচ্ছে। জাতিসংঘ-নিযুক্ত মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা এই অভিযানগুলোকে ‘বিচারবহির্ভূত মৃত্যুদণ্ড’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