‘এইবার পুরাপুরি শীতের দিন চলে আইচ্ছে’
Published: 12th, November 2025 GMT
দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় দুই দিন ধরে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হচ্ছে। উত্তরের এ জনপদে বাড়ছে শীতের অনুভূতি।
তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যাবেক্ষণাগার সূত্রে জানা যায়, আজ বুধবার সকাল নয়টায় তেঁতুলিয়ায় দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি সারা দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। রাত থেকে ভোর পর্যন্ত ঘন কুয়াশা থাকলেও সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে কুয়াশা কেটে গিয়ে উঠেছে ঝলমলে রোদ।
এর আগে গতকাল মঙ্গলবার সকাল নয়টায় তেঁতুলিয়ায় সারা দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল।
আজ সকাল সাড়ে সাতটার দিকে সদর উপজেলার ডাঙ্গাপাড়া এলাকার সাহিরুল ইসলাম (৪২) বলেন, ‘এইবারের মধ্যে আইজা রাতিত সবচেয়ে বেশি ঠান্ডা (শীত) লাগিছে। সকালের বাতাসখান খুপে ঠান্ডা। এইবার পুরাপুরি শীতের দিন চলে আইচ্ছে।’
তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জিতেন্দ্র নাথ রায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তেঁতুলিয়ায় দুই দিন ধরে সারা দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হচ্ছে। আকাশে মেঘ নেই, রাতে ঘন কুয়াশা ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে কুয়াশার পরিমাণ কমে যেতে শুরু করেছে। দিনে রোদের কারণে কিছুটা উষ্ণতা বাড়ছে। তবে সন্ধ্যার পর থেকে সকাল পর্যন্ত শীত অনুভূত হচ্ছে।
এখন থেকে তেঁতুলিয়ার দিনের তাপমাত্রা দিন দিন কমতে থাকবে বলে জানান এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, চলতি নভেম্বর মাসের শেষ সময় থেকে ডিসেম্বরের শুরুর দিকে এই এলাকায় একটি মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র কর ড কর
এছাড়াও পড়ুন:
মুসলিম সভ্যতায় উন্মুক্ত শিক্ষাঙ্গন
মুসলিম সভ্যতায় ছিল শিক্ষাব্যবস্থার বৈচিত্র্য ও উন্মুক্ততা। এই ব্যবস্থার জোরেই মুসলিমরা একদিন দুনিয়ার সব শহরের সেরা হয়ে উঠেছিল, জ্ঞান আর চিন্তার জগতে। যেকোনো সাংস্কৃতিক জাগরণের তো মূল ভিত্তিই তো জ্ঞান ও শিক্ষা।
ইসলামই হলো জ্ঞানচর্চার প্রথম এবং প্রধান অনুপ্রেরণা। ইসলাম জ্ঞান অর্জনের কথা বলে। জ্ঞান সঞ্চয়ের জন্য উৎসাহ দেয়। সেই জ্ঞান লিখে রাখতে আর ছড়িয়ে দিতে প্রেরণা জোগায়। আবার জ্ঞানকে লুকিয়ে রাখাকেও সে পাপ বলে মনে করে। ইসলামের বারবার বলা হয়েছে জ্ঞান, শিক্ষা আর শেখানোর গুরুত্বের কথা; ইহকালে ও পরকালে তার সম্মান ও মর্যাদার কথা।
এই গুরুত্বের দিকটা মাথায় রেখেই, মুসলিমরা জ্ঞান অর্জনে আশ্রয় নিয়েছে বিচিত্র পদ্ধতির। কোনো একটা নির্দিষ্ট শিক্ষাক্ষেত্র, শিক্ষাধারা বা সিলেবাসে আবদ্ধ থাকেনি। এ জন্য মুসলিমদের জ্ঞান–বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগে বিভিন্ন ধরনের উন্মুক্ত শিক্ষালয় দেখা যায়। স্বতন্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে যেসব শিক্ষাক্ষেত্র ছিল, তার কয়েকটি এখানে তুলে ধরছি।
১. মসজিদইসলামের সবচেয়ে পুরোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো মসজিদ। ইসলামের উষালগ্ন থেকেই তার পথচলা। ইসলামি শিক্ষা দেওয়া, মুসলিমদের মননকে শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনস্ক করে তোলার প্রধান দায়িত্ব ছিল তারই। এককথায়, আজকের দিনের স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ের যা কাজ, ইসলামের প্রথম যুগে সেই সবটাই করত মসজিদ। (হাসান আবদুল আল, আত-তারবিয়াতুল ইসলামিয়্যাহ, পৃ. ১৮৮)
