দেশে কিডনি বিক্রি হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে গেল কি না, এমন উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন অধ্যাদেশ ২০২৫ অনুমোদন দেওয়ার পর কেউ কেউ এই উদ্বেগ দেখিয়েছেন। আবেগের বশবর্তী হয়ে অনাত্মীয় ব্যক্তিকেও কিডনি দান করা যাবে, এমন সুযোগ অধ্যাদেশে রাখা হয়েছে।

৩০ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, পরিবারের বাইরে কেউ চাইলে নিঃস্বার্থভাবে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করতে পারবেন।

শরীরে সংযোজনের জন্য নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেওয়ার বিধান আছে। আগের আইনে ছিল ২২ নিকটাত্মীয়। এবারের অধ্যাদেশে আছে ৩০ নিকটাত্মীয়। এর মধ্যে আছে পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী ও রক্ত-সম্পর্কিত আপন চাচা, ফুফু, নানা-নানি, দাদা-দাদি, নাতি-নাতনি, আপন চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো, খালাতো ভাই বা বোন, ভাতিজা-ভাতিজি, ভাগনে-ভাগনি এবং সৎভাই বা বোন।

কোনো ব্যক্তির অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দরকার হলে এই ৩০ নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে তা নিতে পারবেন। এই নিকটাত্মীয় ছাড়াও অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, ‘পরার্থবাদী দাতা’ বা ‘ইমোশনাল ডোনার’ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করতে পারবেন।

দেশে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন নিয়ে বিতর্ক মূলত কিডনি দানকে কেন্দ্র করে। যকৃৎ সংযোজন নিয়েও কিছু বিতর্ক হয়েছে। অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে আলোচনা কম। কিডনির বিষয়ে মানুষের ভয় ও আগ্রহ বেশি।

‘নিকটাত্মীয়’, এই পরিচয় ব্যবহার করে এ দেশে কিডনি বেচাকেনার বড় বাজার গড়ে উঠেছে। ভুয়া নিকটাত্মীয় পরিচয় দিয়ে বহু মানুষ কিডনি বিক্রি করেছেন, বহু মানুষ কিডনি কিনেছেন। যাঁরা দেশে কিডনি কিনতে বা বিক্রি করতে পারেননি, তাঁরা প্রতিবেশী দেশে গিয়ে তা করেছেন। অনেকে জাল পাসপোর্ট করেছেন। একসময় যাঁরা কিডনি বিক্রি করেছেন, এখন তাঁরা কিডনি কেনাবেচার দালালি করছেন। এই কেনাবেচার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, চিকিৎসক, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মিলে একটি বড় শক্তিশালী চক্র আছে।

কিডনি কেনাবেচার সবচেয়ে বড় হাট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলা। দারিদ্র্যপীড়িত এই উপজেলার বহু মানুষ কিডনি বিক্রি করেছেন। কেনাবেচার চক্র পাশের একাধিক উপজেলায় বিস্তৃত হয়েছে বলে প্রথম আলোতে প্রতিবেদন বেরিয়েছে। একই ধরনের চক্র আছে রাজধানী ঢাকায়।

বাংলাদেশে কিডনি বিক্রির বিষয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও এ বিষয়ে প্রতিবেদন করেছে। গত বছরের জুলাই মাসে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ ভারতের দিল্লিতে একজন চিকিৎসক গ্রেপ্তার হওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদে বলা হয়, ভারত-বাংলাদেশজুড়ে থাকা কিডনি কেনাবেচার চক্রের সদস্য ওই চিকিৎসক।

অধ্যাদেশে কী আছে

কেউ কেউ মনে করছেন, ইমোশনাল ডোনার এই ঝুঁকি আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, ‘পরার্থবাদী দাতা (ইমোশনাল ডোনার) বলিতে সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের বুঝাইবে, যাঁহারা গ্রহীতার সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্কে সম্পর্কিত হোক বা না হোক তাঁহাদের দীর্ঘদিনের পরিচয়সূত্রে সম্পর্কের কারণে স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে তাঁহাদের কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গ্রহীতাকে দান করার সিদ্ধান্ত প্রদান করেন।’

