ইমাম তাবারি: জ্ঞানী, দুঃসাহসী, মর্মান্তিক জীবন
Published: 2nd, November 2025 GMT
মুসলিম মনন ও মনীষার ইতিহাসে যে কয়েকজন মনীষী আপন প্রতিভার দ্যুতিতে স্বতন্ত্র এক জগৎ নির্মাণ করেছেন, ইমাম আবু জাফর মুহাম্মদ ইবন জারির আত-তাবারি (২২৪-৩১০ হিজরি) তাঁদের মধ্যে অবিস্মরণীয়।
তাঁর পূর্ণ নাম মুহাম্মদ ইবন জারির ইবন ইয়াযিদ ইবন কাসির ইবনে গালিব। তিনি ছিলেন একাধারে কোরআনের এক অবিসংবাদিত ভাষ্যকার, নিপুণ ইতিহাসবিদ এবং প্রাজ্ঞ ফকিহ। তাঁকে ‘ইমামুল মুফাসসিরিন’ বা মুফাসসিরদের ইমাম উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
২২৪ হিজরি সনে তাবারিস্তানের উর্বর ভূমিতে ইমাম তাবারির জন্ম। শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে আশ্চর্য মেধা ও প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। তাঁর পিতা আল্লাহপ্রদত্ত এই গুণ বুঝতে পেরে শৈশব থেকেই জ্ঞানের পথে তাঁকে পরিচালিত করেন। পুত্রের পড়াশোনা, ভ্রমণ ও গবেষণায় পূর্ণ মনোযোগ নিশ্চিত করতে নিজের জমির আয় পর্যন্ত উৎসর্গ করেছিলেন।
ধীরে ধীরে তিনি আরও প্রাজ্ঞ হয়ে ওঠেন। নিজস্ব ইজতিহাদ তাঁকে স্বতন্ত্র পথে চালিত করে, তখন এই পরিবর্তনও হাম্বলিদের চোখে তাঁকে সন্দেহভাজন করে তোলে।সেই মেধার স্বাক্ষর ইমাম তাবারি রেখেছিলেন জীবনের প্রতিটি ধাপে। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি পবিত্র কুরআন হিফজ করেন। আট বছরে নামাজের ইমামতিতে দাঁড়ান। নয় বছরে হাদিস লিপিবদ্ধ করার মতো গুরুদায়িত্বে মনোনিবেশ করেন।
ইমাম তাবারির কোরআন তিলাওয়াত ছিল শ্রুতিমধুর। ফিকহ শাস্ত্রে তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল ইমাম শাফিঈর মাযহাব অনুসরণের মাধ্যমে। কিন্তু অচিরেই তাঁর স্বাধীন বিচারবুদ্ধি ও জ্ঞানের গভীরতা তাঁকে অনুকরণের পথ থেকে স্বতন্ত্র ইজতিহাদের বিশাল প্রান্তরে নিয়ে আসে। তিনি এক স্বয়ংসম্পূর্ণ মুজতাহিদ ইমাম হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন।
জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের এমন এক প্রোজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের চারপাশে জ্ঞানপিপাসু পতঙ্গের মতো সমবেত হয়েছিলেন সমকালের বহু শ্রেষ্ঠ বিদ্যার্থী।
ইমাম তাবারির লেখনী থেকে উৎসারিত হয়েছিল জ্ঞানজগতের অমূল্য সব গ্রন্থ। এর মধ্যে অন্যতম, মুসলিম সমাজে ব্যাপক গ্রহণযোগ্য কুরআনের ভাষ্যগ্রন্থ তাফসিরুত তাবারি (জামিউল বায়ান আন তা’বিলি আয়িল কুরআন) এবং ইতিহাসের বিখ্যাত গ্রন্থ তারিখুত তাবারি (তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক)।
অথচ যাঁর কীর্তি এত ভাস্বর, তাঁকেও জীবনের সায়াহ্নে নিদারুণ এক সংকট ও পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছিল; জীবনের শেষভাগে তিনি যখন বাগদাদে স্থায়ী হন। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, যাহাবি, ১৪/২৬৯)
বাগদাদের জ্ঞানকেন্দ্র ইমাম তাবারির স্বাধীন পাণ্ডিত্য ও স্বতন্ত্র চিন্তার ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। দীর্ঘ সফরের মাধ্যমে সংগৃহীত জ্ঞান তিনি এখানে সংকলন করতে শুরু করেন। বিভিন্ন মতামতের চুলচেরা বিশ্লেষণ শেষে নিজের স্বতন্ত্র মাযহাব—যা ‘জারিরি মাযহাব’ নামে পরিচিত—প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পান।
