হোয়াইট হাউসে সাবেক ‘জিহাদি কমান্ডার’, মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে নতুন বাজি
Published: 12th, November 2025 GMT
কয়েক মাস আগেও যা কল্পনাতীত ছিল, সেই দৃশ্যই এখন বাস্তব। যুক্তরাষ্ট্র সফর করা প্রথম কোনো সিরীয় নেতা হিসেবে দেশটির প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা হোয়াইট হাউসে ঢুকেছেন। তাঁর এই যাত্রা এক চমকপ্রদ পরিবর্তনের ইঙ্গিত।
মাত্র এক বছর আগেও আল-শারা ছিলেন এমন এক বিদ্রোহী, যাঁর মাথার দাম যুক্তরাষ্ট্রই ঘোষণা করেছিল এক কোটি ডলার। আর এখন তিনিই বসে আছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সামনে। ঘৃণিত শত্রু নয়; বরং মধ্যপ্রাচ্যের ভাঙাচোরা রাজনীতিকে নতুনভাবে সাজানোর সম্ভাব্য সহযোগী হিসেবে।
একজন জিহাদি কমান্ডার থেকে আল-শারার রাষ্ট্রপ্রধানে রূপান্তর সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে নাটকীয় রাজনৈতিক পালাবদলগুলোর একটি। একসময় ‘আবু মুহাম্মদ আল-জোলানি’ নামে পরিচিত এই লোক যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইরাকে যুদ্ধ করেছেন। পরে আল-কায়েদার শাখা সংগঠন হায়াত তাহরির আল-শামের নেতৃত্বও দিয়েছেন। এমনকি একসময় তিনি মার্কিন বাহিনীর হাতে বন্দিও ছিলেন।
২০১৩ সালে তালিকাভুক্ত ছিলেন বৈশ্বিক সন্ত্রাসী হিসেবে। অথচ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তাঁর বাহিনীই মাত্র ১১ দিনে বাশার আল-আসাদের শাসনকে শেষ করে দিল। শেষ করে দিল অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে চলা এক নিষ্ঠুর একনায়কতন্ত্র।
আরও পড়ুনসিরিয়া কি নতুন ইসলামপন্থা হাজির করছে১১ মার্চ ২০২৫নানা প্রলোভনআল-শারার এই পরিবর্তনের গতি ছিল চোখধাঁধানো। গত বছর ওয়াশিংটন নিঃশব্দে তাঁর ওপর থেকে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা তুলে নেয়। এদিকে হোয়াইট হাউস সফরের ঠিক কয়েক দিন আগে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আল-শারা ও তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ওপর থেকে বাতিল করে নিষেধাজ্ঞা।
ট্রাম্পও স্বভাবসুলভভাবে বরণ করে নিয়েছেন এই সিরীয় নেতাকে। ট্রাম্পের ভাষায় আল-শারা এখন ‘কঠিন এক অঞ্চলের কঠিন মানুষ।’ তাঁর দেশ পুনর্গঠনের প্রচেষ্টার প্রশংসাও করেছেন ট্রাম্প।
মার্কিন প্রশাসন ইতিমধ্যে ‘সিজার আইন’-এর আওতায় আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করেছে। এখন কংগ্রেসে তা স্থায়ীভাবে বাতিলের উদ্যোগ নিচ্ছে। যা সিরিয়াকে পুনর্গঠনের জন্য শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগের দরজা খুলে দিতে পারে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে সিরিয়ায় পুনর্গঠনের ব্যয় ২০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি হতে পারে। তাই আল-শারার সফরের অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিঃসন্দেহে বিশাল।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের কাছে একটি বিষয় পরিষ্কার—পশ্চিমা চাহিদার সিরিয়া মানে ইরান ও তার ‘প্রতিরোধ জোটের’ জন্য এক ভয়াবহ ধাক্কা। যদি দামেস্ক তেহরান ও হিজবুল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তবে আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য নাটকীয়ভাবে চলে যাবে ওয়াশিংটনের উপসাগরীয় মিত্র ও তেল আবিবের পক্ষে। নেতানিয়াহু বিষয়টি একেবারে স্পষ্টই বলেছেন, ইরান ও হিজবুল্লাহর দুর্বলতাই সিরিয়ার সঙ্গে আলোচনাকে ‘সম্ভব’ করে তুলেছে।তবে আল-শারার ওয়াশিংটন সফরের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিকটি অর্থনৈতিক নয়; বরং পুনর্মিলনের। বিশেষ করে ইসরায়েলের সঙ্গে। গোপন বৈঠকগুলোয় মার্কিন মধ্যস্থতাকারীরা চেষ্টা চালাচ্ছেন ১৯৪৮ সাল থেকে একপ্রকার যুদ্ধাবস্থায় থাকা দামেস্ক ও তেল আবিবের মধ্যে এমন একটি নিরাপত্তা চুক্তির, যা আগে কখনো ঘটেনি।
