পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে স্বাধীন কমিশন অপরিহার্য
Published: 1st, November 2025 GMT
দীর্ঘদিন পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই বাহিনীর একাংশের দলীয় আনুগত্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তার চূড়ান্ত রূপ দেখা গেছে গত বছর জুলাই–আগস্টে। এই পুলিশকে পুনর্গঠন করে জনবান্ধব ও জবাবদিহির আওতায় আনতে হলে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করাটাই প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ জন্য স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনকে অপরিহার্য মনে করছেন অংশীজনেরা। তবে কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা থাকতে হবে।
গতকাল শনিবার প্রথম আলোর কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশ পুলিশের সংস্কার: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় অংশীজনদের বক্তব্যে এমন মত উঠে এসেছে। প্রথম আলো ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার কল্যাণ সমিতি আয়োজিত এই আলোচনায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, রাজনীতিবিদ, পুলিশের সাবেক ও বর্তমান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
বক্তারা প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশনের ক্ষমতা, কার্যাবলি নিয়েও আলোচনা করেন। এই কমিশন যাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে পড়ে না যায়, সেটার ওপরও জোর দেন সবাই।
আলোচনায় অংশ নিয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল আশ্বাস দেন প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশে কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নিশ্চয়তার বিষয়টি থাকবে। তিনি পুলিশ সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম তুলে ধরেন। তিনি জানান, এরই মধ্যে ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করা হয়েছে, ১২ ঘণ্টার মধ্যে আটক করা ব্যক্তির স্বজনদের জানাতে হবে। কাউকে আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্বজনদের না জানালে সেটা হলে গুম হিসেবে গণ্য হবে।
আইন উপদেষ্টা বলেন, শেখ হাসিনা পুলিশকে একটি নির্মম, অত্যাচারী, পাশবিক এবং দানবীয় বাহিনীতে পরিণত করেছিল। পুলিশে ‘আমার লোক, তোমার লোক’ এই বিষয়টি আওয়ামী লীগ আমলে ভয়াবহ অবস্থায় গিয়েছিল। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, ভুয়া নির্বাচন, দলীয়করণ—সবই করেছে। সবকিছু শুরু করেছে আওয়ামী লীগ, বাকিরা সেটি ‘কন্টিনিউ’ করেছে।
বিগত সময়ে পুলিশ যে এমন অত্যাচারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো, সে প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা কেউ কেউ করেছে সরকারি দলের আদেশে, সরকারি দলের ইচ্ছাপূরণের জন্য। আর কেউ কেউ করে নিজ স্বভাবে, সে ক্ষমতাশালী হতে চায় টাকা বানাতে চায়। সরকার তাকে যতটুকু অত্যাচার করতে বলে, তার থেকেও দশ গুণ বেশি করে।’
পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে আইনের আওতায় স্বাধীনভাবে কাজ করার নিশ্চয়তার বিষয়ে জোর দেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। তিনি বলে, ‘কাজের ক্ষেত্রে ইনডিপেনডেন্স, ফাংশনাল ইনডিপেনডেন্সটা আমাকে দেন। আমি আগেও বলেছি যে মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে, গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে যেন আমার কাছে কোনো নির্দেশনা না আসে। বইতে (আইনে) সবকিছু লেখা আছে। সেই অনুযায়ী পুলিশকে কাজ করতে দেন।’
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। শনিবার প্রথম আলোর কার্যালয়ে গোলটেবিল বৈঠকে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আইন উপদ ষ ট র জন ত ক সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
যেভাবে আবিষ্কৃত হলো ডুবে যাওয়া টাইটানিক
প্রায় ৪০ বছর আগে ১ সেপ্টেম্বর ভোরের দিকে বিশ্বের বিখ্যাত জাহাজ টাইটানিকের খোঁজ মেলে। সেই দিন আটলান্টিকের তলদেশে তল্লাশি চালানো গবেষণা জাহাজ নরের কমান্ড সেন্টারের ভিডিও ফিডে একটি ধাতব সিলিন্ডারের অস্পষ্ট সাদাকালো ছবি ভেসে ওঠে।
জাহাজের চার সদস্যের পর্যবেক্ষণ দলের সদস্যরা সন্দেহ করেন বস্তুটি কোনো একটি ডুবে যাওয়া জাহাজের বয়লার হতে পারে। পর্যবেক্ষকেরা তখন জাহাজের রাঁধুনিকে পাঠান অভিযাত্রার প্রধান বিজ্ঞানী বব ব্যালার্ডকে ডেকে আনতে। বব ১৯৭০ দশক থেকে এই ধ্বংসাবশেষ খুঁজছিলেন। ব্যালার্ড তখন তাঁর কেবিনের বাংকে শুয়ে পড়ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের উডস হোল ওশানোগ্রাফিক ইনস্টিটিউশনের ফলিত সমুদ্র পদার্থবিদ্যা ও প্রকৌশলের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ব্যালার্ড স্মরণ করে বলেন, সেই রাঁধুনি তাঁর বাক্য শেষ করার আগেই আমি লাফিয়ে উঠলাম। আমি আক্ষরিক অর্থে আমার ফ্লাইটসুটটি পায়জামার ওপর পরেছিলাম তখন। পরের কয়েক দিন সেই সুট আর খুলিনি। টাইটানিক আবিষ্কারের ৪০তম বার্ষিকী উপলক্ষে নিজের অভিজ্ঞতা এভাবে প্রকাশ করেন বব ব্যালার্ড। ব্যালার্ড বলেন, ‘আমি যখন কমান্ড সেন্টারের ভেতরে, তখন বয়লার দেখলাম। আমাদের কাছে বয়লারের একটি ছবি ছিল। আমরা বুঝতে পারলাম এটি নিশ্চিতভাবেই টাইটানিকের।’
১৯১২ সালে সেই আইকনিক জাহাজটির যাত্রা শুরুর ৭৩ বছর পর ব্যালার্ড ও তাঁর দল ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পান। এর আগপর্যন্ত টাইটানিক যেন ছিল এক অবিরাম আকর্ষণের উৎস। ডুবন্ত নয় বলে পরিচিত এই জাহাজ এক স্বর্ণালি যুগে আমেরিকান ধনীদের নিয়ে প্রথম যাত্রায় ডুবে যায়। মানুষের নির্বুদ্ধিতা, শ্রেণিগত কুসংস্কার আর প্রযুক্তিগত ব্যর্থতার এক করুণ গল্প হিসেবে টাইটানিক আজও আলোচিত।
১৯৮৫ সালে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার টাইটানিকের প্রতি আরও আকর্ষণকে তীব্র করে তোলে। বিজ্ঞানী ব্যালার্ড ও তাঁর সহকর্মীদের মতো সমুদ্র অভিযাত্রীদের জন্য টাইটানিক খুঁজে পাওয়া ছিল মাউন্ট এভারেস্টে প্রথমবার আরোহণ করার মতো। ১৯৮৫ সালে টাইটানিকের অনুসন্ধান ব্যালার্ডের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করার প্রথম প্রচেষ্টা ছিল না। ব্যালার্ড তাঁর স্মৃতিকথা ইনটু দ্য ডিপে লিখেছেন, ১৯৭৭ সালের একটি অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল, যখন একটি ৩ হাজার ফুটের ড্রিলিং পাইপ সোনার ও ক্যামেরা নিয়ে মাঝখানে ভেঙে যায়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে ব্যালার্ড রিমোটলি অপারেটেড আন্ডারওয়াটার ভেহিকেল (আরওভি) ব্যবহার করার চেষ্টা করেন।
