সহজ সাবলীল স্বতঃস্ফূর্ত― শরৎচন্দ্রের লেখাগুলি সম্পর্কে এ ক’টা শব্দ ব্যবহার করাই যায়। স্বাভাবিকভাবেই আমরা এও জানি, যার যা শক্তি, তাই হয়ে ওঠে তার দুর্বলতা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে জটিল গ্রন্থিল গম্ভীর হওয়াটাই ‘আধুনিক’ বলে গণ্য। ফলে কারো কারো মতে, ওই তিনটি শরৎচন্দ্রের যতটা না শক্তি ততটাই যেন দুর্বলতা। অনেক আধুনিক লেখক নিজেদের তৈরি করতে গিয়ে মনে করেছেন, বাংলা গল্প-উপন্যাসচর্চায় শরৎচন্দ্রের আর দরকার নেই। কারণ, বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথের পর শরৎচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের নিরাকরণ। তাকে পারলে পুরোপুরি বাদ দিয়ে পরের বিভূতি-তারাশঙ্কর-মানিক-সতীনাথ অব্দি দিব্যি চর্চা করলেই হাতে তৈরি হবে গদ্য এবং গল্প-উপন্যাস লেখার তাকত। অথচ এই সত্যও সবাই জানেন, শরৎচন্দ্র না হলে বিভূতি-তারাশঙ্কর-মানিক অন্তত এত আগে আগে বা রবীন্দ্রনাথ থাকতে থাকতেই, তৈরি হতেন না। রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে শরৎচন্দ্রের যেমন বিস্ময়ের অবধি ছিল না, তেমন শরৎচন্দ্রের আকুল-ব্যাকুল করা কাহিনিগুলির সামনে পরের প্রজন্মের প্রধান লেখকরা এক রকম ডুকরে উঠেছিলেন। মানিক তো মনেই করতেন, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলি তার চাওয়ার মতো নয়, বরং শরৎচন্দ্র তাকে উজ্জীবিত করেছিলেন নতুন সাহিত্যযাত্রায় পা ফেলতে।
আমরা অনেকেই জানি, অতি উচ্চ শ্রেণির বা প্রথম লেখকদের অনুকরণ-অনুসরণ করা যায় না। সাহিত্য গড়েই ওঠে দ্বিতীয় শ্রেণির লেখকদের অনুসরণ করে। অর্থাৎ মাঝারি লেখকদের অনুসরণ করেই পরের প্রজন্মের বড় লেখকরা গড়ে ওঠেন। এ কথা ঢালাওভাবে বলাটা যদিও ঠিক নয়, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের তিন বাড়–জ্জের বিস্ময় (বিশেষ করে বিভূতি-তারাশঙ্কর) রবীন্দ্রনাথ হলেও, তাদের সাহিত্যের ভিত্তিভূমি তৈরি হয়েছে শরৎ-সাহিত্যের পথ ধরে।
বিষয়টা চেনানো খুব জটিল কিছুও নয়। বঙ্কিমের উপন্যাসে রোমান্স- অভিমুখী বাস্তবতা, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের আর্দশবাদ-অভিমুখী বাস্তবতা ও মনোবিশ্লেষণ― উভয় ক্ষেত্রেই উচ্চ শ্রেণি থেকে উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব; শরৎচন্দ্রে এসে সেই ভূমিতে হাজির করলেন গ্রামের সাধারণ মানুষদের; বিশেষ করে হতদরিদ্র প্রায় নিরন্ন মানুষেরা তাদের জীবনের প্রবল আর্তি নিয়ে নিজেদের ঘোষণা করল যে তারাও আছে। সেখানে বঙ্কিমের রোমান্স ও রবীন্দ্রনাথের মনোবিশ্লেষণের দুর্বল অনুসরণও ছিল। ফলে নান্দনিকভাবে শরৎচন্দ্রের প্রয়াস অসম্পূর্ণও ছিল, সেই অসম্পূর্ণতাকে সম্পূর্ণ করলেন তার পরবর্তী পর্যায়ের ভাবশিষ্যরা। কালি-কলম ও কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকরা নি¤œবিত্তের দগদগে জীবনের কাহিনিতে মাতিয়ে দিলেন কিছু কাল। এর ভেতরে আড়ালে থাকা জগদীশ গুপ্ত বহু বছর পর নতুন করে মূল্যায়িত হলেন তার প্রবল নিষ্ঠুর-নিয়তির তাড়িত দৃষ্টি ও ক্রুর কঠোর চরিত্রগুলির হীনতা নিয়ে। যদিও তাকে বলা হয়, ভেতরে ভেতরে তিনি মূলত শরৎচন্দ্রীয়ই। একদম আধুনিক লেখক, রমানাথ রায়ও তার সাহিত্যচর্চায় শরৎচন্দ্রের ভূমিকাকে সবচেয়ে প্রবল বলে মানেন। অথচ রমানাথ রায়ের সঙ্গে বিষয়ে, রীতিশৈলীতে বা অভিপ্রায়ে কোনো মিল নেই শরৎচন্দ্রের।
২.
