বাংলাদেশ ব্যাংক পূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমাতে একটি ব্যাপক আইনি সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে। অর্থ উপদেষ্টার কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ ১৯৭২-এর ৯টি সংশোধনী খসড়া উপস্থাপন করেছেন, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রশাসন ও শাসনব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাদেশ ২০২৫ অনুযায়ী, ব্যাংকের প্রশাসন ও শাসনকাঠামোয় বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হবে, যার মধ্যে ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা পর্ষদ এবং অন্যান্য কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত।

এই প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে গভর্নর ও উপগভর্নরদের নিয়োগের জন্য একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা, যাতে রাজনৈতিক পছন্দ নয়, পেশাগত দক্ষতার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করা যায়। দ্বিতীয়ত, নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তদন্তের জন্য একটি তদন্ত আদালত গঠন করা হবে, যা বিচার শেষে আনুষ্ঠানিক পরামর্শ দিতে পারবেন। এর ফলে নিয়োগ ও অপসারণপ্রক্রিয়া আরও অরাজনৈতিক হবে।

আরও পড়ুন ব্যাংক খাতে ‘লাইসেন্স টু লুট’, বাংলাদেশ সংস্করণ২৩ জানুয়ারি ২০২৩

পরিচালনা পর্ষদের কাঠামোও আরও স্বাধীন হবে—সরকারি সদস্যের সংখ্যা কমিয়ে স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের সংখ্যা বাড়ানো হবে। গভর্নরের পদমর্যাদা মন্ত্রিসভার সদস্যের সমপর্যায়ে উন্নীত করা হবে, যাতে ভারত বা সিঙ্গাপুরের মতো দেশের মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য আসে এবং প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা জোরদার হয়। খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংককে হুইসেলব্লোয়ারদের সুরক্ষা, ক্রেডিট রেটিং নিয়ন্ত্রণ, জামানতের মূল্যায়ন ও একচেটিয়া ব্যবসার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আইনগত ক্ষমতা প্রদান করা হবে, যাতে আর্থিক খাতে জবাবদিহি ও শৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায়।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির অধীন প্রদত্ত সুপারিশের ভিত্তিতে এই সংস্কারগুলোকে দীর্ঘদিনের বিলম্বিত পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের দীর্ঘস্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা—কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার অভাব দূর করার একটি বহুপ্রতীক্ষিত প্রচেষ্টা। বহু দশক ধরে ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাজনৈতিক বিবেচনার সঙ্গে জড়িত থেকেছে—মৌলিক অর্থনৈতিক নীতি, ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রণ বা আর্থিক শাসনের ক্ষেত্রেই হোক না কেন। আহসান এইচ মনসুরের এ উদ্যোগের লক্ষ্য হলো সেই স্বায়ত্তশাসনের নীতিকে আইনি কাঠামোয় রূপ দেওয়া। অন্যভাবে বললে, এটি এমন একটি প্রাতিষ্ঠানিক রক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা, যা রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবর্তনের পরও টিকে থাকবে।

স্বায়ত্তশাসন কেবল আইনের প্রশ্ন নয়, এটি রাজনীতিরও প্রশ্ন—রাজনৈতিক নেতৃত্ব কতটা স্বাধীনতা দিতে প্রস্তুত এবং কী উদ্দেশ্যে তা ব্যবহৃত হবে, সেটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

তবে এই পদক্ষেপ যতটা উচ্চাভিলাষী, ততটাই ভঙ্গুর হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সময়টি—একটি অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এবং আইএমএফের শর্তাধীন অবস্থায়—একই সঙ্গে সুযোগ ও ঝুঁকি উভয়ই তৈরি করেছে। একদিকে এটি একটি তুলনামূলক নিরপেক্ষ সময়, যেখানে দলীয় বাধা ছাড়াই কারিগরি সংস্কার প্রস্তাব পাস হতে পারে। অন্যদিকে এটি বৈধতা ও স্থায়িত্বের প্রশ্নও তোলে। যদি ব্যাপক রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া অধ্যাদেশটি কার্যকর হয়, ভবিষ্যৎ সরকার সহজেই তা বাতিল করতে পারে। বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসে সংস্কার প্রত্যাহারের উদাহরণ ভরপুর—সে শিক্ষা ভুলে যাওয়া উচিত নয়।

