জনপ্রিয় কোনো রেস্তোরাঁয় সাধারণ মানুষের সঙ্গে কয়েকজন ধনকুবের একসঙ্গে খাচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন—এমন দৃশ্য সচরাচর দেখা যায় না। এমনটি হলে সেখানে নিশ্চিতভাবে বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটতেও পারে। সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে তেমনটি ঘটেছে।

আর দশ দিনের মতো গত বৃহস্পতিবারও কর্মব্যস্ত সিউলের ‘কানবু চিকেনে’ মানুষের ভিড় ছিল। ফ্রাইড চিকেনে কামড় দিতে দিতে কর্মক্লান্ত সিউলবাসী যখন ঠান্ডা বিয়ারে চুমুক দিচ্ছিলেন, তখনই ঘটে গেল এক ‘অপ্রত্যাশিত’ ঘটনা। সিউলের সুপরিচিত এই রেস্তোরাঁয় আচমকা উপস্থিত হন বিশ্ববিখ্যাত তিন প্রযুক্তি কোম্পানির শীর্ষ তিন কর্মকর্তা।

এই তিন ধনকুবের হলেন চিপ জায়ান্ট এনভিডিয়ার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জেনসেন হুয়াং, স্যামসাং ইলেকট্রনিকসের চেয়ারম্যান লি জে-ইয়ং এবং হুন্দাই মোটর গ্রুপের নির্বাহী চেয়ারম্যান চুং উই-সান। তাঁরা মূলত সিউলের অদূরে গ্যংজু শহরে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থার (এপেক) শীর্ষ সম্মেলনে যাচ্ছিলেন। যাওয়ার পথে সিউলের কানবু চিকেনে ঢুঁ মারেন। রেস্তোরাঁর এক পাশে একটি ছোট টেবিলে বসে তাঁরা ‘চিমেক’ ফ্রাইড চিকেনের সঙ্গে ঠান্ডা বিয়ার উপভোগ করেন।

রেস্তোরাঁয় তাঁদের অবস্থানকালে যাঁরা খেয়েছেন, সবার বিল পরিশোধ করে দেন এই তিন ধনকুবের। রেস্তোরাঁর বাইরে ভিড় জমানো মানুষের মধ্যে চিমেকের কিছু বক্স ভাগাভাগি করেন। তাঁদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।

রেস্তোরাঁ থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত এক ভিডিওতে দর্শকদের উদ্দেশে এনভিডিয়ার সিইও হুয়াং বলেন, ‘আমি বন্ধুদের সঙ্গে ফ্রাইড চিকেন আর বিয়ার পছন্দ করি। এ জন্য কানবু একদম সঠিক জায়গা, তাই না?’ কোরীয় ভাষায় কানবু শব্দের অর্থ ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

স্থানীয় ইয়োনহাপ সংবাদ সংস্থার তথ্যমতে, ওই বিলিয়নিয়াররা চিজ বল, চিজ স্টিক, বোনলেস চিকেন এবং ফ্রাইড চিকেন খেয়েছেন। সঙ্গে নিয়েছিলেন টেরা বিয়ার এবং সোজু। সোজু চাল থেকে তৈরি একধরনের মদ, যা কোরিয়ায় জনপ্রিয়।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের ভিডিওতে দেখা গেছে, টেক জায়ান্টের এই তিন কর্ণধার বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে পরস্পরের হাত ধরে রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করেন। এই তিন ধনকুবেরের মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৯ হাজার ৫০০ কোটি (১৯৫ বিলিয়ন) ডলার।

রেস্তোরাঁর বাইরে কৌতূহলী দর্শকের মধ্যে খাবার ভাগাভাগি করার সময় হুয়াং একটি ঝুড়ি ধরে বললেন, ‘চিকেন উইংসটা দারুণ ছিল। আপনারা কি আগেও এখানে এসেছেন? অসাধারণ, তাই না?’ এরপর তিনি প্রস্তাবের সুরে বলেন, ‘কেউ কি নেবেন? ফ্রাইড চিকেন?’

