ইসলামে কলবের মর্যাদা ও গুরুত্ব
Published: 12th, November 2025 GMT
মানুষের শরীরে একটা ছোট্ট অঙ্গ আছে, যাকে বলি হৃদয়। ইসলামে এটাকে বলা হয় কল্ব। কিন্তু ইসলাম অনুসারে এটা শুধু রক্ত সঞ্চালন করা যন্ত্র নয়, বরং আত্মার কেন্দ্র, ইমানের আধার, সব আমলের উৎস। হৃদয় দিয়ে ভালো হলে সারা জীবন ভালো হয়, খারাপ হলে সবকিছু নষ্ট হয়।
আল্লাহ বলেছেন: ‘সেই দিন কোনো সম্পদ বা সন্তান কাজে আসবে না, শুধু সে ছাড়া যে আল্লাহর কাছে পৌঁছবে পরিচ্ছন্ন হৃদয় নিয়ে।’ (সুরা শুয়ারা, আয়াত: ৮৮-৮৯)
এই আয়াত যেন বলে, কেয়ামতের দিন হৃদয়ই সবচেয়ে বড় সম্বল। আজকের এই লেখায় আমরা দেখব, ইসলামে হৃদয়ের কী মর্যাদা, অন্তরের আমল কী, তার রোগ কী, আর কীভাবে পরিষ্কার রাখব। পড়তে পড়তে মনে হবে, যেন নিজের হৃদয়কে আয়নায় দেখছি।
শোনো, শরীরে একটা মাংসপিণ্ড আছে, সেটা ভালো হলে সারা শরীর ভালো হয়, খারাপ হলে সব খারাপ হয়। সেটা হলো হৃদয়।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫২ইসলামে হৃদয় সবচেয়ে মহৎ অঙ্গ। এটা আল্লাহকে চেনে, তাঁর জন্য কাজ করে, তাঁর দিকে ছোটে। বাকি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তার অনুসারী, যেন রাজার চাকর। (ইবনে তাইমিয়া, মুখতাসার মিনহাজিল কাসিদিন, পৃষ্ঠা ১৯৩, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
ইজ্জুদ্দিন ইবনে আব্দুস সালাম বলেন, হৃদয় রাজা, শরীর তার সৈন্য। শরীরের ভালো-মন্দ হৃদয়ের ওপর নির্ভর করে। নবীজি (সা.
ইবনে রজব হাম্বলি বলেন, হৃদয় ভালো হলে শুধু আল্লাহর ভালোবাসা, তাঁর ভয় থাকে, তাই অঙ্গগুলো সব হালাল করে, হারাম এড়ায়। হৃদয় খারাপ হলে খেয়ালখুশি চলে, সব অঙ্গ পাপে ডোবে। (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম, পৃষ্ঠা ১৪৪, দারু ইবনে কাসির, দামেস্ক, ২০০২)
কোরআন-সুন্নাহে হৃদয়ের মর্যাদা অপরিসীম। আল্লাহ বলেন: ‘বলো, আমার নামাজ, কোরবানি, জীবন, মৃত্যু—সব আল্লাহর জন্য, বিশ্বের রব।’ (সুরা আনআম, আয়াত: ১৬২)
এটা ইখলাসের কথা। মুশরিকরা মূর্তির জন্য করত, আল্লাহ বললেন, খাঁটি ইখলাস নিয়ে করো। নুমান বিন বশির (রা.) থেকে হাদিস, নবীজি (সা.) বলেছেন, হৃদয়ই সব। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫২)
আরও পড়ুনযে ৮ কারণে ‘কলব’ কঠিন হয়ে যায়০৮ নভেম্বর ২০২৫‘কলবই সব’, এর অর্থ কীপ্রথম. আমলের ভালো-মন্দ কলব বা হৃদয়ের ওপর। ইবনে রজব বলেন, কলব যদি শুধু আল্লাহকে চায় তাহলে অঙ্গগুলো শুধু তাঁর জন্য চলে।
দ্বিতীয়. কলবের দেখভাল করো, সংশয় ও মন্দ প্রবৃত্তি থেকে থেকে বেঁচে থাকা। যারা ইসলামের দাওয়াত দেন, তাদের হৃদয় সংশোধন করতে হবে।