পরার্থবাদী দাতার বয়স ১৮ বছরের বেশি, তিনি মানসিকভাবে সুস্থ ও সজ্ঞানে সম্মতিদানে সক্ষম, আর্থিক প্রলোভন বা চাপে পড়ে নয়; বরং স্বেচ্ছায় অঙ্গদানে আগ্রহী, গ্রহীতার নিকটাত্মীয় নন ও দীর্ঘদিনের পরিচিত, এ-সম্পর্কিত কমিটির সুপারিশপ্রাপ্ত। তবে মাদকাসক্ত, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বা আর্থিক প্রলোভনে অঙ্গদানে আগ্রহী এবং যাঁর এমন রোগ আছে, যা অঙ্গদানের জন্য অনুপযুক্ত, তিনি পরার্থবাদী দাতা হতে পারবেন না।

একজন ব্যক্তি পরার্থবাদী দাতা কি না, তা নির্ধারণ করবে একটি কমিটি। সাত সদস্যের এই কমিটির সভাপতি বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য ও সদস্যসচিব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। এই কমিটির অন্যান্য কাজের মধ্যে একটি কাজ হচ্ছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে অর্থ লেনদেনের বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখা।

কেন উদ্বেগ

অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ করেছে বটে, তবে এর ভালো-মন্দ নিয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা বা বিতর্ক হয়নি। দেশে প্রতিস্থাপন কেন বেশি পরিমাণে হচ্ছে না, উপযুক্ত জনবল পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে কি না, হাসপাতালগুলো প্রস্তুত কি না—এসব বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেনি অন্তর্বর্তী সরকার। এখন অনেকেই প্রশ্ন করছেন, অন্তর্বর্তী সরকার কাদের সঙ্গে কথা বলে কাজটি করল। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের সঙ্গে জড়িত, এমন দুজন অধ্যাপক প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা বিষয়টি জানেন না।

অনেক মানুষের দুটো কিডনি অকেজো হয়ে পড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসা দুটি। একটি হচ্ছে ডায়ালাইসিস। কিডনি ডায়ালাইসিস সপ্তাহে দুবার বা তিনবার করতে হয়। এর বিকল্প হচ্ছে কিডনি প্রতিস্থাপন। দেশে প্রতিবছর ৩৫ থেকে ৪০ হাজার মানুষের দুটি কিডনি অকেজো হয়ে পড়ে। সংখ্যাটি অনুমিত। কিছু কম বা বেশি হতে পারে। অন্যদিকে সারা বছর দেশে কিডনি প্রতিস্থাপিত হয় ৪৫০ থেকে ৫০০ জনের। চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট-এর সর্বশেষ অক্টোবরের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে কিডনিজনিত রোগে বছরে ২১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যান।

মানুষ একটি কিডনি দিয়েই চলতে পারে, এমন বলা হয়। সুতরাং একটি কিডনি অন্যকে দান করা যায়। তাই দানের নামে কেউ কেউ একটি কিডনি বিক্রি করেন। কিন্তু কেউ কিডনি বিক্রি করেছেন, এমন কথা কোনো দলিলে লেখা থাকে না। কিডনি বিক্রি করা আইনত অপরাধ। অথচ কিডনি বিক্রি হচ্ছে। অধ্যাদেশ পাসের পর অনেক পরার্থবাদী দাতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

কমিটির পক্ষে প্রলোভন ও টাকাপয়সা লেনদেন যাচাই করা কঠিন। বিশিষ্ট কিডনির রোগ চিকিৎসক ও কিডনি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক হারুন অর রশীদ এই প্রতিবেদককে বলেন, কোনো কোনো ধনী মানুষের বাড়িতে কাজের মানুষ থাকেন। অনেকে অনেক বছর ধরে কাজ করেন। এ ধরনের কাজের মানুষ পরার্থবাদী দাতা হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: চ ক ৎসক প রব ন কম ট র গ রহ ত কর ছ ন দ ন কর স য জন সরক র সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বাড়তি নজর দিন