হুয়াং যখন রেস্তোরাঁয় থাকা ‘গোল্ডেন বেল’ বাজান, তখন উপস্থিত সবাই উল্লাসে ফেটে পড়েন। কারণ, এই বেল বাজার অর্থ, তিনি সবার বিল দেবেন। তবে ইয়োনহাপ সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, স্যামসাংয়ের লি প্রথম রাউন্ডের বিল পরিশোধ করেছেন। আর হুন্দাইয়ের চুং পরিশোধ করেছেন দ্বিতীয় রাউন্ডের।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ত ন ধনক ব র এই ত ন স উল র

এছাড়াও পড়ুন:

যেভাবে আবিষ্কৃত হলো ডুবে যাওয়া টাইটানিক

প্রায় ৪০ বছর আগে ১ সেপ্টেম্বর ভোরের দিকে বিশ্বের বিখ্যাত জাহাজ টাইটানিকের খোঁজ মেলে। সেই দিন আটলান্টিকের তলদেশে তল্লাশি চালানো গবেষণা জাহাজ নরের কমান্ড সেন্টারের ভিডিও ফিডে একটি ধাতব সিলিন্ডারের অস্পষ্ট সাদাকালো ছবি ভেসে ওঠে।

জাহাজের চার সদস্যের পর্যবেক্ষণ দলের সদস্যরা সন্দেহ করেন বস্তুটি কোনো একটি ডুবে যাওয়া জাহাজের বয়লার হতে পারে। পর্যবেক্ষকেরা তখন জাহাজের রাঁধুনিকে পাঠান অভিযাত্রার প্রধান বিজ্ঞানী বব ব্যালার্ডকে ডেকে আনতে। বব ১৯৭০ দশক থেকে এই ধ্বংসাবশেষ খুঁজছিলেন। ব্যালার্ড তখন তাঁর কেবিনের বাংকে শুয়ে পড়ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের উডস হোল ওশানোগ্রাফিক ইনস্টিটিউশনের ফলিত সমুদ্র পদার্থবিদ্যা ও প্রকৌশলের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ব্যালার্ড স্মরণ করে বলেন, সেই রাঁধুনি তাঁর বাক্য শেষ করার আগেই আমি লাফিয়ে উঠলাম। আমি আক্ষরিক অর্থে আমার ফ্লাইটসুটটি পায়জামার ওপর পরেছিলাম তখন। পরের কয়েক দিন সেই সুট আর খুলিনি। টাইটানিক আবিষ্কারের ৪০তম বার্ষিকী উপলক্ষে নিজের অভিজ্ঞতা এভাবে প্রকাশ করেন বব ব্যালার্ড। ব্যালার্ড বলেন, ‘আমি যখন কমান্ড সেন্টারের ভেতরে, তখন বয়লার দেখলাম। আমাদের কাছে বয়লারের একটি ছবি ছিল। আমরা বুঝতে পারলাম এটি নিশ্চিতভাবেই টাইটানিকের।’

১৯১২ সালে সেই আইকনিক জাহাজটির যাত্রা শুরুর ৭৩ বছর পর ব্যালার্ড ও তাঁর দল ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পান। এর আগপর্যন্ত টাইটানিক যেন ছিল এক অবিরাম আকর্ষণের উৎস। ডুবন্ত নয় বলে পরিচিত এই জাহাজ এক স্বর্ণালি যুগে আমেরিকান ধনীদের নিয়ে প্রথম যাত্রায় ডুবে যায়। মানুষের নির্বুদ্ধিতা, শ্রেণিগত কুসংস্কার আর প্রযুক্তিগত ব্যর্থতার এক করুণ গল্প হিসেবে টাইটানিক আজও আলোচিত।

১৯৮৫ সালে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার টাইটানিকের প্রতি আরও আকর্ষণকে তীব্র করে তোলে। বিজ্ঞানী ব্যালার্ড ও তাঁর সহকর্মীদের মতো সমুদ্র অভিযাত্রীদের জন্য টাইটানিক খুঁজে পাওয়া ছিল মাউন্ট এভারেস্টে প্রথমবার আরোহণ করার মতো। ১৯৮৫ সালে টাইটানিকের অনুসন্ধান ব্যালার্ডের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করার প্রথম প্রচেষ্টা ছিল না। ব্যালার্ড তাঁর স্মৃতিকথা ইনটু দ্য ডিপে লিখেছেন, ১৯৭৭ সালের একটি অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল, যখন একটি ৩ হাজার ফুটের ড্রিলিং পাইপ সোনার ও ক্যামেরা নিয়ে মাঝখানে ভেঙে যায়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে ব্যালার্ড রিমোটলি অপারেটেড আন্ডারওয়াটার ভেহিকেল (আরওভি) ব্যবহার করার চেষ্টা করেন।