তৃতীয়. দোয়া করা। আল্লাহ দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন, ‘রব্বানা লা তুঝিগ কুলুবানা বা’দা ইজ হাদাইতানা’, অর্থাৎ হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের হেদায়াত দেওয়ার পর হৃদয় বাঁকা কোরো না।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৮)
নবীজি দোয়া করতেন: ‘ইয়া মুকাল্লিবাল কুলুব, সাব্বিত কুলবানা আলা তআতিক’ অর্থাৎ হে হৃদয়ের পরিবর্তনকারী, আমাদের হৃদয় তোমার আনুগত্যে স্থির রাখো।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৫৪) আর: ‘হে আল্লাহ, আমি পরিচ্ছন্ন হৃদয় ও সত্যবাদী জিহ্বা চাই।’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস: ১৭৩৪১)
ইসলামে হৃদয় সবচেয়ে মহৎ অঙ্গ। এটা আল্লাহকে চেনে, তাঁর জন্য কাজ করে, তাঁর দিকে ছোটে। বাকি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তার অনুসারী, যেন রাজার চাকর।অন্তরের আমল ইমানের ভিত্তি। ইবনে তাইমিয়া বলেন, আল্লাহ-রাসুলের ভালোবাসা, আল্লাহর ওপর ভরসা করা, একনিষ্ঠ আল্লাহর জন্য ইবাদত, শোকর, সবর বা ধৈর্য, ভয়, আশা—সব ওয়াজিব। (মাজমু আল-ফাতাওয়া, ১০/১২৫, দারুল ওফা, মানসুরা, ২০০৫)
সবচেয়ে বড় ইখলাস বা একনিষ্ঠ আল্লাহর জন্য ইবাদত। আল্লাহ বলেন: ‘আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ইবাদাত করে তাঁরই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে।’ (সুরা বাইয়িনা, আয়াত: ৫)
আর ‘যে তার মুখ আল্লাহর দিকে সমর্পণ করে এবং সৎকর্মশীল।’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত: ১২৫)
ফুযাইল ইবনে আয়াজ বলেন, সবচেয়ে ভালো আমল হলো যা খাঁটি ও সঠিক। নিয়তের ভূমিকা বড়। পূর্বেকার বুজর্গরা বলতেন, ফকিহদের মধ্যে কেউ শুধু নিয়ত শেখাক।
যে ৪টি হৃদয়ের রোগ আমল নষ্ট করে১. রিয়া: লোকদেখানো। গাজালি বলেন, রিয়া মানে লোকের মনে মর্যাদা চাওয়া। ইবনে হাজার বলেন, রিয়া মানে দৃষ্টি আকর্ষণ (ইবনে হাজার, ফাতহুল বারি, ১১/৩৪৪, দারু রায়য়ান, কায়রো, ১৯৮৭)। ইবনে কাসির বলেন, রিয়া মানে লোকের প্রশংসা চাওয়া, আল্লাহর না। (তাফসির, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪৬৩, দারু তাইবা, রিয়াদ, ১৯৯৯)
কোরআনে আছে, মুনাফিকরা নামাজে অলস, লোকদেখানো ইবাদত করে। (সুরা আন-নিসা, আয়াত: ১৪২)
হাদিসে আছে, ‘যে শোনায়, সে আল্লাহ শোনাবে; যে দেখায়, সে শুধু আল্লাহ দেখাবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৯৮৬)
২. লুকানো বিদ্বেষ: এ ধরনের বিদ্বেষ থাকা অবস্থায় জান্নাতে যাওয়া যাবে না। কোরআনে এসেছে, আর তাদের অন্তরে যে বিদ্বেষ ছিল, আমি তা বের করে নিয়েছি (সুরা আরাফ, আয়াত: ৪৩)
ইবনে কাসির বলেন, যদি অপরের হক নষ্ট করে না থাকে, তাহলে জান্নাতের দরজায় গিয়ে কাউসারের পানি পান করার মধ্য দিয়ে তাদের সামান্য যা থাকবে, তা নির্মূল হবে এবং এরপর জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। (ইবনে কাসির, তাফসির, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ১৮৯, দারু তাইবা, রিয়াদ, ১৯৯৯)