শরৎচন্দ্রর উপন্যাসগুলির প্রধান ক’টিকে একদম কাট-টু-কাট রবীন্দ্র-উপন্যাসের সরলীকরণ বলা হয়। গোরা থেকে শ্রীকান্ত, চোখের বালি থেকে চরিত্রহীন, নৌকাডুবি/ঘরে-বাইরে থেকে গৃহদাহ, যোগাযোগ থেকে দেনা-পাওনা, চার অধ্যায় থেকে পথের দাবী― এমন করে দাগিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে শরৎচন্দ্রের ভূমিকাকে ধরিয়ে দিতে চান কেউ কেউ। এর মানে হলো, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলির পর শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলি স্কিপ করলে বাঙালি আগামী পাঠকের বা লেখকের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হবে না। আদতে কি তাই?
কথা তো গল্প বলা নিয়ে। সেই গল্প আপনি-আমি কীভাবে বলতে চাই তার ওপর নির্ভর করে আমাদের কারুকৃতি। শরৎচন্দ্রের গল্প বলা খুব সরল স্বাভাবিক। কিন্তু একটা বিন্দুর ছেলে বা রামের সুমতি বা মেজদিদি, বা বিলাসী বা মহেশ বা অভাগীর স্বর্গের মতো গল্পে সরলতার ভেতরে সহজতার ভেতরে এমন এক মানবিক আর্তি নিহিত আছে, সেটি খুব ভেতর থেকে না এলে এতটা চিরায়ত হতো কি? মানুষ প্রাচীনকাল থেকে অনেক বাড়িঘর বা স্থাপত্য-স্থাপনা তৈরি করে এসেছে। কালের ধুলায় মুছে গেছে অনেক বাড়িঘর-স্থাপনা। পাশপাশি কালের ক্ষয় এড়িয়েও কিছু বাড়ি বা স্থাপনা এখনও টিকে আছে। এসব কীসের জোরে টিকে আছে? জর্ডানের পেত্রাতে আল-খাজনেহ’র মতো স্থাপনার দিকে তাকালে কী মনে হয় না, বা যে কোনো তেমন প্রাচীন স্থাপনার দিকে তাকালে: মিশরে ইরাকে ইরানে বা হরপ্পা মহেঞ্জোদারো বা অজন্তা ইলোরা কোনারকের স্থাপনাগুলি কালের ক্ষয় এড়িয়ে টিকে রইল কেন? নিশ্চিয়ই তাতে এমন এক প্রতœশক্তি আছে যা ভেতর থেকে জারিত। বাহিক্য যতœ ওসব দেশের প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরগুলি নিক বা না নিক, নিজের জোরে বা নিহিত শক্তিটি হারিয়ে যায়নি বলেও এগুলি টিকে আছে।
শরৎচন্দ্রের টিকে থাকার একটা দিক হলো গণমানুষের আর্তিকে ভাষা দেওয়ার কাজটি তিনি ঘটিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের সহজতা সরলতা স্বতঃস্ফূর্ততার প্রতœরূপই আসলে শরৎচন্দ্রের সাহিত্যের ভাস্বর হয়েছে। তলস্তয়ের যুদ্ধ ও শান্তি উপন্যাসে মূল যে বিষয়টি অভিব্যক্ত হয়েছে, তা হলো: একক কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে নয়, ইতিহাসের পরিবর্তন ঘটে সম্মিলিত মানুষ বা জনগণের হাতে। বারবার তাই হয়েছে, কিন্তু সেই পরিবর্তন হাতছাড়া হয়েছে কায়েমি স্বার্থবাদীদের হাতেই। ফলে একটি সত্য উদ্ভাসিত হলেও পরের যে বাস্তবতা, এই যে ইতিহাসের বাঁক বদলের পরের ফের নতুন করে জনগণ ফাঁদে পড়ে, নতুন বোতলে পুরানো ‘মদ’ই তাদের পান করতে বাধ্য করা হয়― এর হাত থেকে বেরুনোর নতুন চেতনা তৈরি করতেই নতুন একজনকে দায়িত্ব নিতে হবে। নতুন যুদ্ধ ও শান্তি হয়ত তাকে লিখতে হতে পারে। ব্যাপার হলো এই যে, তলস্তয় ছিলেন বলেই জগতে আরো লেখার প্রবাহ তৈরি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টমাস পিঞ্চন বা পেরুর মারিও ভার্গাস ইয়োসা বা তুরস্কের ওরহান পামুকরা তো তলস্তয়-ঘরানারই পরম্পরা। বাংলা সাহিত্যে অন্নদাশঙ্কর রায়, দেবেশ রায়ও তাই। কিন্তু কোনোভাবেই তারা হুবহু তলস্তয়-অনুকরণকারী নন। তলস্তয়ের তিন লক্ষ শব্দের বিরাট উপন্যাস যুদ্ধ ও শান্তিতে একটি বাক্য পাওয়া যাবে না যা দুর্বোধ্য বা অস্পষ্ট। অথচ তার ভাবশিষ্যদের লেখা মোটেও তার মতো সহজ সাবলীল নয়। তাহলে? তাহলে তো এটা বলতেই হয়: জটিল গ্রন্থিল গম্ভীর হওয়া মানেই আধুনিক সাহিত্য নয়; অন্যদিকে সহজ সাবলীল স্বতঃস্ফূর্ত হওয়া কখনোই অনাধুনিক নয়; তেমন হওয়াটা কখনোই কারো সাহিত্যের দোষ হতে পারে না।
শরৎচন্দ্রের বিপক্ষে দাঁড়ানোর সূত্র হলো, তিনি নাকি বাংলা গদ্য লেখাটাকে একদম সহজ করে দিয়েছেন। মোদ্দা কথা হাটে নামিয়ে দিয়েছেন, বাজারে বসিয়ে দিয়েছেন। তার লেখা এমন এক মধুরচাক, যাকে ঘিওে নির্বোধ ভাবনা-বুদ্ধিহীন পাঠক মাছির মতো ভনভন করছে।
আমরা জানি, পাঠকের জন্ম নতুন নতুনভাবে নানান পর্যায়ে ঘটে থাকে। লেখকের জন্মও হয় পাঠক হওয়ার ভিত্তিতে। কিন্তু এর ভেতরে সব পাঠকই প্রকৃত পাঠক হয়ে ওঠেন না, তেমন সব লেখকই প্রকৃত লেখক হয়ে উঠতে পারেন না। সর্বোপরি লেখালেখির যে শৈল্পিক ও নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, সেখানে লেখকের খামতি ঘাটতি থাকলে সমূহ বিপদ। এখন শিল্প যদি হয় সঞ্চার করা, শিল্প যদি হয়, মানবিক আর্তিকে বেদনাবোধকে বুকের মাঝখানে বা গলার ভেতরে দলা পাকানোর অনুভূতি তৈরি করে দেওয়া, সেখানে আদতে খুব দোষণীয় কিছু ঘটবে কি?
