মব ভায়োলেন্সের মধ্যে ‘ডাকাত পড়েছে’ শোর তুলে ডেমরায় হত্যা করা হয়েছিল যুবদল নেতাকে
Published: 12th, November 2025 GMT
মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়—এলাকায় ডাকাত পড়েছে। এরপর পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয় এক ব্যক্তিকে। পরে তদন্ত করে পুলিশ জানিয়েছে, আসলে ডাকাত পড়েনি; বরং সেদিন পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন ওই ব্যক্তি, যিনি যুবদলের নেতা ছিলেন।
রাজধানীর ডেমরায় গত বছরের ৯ আগস্ট এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। নিহত সাঈদ আহমেদ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ৬৭ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের আহ্বায়ক ছিলেন।
হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শেষে গত ৩০ আগস্ট ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২০ জনকে আসামি করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পুলিশ। এখন মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি হবে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সারা দেশে তিন দিন পুলিশের কার্যক্রম ছিল না। এ সময় বিভিন্ন জায়গায় ‘মব ভায়োলেন্স’ ঘটে। এরই মধ্যে ৯ আগস্ট বিকেলে সরকারের পতন উপলক্ষে বিজয় মিছিল করেন স্থানীয় যুবদলের নেতা–কর্মীরা। সেই কর্মসূচি শেষে সন্ধ্যায় সাঈদ ডেমরার ওরিয়েন্টাল স্কুলের মোড় এলাকা থেকে বাসায় ফেরার পথে আক্রান্ত হন।
সাঈদের মামা আপেল মাহমুদ প্রথম আলোকে জানান, ২০-২৫ জনের একটি দল সাঈদের ওপর হামলা চালিয়েছিল।
সাঈদের স্ত্রী সাদিয়া ইসলাম বিথীর করা মামলার অভিযোগপত্রে তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক আবদুল মোমিন বলেছেন, পুরোনো শত্রুতার জেরে সাঈদকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়।
রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণেই খুন হন সাঈদ আহমেদ।উপপরিদর্শক আবদুল মোমিন, ডিবিঅভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, সন্ধ্যা ৬টার দিকে ওরিয়েন্টাল স্কুলের কাছে পৌঁছামাত্রই সাঈদকে মারতে মারতে আল ফালাহ স্কুলের গলির ভেতর নেওয়া হয়। সেখানে আসামিরা তাঁকে আবার মারধর করেন। ওই সময় স্থানীয় মসজিদে মাগরিবের নামাজ চলছিল। আসামি শুক্কুর আলী নামাজে ছিলেন। নামাজ শেষ হওয়ামাত্রই আরেক আসামি বিল্লাল হোসেন মসজিদের ইমামের কাছ থেকে মাইক নিয়ে এলাকাবাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘এলাকায় ডাকাত ঢুকেছে। আপনারা সবাই এসে দেখে যান।’ বিল্লাল ও শুক্কুর মসজিদ থেকে ঘটনাস্থলে গিয়ে সাঈদকে মারধর করেন। আসামি জাকির ঘটনার সময় সাঈদের কাছে থাকা আইফোন-১৪ প্রোম্যাক্সসহ ১৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেন।
আরও পড়ুনডেমরায় যুবদলের নেতাকে কুপিয়ে হত্যা১০ আগস্ট ২০২৪খবর পেয়ে সাঈদের স্ত্রী ও মা ঘটনাস্থলে আসেন। তাঁকে বাঁচানোর জন্য তাঁরা অনেক কাকুতি-মিনতি করলেও আসামিদের আটকাতে পারেননি। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে সাঈদের মাথার বিভিন্ন অংশসহ ডান চোখে গুরুতর জখম হয়। একপর্যায়ে তাঁর হাত-পায়ের রগও কেটে দেওয়া হয় বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টা পর রাত ১০টায় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় লাশ উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান স্থানীয় লোকজন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল সাঈদ আহমেদকে, তাঁর হাত-পায়ের রগও কেটে দেওয়া হয়। সাঈদের স্ত্রী ও মায়ের কাকুতি-মিনতিতেও হামলাকারীরা থামেনি।ঘটনার পরদিন ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয়ের ২০-২৫ জনকে আসামির তালিকায় রেখে ডেমরা থানায় হত্যা মামলা করেন সাঈদের স্ত্রী সাদিয়া ইসলাম। চতুর্থ তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে গত বছরের ৪ ডিসেম্বর মামলার দায়িত্ব নেন ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক আবদুল মোমিন।
আদালত থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মামলায় ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে শুক্কুর আলী হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছেন। অন্যরা বর্তমানে কারাগারে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল মোমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সাঈদের এলাকার। তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয় মুখ্য নয়। তাঁরা অপরাধী, এটাই বড় পরিচয়। রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণেই খুন হন সাঈদ।’
এদিকে আসামিদের কয়েকজনের আইনজীবী মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমার মক্কেলরা এ মামলার সঙ্গে জড়িত নন। ঘটনার বিষয়ে ওনারা কিছুই জানতেন না। শত্রুতা থেকে এই মামলায় তাঁদের ফাঁসানো হয়েছে।’
বাদীর এজাহারে চারজন আসামির ভূমিকা উল্লেখ করলেও অন্যদের বিষয়ে কিছু বলেননি জানিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেন, ‘এজাহারে নাম থাকায় পুলিশও অভিযোগপত্রে তাঁদের নাম দিয়েছে। একজন ছাড়া বাকিদের বিরুদ্ধে আগে কোনো সাধারণ ডায়েরিও ছিল না। অভিযোগপত্র আসায় এখন তাঁদের জামিনও বাতিল হয়েছে। আমরা আদালতের কাছে বিষয়গুলো উপস্থাপন করব।’