আরও পড়ুনবিপ্লবী চিন্তাবিদ ইমাম ইবনে তাইমিয়া১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫কিন্তু ইমাম তাবারির এই পদক্ষেপ তৎকালীন বাগদাদের রক্ষণশীল পরিমণ্ডলে প্রচণ্ড সংঘাতের জন্ম দেয়। সেই সময়ে বাগদাদ ছিল হাম্বলি মাযহাবের অনুসারীদের এক অপ্রতিহত দুর্গ। ইবনুল আসিরের বর্ণনা মতে, সংখ্যায় ও প্রভাবে তাঁরা ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। (আল-কামিল ফিত তারিখ–ইবনুল আসির, ৮/১৩৪)
এই হাম্বলিরাই ইমাম তাবারির বিরুদ্ধে তীব্র হট্টগোল ও প্রতিরোধ সৃষ্টি করে এবং তাঁর সম্পর্কে যা খুশি তাই বলতে থাকে। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, যাহাবি, ১১/১৮৮-১৮৯)
এই গভীর বিদ্বেষের নেপথ্যে ক্রিয়াশীল ছিল একাধিক কারণ।
প্রথমত, সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে ইমাম তাবারির একটা সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে। তিনি গবেষণা ও পর্যালোচনার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল ছিলেন মূলত একজন যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও হাদিসশাস্ত্রের হাফেজ। ফকিহ বা আইনবিদ হিসেবে তাঁর পরিচিতি প্রধান ছিল না।
এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতেই তিনি যখন ইখতিলাফুল ফুকাহা (ফকিহগণের মতপার্থক্য) শীর্ষক গ্রন্থটি রচনা করেন, তখন ফকিহদের তালিকায় ইমাম আহমদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেননি। (আল-কামিল ফিত তারিখ, ইবনুল আসির, ৮/১৩৪)
ইমাম তাবারির এই সিদ্ধান্ত বাগদাদের হাম্বলি সমাজে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। তারা যখন তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করল, তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তিনি ফকিহ ছিলেন না, বরং মুহাদ্দিস ছিলেন।’
পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ রূপ নেয় যে শহরের সেনাপ্রধানকে সহস্রাধিক সৈন্য নিয়ে এসে উত্তেজিত জনতাকে নিবৃত্ত করতে হয়েছিল। জনতাকে হাম্বলিরাই তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল।এই একটি কথাই যথেষ্ট ছিল তাঁর বিরুদ্ধে সব শক্তিকে একত্রিত করার জন্য। তারা ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী অবস্থান নেয় এবং তাঁকে গৃহবন্দি করে। এমনকি তাঁর বাড়িতে পাথর পর্যন্ত নিক্ষেপ করে। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, যাহাবি, ১৪/২৭৪)
পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ রূপ নেয় যে শহরের সেনাপ্রধানকে সহস্রাধিক সৈন্য নিয়ে এসে উত্তেজিত জনতাকে নিবৃত্ত করতে হয়েছিল। জনতাকে হাম্বলিরাই তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। অন্য ইমামগণও এই নির্মমতার সাক্ষী। ইমাম আবু বকর ইবন খুযাইমার মতো মনীষী পর্যন্ত মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘হাম্বলিরা তাঁর ওপর জুলুম করেছে।’ (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, যাহাবি, ১৪/২৭৫)
দ্বিতীয়ত, ইমাম তাবারি বাগদাদে দশ বছর ধরে ইমাম শাফিঈর মাযহাবের প্রচার করেছিলেন। ইবন সুরাইজের উস্তাদ ইবন বাশশার আল-আহওয়ালের মতো ব্যক্তিত্ব তাঁর কাছ থেকে এই মাযহাবের জ্ঞান লাভ করেন। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, যাহাবি, ১৪/২৭৫)
ধীরে ধীরে তিনি আরও প্রাজ্ঞ হয়ে ওঠেন। নিজস্ব ইজতিহাদ তাঁকে স্বতন্ত্র পথে চালিত করে, তখন এই পরিবর্তনও হাম্বলিদের চোখে তাঁকে সন্দেহভাজন করে তোলে।
তৃতীয়ত, তিনি হাম্বলিদের মতামতের খণ্ডন করে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