বাগদাদে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারে যে মসজিদগুলোর বিরাট ভূমিকা ছিল, এর মধ্যে অন্যতম জামেউল মনসুর। ১৪৫ হিজরিতে (৭৯২ খ্রিষ্টাব্দ) বানানো হয়েছিল মসজিদটি। খতিব আল-বাগদাদি তাঁর ‘তারিখে বাগদাদ’ বইয়ে এর কথা বিস্তারিত লিখেছেন।
এই মসজিদে ফতোয়া দেওয়া হতো। ধর্ম, ভাষা আর সাহিত্যের কত যে পাঠচক্র বা জ্ঞানসভা বসত, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
এই মসজিদের গুরুত্ব বোঝাতে একটি উদাহরণই যথেষ্ট। খতিব আল-বাগদাদির মতো বড় মাপের আলেমরাও এখানে পড়ানোর স্বপ্ন দেখতেন। তিনি চাইতেন এই মসজিদে হাদিসের পাঠদান করতে। ইমাম শাফিঈ যখন এখানে এসেছিলেন, তখন এই মসজিদে প্রায় ৫০টি জ্ঞানসভা চালু ছিল। (ইয়াকুত হামাভী, মুজামুল উদাবা, ১/৪৯৮, আহমাদ আল-বাগদাদি, তারিখে বাগদাদ, ২/৬৮)
বাগদাদে এমন আরও অনেক মসজিদ ছিল, প্রায় ৫৭টি। প্রতিটিই ছিল এক একটি শিক্ষার কেন্দ্র। (মুনিরুদ্দিন আহমাদ, তারিখুত তালিম ইনদাল মুসলিমিন, পৃ. ৭১)
এইভাবেই মুসলিম সভ্যতায় মসজিদগুলো কেবল উপাসনার জায়গা হয়ে থাকেনি, হয়ে উঠেছিল এক-একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জ্ঞানার্জন বা জ্ঞান বিতরণের জন্য যেসব ছাত্র ও পণ্ডিত অন্য দেশ থেকে আসতেন, তাঁরা নিয়মিত এই মসজিদগুলোতে যেতেন, সেখানকার পাঠচক্রে বসতেন।
তারিখে বাগদাদ গ্রন্থে এমন অসংখ্য বিদেশি ছাত্র ও আলেমের নামে ভরা। এই মসজিদগুলো তাই বাগদাদের জ্ঞানচর্চাকে এক নতুন গতি দিয়েছিল। আর তার সুফল শুধু বাগদাদের মধ্যেই আটকে থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছিল পূর্ব থেকে পশ্চিমে, ইসলামি দুনিয়ার সব বড় বড় শহরে।
২. জ্ঞানীদের বাসস্থান
মুসলিম সভ্যতায় পণ্ডিতদের বাড়িতে বাড়িতে জ্ঞানসভা বসত। সেখানে পাঠ দেওয়া হতো, বই পড়া হতো। এমন অনেক উদাহরণ মেলে।
খতিব আল-বাগদাদির লেখা থেকে জানা যায়, এক সাহিত্যিক ধর্মতাত্ত্বিকের কথা। তাঁর নাম আবু উবাইদ আল-মারজুবানি। জ্ঞানপিপাসু মানুষ তাঁর বাড়িতে এসে রাত কাটাতে পারতেন। তাদের জন্য ৫০টা লেপ রাখা থাকত। তাঁর প্রসিদ্ধ ছাত্ররা সবাই তাঁর ঘর থেকেই জ্ঞান অর্জন করেছে। (আহমাদ আল-বাগদাদি, তারিখে বাগদাদ, ৩/১৩৬)
হানাফি পণ্ডিত মুহাম্মদ শায়বানি ছিলেন ইমাম আবু হানিফার ছাত্র। তিনি যখন নিজের বাড়িতে ইমাম মালিকের ‘মুয়াত্তা’ পাঠ করতেন, তখন বাড়িটা লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত। (আহমাদ আল-বাগদাদি, তারিখে বাগদাদ, ৩/১৭৩)
প্রাচ্যবিদ মেয়ারহফ বলেছেন, মুসলিম লজিশিয়ান আবু সুলায়মানের বাড়িতে নানা ধরনের, নানা পথের আলেমরা আসতেন। পশ্চিমে আন্দালুসিয়া, পূর্বে বুখারা আর দক্ষিণে শিরাজ থেকে তাঁরা আসতেন বাগদাদে, ইসলামি সভ্যতার প্রাণকেন্দ্রে, শুধু জ্ঞানলাভের জন্য। (মার্কস মেয়াহফ, আত-তুরাসুল ইউনানি ফিল হাযারাতিল ইসলামিয়্যাহ, পৃ. ৮৯)
জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদ আল-জুজানি ছিলেন ইবনে সিনার ছাত্র। তিনি তাঁর ওস্তাদের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘প্রতি রাতে ওস্তাদের বাড়িতে আমরা, ছাত্ররা, জড়ো হতাম। আমি তাঁর কাছে “আশ-শিফা” বইটা পড়তাম। পালা করে অন্যদের তিনি “আল-কানুন” বইটা পড়াতেন। দিনের বেলা সময় মিলত না, তাই পড়াশোনাটা রাতেই সারতে হতো। এভাবেই আমাদের অনেকগুলো দিন কেটেছিল।’ (ইবনে আবী উসাইবিয়া, তাবাকাতুল আতিব্বা, ৪৪১)