এই চেষ্টার মূল লক্ষ্য হলো দুই দেশের পারস্পরিক সীমান্তে একটি যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। আসাদ সরকারের পতনের পর থেকে ইসরায়েল নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণ দেখিয়ে গোলান মালভূমির একটি নিরস্ত্রীকৃত অঞ্চলে সেনা মোতায়েন করেছে। দামেস্ক চায় সেই সেনাদের ফিরিয়ে নেওয়া হোক। এদিকে ইসরায়েলের দাবি, সিরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল নিরস্ত্রীকরণ করা হোক এবং সেখানে ইরানি প্রভাব পুরোপুরি শেষ করার নিশ্চয়তা দেওয়া হোক।
প্রাথমিকভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিকীকরণ নিয়ে আলোচনা করবে না সিরিয়া। যদিও ট্রাম্প প্রশাসন সিরিয়াকে আব্রাহাম চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে সেই আগ্রহকে আল-শারা উড়িয়ে দিয়েছেন ‘অবাস্তব’ বলে। এই জটিলতার মূল কারণও ধারণা করা যায়। তা হচ্ছে, গোলান মালভূমি। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই মালভূমি ১৯৬৭ সালে সিরিয়ার কাছ থেকে দখল করে ইসরায়েল। ১৯৮১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সংযুক্ত করে নেয় নিজেদের মানচিত্রে। ইসরায়েলের এই পদক্ষেপের স্বীকৃতি যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া দেয়নি কেউই।
বৈধতার বিনিময়ে গোলান মালভূমি?বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, চলমান আলোচনায় সিরিয়া গোলান মালভূমি ফেরত চাওয়ার দাবি জোরালোভাবে তুলছে না। তাদের দাবি সীমিত রয়েছে ইসরায়েলের সম্প্রতি দখল করা বাফার জোনগুলো থেকে সেনা প্রত্যাহারের মধ্যে। কিছু প্রতিবেদনে অবশ্য বলা হচ্ছে, দামেস্ক শান্তিচুক্তির পূর্বশর্ত হিসেবে অন্তত গোলানের এক-তৃতীয়াংশ ফেরত চায়। আবার কেউ কেউ ধাপে ধাপে সেনা প্রত্যাহার বা লিজ চুক্তির মতো জটিল প্রস্তাবও দিয়েছেন। অন্যদিকে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা স্পষ্ট জানিয়েছেন, গোলানের ওপর ইসরায়েলের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি না দিলে কোনো ধরনের চুক্তিই সম্ভব নয়।
আল-শারার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক মিত্র তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তিনিও সম্পূর্ণ কূটনৈতিক স্বাভাবিকীকরণের বিরোধিতা করছেন। কারণ, এতে আঙ্কারার আঞ্চলিক প্রভাব কমে ইসরায়েল ও সৌদি আরবের প্রভাব বাড়তে পারে।
এদিকে সিরিয়ার সাধারণ মানুষ বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান। দামেস্ক ও আলেপ্পোর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অনেকের অভিযোগ, আল-শারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় সিরিয়ার জমি বিকিয়ে দিচ্ছেন।
আরও পড়ুনসিরিয়া নিয়ে কথা বলার অধিকার নেই ইউরোপের০৯ জানুয়ারি ২০২৫যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের কাছে একটি বিষয় পরিষ্কার—পশ্চিমা চাহিদার সিরিয়া মানে ইরান ও তার ‘প্রতিরোধ জোটের’ জন্য এক ভয়াবহ ধাক্কা। যদি দামেস্ক তেহরান ও হিজবুল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তবে আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য নাটকীয়ভাবে চলে যাবে ওয়াশিংটনের উপসাগরীয় মিত্র ও তেল আবিবের পক্ষে। নেতানিয়াহু বিষয়টি একেবারে স্পষ্টই বলেছেন, ইরান ও হিজবুল্লাহর দুর্বলতাই সিরিয়ার সঙ্গে আলোচনাকে ‘সম্ভব’ করে তুলেছে।