আরও পড়ুনমানুষের ‘কলব’ কেন বদলে যায়২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫৩. অহংকার: নিজেকে বড় মনে করা। রাগিব বলেন, নিজেকে অন্যের চেয়ে বড় দেখা। (রাগিব ইসফাহানি, গারিবুল কোরআন, পৃষ্ঠা ৪২১, দারুল কিতাবিল আরাবি, বৈরুত, ১৯৮৫) ইবলিস প্রথম অহংকার করল। (সুরা আল-আরাফ, আয়াত: ১২)
আল্লাহ বলেছেন, ‘লোকের থেকে মুখ ফিরিয়ো না, পৃথিবীতে উদ্ধত হয়ে চলো না।’ (সুরা লুকমান, আয়াত: ১৮-১৯)
হাদিসে আছে, ‘যার হৃদয়ে অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে যাবে না।’ তবে ভালো কাপড় পছন্দ অহংকার নয়, অহংকার হলো সত্য প্রত্যাখ্যান, লোককে তুচ্ছ করা। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯১)
৪. হাওয়া: এর অর্থ শরিয়তবিহীন খেয়াল। আল্লাহ বলেন: ‘হাওয়া অনুসরণ কোরো না, আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করবে।’ (সুরা সোয়াদ, আয়াত: ২৬)
ইবনে কাসির বলেন, এর মানে হলো খেয়ালখুশিকে উপাস্য বানানো। (তাফসির, ৭/১২৩, দারু তাইবা, রিয়াদ, ১৯৯৯)
ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, হাওয়া মানুষের মধ্যে থাকবে, কিন্তু যদি অনুসরণ না করে তাহলে পুরস্কার পাবে। (সুরা আন-নাজিয়াত, আয়াত: ৪০-৪১)
হৃদয় পরিষ্কার করার উপায়১. জিকির ও কোরআন: ‘যারা ইমান এনেছে, তাদের হৃদয় আল্লাহর জিকিরে শান্ত হয়।’ (সুরা আর-রাদ, আয়াত: ২৮)
ইবরাহিম খাওয়াস বলেন, জিকির হৃদয়ের খাদ্য এবং এর পাঁচটা ওষুধ: কোরআন নিয়ে গবেষণা করা, খালি পেট, তাহাজ্জুদ, সাহরিতে দোয়া, সৎ লোকদের সঙ্গ। (আবু নুয়াইম, হিলয়াতুল আউলিয়া, ১০/৩২৭, দারুল কিতাবিল আরাবি, বৈরুত, ১৯৮৫)
২. সৎ লোকদের সঙ্গ: ওমর (রা.) বলেন, ইসলামের পর সবচেয়ে বড় নেয়ামত সৎ সঙ্গী। আল্লাহ বলেন: ‘নিজেকে তাদের সঙ্গে রাখো, যারা সকাল-সন্ধ্যা রবকে ডাকে।’ (সুরা কাহফ, আয়াত: ২৮)
হাদিসে আছে, ‘মানুষ তার সঙ্গীর ধর্মে থাকে।’ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ৪৮৩৩)
৩. গুনাহ থেকে দূরে থাকা: হারাম এড়ানো হৃদয়ের জীবন। হাদিসে আছে, ‘সন্দেহ এড়িয়ে চললে ধর্ম ও সম্মান দুটোই বাঁচে’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫২)। আরও আছে, ‘সেই সবচেয়ে বড় আবেদ, যে হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয় এড়িয়ে চলে।’ (সুনান তিরমিজি, হাদিস: ১২০৯)
আরও পড়ুনইসলামে ‘কলব’ ও ‘আকল’–এর সম্পর্ক১০ নভেম্বর ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সহ হ ব খ র খ র প হল র বল ন র জন য বল ছ ন ক রআন সবচ য় ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
ইসলামে কলবের মর্যাদা ও গুরুত্ব
