ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি যে ২৩৬টি আসনে প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে, তাতে সবচেয়ে বড় চমক হলো দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্য তিনটি আসন রাখা। আসন তিনটি হলো ফেনী-১, বগুড়া-৭ ও দিনাজপুর-৩। নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী, এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। অতীতে এই সংখ্যা ছিল পাঁচ।

এরশাদের শাসনামলে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দুই নেত্রীর ১৫০‍+১৫০ আসনের ফর্মুলা দেন। এরপর নির্বাচন কমিশন পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমিত করে দেয়।

খালেদা জিয়া ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যতগুলো আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, সব কটিতেই বিপুল ভোটে জিতেছেন। কোনো নির্বাচনে পরাজিত হননি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা ব্যতিক্রম ঘটনা। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯১ সালের নির্বাচনে দুটি ও ১৯৯৬ সালে একটি আসনে পরাজিত হন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৯১ সালে জেলে থেকে পাঁচটি আসনে জিতলেও ২০১৪ সালে একটি আসনে পরাজিত হন।

আরও পড়ুনখালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে কেন বিতর্ক১৮ ঘণ্টা আগে

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালে জেলে যাওয়ার পর খালেদা জিয়া রাজনীতিতে তেমন সক্রিয় নন। বিএনপির দাবি, এই মামলা ছিল পুরোপুরি উদ্দেশ্যমূলক ও ভিত্তিহীন। জেলে যাওয়ার আগেই খালেদা জিয়া দলের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে যান।

তারেক সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালে দেশান্তরি হন এবং লন্ডন থেকেই দল পরিচালনা করে আসছেন। সেখান থেকে নিয়মিত দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বৈঠক করছেন, প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন। দলের প্রার্থী মনোনয়নেও তাঁর ভূমিকা ছিল মুখ্য। আগামী মাসে তাঁর দেশে ফেরার কথা।

খালেদা জিয়া বর্তমানে শারীরিকভাবে অসুস্থ। সক্রিয় রাজনীতিতে আছেন, এটাও বলা যাবে না। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সাত বছর তিনি কখনো কারাগারে, কখনো হাসপাতালে ও গৃহে অন্তরিণ ছিলেন। দলের পক্ষ থেকে চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশে পাঠানোর ক্রমাগত দাবি জানানো হলেও তৎকালীন সরকার গ্রাহ্য করেনি।

আরও পড়ুনখালেদা জিয়ার ভাষণ যে পার্থক্য দেখাল০৬ মার্চ ২০২৫

চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন। গত বছর ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হলে খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্তি পান। তাঁর বিরুদ্ধে আনীত সব মামলাও খারিজ হয়ে যায়।

এ অবস্থায় অনেকেই ভেবেছিলেন, খালেদা জিয়া সম্ভবত আর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। কিন্তু দলের প্রাথমিক প্রার্থী তালিকায় আগের মতো তিনটি আসনে তাঁর নাম রাখা হয়েছে। খালেদা জিয়ার বর্তমানে যে শারীরিক অবস্থা, তাতে তিনি নিজে নির্বাচনী প্রচারে যেতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। এরপরও দল তাঁর ওপরই ভরসা রাখছে।

এর প্রধান কারণ হলো দলের ভেতরে ও বাইরে খালেদা জিয়ার আপসহীন ভাবমূর্তি। সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি পুরোপুরি সফল, এটা বলা যাবে না। কিন্তু স্বৈরাচারবিরোধী ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তাঁর সাহসী ভূমিকা সবাই স্বীকার করেন।

আমাদের নিত্য বৈরী রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নেতারা একে অপরকে প্রায় প্রতিদিনই বাক্যবাণে জর্জরিত করেন। অতীতের ঘটনা টেনে প্রয়াত নেতাদের বিরুদ্ধেও বিষোদ্‌গার করেন। এসব দেখে খালেদা জিয়া বিরোধী দলে থাকতে একবার সংসদে জাতীয় নেতাদের নিয়ে অহেতুক বিতর্ক না করার প্রস্তাব এনেছিলেন। সরকারি দল সেটা গ্রহণ করেনি। এরপর তো তিনি সংসদের বাইরে ২০১৪ সাল থেকে।

আওয়ামী সরকারের আমলে ক্ষমতাসীনেরা যেভাবে খালেদা জিয়াকে গালাগাল করেছেন, বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন, তাতে তাঁর প্রতি সাধারণ মানুষের সমীহ আরও বেড়েছে। একজন অসুস্থ মানুষকে নিয়ে পরিহাস করাকেও কেউ ভালো চোখে দেখেননি।