মামলার অভিযোগপত্রসহ এসব বিষয়ে বাদী সাদিয়ার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিল প্রথম আলো। তবে তিনি এখন কিছু বলতে চাননি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ঈদ র স ত র আবদ ল ম ম ন হত য ক ণ ড তদন ত কর য বদল র ন স ঈদ ন ত কর মসজ দ আগস ট
এছাড়াও পড়ুন:
ডিসি নিয়োগে কঠোর অবস্থানে থাকতে পারেনি সরকার
বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কোনো কর্মকর্তাকে আসন্ন নির্বাচনে রাখা হবে না, ঘোষণা দিয়েও শেষ পর্যন্ত সেই অবস্থানে থাকতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। দুজন কর্মকর্তাকে জেলা প্রশাসক (ডিসি) করা হয়েছে, যাঁরা আগের নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার (এআরও) দায়িত্বে ছিলেন।
এ ছাড়া একজন কর্মকর্তাকে প্রমার্জনা করে ডিসি পদে পদায়ন করা হয়েছে, যিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) বা স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক পদে পুরোপুরি দুই বছর দায়িত্ব পালন করেননি। অথচ ২০২২ সালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রণীত পদায়ন নীতিমালায় বলা আছে, ডিসি হতে হলে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের উল্লিখিত পদে দুই বছর চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
দুজন কর্মকর্তাকে ডিসি করা হয়েছে, যাঁরা আগের নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন। একজনকে নিয়োগের ক্ষেত্রে পদায়ন নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি।নির্বাচনের সময় মূলত ডিসিরাই রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ আমলে বিতর্কিত তিনটি নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের বাদ দিতে গিয়ে যোগ্য ডিসি খুঁজে পেতে বিপাকে পড়ে সরকার।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগের তিনটি নির্বাচনের কাউকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে না রাখার সিদ্ধান্তটি দূরদর্শী ছিল না। কারণ, বিগত তিনটি নির্বাচনে বেশির ভাগ কর্মকর্তাই এবারও ছিলেন। এ শর্ত প্রতিপালন করা কঠিন।
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গত শনি ও রোববার দুই দিনে দেশের ২৯ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদায়ন করে সরকার। এর মধ্যে রোববার ১৪ জেলায় এবং আগের দিন ১৫ জেলায় নতুন ডিসি পদায়ন করা হয়। এই ২৯ জেলার মধ্যে একেবারে নতুন ডিসি করা হয় ২১ কর্মকর্তাকে। বাকি আটজন ডিসিই ছিলেন, তাঁদের জেলা পরিবর্তন করা হয়েছে।
পদায়নে এ শর্ত বাতিলের পক্ষে মত জানাচ্ছেন জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, কেউ ডিসি হবেন, আবার কেউ বঞ্চিত হবেন কেন?জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দুটি প্রজ্ঞাপন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিসিএস ২৭তম ও ২৮তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের দুজন কর্মকর্তাকে ডিসি করা হয়েছে, যাঁদের একজন ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে, অন্যজন ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন।
এ দুজনকে ডিসি করায় প্রশাসনের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সরকার নিজেদের সিদ্ধান্তে থাকতে পারেনি। তাহলে কেউ ডিসি হবেন, আবার কেউ বঞ্চিত হবেন কেন? ডিসি পদে পদায়নে এ শর্ত বাতিল করা উচিত বলে মত দেন তাঁরা।
এ ছাড়া বিসিএস ২৮তম ব্যাচের একজন কর্মকর্তাকে ডিসি করা হয়েছে, যাঁর ইউএনও, এডিসি পদে পুরোপুরি দুই বছরের অভিজ্ঞতা নেই। এ ক্ষেত্রে ওই কর্মকর্তাকে প্রমার্জনা করা হয়েছে।
গত তিন নির্বাচনে প্রশাসন ও পুলিশের তৎকালীন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করার জোরালো অভিযোগ ছিল। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ওই তিন নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারীদের এবারের নির্বাচন থেকে দূরে রাখার দাবি জানিয়ে আসছে।
আরও পড়ুনআগের ভোটের সবাই বাদ, ‘যোগ্য’ নতুন ডিসি খুঁজে পাচ্ছে না সরকার০১ নভেম্বর ২০২৫প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মাঠ প্রশাসনে বিশেষ করে ডিসি, এডিসি (অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক), ইউএনওসহ (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) বিচারিক দায়িত্বে এমন কাউকে পদায়ন করা হবে না, যিনি গত তিনটি নির্বাচনের কাজে যুক্ত ছিলেন। ন্যূনতম ভূমিকা থাকলেও তাঁকে এই নির্বাচনে দায়িত্বে রাখা হবে না।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং নির্বাচন কমিশন একই কথা বলেছিল। এদিকে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ইকোনমিক ক্যাডারের তিনজন কর্মকর্তাকে ডিসি পদায়ন নিয়েও প্রশাসনে আলোচনা চলছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইকোনমিক ক্যাডার ২০১৮ সালে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত হয়। ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মাঠ প্রশাসনে (সহকারী কমিশনার, সহকারী কমিশনার (ভূমি) এসব পদে কাজের অভিজ্ঞতা ছিল না। তাঁরা সরাসরি ইউএনও, এডিসি বা স্থানীয় সরকারের উপপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। মাঠ প্রশাসনে কাজের অভিজ্ঞতা না থেকেও ডিসি হওয়া নিয়ে চাপা ক্ষোভ রয়েছে জনপ্রশাসনে।
নির্বাচনের আগে আরও অন্তত পাঁচ থেকে আট জেলায় ডিসি পদে পদায়ন হবে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। সেসব ক্ষেত্রে শর্ত শিথিলের দাবি জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।