ইসলামের আলোকে নবীজির জীবন এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত। তিনি তো মানুষের মাঝে সর্বোত্তম আদর্শ। কিন্তু একটা প্রশ্ন অনেকের মনেই ঘুরপাক খায়, যদি নবীগণ গুনাহ থেকে পবিত্র থাকেন, তাহলে কেন আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা চাইতে বলেছেন? আর কেন তিনি দিনরাত এত বেশি ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করতেন?

আজ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজব আমরা।

আল্লাহ তায়ালা সুরা মুহাম্মাদে বলেছেন, ‘অতএব জেনে রাখো, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং তোমার গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো, আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের জন্যও।’ (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ১৯)

এই আয়াতে নবীজিকে নিজের গুনাহের জন্য ইস্তিগফার করতে বলা হয়েছে। কিন্তু নবী তো গুনাহমুক্ত, তাহলে এর অর্থ কী?

ইমাম কুরতুবি তাঁর তাফসিরে বলেছেন, এটা কয়েকভাবে বোঝা যায়। প্রথমত, এটা প্রতিরোধমূলক, অর্থাৎ, যেন আল্লাহ তাঁকে ভবিষ্যতে গুনাহ থেকে আরও সুরক্ষিত রাখেন। দ্বিতীয়ত, এটা উম্মতকে শেখানোর জন্য, যাতে আমরা বুঝি ইস্তিগফার কত জরুরি। তৃতীয়ত, নবীজি নিজে এটা করে আমাদের জন্য আদর্শ হয়ে উঠেছেন। (আল-জামি লি আহকামিল কোরআন, ১৬/২৭৮, দারুল কুতুবিল মিসরিয়া, কায়রো, ১৯৬৪)

আরও পড়ুনক্ষমা প্রার্থনা করার শ্রেষ্ঠ ৩ সময়২৪ এপ্রিল ২০২৫নবীজির মর্যাদা এত উঁচু যে, যা আমাদের কাছে সাধারণত ভালো, তাঁর কাছে তা-ও কমতি। আল্লাহর কাছের বান্দাদের হিসাব আলাদা হয়। তাদের ছোটখাটো ভুলও, যা অন্যদের জন্য স্বাভাবিক, তাঁদের জন্য গুনাহের মতো মনে হয়।

এই আদেশ শুধু নবীজির জন্য নয়, আমাদের জন্যও পাঠ। কারণ নবীজি যখন ইস্তিগফার করেন, তখন তিনি আমাদের দেখান যে উচ্চ মর্যাদা পেলেও বিনয়ী থাকতে হয়। এটা যেন একটা আয়না, যাতে আমরা নিজেদের দেখি।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ আয়াত আছে সুরা ফাতহে, ‘যাতে আল্লাহ তোমার অতীত ও ভবিষ্যতের গুনাহ ক্ষমা করে দেন।’ (সুরা আল-ফাতহ, আয়াত: ২)

এখানে ‘গুনাহ’ শব্দটা নবীজির প্রসঙ্গে এসেছে, অথচ তিনি তো পাপ করেননি। বিদ্বানরা বলেন, এটা ‘হাসানাতুল আবরার সাইয়্যাতুল মুকাররাবিন’, অর্থাৎ সাধারণ মানুষের জন্য যা ভালো কাজ, নবীজির মতো আল্লাহর কাছের বান্দার জন্য তা ত্রুটি বলে গণ্য হতে পারে।

বিষয়টা এমন যে আমরা সাধারণ মানুষ। কেউ যদি অসুখে পড়ি, আর সাধারণ বন্ধু একবার দেখতে আসে, আমরা খুশি হই। বলি, ‘ভালো করেছিস।’ কিন্তু খুব কাছের বন্ধু যদি মাত্র একবার আসে, আমরা বলি, ‘এতটুকু?’ মানে আমরা আরও আশা করেছি তার থেকে।