আমাদের মতো দেশে ক্ষমতায় থাকতে নেতা–নেত্রীদের জনপ্রিয়তা যাচাই করা কঠিন। এক দল নেতা-কর্মী সব সময় বন্দনা করতে থাকেন। তদুপরি রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র তো আছেই মহিমা প্রচারের জন্য। নেতা-নেত্রীদের প্রকৃত জনপ্রিয়তা যাচাই হয় যখন তাঁরা বিরোধী দলে থাকেন। খালেদা জিয়া সেটা পেরেছেন ধারণা করি।

বিএনপির প্রার্থী তালিকা নিয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কয়েকটি স্থানে সহিংস ঘটনা ঘটেছে। সড়ক অবরোধ ও আগুন দেওয়ার মহড়াও বাদ যায়নি। বিএনপির নেতৃত্ব যত সহজে পরিস্থিতি সামাল দেবে ভাবছিল, তত সহজ হচ্ছে না। এখানেও শেষ পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্ব খালেদা জিয়াকে হয়তো ‘ত্রাতা’ হিসেবে দেখতে চাইবে। বঞ্চিত মনোনয়নপ্রত্যাশীরা অন্য কারও কথা না শুনলেও তাঁর পরামর্শ অগ্রাহ্য করবেন না।

আমরা লেখক–গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের এক–এগারো: ২০০৭-২০০৮ বই থেকে জানতে পারি, তৎকালীন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা নিরাপদ প্রস্থানের জন্য দুই দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া সে প্রস্তাবে রাজি হননি। তাঁর প্রতিপক্ষ রাজি হয়েছিল। এসব ঘটনাও তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে।

নির্বাচন এলে সব রাজনৈতিক দলই বড় বড় ইশতেহার দেয়। দেশকে সমৃদ্ধির শিখরে নিয়ে যাওয়া এবং আমজনতার জন্য দুধের নহর বইয়ে দেওয়ার বড় বড় বুলি আওড়ায়। জনগণ এসবের প্রতি কম আস্থা রাখে। এরপরও তারা নেতা ও প্রতীক দেখে ভোট দেয়।

এবার বিএনপি নেতৃত্ব মূলত খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তিকে সম্বল করেই নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে চাইছে। তারা মনে করছে, খালেদা জিয়া নিজে নির্বাচনী প্রচার চালাতে না পারলেও তাঁর নাম ও নির্বাচনে অংশগ্রহণই দলকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিএনপির রাজনীতির যাঁরা কট্টর সমালোচক, তাঁরাও খালেদা জিয়াকে সম্মানের চোখে দেখেন।

এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ৪ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার আসনে আমরা কোনো প্রার্থী দিচ্ছি না। তিনি প্রার্থী হয়েছেন, আমরা তাঁকে স্বাগত জানাই। তাঁর আপসহীন ও লড়াকু নেতৃত্ব বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করেছে।’ গণ অধিকার পরিষদও খালেদা জিয়ার আসনে প্রার্থী না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে এটি সংগতিপূর্ণ না হলেও একজন নেতা বা নেত্রীর প্রতি এ সম্মান প্রদর্শনেরও মূল্য আছে।

বিএনপির প্রার্থী তালিকা নিয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কয়েকটি স্থানে সহিংস ঘটনা ঘটেছে। সড়ক অবরোধ ও আগুন দেওয়ার মহড়াও বাদ যায়নি। বিএনপির নেতৃত্ব যত সহজে পরিস্থিতি সামাল দেবে ভাবছিল, তত সহজ হচ্ছে না। এখানেও শেষ পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্ব খালেদা জিয়াকে হয়তো ‘ত্রাতা’ হিসেবে দেখতে চাইবে। বঞ্চিত মনোনয়নপ্রত্যাশীরা অন্য কারও কথা না শুনলেও তাঁর পরামর্শ অগ্রাহ্য করবেন না।

বিএনপির অনেক নেতাই বলতে চাইছেন, বড় দলে এ রকম ছোটখাটো সমস্যা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তাদের সেই অঘটন কয়েকটি আসনে সীমিত থাকছে না। বেশ কিছু আসনের মনোনয়ন নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তা অযৌক্তিক নয়। বিএনপি কিসের ভিত্তিতে তালিকা করেছে? তারা কি তৃণমূলের নেতা–কর্মীদের সঙ্গে বসেছে?