মূল প্রশ্ন হচ্ছে, আল-শারার হাতে কি যথেষ্ট রাজনৈতিক পুঁজি আছে নিজের প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের জন্য? তিনি এখনো একটি বিভক্ত দেশের শাসক, তাঁর নিরাপত্তা বাহিনীর আনুগত্যও প্রশ্নবিদ্ধ। তাঁর নিজের জোটের মধ্যেই তুরস্ক-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর বিরোধিতা রয়েছে। একসময় জিহাদি কমান্ডার হিসেবে তাঁর অতীত তাঁকে আসাদকে উৎখাত করার সক্ষমতা দিয়েছে বটে; কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজন ভিন্ন দক্ষতা।
বাজির মঞ্চে এক জিহাদিআল-শারার হোয়াইট হাউস সফর খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এক বাজি। এই বাজির অংশীদার আরও অনেকে। ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর বাজি হচ্ছে, অর্থনৈতিক প্রলোভন ও কূটনৈতিক স্বীকৃতির সমন্বয়ে তাঁরা এক সাবেক সন্ত্রাসী নেতাকে নির্ভরযোগ্য অংশীদারে রূপান্তর করতে পারবেন।
অন্যদিকে সদ্য ক্ষমতায় আসা সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাজি ধরেছেন যে তিনি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও পুনর্গঠনের অর্থায়ন পেতে পারেন। সেটি নিজের দেশের জনগণকে সম্পূর্ণভাবে দূরে সরিয়ে না দিয়েই কিংবা সিরিয়ার দীর্ঘমেয়াদি ভূখণ্ডগত দাবি বিসর্জন না দিয়েই।
আল-শারা হয়তো মনে করছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত এক জাতির জন্য তিনি বাস্তববাদী পথই নিচ্ছেন; কিন্তু যে জনগণ এত ত্যাগ স্বীকার করেছে, তাদের কাছে এই বাস্তববাদই আত্মসমর্পণের মতো।
সামনের মাসগুলোই নির্ধারণ করবে আল-শারা স্বীকৃতি অর্জন করতে পারবেন কি না, আত্মসমর্পণ ছাড়া পুনর্গঠন এগিয়ে নিতে পারবেন কি না, স্বাধীনতা হারানো ছাড়া এবং বৈধতা অর্জন করতে পারেন বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া।
আপাতত আহমেদ আল-শারা দাঁড়িয়ে আছেন এক বিশাল কূটনৈতিক পরীক্ষার কেন্দ্রে। যা হয়তো অস্থির এক অঞ্চলকে স্থিতিশীল করবে, নয়তো নতুন করে আগুন জ্বালিয়ে দেবে এমন এক ভূমিতে, যা ইতিমধ্যেই সহ্য করেছে অগণিত যন্ত্রণা।
জাসিম আল-আজযাভি মধ্যপ্রাচ্যের সাংবাদিক ও টেলিভিশন উপস্থাপক। কাজ করেছেন এমবিসি, আবুধাবি টিভি ও আলজাজিরা ইংরেজিতে
মিডিল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ইসর য় ল র স দ আল শ র ক টন ত ক আল শ র র র জন য শ ষ কর
এছাড়াও পড়ুন:
পঞ্চগড়ে কমছে তাপমাত্রা, বাড়ছে শীত
পঞ্চগড়ে দিন দিন কমছে তাপমাত্রা, বাড়ছে শীতের অনুভূতি। ভোরবেলা ও গভীর রাতে হালকা কুয়াশা আর ঠান্ডা বাতাসে শীতের আগমনী বার্তা পাচ্ছেন সীমান্ত জেলা পঞ্চগড়ের মানুষ।
বুধবার (১২ নভেম্বর) সকাল ৯টার দিকে তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এর আগে, মঙ্গলবার এখানে দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিলো ১৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ, একদিনের ব্যবধানে তাপমাত্রা কমেছে ১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থানের কারণে দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় পঞ্চগড়ে আগে শীত নামে। নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে এ অঞ্চলে শীতের তীব্রতা বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
এখনই ভোরের দিকে ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ছে চারপাশ। সূর্যের দেখা মিলছে দেরিতে। দুপুরের দিকে তাপমাত্রা কিছুটা বাড়লেও বিকেল গড়াতেই আবারো বাড়ছে শীতের অনুভূতি। হঠাৎ তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের পোশাকে এসেছে পরিবর্তন। সন্ধ্যা নামলেই অনেকে শীতের পোষাক পরা শুরু করেছেন।
তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জিতেন্দ্রনাথ রায় বলেন, “তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমছে। নভেম্বরের শেষ দিকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। এরপর ডিসেম্বর মাসজুড়ে পঞ্চগড় ও আশপাশের এলাকায় একাধিক শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”
ঢাকা/নাঈম/এস