আরও পড়ুনকেন্দ্রীয় ব্যাংক সংস্কারের আলাপ কোথায়?২৫ জুন ২০২৫

প্রস্তাবের নকশা আন্তর্জাতিক মডেল থেকে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত, বিশেষ করে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ও ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের কাঠামো থেকে। এটি আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছানোর একটি প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা।

তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি ভিন্ন। বাংলাদেশ ব্যাংক এমন এক পটভূমিতে কাজ করে, যেখানে অনানুষ্ঠানিক প্রভাব, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশাসনিক দ্বৈত খবরদারি গভীরভাবে প্রোথিত। শুধু আইনি সুরক্ষায় এই শক্তিগুলোকে নিরপেক্ষ করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ স্বায়ত্তশাসন কেবল আইনের প্রশ্ন নয়, এটি রাজনীতিরও প্রশ্ন—রাজনৈতিক নেতৃত্ব কতটা স্বাধীনতা দিতে প্রস্তুত এবং কী উদ্দেশ্যে তা ব্যবহৃত হবে, সেটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

এরপরও গভর্নরের পদমর্যাদা মন্ত্রিসভার সদস্যের পর্যায়ে উন্নীত করা প্রতীকীভাবে শক্তিশালী হলেও এটি আর্থিক ও রাজস্বনীতির সীমারেখা অস্পষ্ট করতে পারে, যদি তা সতর্কভাবে পরিচালিত না হয়। একইভাবে হুইসেলব্লোয়ার সুরক্ষা ও একচেটিয়া ব্যবসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আওতায় আনা হলে তা সক্ষমতা ও আন্তসংস্থার সমন্বয় ছাড়া কার্যকর হবে না।

আরও পড়ুনব্যাংক সংস্কার: রাজনৈতিক অর্থনীতির সম্মিলিত সিদ্ধান্ত কেন প্রয়োজন০৩ জানুয়ারি ২০২৫

সব মিলিয়ে প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো প্রশংসনীয় এবং জরুরি এক সূচনা, তবে এটি কোনো জাদুর কাঠি নয়। স্বাধীনতা কেবল আইনের মাধ্যমে দেওয়া যায় না; এটি গড়ে তুলতে হয় বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্ব, স্বচ্ছতা ও নিয়মের ধারাবাহিক প্রয়োগের মাধ্যমে। যদি এই সংশোধনীগুলো গ্রহণ করা হয়, তবে তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের আর্থিক শাসনের আইনি ভিত্তি মজবুত করবে। কিন্তু রাজনৈতিক বিচক্ষণতা, পেশাগত সততা ও ধারাবাহিক বাস্তবায়ন ছাড়া এগুলোও দেশের দীর্ঘ সংস্কার-প্রতিশ্রুতির ইতিহাসে আরেকটি অসম্পূর্ণ অধ্যায় হিসেবেই থেকে যেতে পারে।

সেলিম রায়হান অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, সানেম

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ব ধ নত র জন ত ক প রস ত ব ব যবস থ পর চ ল আর থ ক

এছাড়াও পড়ুন:

বাজেটের মধ্যে সেরা টিভি: কোন দামে পাবেন সেরা ফিচার

সারা দিনের কর্মব্যস্ততা, মিটিং, যানজট আর ক্লান্তিকর সময়ের পর যখন মানুষ ঘরে ফেরেন, তখন একটু শান্তি ও বিনোদনই হয়ে ওঠে দিনের শেষ আশ্রয়। কেউ দিন শেষে সব কাজ সেরে বসে যান পছন্দের সিরিজের নতুন পর্ব দেখতে, আবার কেউ পরিবারের সঙ্গে একসঙ্গে খবর বা সিনেমা উপভোগ করেন। এই মুহূর্তগুলোই যেন সারা দিনের ক্লান্তিকে পরিণত করে নির্মল আনন্দে।