একজন বঞ্চিত মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের একজন সাংগঠনিক নেতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি তাঁর বিরোধী শিবিরের বলে আমাকে আলোচনাতেই ডাকা হয়নি।’ অনেক আসনে ত্যাগী নেতা-নেত্রীদের বাদ দিয়ে দখলদারি, চাঁদাবাজির দায়ে অভিযুক্ত নেতাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ আছে। যাঁরা আওয়ামী লীগের পুরো শাসনামলে সংসদের ভেতরে–বাইরে প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়েছেন এবং টিভি টক শোতেও সোচ্চার ছিলেন, তাঁদের বাদ দেওয়াকেও সাধারণ কর্মীরা সুনজরে দেখছেন না।

তিনটি আসনে বিএনপি খালেদা জিয়াকে মনোনয়ন দিয়ে এটাই প্রমাণ করেছে যে তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় থেকেও অনেক বেশি সক্রিয়া ভোটারদের মনে। তাঁর নামই দলকে এগিয়ে নেবে, তাঁর ভাবমূর্তিই বিজয় ছিনিয়ে আনবে, এটাই বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের ধারণা।

সোহরাব হাসান কবি ও সাংবাদিক

[email protected]

*মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক ব এনপ র সরক র র র জন য র র জন আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

বিএনপির ৩১ দফা: অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক দর্শনের রূপরেখা

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক দর্শন এমন এক গণতান্ত্রিক চিন্তা ও নীতিভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামো, যেখানে সমাজের সব শ্রেণি, পেশা, ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ, অঞ্চল ও সক্ষমতার মানুষের অংশগ্রহণ, প্রতিনিধিত্ব ও মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়। এই দর্শনের মূল লক্ষ্য হলো—ক্ষমতা, সম্পদ ও সুযোগের ওপর কারও একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ না রেখে, ন্যায়বিচার ও সাম্যের ভিত্তিতে সব নাগরিককে রাষ্ট্র ও সমাজের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা। এটি একাধিপত্যমূলক রাজনীতির পরিবর্তে আলোচনাভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক ও বিকেন্দ্রীকৃত গণতন্ত্র গড়ে তোলে। 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিএনপির ঘোষিত ৩১ দফা একটি যুগান্তকারী ও সুসংগঠিত রূপরেখা, যা রাষ্ট্রের কাঠামো ও রাজনীতির মৌলিক রূপান্তরের দর্শন তুলে ধরে। এই কর্মসূচি দেশের গণতান্ত্রিক দল, নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী, শিক্ষাবিদ এবং সাধারণ জনগণের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। যা গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার ও টেকসই উন্নয়নকে একই সুতায় গেঁথে রাষ্ট্র পরিচালনায় জনসম্পৃক্ততা ও নৈতিকতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নির্ধারণ করে।

আরো পড়ুন:

নির্বাচন পেছালে বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে: মির্জা ফখরুল

নির্বাচন পেছালে দায়ী থাকবে বিএনপি-জামায়াত: নাসীরুদ্দীন

গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি হলো জনগণের অংশগ্রহণ। ন্যায়বিচার, জবাবদিহি এবং দেশের সব নাগরিকের অধিকার ও উন্নয়নের পথ উন্মুক্ত করার অন্যতম মাধ্যম নির্বাচন। অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন বলতে বোঝায়— নারী, যুবক, শ্রমজীবী, সংখ্যালঘু, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং সকল সামাজিক ও রাজনৈতিক শ্রেণির মানুষ যেন ভয়ভীতিমুক্তভাবে ভোট দিতে এবং মতপ্রকাশ করতে পারে। ভোটাধিকার সরকারের বৈধতা নিশ্চিত করে, রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল করে এবং নাগরিক-রাষ্ট্র সম্পর্ককে শক্তিশালী করে।

গবেষণা দেখিয়েছে, যেখানে অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ নিশ্চিত, সেখানে উন্নয়ন টেকসই হয়, সংঘাত কমে এবং জনগণ নিজেদের রাষ্ট্রের অংশীদার হিসেবে অনুভব করে। গণতন্ত্র পুনর্গঠনের প্রধান শর্ত হলো অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সর্বদলীয় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এটি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে এবং গণতন্ত্রকে স্থায়ী ভিত্তি দিতে পারে। 

৩১ দফার মূল লক্ষ্য হলো জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করা। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার নৈতিকতা ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা। দফাগুলোতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ব্যক্তি ও জনগণের রাজনৈতিক অধিকার, আইনের শাসন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণের অঙ্গীকার রয়েছে।