৩. পথের ধারে জ্ঞানের আসর
এ বিষয়ে খতিব আল-বাগদাদি একটি ঘটনার কথা বলেছেন। আবু মুসলিম ইব্রাহিম ইবনে আব্দুল্লাহ আল-বসরি, যখন বাগদাদে এলেন, তখন ঘাসসানের এক খোলা চত্বরে হাদিস শোনাতে শুরু করলেন।
তাঁর আসর এত বড় ছিল যে কথাগুলো সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সাতজন ঘোষকের দরকার হতো। একজন আরেকজনের কাছে কথাগুলো পৌঁছে দিত।
লোকেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লিখত, হাতে তাদের দোয়াত। দর্শকদের বাদ দিয়েই, শুধু যারা দোয়াত-কলম নিয়ে আসত, তাদের সংখ্যাই ছিল ৪০ হাজারের বেশি। (আহমাদ আল-বাগদাদি, তারিখে বাগদাদ, ৬/১২১)
আল-জু’আনি নামে আরেকজন আলেম ছিলেন। তিনি যখন পথের ওপর হাদিস শোনাতেন, তখন ছাত্রদের ভিড়ে রাস্তা প্রায় বন্ধ হয়ে যেত। পথচারীদের চলার উপায় থাকত না। (আহমাদ আল-বাগদাদি, তারিখে বাগদাদ, ৩/২৮)
এই সব ঘটনা থেকে বোঝা যায়, কত আলেম যে কোনো প্রথাগত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরেই অগণিত ছাত্রকে পড়িয়েছেন, আর ছাত্ররাও তাঁদের হাত ধরেই জ্ঞানচর্চা শেষ করে বেরিয়ে গেছেন, তার কোনো হিসাব নেই।
৪. বাজার
বাজার হলো সাধারণ আর বিশেষ সব মানুষের মেলামেশার জায়গা। অনেক আলেম বাজারেই তাঁদের রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা করতেন। তাঁরা নিজেদের দোকানে বসেই ছাত্রদের স্বাগত জানাতেন। জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আলেমরা ছিলেন উন্মুখ, আর মানুষও ছিল শিখতে আগ্রহী, সঠিক পথের দিশা পেতে উদগ্রীব। তাই এই জায়গাগুলোই হয়ে উঠেছিল জ্ঞানচর্চার এক একটি কেন্দ্র।
এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা বলা যায়। আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ, যিনি আল-মুস্তাইনি নামে পরিচিত ছিলেন, তিনি বাগদাদের ইয়াহিয়া বাজারে আসতেন এবং লোকেদের সঙ্গে কথা বলতেন, তাদের জ্ঞান শোনাতেন। (আহমাদ আল-বাগদাদি, তারিখে বাগদাদ, ৫/৪৪৭)
সুবকি তাঁর ‘তাবাকাত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন আইনশাস্ত্রের পণ্ডিত আবু বকর আস-সিবগির কথা। মক্কি সরাইখানার দরজার কাছে, কিরমানি চত্বরে তাঁর একটা দোকান ছিল। সেটিই হয়ে উঠেছিল হাদিস বিশারদদের মিলনক্ষেত্র। (তাজুদ্দিন সুবকি, তাবাকাতুশ শাফিঈয়্যাতিল কুবরা, ৩/১৮৩)
শেষ কথা
এই ছবিগুলো থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মুসলিম সভ্যতায় জ্ঞানচর্চা শুধু বইয়ের পাতায় বা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে ছিল না। গোটা শহরটাই যেন হয়ে উঠেছিল এক উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
মসজিদ ছিল ক্লাসরুম। জ্ঞানীদের বাড়ি ছিল বিদ্যালয়। আর পথের ধার বা বাজারের কোলাহলও হয়ে উঠত জ্ঞান বিতরণের মঞ্চ।
জ্ঞানের প্রতি মানুষের এই তীব্র পিপাসা আর শেখানোর প্রতি আলেমদের এই নিঃস্বার্থ দায়বদ্ধতাই ছিল মুসলিম সভ্যতার আসল চালিকা শক্তি। জ্ঞান সেখানে কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা ডিগ্রির আড়ালে বন্দী ছিল না, বরং তা ছিল জীবনেরই এক স্বাভাবিক ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মেলবন্ধনই মুসলিম বিশ্বকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জ্ঞানের নেতৃত্বে পথ দেখিয়েছিল।
[email protected]
আবদুল্লাহিল বাকি: লেখক, আলেম ও সফটওয়্যার প্রকৌশলী