মুন্সীগঞ্জের হিমাগারগুলোতে আলু সংরক্ষণ করে এবার পুরোটাই লোকসানের মুখে পড়েছেন মুন্সীগঞ্জের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, ৫০ কেজির বস্তা শেডে বাছাই করলে ৪৮ কেজি আলু পাওয়া যায়। সেই আলু ৮ টাকা কেজি ধরে ৩৮৪ টাকা বস্তা বিক্রি হচ্ছে। যার মধ্যে হিমাগার ভাড়া ৩০০ টাকা। শ্রমিক খরচ কেজিতে আরো এক টাকা। এক বস্তা আলু বিক্রি করলে পাওয়া যাচ্ছে ৩৬ টাকা।

মুন্সীগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ জেলায় ৩৪ হাজার ৭৫৮ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়। এতে উৎপাদন হয় ১০ লাখ ৮২ হাজার ৫৩৮ মেট্রিক টনের বেশি আলু। আলু সংরক্ষণের জন্য জেলায় ৬১টি হিমাগার রয়েছে। এ বছর স্থানীয় উৎপাদিত আলুসহ রংপুর, কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুরের কয়েকটি এলাকা থেকে আলু সংগ্রহ করেন ব্যবসায়ীরা। কৃষক ও ব্যবসায়ীরা ৫ লাখ ২৩ হাজার ৩৩৫ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ করেন।

আরো পড়ুন:

‘ধান আবাদ করেও ভাত খাইতে পারি না’

স্বর্ণের সঙ্গে কমেছে রুপার দামও

গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত হিমাগারগুলোতে আলুর মজুত ছিল ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৯০ মেট্রিক টন। যার মধ্যে ১ লাখ ৯০ হাজার ৪৬৫ মেট্রিক টন খাওয়ার  এবং ৯৭ হাজার ২৫ মেট্রিক টন বীজ আলু রয়েছে। গত বছর এ সময় ছিল বীজ ও খাবার আলু ছিল মাত্র ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৮৭ মেট্রিক টন।

আলুচাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ বছর আলুর বীজ, সার ও জমিভাড়া অন্য বছরের তুলনায় দ্বিগুণের কাছাকাছি। এ বছর এক কেজি আলু উৎপাদন করতেই কৃষকের ১৭–১৯ টাকা খরচ হয়েছিল। বাছাই করে হিমাগারে রাখার উপযোগী করতে বস্তা, পরিবহন, শ্রমিকদের মজুরিসহ প্রতি কেজিতে খরচ তিন টাকা। এর সঙ্গে হিমাগার ভাড়া কেজিতে আরও ছয় টাকা। অর্থাৎ হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করা পর্যন্ত প্রতি কেজিতে মোট ২৬ থেকে ২৮ টাকা খরচ হয়েছিল। গত কয়েকদিন ধরে আলু হিমাগারে পাইকারিতে মাত্র ৮ টাকা কেজি দরে বেচাকেনা হচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে সেই দামেও আলু কিনতে চাচ্ছে না কেউ।

মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার চরকেওয়ার ইউনিয়নের হামিদপুর এলাকার বাসিন্দা সাহারা বেগম (৪৫)। তার বাব-দাদারা বংশ পরম্পরায় আলু চাষ ছিলেন। বিয়ের পর স্বামীর সংসারে এসেও দেখেছেন আলুর আবাদ। গত মৌসুমে আলু চাষের আগে তার স্বামী স্ট্রোক করে পক্ষাঘাতগ্রস্থ হন। এরপর তিনি তার দুই ছেলে ও শ্রমিকদের নিয়ে তিন একর ২০ শতাংশ জমিতে আলুর আবাদ করেন।

সাহারা বেগম বলেন, ‍“আমাদের অন্য কোনো কাজ জানা নেই। তাই স্বামী সংসার নিয়ে টিকে থাকতে ও তিন ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার খরচ চালাতে আলু চাষ করি। প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা ধার করে জমি চাষ করেছিলাম। জমি থেকে পৌনে ৭০০ বস্তা (৫০ কেজির বস্তা) আলু পাই। মৌসুমের শুরুতেই আলুর দাম কম থাকায় তাতে খরচ উঠছিল না। লাভের আশায় সব আলু হিমাগারে রাখি। এখনো কেউ দামই জিঙ্গেস করে না। শুনলাম, হিমাগারে পাইকারি ৭-৮ টাকা কেজি ধরে আলু বেচাকেনা হচ্ছে। এ পরিস্থিতে সংসার চলবে কীভাবে আর ধার শোধ করব কীভাবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।”

মুন্সীগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড.