বিএনপির ৩১ দফায় দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা দূর করে রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে জনগণের কল্যাণে নিবেদিত করতে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিচারব্যবস্থার পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রস্তাব রয়েছে। এর পাশাপাশি রয়েছে কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে আলাদা পরিকল্পনা। যেমন, কৃষকদের জন্য ‘ফারমার্স কার্ড’ চালুর উদ্যোগ, যা গ্রামের অর্থনীতি পুনর্গঠনের নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। 

‘বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু নয়’ অর্থাৎ কেউ যেন অর্থের অভাবে চিকিৎসা না পেয়ে মারা না যায়। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও ক্লিনিক গড়ে তোলা হবে। স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হবে এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য স্বাস্থ্য কার্ড চালু করা হবে।

ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে দেশের প্রতিটি পরিবারকে খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হবে। মা বা গৃহিণীকে দেওয়া পরিচয়পত্রের মাধ্যমে খাদ্য সামগ্রীর কিছু অংশ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হবে। প্রথমে সুবিধাবঞ্চিত গ্রামের পরিবারদের দেওয়া হবে, পরে শহর, থানা, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে সম্প্রসারিত হবে। এই পদক্ষেপ শুধু দারিদ্র্য নিরসন নয়, বরং সামাজিক সমতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের একটি শক্ত ভিত্তি গড়বে।

শিক্ষিত যুবসমাজের প্রায় ৪০ শতাংশ বেকার। বেকারত্ব দূরীকরণে বেকার ভাতা চালু করে শিক্ষিত যুবকদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। কর্মসংস্থান সুষ্টির মাধ্যমে যুবসমাজকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সক্রিয় রাখা হবে। দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও উদ্ভাবনী উদ্যোগের মাধ্যমে স্থায়ী কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হবে। যা যুবসমাজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও উদ্যোগী মনোভাব গড়ে তুলবে।

৩১ দফায় অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে নারী, শিশু, যুবক, সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও দলিত জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার করা হয়েছে। উন্নয়নের সুবিধা শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে দিতে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, পরিবেশ সুরক্ষা এবং শহর-গ্রামের বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা উত্থাপন করা হয়েছে।
৩১ দফা কেবল প্রশাসনিক বা অর্থনৈতিক সংস্কারের নথি নয়; বরং এটি রাষ্ট্রের নৈতিকতা, মানবিকতা ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার একটি পুনর্নির্মাণমূলক নকশা। এটি অতীতের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি ভবিষ্যৎবান্ধব রাষ্ট্র নির্মাণের প্রয়াস। এই কর্মসূচিতে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে জনগণের অংশগ্রহণ, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং আইনের শাসনের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিশ্রুতি।

অর্থনীতিকে জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচনায় এনে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ও উৎপাদন খাতকে শক্তিশালী করতে ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন’ গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে একটি ন্যায্য, দুর্নীতিমুক্ত ও দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধিমুখী কাঠামো গড়ে তোলা হবে। 

জাতীয় ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক পরিচয় সংরক্ষণ এবং বৈশ্বিক সংস্কৃতির সঙ্গে ভারসাম্য রেখে সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, একটি আধুনিক, মানবিক ও বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে মানসম্মত ও সবার জন্য সুষম শিক্ষা নিশ্চিত করার পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এতে আইনের শাসনকে রাষ্ট্রের ভিত্তি বিবেচনায় এনে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সুবিচার এবং সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। জনগণের অংশগ্রহণ ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হবে রাষ্ট্রের কার্যক্রম। এজন্য একটি দক্ষ, নিরপেক্ষ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের লক্ষ্যে বিকেন্দ্রীকরণ, জনসেবার সহজলভ্যতা এবং সুশাসনের কার্যকর রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে।

‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’— এই মূলনীতিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় স্বাধীনতা, রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ ভূমিকা এবং সকল ধর্মাবলম্বীর সমান অধিকার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতীয় ঐক্য ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য শহিদদের স্মৃতি সংরক্ষণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অঙ্গীকার করা হয়েছে।

