মিস ইউনিভার্সের মঞ্চে মিথিলাকে এগিয়ে রাখার সুযোগ এখন আপনার হাতে
Published: 12th, November 2025 GMT
‘তানজিয়া জামান মিথিলা, বাংলাদেশ!’
হ্যাঁ, থাইল্যান্ডে চলমান ৭৪তম মিস ইউনিভার্সের আসরে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন মিথিলা। আর প্রথমবারের মতো কোনো বাংলাদেশির মিস ইউনিভার্স জেতার সম্ভাবনা নিয়েও চলছে আলোচনা। এরই মধ্যে পিপলস চয়েসের ভোটিং পর্বে সেরা তিনে উঠে এসেছিলেন মিথিলা। তবে প্রতিদিন পাল্টে যাচ্ছে ভোটের হিসাব। এই মূহুর্তে (১২ নভেম্বর দুপুর ২টা পর্যন্ত) মিস ইউনিভার্সের অ্যাপে ঢুকে দেখা গেলো তিনি এখন আছেন সেরা চারে। তাই মিথিলাকে এগিয়ে রাখতে আপনিও দিতে পারেন ভোট।
অন্য প্রতিযোগীদের মতো মিথিলাও ঘুরে বেড়াচ্ছেন থাইল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গায়.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম স ইউন ভ র স
এছাড়াও পড়ুন:
আলু, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও কৃষকের দীর্ঘশ্বাস
১০ টাকা কেজির আলু যখন শহরে এসে ভোক্তাদের প্লেটে ২০০ টাকার ফ্রেঞ্চ ফ্রাই হয়, তখন বোঝা যায় এক দেশে দুই অর্থনীতি। তাই একদিকে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করছেন কৃষক, অন্যদিকে ক্ষুদ্রঋণের বাজার আরও বিস্তৃত হচ্ছে। দাম না পেয়ে নিরুপায় কৃষক রাস্তায় আলু–পেঁয়াজ ফেলে প্রতিবাদ করলেও তাঁদের কথা কেউ শুনছে না। অন্যদিকে খাদ্য সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা বলছেন শক্তিশালী বিতরণব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু কেন?
ভোক্তা যে দামে কেনে, তার মধ্যে কৃষকের ভাগ দিন দিন কমছে। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য ব্যবহার করে একটি গবেষণায় (মাবরুর মাহমুদ, ২০২৪ দ্য বিলিয়নিয়ার ফার্মার) দেখা গেছে, ১৯৮৩ সালে একজন কৃষক ধান উৎপাদন করে যেখানে ভোক্তামূল্যের প্রায় ৭২ শতাংশ পেতেন, সেখানে ২০১৮ সালে একজন কৃষক ৫০ শতাংশ পান। অর্থাৎ ৪০ বছরে বাজারমূল্য নির্ধারণে কৃষকের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমেছে।
আজকের পৃথিবীতে ফসলের মূল্য বাজারের হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে আছে সরকার। যেন উৎপাদন বাড়লেই হবে, দেশের ২৩ শতাংশ কৃষকের সন্তানেরা যদি প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পার হতে না পারে, তাতে কোনো সমস্যা নেই। কৃষক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করলে সমস্যা নেই। সারা দেশে ক্যানসারে আক্রান্তদের ৬৪ শতাংশ কৃষক হলে ও বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেও সমস্যা নেই।
বাংলাদেশে সার ব্যবহার সবচেয়ে বেশি
কৃষি সংস্কার নিয়ে টাস্কফোর্সের রিপোর্টের প্রথম পাতায় দেখা যায় বাংলাদেশ, ভারত, ভিয়েতনাম, নেপাল, পাকিস্তানের মধ্যে বাংলাদেশে সার ব্যবহার সর্বোচ্চ। সেই সঙ্গে ২০১০-এর দশকজুড়ে কৃষির প্রবৃদ্ধিও বাংলাদেশেই সর্বোচ্চ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই প্রবৃদ্ধির কথা বলে গর্ব করা যায়, কিন্তু সঙ্গে সার ও কীটনাশকের কারণে কৃষকের ক্যানসারের কথাটা বলা যায় না। উন্নয়নের এ এক অপূর্ব প্রদর্শনী।
