‘সাংস্কৃতিক বৈষম্য’ কোনো শব্দবন্ধ হিসেবে কতটা দরকারি, তা নির্ভর করে আপনি কীভাবে সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়িত করছেন, তার ওপর। সংস্কৃতিকে আপনি যদি স্রেফ শিল্প, সাহিত্য, সংগীত—এ রকম কিছু কর্মকাণ্ডে আটকিয়ে ফেলেন, তখন হয়তো বৈষম্য জিনিসটার প্রায়োগিক মানে দাঁড়ায়। কিন্তু সংস্কৃতি যদি হয় গণমানুষের সাবজেক্টিভিটিকে আমূল বদলে দেওয়ার চর্চা, সেখানে ‘বৈষম্য’ প্রত্যয়টার অর্থ আলাদাভাবে বোধগম্য নয়। ওই জায়গায় সাংস্কৃতিক বৈষম্য জিনিসটাকে বুঝতে হবে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ঐতিহাসিকভাবে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পটভূমি দিয়ে।

সব মিলিয়েই আমি

আমরা যার যার কুঠুরির মধ্যে বাস করতে পছন্দ করি। এটাকে সাংস্কৃতিক কুঠুরি বলা যায়। আমার অভ্যাস, আমার প্রার্থনা, আমার গান, আমার আচার, আমার বিশ্বাস—এসব মিলিয়েই আমি। অন্য থেকে নিজেকে আলাদা করার মাধ্যমে আমি আমার সংস্কৃতিকে চিনতে ও চেনাতে পারি—দেরিদার ভাষায় যাকে বলে ‘ডিফার’ ও ‘ডেফার’ করা। আত্ম-আবিষ্কারের এই যে নিরন্তর পিচ্ছিল পথ, এই পথের পথিক না হয়ে উপায়ও নেই। সময় আমাকে বাধ্য করে। ঘটনা আমাকে ঠেলে দেয়। আমার মাঝে আমি এক অচেনা আমাকে আবিষ্কার করি। তাকে ভালোবেসে ফেলি। এই ভালোবাসা নিঃশর্ত নয়। এই ভালোবাসাকে অর্থপূর্ণ করার জন্য আমাকে একটা বর্গের অধীন যেতে হয়। একটা গোষ্ঠীর মধ্যে নিজেকে আমি শনাক্ত করি। অপরাপর গোষ্ঠীর থেকে পৃথক একটা জায়গা খুঁজে নিতে হয়। 

ফলে সংস্কৃতি, আন্তশ্রেণি প্রশ্নে প্রায় সব সময়ই বৈষম্যমূলক। বৈষম্য তৈরি হয়। কারণ, আমাদের অনেকগুলো বস্তুগত সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে প্রতিদিনের জীবনকে মোকাবিলা করতে হয়। এদের কোনো কোনোটাকে আমি আমার বর্গের বলে শনাক্ত করি। কোনো কোনোটাকে ‘অপর’ বলি। এদের মধ্যে লড়াই খুব চলে। ক্ষমতা ও সংস্কৃতি একে অপরকে পোক্ত করে। 

কিন্তু কখনো এমন দিন আসে, যখন বিরাজমান সংস্কৃতিসমূহ তাদের অন্তর্গত বিভেদ ও বৈষম্য ভুলে যায়। রাজনীতি ও অর্থনীতি এই ক্যারিশমা ঘটায়। চব্বিশের জুলাই আন্দোলন যখন র্যাপ, কাওয়ালি, পপ গান, লালন আর আরবান ফোককে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দিল, আমাদের মধ্যে অবলীলায় একটা বৃহত্তর ঐক্যের ধারণার জন্ম হলো। তৈরি হলো এক অভেদের ন্যারেটিভ। এক বৃহত্তর রাজনৈতিকতার আদেশে আমরা একে অপরের সাংস্কৃতিক চিহ্নগুলোকে নিজের বলয়ে প্রবেশ করতে দিলাম। শত্রুভাবাপন্ন সংস্কৃতিসমূহ বৈষম্য ভুলে গেল, একে অপরের বন্ধু হয়ে উঠতে চাইল। স্বৈরাচার এই নব উদ্ভাবিত সাংস্কৃতিক ঐক্যকে মোকাবিলা করতে পারল না।

কিন্তু যা আমরা জানতাম না, শত্রুবিজিত ভূখণ্ডে বিজয়ীদের ঐক্য ক্ষণস্থায়ী। অচিরেই আমরা আবিষ্কার করতে থাকলাম যে আমরা আসলে আলাদা। আমাদের বিভেদ ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। ঐক্যের যে ন্যারেটিভ জনচৈতন্যের ভেতরে জন্ম নিয়েছিল, তার ক্ষণস্থায়িত্ব আমাদের আবার নিজ নিজ গোষ্ঠীর পাদদেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। আমরা আবার একে অপরের সাংস্কৃতিক প্রতিদ্বন্দ্বী (ক্ষেত্রবিশেষে শত্রু) হয়ে উঠতে থাকলাম।