নারীর উন্নয়ন ছাড়া জাতীয় অগ্রগতি সম্ভব নয়— এই উপলব্ধি থেকে নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আর্থিক স্বাবলম্বিতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৩১ দফায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সহিংসতা প্রতিরোধে কঠোর আইন ও যুগোপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ করার কথা উল্লেখ রয়েছে। শিশুদের বিকাশ নিশ্চিত করতে শিক্ষা, পুষ্টি ও নিরাপদ পরিবেশ গঠনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শিশুশ্রম রোধে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং সব শিশুকে স্কুলে রাখার পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা বলেছে।

ছাত্র সংসদ নির্বাচন, শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫% বরাদ্দ, গবেষণা ও প্রযুক্তিতে গুরুত্ব এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী ও দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের ভিত্তি হিসেবে রূপান্তরের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পরিবেশ রক্ষা, খাল-নদী পুনঃখনন, বনভূমি সংরক্ষণ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে একটি জলবায়ু-সহনশীল উন্নয়ন কাঠামো গড়ে তোলার কথা বলেছে।

আদিবাসী, সংখ্যালঘু ও দলিত জনগণের অধিকার, নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ভূমি অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। পিছিয়ে পড়া সকল নাগরিকের জন্য সামাজিক সুরক্ষা, কর্মসংস্থান ও রাজনৈতিক স্বীকৃতির মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে।

পেশাজীবী যেমন শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, আইনজীবী, প্রকৌশলী ইত্যাদির পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। শহর ও গ্রামের মধ্যে বৈষম্য দূর করে প্রতিটি গ্রামে আধুনিক কৃষি, প্রযুক্তি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন কাঠামো গড়ে তোলার অঙ্গীকার রয়েছে।

‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’— মানেই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক দর্শন। শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা ছিল একটি দুর্বল রাষ্ট্রকে আত্মনির্ভরশীল, আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা। সেখানে খাদ্য, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, নাগরিক অধিকার ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। তার সেই রাষ্ট্রচিন্তার উত্তরাধিকার বহন করে তারেক রহমানের নেতৃত্বে ৩১ দফা কর্মসূচি আজকের বাস্তবতায় একটি যুগোপযোগী রূপ নিয়েছে বলে মনে করেন বিএনপির নেতৃবৃন্দ।

বিএনপির ভাষ্যমতে, এই ৩১ দফা এখনো একটি চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ। জনগণের কাছ থেকে মতামত, প্রস্তাব ও প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করে দল এটিকে আরও পরিমার্জিত ও সমৃদ্ধ করবেন। একাধিক সেমিনার, আলাপ-আলোচনা ও জাতীয় সংলাপের মাধ্যমে জনগণের সামনে এটি পুনরায় উপস্থাপন করা হবে। যা আগামী নির্বাচনের ইশতেহারেও যুক্ত হবে।

এই কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য হলো চলমান স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী কাঠামোর অবসান ঘটিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক, গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। ভবিষ্যতে যাতে কোনো সরকার যেন জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েও স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত হতে না পারে, সেই লক্ষ্যেই রাষ্ট্র, প্রশাসন ও সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ৩১ দফার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।

ভোটাধিকার হরণ, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দলীয়করণ, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও দমন-পীড়ন এক ভয়াবহ বাস্তবতা মোকাবেলায় অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক দর্শনই একমাত্র পথ— যার মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের জীবনমানের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। যদি বিএনপির ৩১ দফা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়, তাহলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের চেতনা অনেকটাই পূরণ হবে— যেখানে অন্তর্ভুক্তি, ন্যায়বিচার ও ভোটাধিকার নিশ্চিত হবে। 

লেখক: গবেষক ও রাজনৈতিক কলাম লেখক

ঢাকা/তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • প্রার্থিতা নিয়ে বিএনপির মিত্রদের মধ্যে অস্থিরতা
  • শেখ হাসিনার নির্দেশেই কয়েকটি বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে: রিজভী
  • বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ঘুষ দিয়ে চাকরি নেওয়ার প্রয়োজন হবে না: এ জেড এম জাহিদ
  • জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠাই আমাদের মূল লক্ষ্য: নিপুন রায় 
  • বিএনপি গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন একটি রাজনৈতিক দল: রিজভী
  • যারা জুলাই বিপ্লব মানবেন না, তাদের জন্য নির্বাচন নাই: জামায়াত আম
  • পাকিস্তান আরও স্বৈরশাসনের পথে
  • বিএনপির ৩১ দফা: অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক দর্শনের রূপরেখা
  • শহীদ নূর হোসেন, বৃদ্ধ মজিবুর রহমান এবং শামসুর রাহমানের কবিতা