মো. হাবিবুর রহমান বলেন, “আলু চাষ এ জেলার কৃষকদের আবেগ ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে গেছে।লোকসান হলেও এ জেলার মানুষ আলু উৎপাদন করেন। এবার সবজিটির দাম কম ছিল। এ অবস্থায় সরকার ২২ টাকা কেজি ধরে আলু কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটি করা গেলে এ যাত্রায় কৃষক ও ব্যবসায়ীরা টিকে থাকতে পারবেন। যতটুকু জানি, সরকার সে চেষ্টা এখনো চালিয়ে যাচ্ছে।”

তিনি আরো বলেন, “কৃষক ও ব্যবসায়ীদের এ দুরবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য বিদেশে আলু রপ্তানির উদ্যােগ নিতে হবে। জেলায় আলু ভিত্তিক শিল্প গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি আমাদের কৃষকদের আলুর আবাদ কমিয়ে সূর্যমুখী বীজের চাষ ও মিষ্টি আলুসহ মৌসুমি সবজি চাষ করতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।”

রোববার (২ নভেম্বর) সরেজমিনে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুরে এলাইড কোল্ডস্টোরেজ, বিক্রমপুর মাল্টিপারপাস, দেওয়ান কোল্ডস্টোরে ও কদমরসূল কোল্ডস্টোরেজ গুলোতে গিয়ে দেখা যায়, হিমাগারগুলোতে কর্মচাঞ্চলতা তেমন নেই। এসব হিমাগারে শেডে হাতেগোনা কিছু শ্রমিক আলু বাছাই করছেন।

দেওয়ান কোল্ডস্টোরেজে কথা হয় কৃষক বাদশা মিয়ার সঙ্গে। এই হিমাগারে তাদের ৫০০ বস্তা আলু আছে। তিনি বলেন, “৫০ কেজির বস্তা শেডে বাছাই করলে ৪৮ কেজি আলু পাওয়া যায়। সেই আলু ৮ টাকা কেজি ধরে ৩৮৪ টাকা বস্তা বিক্রি হচ্ছে। যার মধ্যে হিমাগার ভাড়া ৩০০ টাকা। শ্রমিক খরচ কেজিতে আরো এক টাকা। এক বস্তা আলু বিক্রি করলে পাওয়া যাচ্ছে ৩৪ টাকা বা ৬৮ পয়সা। তাই হিমাগারের আলু হিমাগারেই ফেলে চলে যাচ্ছি।”

বিক্রমপুর মাল্টিপারপাস হিমাগারে ফজর আলী নামের এক আলু ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, “গত চারদিন আগে ১০ টাকা কেজি দরে ৬ হাজার বস্তা আলু কিনেছিলাম। এখন দাম কমে ৮ টাকা কেজি হয়েছে। মাত্র চারদিনের ব্যবধানে বর্তমান হিসেবে ৬ লাখ টাকা শেষ। দাম আরো কমলে অথবা বিক্রি করতে না পারলে আরো বেশি মরতে হবে। ২২ টাকার ঘোষণা দিয়েও আলু কেনেনি সরকার।”

গত আগস্ট মাসে হিমাগারে সাড়ে ১২ থেকে ১৩ টাকা কেজি ধরে আলু বিক্রি হচ্ছিল। এতে কৃষকদের প্রায় অর্ধেক টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছিল। এর প্রেক্ষিতে গত ২৭ আগস্ট হিমাগারে আলুর দাম সর্বনিন্ম ২২ টাকা নির্ধারণ করে কৃষি মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি হিমাগার থেকে ৫০ হাজার মেট্রিক টন আলু সরকারি উদ্যোগে কিনে হিমাগারে সংরক্ষণ করা এবং অক্টোবর-নভেম্বর মাসে তা বাজারে বিক্রি করার কথা জানানো হয়েছিল সে সময়। সে ঘোষণার পর মুন্সীগঞ্জের হিমাগারগুলোতে কৃষি সম্প্রসার অধিদপ্তর ব্যানারও ঝুলিয়ে দেয়। সরকারের এমন উদ্যােগে খুশি ছিলেন কৃষকরা। তবে, বাস্তবে কোন কাজ না হওয়ায় আরো বেশি বিপদে পড়তে হয়েছে বলে জানান কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।

আলু ব্যবসায়ী বাবুল পাইক বলেন, “সরকারি ঘোষণার পর হিমাগারে বেশ কিছুদিন আলু বিক্রি বন্ধ ছিল। দাম বাড়ার আশায় আবার অনেকে ১৩-১৪ টাকা দরে আলুও কিনে ছিলেন। প্রায় দুই মাস এ অবস্থায় ছিল। শেষ পর্যন্ত সরকার আলু না কেনায় এখন কৃষক-ব্যবসায়ী সবাই বেকায়দায় পড়েছে। সরকারের এমন ছলচাতুরীতে শত শত কোটি টাকা লোকসানের মুখে কৃষক। হিমাগারে যে পরিমাল আলু এখনো মজুদ আছে, ৮ টাকা দামে বিক্রি করেও শেষ করতে পারবে না।

আগামী নভেম্বর মাসের মধ্যভাগে নতুন আলু বাজারে আসতে শুরু করবে। পুরনো আলু হিমাগারে রাখা যাবে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। সে ক্ষেত্রে পুরনো আলুর কোন ব্যবস্থা না হলে হিমাগার থেকে ফেলে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না বলে জানান নিপ্পন আইস এন্ড কোল্ডস্টোরেজের ব্যবস্থাপক রিজাউল করিম।