দস্তয়েভস্কির মতো লেখকও প্রবল আবেগ অনুভূতিরই প্রতিনিধিত্ব করেছেন। প্রেম বাসনা একদম থরথর করেছে তার উপন্যাসের চরাচরজুড়ে। ফরাসি পাঠকরা প্রথমদিকে দস্তয়েভস্কিকে মার্কি দ্য সাদের মতোই একজন মনে করতেন। এখন যারা মার্কি দ্য সাদের লেখা পড়েন, সাদের দগদগে ইরোটিসিজমের সামনে বেতসলতা হয়ে যান, তারাও কি স্বীকার করবেন দস্তয়েভস্কি আর মার্কি দ্য সাদ হুবহু এক শ্রেণি বা এক জাতের লেখক? হ্যাঁ, সাদ যেখানে বাহ্যিকভাবে সরাসরি আক্রমণ শানাচ্ছেন; দস্তয়েভস্কির সেখানে ভেতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছেন পাঠককে। আক্রমণে মিল আছে তাদের, কিন্তু তার মানে কেউ কারো নকল তো ননই, বরং দার্র্শনিকভাবেই সাদের দর্শন আর দস্তয়েভস্কির দর্শন আলাদা―যথাক্রমে ধর্ষকামপীড়িত আর আত্মনিপীড়নবাদী; এতে পীড়নে মিল থাকতে পারে, কিন্তু ধরন একদমই আলাদা। সাদের আক্রমণ শরীরে-যৌনতায়, আর দস্তয়েভস্কি আক্রান্ত করেন মনে, মননে ও বোধনের আদি-অন্তে।
বাংলা সাহিত্যে শরৎচন্দ্রের অভিঘাত বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথের পর অভিনব বৈকি। কারণ সাহিত্য রচনার জন্য যে প্রগাঢ় শিল্পদক্ষতা, নন্দনিকতা ও উচ্চমানের রুচি আভিজাত্যের বালাই ছিল, শরৎচন্দ্র সেটি ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছেন। বা তিনি না চাইলেও সেটি ভেঙে গেছে। তার পূর্বপর্যন্ত আমরা দেখি, যারাই সাহিত্য করতে এসেছেন, তারা উচ্চ শ্রেণির বা ইংরেজের বড় চাকুরে। তাদের কাজ ছিল লেখাকে শখের লেখা নয়, বরং দেশ-জাতির কল্যাণে কাজে লাগানো। ইতিহাস সমাজ জাতি জনগোষ্ঠীর প্রতি, সাহিত্যের প্রতি তো বটেই, গভীর দায় তারা বোধ করেছেন। রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী অব্দি। সাহিত্যের এই আভিজাত্যের হাঁড়ি হাটে ভেঙে গেল শরৎচন্দ্রের মাধ্যমে। এটা এক অর্থে বিপ্লবই। আমূল বদলে গেল সাহিত্যচর্চা প্রত্যয় ও প্রেরণা। সাহিত্যচর্চাকে পেশা হিসেবেও নিলেন শরৎচন্দ্র। আর পরবর্তীকালে বেকার ভবঘুরে তাদের অদম্য প্রতিভায় আত্মবিশ^াসী হয়ে উঠল। সেটি নজরুল থেকে মানিক, সমরেশ বসু অব্দি আমরা টেনে নিয়ে একেবারে হাল আমল অব্দি আনতে পারি। মানে হলো, যে কেউ সাহিত্য করতে পারে। এর জন্য অত শিক্ষিত মার্জিত অভিজাত হওয়ার দরকার নেই। বাংলা সাহিত্যচর্চার বাহ্যিক দিকে এটা শরৎচন্দ্রেরই দান বটে।