ঠিক তেমনি, নবীজির মর্যাদা এত উঁচু যে, যা আমাদের কাছে সাধারণত ভালো, তাঁর কাছে তা-ও কমতি। আল্লাহর কাছের বান্দাদের হিসাব আলাদা হয়। তাদের ছোটখাটো ভুলও, যা অন্যদের জন্য স্বাভাবিক, তাঁদের জন্য গুনাহের মতো মনে হয়।

ইমাম আলুসি বলেছেন, নবীজির ইস্তিগফার তাঁর বিনয় আর আত্মসমালোচনার প্রতীক। তিনি সবসময় নিজেকে কম দেখতেন, যদিও আল্লাহ তাঁকে পবিত্র রেখেছেন। এমনকি তিনি বলতেন, ‘আমার অন্তরে মাঝে মাঝে পর্দা পড়ে যায়।’ অর্থাৎ তাঁর মনের উন্নতি এত দ্রুত যে, পেছনের অবস্থা তাঁর কাছে ত্রুটি মনে হয়। তাই তিনি ক্ষমা চান, যাতে আরও উঁচুতে উঠতে পারেন। (রুহুল মাআনি, ২৬/১৪৫, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৫)

আরেক দিক থেকে দেখলে, নবীজি বলেছেন, ‘আমার উম্মতের ভুল, ভুলে যাওয়া আর জোর করে করানো গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়েচে।’ কিন্তু এই ছাড় নবীজির জন্য নয়। তাই তাঁর ছোট ভুলও, যা অন্যদের জন্য গুনাহ নয়, তাঁর জন্য গুনাহ। এটা তাঁর মর্যাদার দাবি।

আরও পড়ুনজিভের জড়তা কাটাতে মুসা (আ.

) যে প্রার্থনা করেছিলেন০৮ এপ্রিল ২০২৫আয়েশা (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আপনার তো সব গুনাহ মাফ, তবু এত কষ্ট কেন করেন?’ তিনি বললেন, ‘আয়েশা, আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হব না?’

সুরা ফাতহের আয়াতে আবার বলা হয়েছে, এই ক্ষমা বিজয়ের ফল। অর্থাৎ হুদাইবিয়ার বিজয়ের কারণে আল্লাহ নবীজির অতীত-ভবিষ্যত সব ক্ষমা করে দিয়েছেন। তাফসিরে ‘ওয়াসিত’-এ বলা হয়, এখানে ‘গুনাহ’ মানে নবুয়তের আগে-পরের ছোটখাটো কমতি, যা তাঁর মর্যাদার সঙ্গে খাপ খায় না। অথবা এটা এক ধরনের প্রতিরক্ষা পদ্ধতি, যেন কোনো গুনাহই আর না হয়। কারণ ক্ষমা মানে ঢেকে দেওয়া, লুকিয়ে রাখা। (তাফসির আল-ওয়াসিত, ৪/১২৩, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৪)

এখন প্রশ্ন আসে, আল্লাহ যখন তাঁর পূর্বাপর সব ক্ষমা করে দিয়েছেন, তাহলে নবীজি এত বার ইস্তিগফার কেন করতেন? উত্তরটা অপূর্ব। তিনি বলতেন, ‘আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হব না?’ হাদিসে এসেছে, নবীজি এত নামাজ পড়তেন যে পা ফুলে যেত। আয়েশা (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আপনার তো সব গুনাহ মাফ, তবু এত কষ্ট কেন করেন?’ তিনি বললেন, ‘আয়েশা, আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হব না?’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪,৮৩৭)

এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, নবীজির ইস্তিগফার গুনাহের ভয় থেকে নয়, বরং শুকরিয়া আদায় করার দাবি থেকে। তিনি আল্লাহর নেয়ামতের শোকর আদায় করতেন। ক্ষমা পাওয়া তো সবচেয়ে বড় নেয়ামত। তাই তিনি আরও বেশি ইবাদত করতেন। ইবনে কাসির বলেন, এটা তাঁর সর্বোচ্চ আনুগত্যের প্রমাণ। (তাফসিরুল কুরআনিল আজিম, ৭/৪৫৬, দারু তাইবা, রিয়াদ, ১৯৯৯)