তিনি বলেন, “মৌসুমের শুরুতে ১ লাখ ৮১ হাজার বস্তা আলু ছিল। এখনো হিমাগারে ৭৫ হাজার বস্তা আলু আছে। জেলার সব হিমাগারের কোথাও মজুতের অর্ধেক, কোথাও অর্ধেকের কাছাকাছি আলু রয়েছে। কৃষকরাও আর হিমাগারে আসছেন না। তারা আলু বের করছেন না, আমাদের ভাড়াও দিচ্ছে না। নভেম্বর মাস পর্যন্ত তাদের আলু আমরা ধরতেও পারবো না। কিছুদিন পর এ আলুর চাহিদাও থাকবে না। আলু অবিক্রিত থাকলে বিদ্যুত বিল, শ্রমিক খরচ ও রক্ষানাবেক্ষণ খরচ হিসেবে হিমাগার কর্তৃপক্ষকেও কোটি কোটি টাকার লোকসান গুণতে হবে।”

মুন্সীগঞ্জের আলুর তথ্য শুরু থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা জানিয়ে মুন্সীগঞ্জ কৃষি বিপণন কর্মকর্তা এ বি এম মিজানুল হক বলেন, “সরকার ২২ টাকা কেজি ধরে হিমাগার থেকে আলু কেনার ঘোষণা দিলেও মুন্সীগঞ্জের হিমাগার গুলো থেকে কোনো আলু কেনেনি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তাই বর্তমানে আলু নিয়ে বিপদে আছেন জেলার কৃষকরা। দিন যত যাচ্ছে ততই দাম কমছে। আগামী মাসে উত্তরাঞ্চলের জেলায় চাষ করা আগাম জাতের নতুন আলু বাজারে আসতে শুরু করবে। তাতে পুরনো আলুর চাহিদা আর থাকবে না।

ঢাকা/মাসুদ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর হ ম গ রগ ল ত ম ট র ক টন ব ছ ই কর জ র বস ত চ ষ কর দ ম কম আম দ র ২২ ট ক উৎপ দ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের কর্মসূচি ঘোষণা বিএনপির 

ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে ৫ থেকে ১৩ নভেম্বর ১০ দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি।

ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস পালন করতে রবিবার দুপুরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে দলের নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক যৌথসভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।

আরো পড়ুন:

ফখরুলের কণ্ঠ নকল, সতর্ক করল বিএনপি

শরীয়তপুরে দু’পক্ষের সংঘর্ষ, শতাধিক হাতবোমা বিস্ফোরণ

কর্মসূচিআর মধ্যে রয়েছে, ৭ নভেম্বর মহান জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে এ দিন সকাল ৬টায় নয়াপল্টনে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশে দলীয় কার্যালয়গুলোতে দলীয় প্রতাকা উত্তোলন করা হবে। দিবসটি উপলক্ষে ৭ নভেম্বর সকাল ১০ টায় দলের জাতীয় নেতাসহ সব পর্যায়ের নেতাকর্মী মহান স্বাধীনতার ঘোষক সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান বীর উত্তম এর মাজারে পুস্পস্তবক অর্পণ ও ফাতেহা পাঠ করবেন।

দিবসটি উপলক্ষে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির উদ্যোগে ৭ নভেম্বর শুক্রবার বিকেল ৩ টায় নয়াপল্টনে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে র‌্যালী হবে। ঐ দিন সারা দেশে বিএনপির উদ্যোগে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে র‌্যালি হবে।

এছাড়া দিবসটি উপলক্ষে দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন আলোচনা সভা ও অন্যান্য কর্মসূচি পালন করবে।

এছাড়া শ্রমিক দল-৫ নভেম্বর-আলোচনা সভা, ছাত্রদল-৮ নভেম্বর-আলোচনা সভা (৭ ও ৮ নভেম্বর টিএসসি-তে আলোকচিত্র প্রদর্শনী), ওলামা দল-৯ নভেম্বর-এতিম শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, তাঁতী দল-১০ নভেম্বর-আলোচনা সভা, কৃষকদল-১১ নভেম্বর-আলোচনা সভা, জাসাস-১৩ নভেম্বর-শহীদ মিনারে সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে বিএনপির উদ্যোগে ১২ নভেম্বর চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভা, ৬ নভেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত ডকুমেন্টরি (ভিডিও, স্থিরচিত্র) ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়াসহ ফেসবুক, ইউটিউব, অনলাইনে প্রকাশ করা হবে। ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব  ও সংহতি দিবস উপলক্ষে পোষ্টার ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হবে।

সভায় দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিব, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব এবং কেন্দ্রীয় অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি/আহবায়ক ও সাধারণ সম্পাদক/সদস্য সচিবরা উপস্থিত ছিলেন। 

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/এসবি 

সম্পর্কিত নিবন্ধ