সাংস্কৃতিক বিপ্লব আসলে কী

সাংস্কৃতিক বিপ্লব তাহলে কি পুরোটাই আরোপিত ঘটনা? চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব নিয়ে বহু লেখাজোখা আছে। অন্তত দেড় মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করা হয় চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়। অনেক মার্ক্সিস্ট তাত্ত্বিক বলেছেন, সমাজে বিরাজিত অর্থনৈতিক ও শ্রেণিগত বৈষম্যকে পাশ কাটিয়ে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের উদ্যোগ সমাজকে অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। চীনে অন্তত এমনটাই ঘটেছে। দেড় মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করা হয়, বহু মানুষকে জেলে যেতে হয়, বহু সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়, বহু সাংস্কৃতিক স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় এবং প্রচুর পরিমাণ নিগ্রহের শিকার হয় মানুষ। 

সংস্কৃতির সংজ্ঞা খুবই ব্যাপক হতে পারে, আবার খুব সংকীর্ণভাবে দেওয়া যায়। আমরা যখন বলি ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’, সংস্কৃতির কোন জায়গাটা বৈপ্লবিক বদলের মধ্য দিয়ে যাবে, সে বিষয়ে কোনো সর্বজনমান্য ফর্মুলা কি আছে? আবার আমরা যখন বলি ‘সাংস্কৃতিক বৈষম্য’, সেটাই-বা কী অর্থে? রাষ্ট্র কোনো একটি সংস্কৃতির প্রতি বেশি পক্ষপাত দেখাচ্ছে? সেটা তো হওয়ারই কথা? প্রতিটি রাষ্ট্রেরই একটা ‘প্রবল’ সংস্কৃতি থাকে। রাষ্ট্র সেটাকে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি আকারে হাজির করে। এর সঙ্গে কেন্দ্রে না থাকা সংস্কৃতিগুলোর বিপুল এবং বিচিত্র আদান-প্রদান চলে। শ্রেণি ও ক্ষমতা সম্পর্কের জায়গা থেকে দেখলে হয়তো এখানে বৈষম্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু আসলে যা আছে, তা হলো বৈচিত্র্য। সমাজ যেহেতু বহুধাবিভক্ত, ফলে এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আমাদের সামনে কখনো কখনো পরিবেশিত হয় সাংস্কৃতিক বৈষম্য হিসেবে।

চব্বিশের জুলাই আন্দোলন র‍্যাপ, কাওয়ালি, পপ গান, লালন আর আরবান ফোককে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

‘টেস্ট অব চেরি’ অভিনেতা মারা গেছেন

‘টেস্ট অব চেরি’ সিনেমায় বাদি চরিত্রে অভিনয় করে দুনিয়াজুড়ে খ্যাতি পাওয়া অভিনেতা হোমায়ুন এরশাদি মারা গেছেন। গতকাল সোমবার তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে ইরানি বার্তা সংস্থা আইআরএনএন। ৭৮ বছর বয়সী এই অভিনেতা দীর্ঘদিন ধরে ক্যানসারে ভুগছিলেন।

অভিনয়ে নাম লেখানোর আগে তিনি পেশায় স্থপতি ছিলেন। ১৯৯৭ সালে ইরানি নির্মাতা আব্বাস কিয়ারোস্তামির ‘টেস্ট অব চেরি’ দিয়ে বড় পর্দায় অভিষেক ঘটে এরশাদির। সিনেমার মূল চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।

কাকতালীয়ভাবে সিনেমাটিতে অভিনয়ের সুযোগ পান এরশাদি। যানজটের মধ্যে তেহরানের রাস্তায় গাড়িতে বসেছিলেন তিনি। তাঁকে দেখে এগিয়ে আসেন আব্বাস কিয়ারোস্তামি। বলেন, ‘আমি একটা সিনেমা বানাতে চাই, আপনি অভিনয় করবেন?’
সিনেমাটি এরশাদিকে রাতারাতি তারকাখ্যাতি এনে দেয়। সিনেমায় দেখা গেছে, বাদি চরিত্রটি আত্মহত্যা করার পরিকল্পনা করেছেন। তাঁর ইচ্ছা, তাঁকে যেন একটি চেরিগাছের নিচে সমাহিত করা হয়। তাঁকে সমাহিত করবেন—এমন মানুষকে খুঁজতে থাকেন তিনি।

আরও পড়ুনপড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য ট্রাফিক পুলিশে কাজ করতেন আব্বাস২২ জুন ২০২২

১৯৯৭ সালে কানে ‘টেস্ট অব চেরি’ স্বর্ণপাম জিতেছিল। আব্বাস কিয়ারোস্তামি বরাবরই অপেশাদার অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে কাজ করেন। ফলে তাঁর সিনেমার বেশির ভাগ শিল্পীকে অভিনয়ে নিয়মিত দেখা যায় না। তবে এরশাদি নিয়মিত কাজ করেছেন।

২০০৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মার্ক ফরস্টারের ‘কাইট রানার’ সিনেমা এরশাদিকে আরও খ্যাতি এনে দেয়। তিন দশকের ক্যারিয়ারে ৯০টির মতো চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন তিনি।

১৯৪৭ সালের ২৬ মার্চ ইরানের ইস্পাহানে জন্ম এরশাদির। তিনি ইতালির ভেনিসে স্থাপত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। ইরানে ফিরে পেশাদার স্থপতি হিসেবে কাজ করতে থাকেন। ১৯৭৯ সালে পরিবার নিয়ে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে পাড়ি জমান। সেখানে একটি স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানে প্রায় এক দশকের বেশি সময় কাজ করেছেন। পরে ইরানে ফেরেন তিনি।

তথ্যসূত্র: তেহরান টাইমস

সম্পর্কিত নিবন্ধ