কিন্তু ভেতরের দিকেও শরৎচন্দ্রের দানটি ন্যূন নয়। বাংলা কথাসাহিত্যে গদ্যের মেজাজ বদল হলো তার হাতে। আমরা জানি, বিদ্যাসাগরের কঠিন নীরেট তৎসম-তদ্ভবনির্ভর গদ্যের (থিসিস) বিপরীতে প্যারীচাঁদ মিত্র কালীপ্রসন্ন সিংহরা যে দিশি/কথ্য-গদ্য(অ্যান্টিথিসিস) হাজির করলেন, বঙ্কিমের হাতে এর সমন্বয় (সিন্থেসিস) ঘটল। শরতের বেলায় বলতে হয়, তিনি সাধু ভাষায় লিখেছেন অথচ মেজাজে তা একেবারেই চলিত ভাষার। তুলনাটা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের গদ্যের সঙ্গে করলেই আরো স্পষ্ট হবে। সুধীন দত্ত চলিত গদ্যে লিখেছেন, কিন্তু মেজাজে সেই গদ্য সাধুরও অধিক। ফলে শরৎচন্দ্রের এ ক্ষেত্রে মারাত্মক ভূমিকা আছে। বাংলা কথা-কাহিনিচর্চার গদ্যকে তিনি এক অর্থে ধ্বসিয়ে দিলেন। আকাশ থেকে মাটিতে নামিয়ে আনলেন। আর মাটিবর্তী গদ্যের সুফল ফলল তার পরের প্রজন্মের সাহিত্যিকদের হাতে― এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
৩.
আজও ভারতে যে কোনো ভাষায় অনূদিত শরৎচন্দ্রই যেন প্রধান লেখক। সে দেশের যে কোনো ভাষার চলচ্চিত্রে তার কাহিনি রূপ পেলে তা সুপারহিট হওয়ার সম্ভবনা বাস্তবতা পেয়ে যায়। প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুবোধ ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র থেকে বিমল করকে শরৎচন্দ্র ছাড়া কি ভাবা যায়? তা তারা যতই আলাদা মনের ও মানের হোন না কেন!
আমাদের প্রজন্মের আশি-নব্বইয়ের দশকে যারা বেড়ে উঠছিলাম, বাল্যবয়স থেকে শরৎচন্দ্র সম্পর্কে একটা অভিধা খুব শুনেছি― অমর কথাশিল্পী। বিশেষ করে তার গল্প-উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত কোনো চলচ্চিত্র মুক্তি পেলেই, বেবিট্যাক্সি বর্তমানে সিএনজি বা অটো যেগুলো বলা হয়, বা কোনো রিকশায় মাইক বাজিয়ে বলা হচ্ছে: ঢাকা নারায়ণগঞ্জসহ সারাদেশে প্রেক্ষাগৃহী মুক্তি পেয়েছে অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের বৈকুণ্ঠের উইল বা শুভদা।
শরৎচন্দ্র সম্পর্কে এখন খুব জোরের সঙ্গে ‘অমর কথাশিল্পী’ বলা হয় না বোধ করি। অভিধা-উপাধি প্রিয় বাঙালি এসব থেকে খারিজ করে দেওয়ার ক্ষেত্রেও অনন্য। নতুন বয়ান তৈরি করে করে বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথ ও শরতের ভূমিকাকে বদলে তো দেওয়াই যায়। কিন্তু তাদের সাহিত্যিক নিবিষ্টতা, তাদের রচনাবলির ভেতরগত শক্তিকে তাতে কোনোমাত্রই হেয়প্রতিপন্ন করা যায় না।
বাংলা ভাষা সাহিত্য ও বাঙালি জীবনের অবিচ্ছিন্নভাবে নিরবচ্ছিন্ন হয়ে আছে পূর্ববর্তী লেখকশিল্পীদের সাধনা। দু’চারটি দুর্বল এবং আদতে নন্দনবোধহীন কিছু অর্বাচীন ‘করতেসিলাম, পারতেসিলাম’, মে বি সো বাট-এর মতো অনর্থক বাংলা-ইংরেজি ‘শহুরে অশিক্ষায় কুশিক্ষিত’; এক আনা সাধ্য নেই কবিতা গল্প প্রবন্ধ লেখার কিন্তু ষোল আনা খায়েসওয়ালা; তারওপর