শেষ কথা, নবীজির ইস্তিগফার আমাদের শেখায় যে ক্ষমা চাওয়া শুধু পাপীদের জন্য নয়। এটা বিনয়ের পথ, আল্লাহর কাছে যাওয়ার সিঁড়ি। নবীজি যেমন উম্মতের জন্য দোয়া করতেন, তেমনি আমরাও যেন করি।

এটা আমাদের হৃদয় পরিষ্কার রাখবে, মর্যাদা বৃদ্ধি করবে। চলুন, আমরাও নবীজির আদর্শে চলি—প্রতিদিন ইস্তিগফার করি, শোকর আদায় করি। তাহলে জীবন সুন্দর হয়ে উঠবে।

আরও পড়ুনসাহাবিদের প্রতি মহানবী (সা.)-এর শেষ উপদেশ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য গ ন হ আল ল হ ত দ র জন য নব জ র বল ছ ন অর থ ৎ আম দ র করত ন

এছাড়াও পড়ুন:

বিচারকের ছেলের মৃত্যু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে: চিকিৎসক

রাজশাহী মহানগর দায়রা জজ আব্দুর রহমানের ছেলে তাওসিফ রহমান সুমনের (১৬) মৃত্যু হয়েছে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে। ধারালো ও চোখা অস্ত্রের আঘাতে তার শরীরের তিনটি স্থানে রক্তনালী কেটে গিয়েছিল। এর ফলে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণও হয়েছিল।

শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) সকাল পৌনে দশটায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের মর্গে লাশের ময়নাতদন্ত শুরু হয়। ময়নাতদন্ত করেন ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. কফিল উদ্দিন ও একই বিভাগের প্রভাষক শারমিন সোবহান কাবেরী। ময়নাতদন্ত করতে প্রায় ৩০ মিনিট সময় লাগে।

এসময় বাইরে অপেক্ষা করছিলেন তাওসিফের বাবা বিচারক আব্দুর রহমান। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক কফিল উদ্দিন বেরিয়ে এসে তার সঙ্গে কথা বলেন। এছাড়া পরে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলেন। 

ময়নাতদন্তকারী ওই চিকিৎসক জানান, তাওসিফের ডান উরু, ডান পা ও বা বাহুতে ধারালো ও চোখা অস্ত্রের আঘাত পাওয়া গেছে। এই তিনটি জায়গায় রক্তনালী আছে। সেগুলো কেটে গিয়েছিল। এ কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়। অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণও ছিল শরীরে। তারা মনে করছেন, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে। 

পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে তাওসিফের গলায় কালশিরা দাগ আছে বলে বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক বলেন, “নরম কাপড় দিয়ে শ্বাসরোধের কারণে এই দাগটি হতে পারে। তবে এটি মৃত্যুর প্রধান কারণ নয়। ধারালো অস্ত্রের আঘাত ও শ্বাস রোধে হত্যার চেষ্টা একই সময়ে হয়েছে।” 

এর আগে বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) বিকেলে রাজশাহী নগরের ডাবতলা এলাকায় ভাড়া বাসায় খুন হয় নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাওসিফ। হামলাকারী লিমন মিয়া (৩৫) তাদের পূর্ব পরিচিত। তার হামলায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন তাওসিফের মা তাসমিন নাহার লুসী (৪৪)। এছাড়া ধস্তাধস্তিতে হামলাকারী নিজেও আহত হয়ে হাসপাতালে পুলিশের হেফাজতে চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায় শুক্রবার বেলা ১১টা পর্যন্ত থানায় কোন মামলা হয়নি।

তাওসিফের মরদেহ দাফনের জন্য জামালপুরে গ্রামের বাড়ি নেওয়া হবে।

ঢাকা/কেয়া/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