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে খেতমজুরের পরিবর্তে যন্ত্র ব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর, হিমাগারের চার্জ কমানোর বদলে বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করার, সারের কৃত্রিম সংকট রোধ না করে ভর্তুকি কমানোর এবং কৃষকের ঋণ কমানোর বদলে ফিনটেক (ফাইন্যান্স প্রযুক্তি) ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কৃষিমূল্য কমিশন গঠন করে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ বা মূল্য নিয়ন্ত্রণের কোনো প্রস্তাব নেই। সব সুপারিশেই কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বেসরকারি খাতের ব্যবসা বিস্তার, যেখানে সরকারের ভূমিকা সীমিত কেবল তাদের সুবিধা নিশ্চিত করা পর্যন্ত।
খাদ্য সম্মেলনে গিয়ে এই বলে বড়াই করে আসা যায়—কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সরকার ৭০ শতাংশ ভর্তুকি দিচ্ছে, কিন্তু বলা যাচ্ছে না এই ভর্তুকির অর্থ প্রকৃত কৃষকের কাছে যাচ্ছে না। যাচ্ছে একদল প্রভাবশালীর কাছে।
ভর্তুকি কাদের জন্য
বারবার প্রসঙ্গ আসে, কৃষিতে উৎপাদন খরচ বেশির কারণ নাকি খেতমজুরের মজুরি বেশি। তো, খেতমজুরের কি বাড়িতে বউ-বাচ্চা নেই? নাকি আশা করা হয়, সে হবে এক পরিবারহীন মুসাফির শ্রমিক? অথচ সার, যন্ত্র, বীজ, সেচ ও হিমাগারের খরচ কীভাবে কমানো যায়, তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে নিশ্চয়ই যন্ত্র দরকার, কিন্তু ভর্তুকি যদি প্রভাবশালীদের মুনাফা নিশ্চিত করার উপায় হয়, তবে কৃষকের কাছে এই ভর্তুকি কেবল দীর্ঘশ্বাসের গল্প।
বিতরণ ব্যবস্থা দুর্বল
আন্তর্জাতিক সম্মেলনে শক্তিশালী বিতরণব্যবস্থা নিয়ে বড়াই করা যায়, উত্তরবঙ্গে খেতেই আড়াই হাজার কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়, তা বলা যায় না। আগে রাষ্ট্রায়ত্ত হিমাগার ছিল। সরকার সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করত। লোকসানের অজুহাত দিয়ে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন যখন প্রভাবশালীরা হিমাগারের মালিক হয়েছেন, তাঁরা হিমাগারে বিনিয়োগের কারণ দেখিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন, কিন্তু বিনিয়োগ করছেন অন্যত্র। হিমাগারের মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাঁরা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রেখেছেন লোকসান দেখিয়ে। এই যে রাষ্ট্রায়ত্ত হিমাগার বন্ধ করে বেসরকারি খাতে হিমাগারের জন্য ঋণ দিল, এখন কেন তারা লোকসানের অজুহাত দেখাচ্ছে? কেন আলুর ভরা মৌসুমে হিমাগারের ভাড়া বাড়িয়ে আলু কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য করছে?
কৃষিভিত্তিক শিল্প কৃষকের পণ্যের বাজার নিশ্চিত করে, কিন্তু ২০২০ সালে উত্তরবঙ্গের ১৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলের মধ্যে ৬টি বন্ধ করে দেওয়া হয়। অন্তর্বর্তী সরকার আবার চালুর ঘোষণা দিলেও এক বছরে মাত্র দুটি চিনিকলের জন্য ১৭ কোটি টাকা বরাদ্দও মেলেনি। লোকসানি অজুহাতে স্থানীয় চিনিকল বন্ধ রেখে সরকার বিদেশ থেকে র-সুগার আমদানি করে বেসরকারি রিফাইনারিকে দিচ্ছে, ফলে চিনির দাম দ্বিগুণ হয়েছে। অথচ এসব রিফাইনারি সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনলে কৃষক, ভোক্তা ও রাষ্ট্র—তিন পক্ষই লাভবান হতো।
অন্তর্বর্তী সরকার এস আলমের রিফাইনারিকে নিলামে তুলেছে। অথচ সরকার যদি এই রিফাইনারি কিনে নিজে পরিচালনা করত, তাহলে চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের লাভ হতো। অন্যদিকে ভোক্তারাও কম দামে চিনি কিনতে পারত। তা ছাড়া চিনিকলের বর্জ্য দিয়ে জৈব সার উৎপাদন করা যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। চিনিকলের উপজাত মোলাসেস গবাদিপশুর চমৎকার খাদ্য। এসব বিবেচনা না করে উল্টো যখন ইকোনমিক জোনগুলোর কৃষিজমি পড়ে আছে, বিনিয়োগ আসছে না, তখন চিনিকলের জমি বিদেশি বিনিয়োগ আনার অজুহাতে ফেলে রাখা হয়েছে।