ঘোর সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির কিছু ঊন-মানুষ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শক্তিশালী ¯্রােতপ্রবাহে এতটুকু চিড় ধরাতে পারেনি। কারণ এখনো বঙ্কিম রবীন্দ্রনাধ প্রমথ চৌধুরী শরৎচন্দ্র নজরুল জসীমউদ্দীন থেকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সৈয়দ শামসুল হক হাসান আজিজুল হক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস শহীদুল জহিরদের লেখা দেদীপ্যমান। এক ফুঁতে এতগুলি প্রদীপ নিভিয়ে দেওয়ার মতো দম তাদের যে নেই, সে কথা বলাবাহুল্য।
ঢাকা/তারা//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র প রজন ম র স হ ত যচর চ র উপন য স রব ন দ র ব স তবত র ভ তর দ র বল প রবল
এছাড়াও পড়ুন:
শরৎ-রহস্য
সহজ সাবলীল স্বতঃস্ফূর্ত― শরৎচন্দ্রের লেখাগুলি সম্পর্কে এ ক’টা শব্দ ব্যবহার করাই যায়। স্বাভাবিকভাবেই আমরা এও জানি, যার যা শক্তি, তাই হয়ে ওঠে তার দুর্বলতা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে জটিল গ্রন্থিল গম্ভীর হওয়াটাই ‘আধুনিক’ বলে গণ্য। ফলে কারো কারো মতে, ওই তিনটি শরৎচন্দ্রের যতটা না শক্তি ততটাই যেন দুর্বলতা। অনেক আধুনিক লেখক নিজেদের তৈরি করতে গিয়ে মনে করেছেন, বাংলা গল্প-উপন্যাসচর্চায় শরৎচন্দ্রের আর দরকার নেই। কারণ, বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথের পর শরৎচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের নিরাকরণ। তাকে পারলে পুরোপুরি বাদ দিয়ে পরের বিভূতি-তারাশঙ্কর-মানিক-সতীনাথ অব্দি দিব্যি চর্চা করলেই হাতে তৈরি হবে গদ্য এবং গল্প-উপন্যাস লেখার তাকত। অথচ এই সত্যও সবাই জানেন, শরৎচন্দ্র না হলে বিভূতি-তারাশঙ্কর-মানিক অন্তত এত আগে আগে বা রবীন্দ্রনাথ থাকতে থাকতেই, তৈরি হতেন না। রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে শরৎচন্দ্রের যেমন বিস্ময়ের অবধি ছিল না, তেমন শরৎচন্দ্রের আকুল-ব্যাকুল করা কাহিনিগুলির সামনে পরের প্রজন্মের প্রধান লেখকরা এক রকম ডুকরে উঠেছিলেন। মানিক তো মনেই করতেন, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলি তার চাওয়ার মতো নয়, বরং শরৎচন্দ্র তাকে উজ্জীবিত করেছিলেন নতুন সাহিত্যযাত্রায় পা ফেলতে।
আমরা অনেকেই জানি, অতি উচ্চ শ্রেণির বা প্রথম লেখকদের অনুকরণ-অনুসরণ করা যায় না। সাহিত্য গড়েই ওঠে দ্বিতীয় শ্রেণির লেখকদের অনুসরণ করে। অর্থাৎ মাঝারি লেখকদের অনুসরণ করেই পরের প্রজন্মের বড় লেখকরা গড়ে ওঠেন। এ কথা ঢালাওভাবে বলাটা যদিও ঠিক নয়, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের তিন বাড়–জ্জের বিস্ময় (বিশেষ করে বিভূতি-তারাশঙ্কর) রবীন্দ্রনাথ হলেও, তাদের সাহিত্যের ভিত্তিভূমি তৈরি হয়েছে শরৎ-সাহিত্যের পথ ধরে।