মার্কিন নৌবাহিনী এমন এক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছিল। আর্গো নামের প্রযুক্তি দিয়ে গভীর সমুদ্রভিত্তিক ইমেজিং সিস্টেম তৈরি করা হয়। মার্কিন নৌবাহিনী জানতে চেষ্টা করছিল এই প্রযুক্তির মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া দুটি পারমাণবিক সাবমেরিন ইউএসএস থ্রেশার ও ইউএসএস স্করপিওন খুঁজে পাওয়া যায় কি না। ১৯৬০–এর দশকে এই দুটি সাবমেরিন আটলান্টিকে ডুবে গিয়েছিল। বিজ্ঞানী ব্যালার্ড নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের সাবমেরিন জরিপ করার অভিযানের সময় টাইটানিক অনুসন্ধানের জন্য কিছু সময় দিতে রাজি করান। এই কৌশল অবশ্য নৌবাহিনীর গোপন মিশনের জন্য একটি কভার স্টোরি হিসেবে কাজ করেছিল। বিজ্ঞানী ব্যালার্ড বলেন, সেই সময় বেশির ভাগ মানুষ যা জানতেন না টাইটানিক অনুসন্ধান আসলে নৌ গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে করা একটি অতি গোপনীয় সামরিক অভিযানের আড়ালের মিশন ছিল। আমরা চাইনি সোভিয়েতরা আমাদের সাবমেরিন কোথায় ছিল তা জানুক।

বহু বছরের পরিকল্পনা সত্ত্বেও ব্যালার্ড দুটি কারণে টাইটানিক খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী ছিলেন না। অনুসন্ধানের জন্য বরাদ্দকৃত সময় ছিল স্বল্প। আর ফরাসি মহাসাগরীয় প্রতিষ্ঠান আইফ্রেমারের প্রকৌশলী জ্যাঁ-লুই মিশেল অত্যাধুনিক জাহাজ-মাউন্টেড সোনার সিস্টেম ব্যবহার করা শুরু করে। ব্যালার্ড বলেন, ‘আমাদের চুক্তি ছিল ফরাসিরা জাহাজটি খুঁজে বের করবে। একবার তারা খুঁজে পেলে এক সপ্তাহ ধরে আমি ভিডিও করব। ফরাসি দলটি কাছাকাছি পৌঁছালেও ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায়নি।’

স্করপিওন সাবমেরিনের ধ্বংসাবশেষের মানচিত্র তৈরি করার সময় ব্যালার্ডের একটি বুদ্ধি খুঁজে পান। সাধারণভাবে ভারী বস্তু সোজা সমুদ্রের তলদেশে ডুবে যায়। আর হালকা ধ্বংসাবশেষ ধীরে ধীরে নিচে নামে আর সমুদ্রের স্রোত তা আরও দূরে নিয়ে যায়। সেই হিসেবে টাইটানিক জাহাজ স্করপিওন সাবমেরিনের মতোই গভীরতায় ডুবেছিল। তখন জাহাজের কাঠামো বা অন্যান্য ভারী অংশ খুঁজে বের করার চেয়ে স্রোত খুঁজে বের করার কাজ করেন তারা।

আর্গোর মাধ্যমে ১৯৮৫ সালে টাইটানিকের সাদাকালো ভিডিও ধারণ করা হয়। এক বছর পরে আরও উন্নত রঙিন ক্যামেরা ব্যবহার করে জাহাজের সুইমিংপুল, গ্র্যান্ড সিঁড়ি এবং ধনুক বা সামনের অংশ পর্যবেক্ষণ করা হয়।

ব্যালার্ড সেই বছর অ্যালভিন নামক একটি ক্রুড সাবমার্সিবলের মাধ্যমে ধ্বংসাবশেষটি পরিদর্শনকারী প্রথম ব্যক্তি হয়েছিলেন। সেই সাবমার্সিবলের মাধ্যমে সমুদ্রের তলদেশে পৌঁছাতে দুই ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। সেখানে তিনি একটি শিশুর পুতুল, শ্যাম্পেনের বোতল ও রুপার থালাবাসনসহ বিভিন্ন নিদর্শন দেখতে পান। টাইটানিকের ওপর মরিচা পড়েছিল। দীর্ঘ ও লালচে কাঁটার মতো কাঠামো তৈরি হয়েছিল সেখানে।

বিজ্ঞানী ব্যালার্ড শুধু টাইটানিকের শেষ বিশ্রামস্থল আবিষ্কার করেননি। তিনি মিড-আটলান্টিক রিজে অভিযান পরিচালনা করেন। নাৎসি যুদ্ধজাহাজ বিসমার্ক, বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস ইয়র্কটাউনসহ বিভিন্ন জাহাজ খুঁজে বের করেন।

সূত্র: সিএনএন

সম্পর্কিত নিবন্ধ