মার্কিন নৌবাহিনী এমন এক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছিল। আর্গো নামের প্রযুক্তি দিয়ে গভীর সমুদ্রভিত্তিক ইমেজিং সিস্টেম তৈরি করা হয়। মার্কিন নৌবাহিনী জানতে চেষ্টা করছিল এই প্রযুক্তির মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া দুটি পারমাণবিক সাবমেরিন ইউএসএস থ্রেশার ও ইউএসএস স্করপিওন খুঁজে পাওয়া যায় কি না। ১৯৬০–এর দশকে এই দুটি সাবমেরিন আটলান্টিকে ডুবে গিয়েছিল। বিজ্ঞানী ব্যালার্ড নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের সাবমেরিন জরিপ করার অভিযানের সময় টাইটানিক অনুসন্ধানের জন্য কিছু সময় দিতে রাজি করান। এই কৌশল অবশ্য নৌবাহিনীর গোপন মিশনের জন্য একটি কভার স্টোরি হিসেবে কাজ করেছিল। বিজ্ঞানী ব্যালার্ড বলেন, সেই সময় বেশির ভাগ মানুষ যা জানতেন না টাইটানিক অনুসন্ধান আসলে নৌ গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে করা একটি অতি গোপনীয় সামরিক অভিযানের আড়ালের মিশন ছিল। আমরা চাইনি সোভিয়েতরা আমাদের সাবমেরিন কোথায় ছিল তা জানুক।
বহু বছরের পরিকল্পনা সত্ত্বেও ব্যালার্ড দুটি কারণে টাইটানিক খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী ছিলেন না। অনুসন্ধানের জন্য বরাদ্দকৃত সময় ছিল স্বল্প। আর ফরাসি মহাসাগরীয় প্রতিষ্ঠান আইফ্রেমারের প্রকৌশলী জ্যাঁ-লুই মিশেল অত্যাধুনিক জাহাজ-মাউন্টেড সোনার সিস্টেম ব্যবহার করা শুরু করে। ব্যালার্ড বলেন, ‘আমাদের চুক্তি ছিল ফরাসিরা জাহাজটি খুঁজে বের করবে। একবার তারা খুঁজে পেলে এক সপ্তাহ ধরে আমি ভিডিও করব। ফরাসি দলটি কাছাকাছি পৌঁছালেও ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায়নি।’
স্করপিওন সাবমেরিনের ধ্বংসাবশেষের মানচিত্র তৈরি করার সময় ব্যালার্ডের একটি বুদ্ধি খুঁজে পান। সাধারণভাবে ভারী বস্তু সোজা সমুদ্রের তলদেশে ডুবে যায়। আর হালকা ধ্বংসাবশেষ ধীরে ধীরে নিচে নামে আর সমুদ্রের স্রোত তা আরও দূরে নিয়ে যায়। সেই হিসেবে টাইটানিক জাহাজ স্করপিওন সাবমেরিনের মতোই গভীরতায় ডুবেছিল। তখন জাহাজের কাঠামো বা অন্যান্য ভারী অংশ খুঁজে বের করার চেয়ে স্রোত খুঁজে বের করার কাজ করেন তারা।
আর্গোর মাধ্যমে ১৯৮৫ সালে টাইটানিকের সাদাকালো ভিডিও ধারণ করা হয়। এক বছর পরে আরও উন্নত রঙিন ক্যামেরা ব্যবহার করে জাহাজের সুইমিংপুল, গ্র্যান্ড সিঁড়ি এবং ধনুক বা সামনের অংশ পর্যবেক্ষণ করা হয়।
ব্যালার্ড সেই বছর অ্যালভিন নামক একটি ক্রুড সাবমার্সিবলের মাধ্যমে ধ্বংসাবশেষটি পরিদর্শনকারী প্রথম ব্যক্তি হয়েছিলেন। সেই সাবমার্সিবলের মাধ্যমে সমুদ্রের তলদেশে পৌঁছাতে দুই ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। সেখানে তিনি একটি শিশুর পুতুল, শ্যাম্পেনের বোতল ও রুপার থালাবাসনসহ বিভিন্ন নিদর্শন দেখতে পান। টাইটানিকের ওপর মরিচা পড়েছিল। দীর্ঘ ও লালচে কাঁটার মতো কাঠামো তৈরি হয়েছিল সেখানে।
বিজ্ঞানী ব্যালার্ড শুধু টাইটানিকের শেষ বিশ্রামস্থল আবিষ্কার করেননি। তিনি মিড-আটলান্টিক রিজে অভিযান পরিচালনা করেন। নাৎসি যুদ্ধজাহাজ বিসমার্ক, বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস ইয়র্কটাউনসহ বিভিন্ন জাহাজ খুঁজে বের করেন।
সূত্র: সিএনএন