তবে সিরিজ, সিনেমা কিংবা খবরই হোক—টিভি ছাড়া কিন্তু একেবারেই জমে না। মোবাইল বা ল্যাপটপের ছোট পর্দায় যতই কিছু দেখা যাক না কেন, বড় স্ক্রিনে পারফেক্ট কালার, কনট্রাস্ট আর স্পষ্ট সাউন্ডে দেখার সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা নেই। কিন্তু বাজারে এত রকম ব্র্যান্ড, প্রযুক্তি আর দাম—বাজেটের মধ্যে কোন টিভিটা আসলে সেরা? টিভি কেনার আগে এই বিষয়গুলো জানা জরুরি।

দামের ভেতর বিকল্প

দেশের বাজারে এখন সীমিত বাজেট থেকে শুরু করে কয়েক লাখ টাকা দামেও টিভি পাওয়া যায়। বর্তমান সময়ে বাজেট-ফ্রেন্ডলি স্মার্ট টিভিগুলোর মধ্যে ফুল এইচডি মডেলগুলোর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ছোট পরিবারের জন্য ৩২ ইঞ্চি স্মার্ট এফএইচডি টিভি সাধারণত ৩০ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। আবার একটু বড় স্ক্রিন চাইলে ৪৩ থেকে ৫৫ ইঞ্চির ফোর-কে আলট্রা এইচডি টিভিগুলোর দাম পড়বে ৫২ হাজার থেকে ৯৬ হাজার টাকা।

বেসিক নাকি হাই-এন্ড?

যদি আপনার টিভি ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্য কেবল নাটক, সিনেমা বা ইউটিউব দেখা, তাহলে এফএইচডি বা ইউএইচডি রেজল্যুশনের বেসিক টিভিই যথেষ্ট। এসব টিভিতে সাধারণ এলইডি প্যানেল ও লিমিটেড স্মার্ট ফিচার থাকে, তবে এগুলো দাম অনুযায়ী বেশ সাশ্রয়ী।

অন্যদিকে সিনেমা, গেমিং বা উচ্চমানের কনটেন্টের জন্য কিউএলইডি, ওএলইডি বা নিও কিউএলইডি টিভিগুলোই সেরা। এগুলোতে পাওয়া যায় ডিপ ব্ল্যাক কালার, হাই-রেজল্যুশন, ফাস্ট রিফ্রেশিং রেট এমনকি ডলবি ভিশন ও ডলবি অ্যাটমস সাউন্ড সিস্টেমসহ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুবিধা। দাম কিছুটা বেশি হলেও এসব টিভিতে কোনো কিছু দেখে পাওয়া যায় থিয়েটারে সিনেমা দেখার মতো এক্সপেরিয়েন্স।

নিরাপত্তা ও স্মার্ট ফিচার

বর্তমান সময়ে স্মার্ট টিভি শুধু ইউটিউব বা নেটফ্লিক্স দেখার মাধ্যম নয়—এটি হয়ে উঠেছে স্মার্ট হোম সিস্টেমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফলে ব্যক্তিগত তথ্য, লগইন ডেটা বা ভয়েস কমান্ডের নিরাপত্তা এখন বড় একটি বিবেচ্য বিষয়। এদিক থেকে নক্স সিকিউরিটি সিস্টেম টিভিতে যুক্ত করে বাড়িয়েছে ব্যবহারকারীর সুরক্ষা, যেখানে প্রতিটি অ্যাপ ও ফিচার আলাদা স্তরে এনক্রিপ্টেড থাকে। স্যামসাংয়ের মতো শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো এখন সফটওয়্যার আপডেট, ডেটা প্রাইভেসি ও ভয়েস রিকগনিশনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা জোরদার করছে। তাই টিভি কেনার সময় শুধু স্ক্রিন সাইজ বা রেজল্যুশন নয়, সফটওয়্যার আপডেট, অ্যাপ সাপোর্ট, ভয়েস কন্ট্রোল ও সিকিউরিটি সিস্টেমের দিকেও খেয়াল রাখা দরকার।

দিন শেষে সব কাজ সেরে অনেকে বসে যান টিভির সামনে। পছন্দের সিরিজের নতুন পর্ব দেখতে, আবার কেউ পরিবারের সঙ্গে একসঙ্গে খবর বা সিনেমা উপভোগ করেন

সম্পর্কিত নিবন্ধ