মানুষের শরীরে একটা ছোট্ট অঙ্গ আছে, যাকে বলি হৃদয়। ইসলামে এটাকে বলা হয় কল্ব। কিন্তু ইসলাম অনুসারে এটা শুধু রক্ত সঞ্চালন করা যন্ত্র নয়, বরং আত্মার কেন্দ্র, ইমানের আধার, সব আমলের উৎস। হৃদয় দিয়ে ভালো হলে সারা জীবন ভালো হয়, খারাপ হলে সবকিছু নষ্ট হয়।
আল্লাহ বলেছেন: ‘সেই দিন কোনো সম্পদ বা সন্তান কাজে আসবে না, শুধু সে ছাড়া যে আল্লাহর কাছে পৌঁছবে পরিচ্ছন্ন হৃদয় নিয়ে।’ (সুরা শুয়ারা, আয়াত: ৮৮-৮৯)
এই আয়াত যেন বলে, কেয়ামতের দিন হৃদয়ই সবচেয়ে বড় সম্বল। আজকের এই লেখায় আমরা দেখব, ইসলামে হৃদয়ের কী মর্যাদা, অন্তরের আমল কী, তার রোগ কী, আর কীভাবে পরিষ্কার রাখব। পড়তে পড়তে মনে হবে, যেন নিজের হৃদয়কে আয়নায় দেখছি।
শোনো, শরীরে একটা মাংসপিণ্ড আছে, সেটা ভালো হলে সারা শরীর ভালো হয়, খারাপ হলে সব খারাপ হয়। সেটা হলো হৃদয়।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫২ইসলামে হৃদয় সবচেয়ে মহৎ অঙ্গ। এটা আল্লাহকে চেনে, তাঁর জন্য কাজ করে, তাঁর দিকে ছোটে। বাকি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তার অনুসারী, যেন রাজার চাকর। (ইবনে তাইমিয়া, মুখতাসার মিনহাজিল কাসিদিন, পৃষ্ঠা ১৯৩, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
ইজ্জুদ্দিন ইবনে আব্দুস সালাম বলেন, হৃদয় রাজা, শরীর তার সৈন্য। শরীরের ভালো-মন্দ হৃদয়ের ওপর নির্ভর করে। নবীজি (সা.) বলেছেন: ‘শোনো, শরীরে একটা মাংসপিণ্ড আছে, সেটা ভালো হলে সারা শরীর ভালো হয়, খারাপ হলে সব খারাপ হয়। সেটা হলো হৃদয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫২; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৫৯৯)
ইবনে রজব হাম্বলি বলেন, হৃদয় ভালো হলে শুধু আল্লাহর ভালোবাসা, তাঁর ভয় থাকে, তাই অঙ্গগুলো সব হালাল করে, হারাম এড়ায়। হৃদয় খারাপ হলে খেয়ালখুশি চলে, সব অঙ্গ পাপে ডোবে। (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম, পৃষ্ঠা ১৪৪, দারু ইবনে কাসির, দামেস্ক, ২০০২)
কোরআন-সুন্নাহে হৃদয়ের মর্যাদা অপরিসীম। আল্লাহ বলেন: ‘বলো, আমার নামাজ, কোরবানি, জীবন, মৃত্যু—সব আল্লাহর জন্য, বিশ্বের রব।’ (সুরা আনআম, আয়াত: ১৬২)
এটা ইখলাসের কথা। মুশরিকরা মূর্তির জন্য করত, আল্লাহ বললেন, খাঁটি ইখলাস নিয়ে করো। নুমান বিন বশির (রা.) থেকে হাদিস, নবীজি (সা.) বলেছেন, হৃদয়ই সব। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫২)
আরও পড়ুনযে ৮ কারণে ‘কলব’ কঠিন হয়ে যায়০৮ নভেম্বর ২০২৫‘কলবই সব’, এর অর্থ কীপ্রথম. আমলের ভালো-মন্দ কলব বা হৃদয়ের ওপর। ইবনে রজব বলেন, কলব যদি শুধু আল্লাহকে চায় তাহলে অঙ্গগুলো শুধু তাঁর জন্য চলে।
দ্বিতীয়. কলবের দেখভাল করো, সংশয় ও মন্দ প্রবৃত্তি থেকে থেকে বেঁচে থাকা। যারা ইসলামের দাওয়াত দেন, তাদের হৃদয় সংশোধন করতে হবে।