তবে এই বিদ্বেষ ও নিপীড়নকে যিনি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন এবং সাধারণ মানুষকে ইমাম তাবারির বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলেন, তিনি ছিলেন বাগদাদের হাম্বলিদের তৎকালীন প্রধান, হাফেজ আবু বকর ইবন আবি দাউদ।
আরও পড়ুনইমাম বুখারির নিঃসঙ্গ মৃত্যু১৪ আগস্ট ২০২৫বাগদাদে ইমাম তাবারির সমাধি.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: হ ম বল দ র স বতন ত র হ ম বল র হয় ছ ল গ রন থ দ ইবন জনত ক আরও প র ইবন ক রআন
এছাড়াও পড়ুন:
জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের কর্মসূচি ঘোষণা বিএনপির
ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে ৫ থেকে ১৩ নভেম্বর ১০ দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি।
ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস পালন করতে রবিবার দুপুরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে দলের নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক যৌথসভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
আরো পড়ুন:
ফখরুলের কণ্ঠ নকল, সতর্ক করল বিএনপি
শরীয়তপুরে দু’পক্ষের সংঘর্ষ, শতাধিক হাতবোমা বিস্ফোরণ
কর্মসূচিআর মধ্যে রয়েছে, ৭ নভেম্বর মহান জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে এ দিন সকাল ৬টায় নয়াপল্টনে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশে দলীয় কার্যালয়গুলোতে দলীয় প্রতাকা উত্তোলন করা হবে। দিবসটি উপলক্ষে ৭ নভেম্বর সকাল ১০ টায় দলের জাতীয় নেতাসহ সব পর্যায়ের নেতাকর্মী মহান স্বাধীনতার ঘোষক সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান বীর উত্তম এর মাজারে পুস্পস্তবক অর্পণ ও ফাতেহা পাঠ করবেন।
দিবসটি উপলক্ষে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির উদ্যোগে ৭ নভেম্বর শুক্রবার বিকেল ৩ টায় নয়াপল্টনে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে র্যালী হবে। ঐ দিন সারা দেশে বিএনপির উদ্যোগে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে র্যালি হবে।
এছাড়া দিবসটি উপলক্ষে দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন আলোচনা সভা ও অন্যান্য কর্মসূচি পালন করবে।
এছাড়া শ্রমিক দল-৫ নভেম্বর-আলোচনা সভা, ছাত্রদল-৮ নভেম্বর-আলোচনা সভা (৭ ও ৮ নভেম্বর টিএসসি-তে আলোকচিত্র প্রদর্শনী), ওলামা দল-৯ নভেম্বর-এতিম শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, তাঁতী দল-১০ নভেম্বর-আলোচনা সভা, কৃষকদল-১১ নভেম্বর-আলোচনা সভা, জাসাস-১৩ নভেম্বর-শহীদ মিনারে সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে বিএনপির উদ্যোগে ১২ নভেম্বর চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভা, ৬ নভেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত ডকুমেন্টরি (ভিডিও, স্থিরচিত্র) ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়াসহ ফেসবুক, ইউটিউব, অনলাইনে প্রকাশ করা হবে। ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে পোষ্টার ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হবে।
সভায় দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিব, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব এবং কেন্দ্রীয় অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি/আহবায়ক ও সাধারণ সম্পাদক/সদস্য সচিবরা উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/এসবি