কঠিন ঋণ
ঋণের চাপে কৃষকেরা আত্মহত্যা করছেন অথচ তাঁদের জন্য কোনো গ্রেস পিরিয়ড নেই। ফলে তাঁরা এক ঋণ শোধে আরেক ঋণ নিতে বাধ্য হন। যেখানে ঋণের শর্ত শিথিল করার কথা, সেখানে এই ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের নামে ব্র্যাক, আশা, টিএমএসএস, ব্যুরো বাংলাদেশ, উদ্দীপনসহ বড় আকারের ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠান বা এনজিওগুলোতে দুজন করে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার বিধান করতে যাচ্ছে।
স্বতন্ত্র পরিচালক হতে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় ১০ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। সমস্যার সমাধান না করে এর মাধ্যমে সরকার মূলত আমলাদের সুবিধা দেওয়ার পথ খুলবে। এতে কৃষকের বৈষম্য বাড়বে, সংকটও গভীর হবে। অন্তর্বর্তী সরকারও সেই পুরোনো পথেই চলছে। নিজ গোত্রকে সুবিধা দেওয়াই যেহেতু এখানে মুখ্য, তাই মনোযোগ এসব দিকেই।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭২ সালের ৩০ এপ্রিল শিবপুরে ঐতিহাসিক কৃষক সম্মেলনে লাখো কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের উপস্থিতিতে শেখ মুজিবকে বলেছিলেন, ‘যদি জাতির জনক হতে চাও, তাহলে তোমার দালানের বাড়িঘর ছেড়ে চলে আসো তোমার ছেলেদের সঙ্গে, যা জোটে খাও, যেভাবে ছেলেমেয়েরা থাকে, সেভাবে থাকো। তা ছাড়া জাতির জনক হওয়া চলবে না।’ (পৃষ্ঠা ৩১৫, মওলানা ভাসানীর কৃষক সমিতি)
শুনলে মনে হবে, ভাসানী আক্ষরিক অর্থে শেখ মুজিবকে তাঁর দালান ছেড়ে চলে আসতে বলছেন। আসলে এর অন্তর্নিহিত অর্থ হলো, তিনি আহ্বান করছেন শহরের বুর্জোয়া রাজনীতি ছেড়ে কৃষকের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজনীতি করতে। মেহনতি মানুষের পক্ষে দাঁড়াতে।
আবু সাইদ কৃষকের সন্তান
২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে প্রথম যে ছয়জন শহীদ হয়েছিলেন, তাঁর মধ্যে যে অকুতোভয় ছেলেটি পুলিশকে আহ্বান জানিয়েছিলেন তাঁর বুকে গুলি করতে, সেই আবু সাঈদ কৃষক পরিবারের। কোটা আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হওয়ার সন্ধিক্ষণে এই আন্দোলনের নামকরণ হয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। আবারও বৈষম্য থেকে মুক্তির যে সর্বজনীন আকাঙ্ক্ষা, তারই প্রতিফলন দেখা যায় এই নামকরণের মধ্য দিয়ে।
মেহনতি জনগণ বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই বৈষম্য নিরসনের আকাঙ্ক্ষা লালন করে আসছে। ৫৩ বছরে সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি বলে ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর মানুষ আবার সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্ন দেখেছিল কৃষি খাত সংস্কারেরও। কিন্তু দেখা গেল, যাঁরা দায়িত্ব নেন, তাঁরা কৃষকের জগৎ থেকে বহুদূরে বাস করেন। যন্ত্র, সার, বীজ, ঋণ নিয়ে ব্যবসার দিকেই তাঁদের মনোযোগ বেশি। উদ্যোক্তা-প্রেমিক, প্রাইভেট সেক্টর-প্রেমিক, এনজিও-প্রেমিক তারকা নীতিনির্ধারক ও উপদেষ্টাদের কাছে জনগণের অর্থ শুধু নিজ গোত্রের মুনাফা বানানোর মাধ্যম। এর বিনিময়ে জনগণ শোনেন কিছু মিষ্টি মিষ্টি প্রতিশ্রুতি। কৃষকের জন্য সেখানে সত্যিই কিছু থাকে না।