তৃতীয়. দোয়া করা। আল্লাহ দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন, ‘রব্বানা লা তুঝিগ কুলুবানা বা’দা ইজ হাদাইতানা’, অর্থাৎ হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের হেদায়াত দেওয়ার পর হৃদয় বাঁকা কোরো না।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৮)
নবীজি দোয়া করতেন: ‘ইয়া মুকাল্লিবাল কুলুব, সাব্বিত কুলবানা আলা তআতিক’ অর্থাৎ হে হৃদয়ের পরিবর্তনকারী, আমাদের হৃদয় তোমার আনুগত্যে স্থির রাখো।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৫৪) আর: ‘হে আল্লাহ, আমি পরিচ্ছন্ন হৃদয় ও সত্যবাদী জিহ্বা চাই।’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস: ১৭৩৪১)
ইসলামে হৃদয় সবচেয়ে মহৎ অঙ্গ। এটা আল্লাহকে চেনে, তাঁর জন্য কাজ করে, তাঁর দিকে ছোটে। বাকি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তার অনুসারী, যেন রাজার চাকর।অন্তরের আমল ইমানের ভিত্তি। ইবনে তাইমিয়া বলেন, আল্লাহ-রাসুলের ভালোবাসা, আল্লাহর ওপর ভরসা করা, একনিষ্ঠ আল্লাহর জন্য ইবাদত, শোকর, সবর বা ধৈর্য, ভয়, আশা—সব ওয়াজিব। (মাজমু আল-ফাতাওয়া, ১০/১২৫, দারুল ওফা, মানসুরা, ২০০৫)
সবচেয়ে বড় ইখলাস বা একনিষ্ঠ আল্লাহর জন্য ইবাদত। আল্লাহ বলেন: ‘আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ইবাদাত করে তাঁরই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে।’ (সুরা বাইয়িনা, আয়াত: ৫)
আর ‘যে তার মুখ আল্লাহর দিকে সমর্পণ করে এবং সৎকর্মশীল।’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত: ১২৫)
ফুযাইল ইবনে আয়াজ বলেন, সবচেয়ে ভালো আমল হলো যা খাঁটি ও সঠিক। নিয়তের ভূমিকা বড়। পূর্বেকার বুজর্গরা বলতেন, ফকিহদের মধ্যে কেউ শুধু নিয়ত শেখাক।
যে ৪টি হৃদয়ের রোগ আমল নষ্ট করে১. রিয়া: লোকদেখানো। গাজালি বলেন, রিয়া মানে লোকের মনে মর্যাদা চাওয়া। ইবনে হাজার বলেন, রিয়া মানে দৃষ্টি আকর্ষণ (ইবনে হাজার, ফাতহুল বারি, ১১/৩৪৪, দারু রায়য়ান, কায়রো, ১৯৮৭)। ইবনে কাসির বলেন, রিয়া মানে লোকের প্রশংসা চাওয়া, আল্লাহর না। (তাফসির, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪৬৩, দারু তাইবা, রিয়াদ, ১৯৯৯)
কোরআনে আছে, মুনাফিকরা নামাজে অলস, লোকদেখানো ইবাদত করে। (সুরা আন-নিসা, আয়াত: ১৪২)
হাদিসে আছে, ‘যে শোনায়, সে আল্লাহ শোনাবে; যে দেখায়, সে শুধু আল্লাহ দেখাবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৯৮৬)
২. লুকানো বিদ্বেষ: এ ধরনের বিদ্বেষ থাকা অবস্থায় জান্নাতে যাওয়া যাবে না। কোরআনে এসেছে, আর তাদের অন্তরে যে বিদ্বেষ ছিল, আমি তা বের করে নিয়েছি (সুরা আরাফ, আয়াত: ৪৩)