চট্টগ্রাম ও ঢাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা এবং বাসে আগুন ও ককটেল বিস্ফোরণকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে জনমনে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। একদিকে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা ঘিরে খুনোখুনি, অন্যদিকে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের অনলাইনে ঘোষিত কর্মসূচি কেন্দ্র করে এমন উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা রাস্তার পাশে জ্বালানি তেল বিক্রি কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখা এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের কথা বললেও তাতে কতটা আস্থা রাখা যাবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

গত ১৪ মাসে সরকার বারবার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা গেছে। ‘অপারেশন ডেভিল হান্টের’ মতো কিছু জনতুষ্টিবাদী পদক্ষেপ নেওয়া হলেও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তা কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আগে-পরে ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা-ব্যবস্থার সুযোগে অনেক অপরাধী জেল থেকে পালিয়ে যান, এর মধ্যে জঙ্গি ও শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও ছিলেন। ভঙ্গুর প্রশাসনিক ব্যবস্থার সুযোগে জামিনেও অনেকে বের হয়ে যান। তাঁদের অনেককেই আর গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। এ সময় থানা ও কারাগার থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদও খোয়া যায়, যার অনেকটাই উদ্ধার করা যায়নি।

এ ধরনের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও খোয়া যাওয়া অস্ত্রের কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হতে পারে বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা নানা সময়ে সরকারকে সতর্ক করেছেন। তা সত্ত্বেও অস্ত্র উদ্ধার ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো অভিযান দেখা যায়নি। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জেল থেকে বের হওয়ার পর অপরাধজগতে আবারও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন, তা নিয়েও প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রায়ই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এসব সন্ত্রাসী খুন, চাঁদাবাজি, অপহরণের মতো ভয়াবহ অপরাধে যে জড়িত হয়ে পড়েছেন, তারও সুনির্দিষ্ট তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বরাতে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এরপরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি শীর্ষ সন্ত্রাসী ও খোয়া যাওয়া অস্ত্র উদ্ধারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাদের সদিচ্ছা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে।

৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর নির্বাচনী জনসংযোগে অংশ নেওয়া সারোয়ার হোসেনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একসময় তালিকাভুক্ত ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ সাজ্জাত আলীর অনুসারী সারোয়ারের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, অস্ত্র, হত্যাসহ ১৫টি মামলা ছিল। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে সোমবার পুরান ঢাকায় মোটরসাইকেলে করে আসা অস্ত্রধারীরা এলোপাতাড়ি গুলি করে পুলিশের তালিকায় থাকা ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ তারিক সাইফকে হত্যা করে। পুলিশের ধারণা, আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের অনুসারীরা ঢাকার অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ নিতে পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।

দুটি হত্যাকাণ্ডের ভিডিওই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। একের পর এ ধরনের হত্যাকাণ্ড জনমনে যেমন আতঙ্ক তৈরি করে, একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি করে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ দলের অনলাইনে ঘোষিত কর্মসূচি ঘিরে ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা নিলেও সোমবার কয়েকটি স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ এবং বাস ও প্রাইভেট কারে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় একটি বাসে আগুন দেওয়া হলে এক ব্যক্তি পুড়ে মারা যান।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং ককটেল হামলা ও যানবাহনে আগুন দেওয়ার মতো নাশকতামূলক ঘটনায় জনমনে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, তা নিরসনের দায়িত্ব সরকারের। বর্তমান বাস্তবতায় জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নাশকতা বন্ধে সরকারের বাড়তি মনোযোগ জরুরি। এটা শুধু মুখে বলার বিষয় নয়, নাগরিকেরা এ ব্যাপারে কার্যকর ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখতে চান।

সম্পর্কিত নিবন্ধ