ইবনে কাসির বলেন, যদি অপরের হক নষ্ট করে না থাকে, তাহলে জান্নাতের দরজায় গিয়ে কাউসারের পানি পান করার মধ্য দিয়ে তাদের সামান্য যা থাকবে, তা নির্মূল হবে এবং এরপর জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। (ইবনে কাসির, তাফসির, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ১৮৯, দারু তাইবা, রিয়াদ, ১৯৯৯)
আরও পড়ুনমানুষের ‘কলব’ কেন বদলে যায়২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫৩. অহংকার: নিজেকে বড় মনে করা। রাগিব বলেন, নিজেকে অন্যের চেয়ে বড় দেখা। (রাগিব ইসফাহানি, গারিবুল কোরআন, পৃষ্ঠা ৪২১, দারুল কিতাবিল আরাবি, বৈরুত, ১৯৮৫) ইবলিস প্রথম অহংকার করল। (সুরা আল-আরাফ, আয়াত: ১২)
আল্লাহ বলেছেন, ‘লোকের থেকে মুখ ফিরিয়ো না, পৃথিবীতে উদ্ধত হয়ে চলো না।’ (সুরা লুকমান, আয়াত: ১৮-১৯)
হাদিসে আছে, ‘যার হৃদয়ে অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে যাবে না।’ তবে ভালো কাপড় পছন্দ অহংকার নয়, অহংকার হলো সত্য প্রত্যাখ্যান, লোককে তুচ্ছ করা। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯১)
৪. হাওয়া: এর অর্থ শরিয়তবিহীন খেয়াল। আল্লাহ বলেন: ‘হাওয়া অনুসরণ কোরো না, আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করবে।’ (সুরা সোয়াদ, আয়াত: ২৬)
ইবনে কাসির বলেন, এর মানে হলো খেয়ালখুশিকে উপাস্য বানানো। (তাফসির, ৭/১২৩, দারু তাইবা, রিয়াদ, ১৯৯৯)
ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, হাওয়া মানুষের মধ্যে থাকবে, কিন্তু যদি অনুসরণ না করে তাহলে পুরস্কার পাবে। (সুরা আন-নাজিয়াত, আয়াত: ৪০-৪১)
হৃদয় পরিষ্কার করার উপায়১. জিকির ও কোরআন: ‘যারা ইমান এনেছে, তাদের হৃদয় আল্লাহর জিকিরে শান্ত হয়।’ (সুরা আর-রাদ, আয়াত: ২৮)
ইবরাহিম খাওয়াস বলেন, জিকির হৃদয়ের খাদ্য এবং এর পাঁচটা ওষুধ: কোরআন নিয়ে গবেষণা করা, খালি পেট, তাহাজ্জুদ, সাহরিতে দোয়া, সৎ লোকদের সঙ্গ। (আবু নুয়াইম, হিলয়াতুল আউলিয়া, ১০/৩২৭, দারুল কিতাবিল আরাবি, বৈরুত, ১৯৮৫)
২. সৎ লোকদের সঙ্গ: ওমর (রা.) বলেন, ইসলামের পর সবচেয়ে বড় নেয়ামত সৎ সঙ্গী। আল্লাহ বলেন: ‘নিজেকে তাদের সঙ্গে রাখো, যারা সকাল-সন্ধ্যা রবকে ডাকে।’ (সুরা কাহফ, আয়াত: ২৮)
হাদিসে আছে, ‘মানুষ তার সঙ্গীর ধর্মে থাকে।’ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ৪৮৩৩)
৩. গুনাহ থেকে দূরে থাকা: হারাম এড়ানো হৃদয়ের জীবন। হাদিসে আছে, ‘সন্দেহ এড়িয়ে চললে ধর্ম ও সম্মান দুটোই বাঁচে’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫২)। আরও আছে, ‘সেই সবচেয়ে বড় আবেদ, যে হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয় এড়িয়ে চলে।’ (সুনান তিরমিজি, হাদিস: ১২০৯)
আরও পড়ুনইসলামে ‘কলব’ ও ‘আকল’–এর সম্পর্ক১০ নভেম্বর ২০২৫