বিষয়টা চেনানো খুব জটিল কিছুও নয়। বঙ্কিমের উপন্যাসে রোমান্স- অভিমুখী বাস্তবতা, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের আর্দশবাদ-অভিমুখী বাস্তবতা ও মনোবিশ্লেষণ― উভয় ক্ষেত্রেই উচ্চ শ্রেণি থেকে উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব; শরৎচন্দ্রে এসে সেই ভূমিতে হাজির করলেন গ্রামের সাধারণ মানুষদের; বিশেষ করে হতদরিদ্র প্রায় নিরন্ন মানুষেরা তাদের জীবনের প্রবল আর্তি নিয়ে নিজেদের ঘোষণা করল যে তারাও আছে। সেখানে বঙ্কিমের রোমান্স ও রবীন্দ্রনাথের মনোবিশ্লেষণের দুর্বল অনুসরণও ছিল। ফলে নান্দনিকভাবে শরৎচন্দ্রের প্রয়াস অসম্পূর্ণও ছিল, সেই অসম্পূর্ণতাকে সম্পূর্ণ করলেন তার পরবর্তী পর্যায়ের ভাবশিষ্যরা। কালি-কলম ও কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকরা নি¤œবিত্তের দগদগে জীবনের কাহিনিতে মাতিয়ে দিলেন কিছু কাল। এর ভেতরে আড়ালে থাকা জগদীশ গুপ্ত বহু বছর পর নতুন করে মূল্যায়িত হলেন তার প্রবল নিষ্ঠুর-নিয়তির তাড়িত দৃষ্টি ও ক্রুর কঠোর চরিত্রগুলির হীনতা নিয়ে। যদিও তাকে বলা হয়, ভেতরে ভেতরে তিনি মূলত শরৎচন্দ্রীয়ই। একদম আধুনিক লেখক, রমানাথ রায়ও তার সাহিত্যচর্চায় শরৎচন্দ্রের ভূমিকাকে সবচেয়ে প্রবল বলে মানেন। অথচ রমানাথ রায়ের সঙ্গে বিষয়ে, রীতিশৈলীতে বা অভিপ্রায়ে কোনো মিল নেই শরৎচন্দ্রের।
২.
শরৎচন্দ্রর উপন্যাসগুলির প্রধান ক’টিকে একদম কাট-টু-কাট রবীন্দ্র-উপন্যাসের সরলীকরণ বলা হয়। গোরা থেকে শ্রীকান্ত, চোখের বালি থেকে চরিত্রহীন, নৌকাডুবি/ঘরে-বাইরে থেকে গৃহদাহ, যোগাযোগ থেকে দেনা-পাওনা, চার অধ্যায় থেকে পথের দাবী― এমন করে দাগিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে শরৎচন্দ্রের ভূমিকাকে ধরিয়ে দিতে চান কেউ কেউ। এর মানে হলো, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলির পর শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলি স্কিপ করলে বাঙালি আগামী পাঠকের বা লেখকের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হবে না। আদতে কি তাই?
কথা তো গল্প বলা নিয়ে। সেই গল্প আপনি-আমি কীভাবে বলতে চাই তার ওপর নির্ভর করে আমাদের কারুকৃতি। শরৎচন্দ্রের গল্প বলা খুব সরল স্বাভাবিক। কিন্তু একটা বিন্দুর ছেলে বা রামের সুমতি বা মেজদিদি, বা বিলাসী বা মহেশ বা অভাগীর স্বর্গের মতো গল্পে সরলতার ভেতরে সহজতার ভেতরে এমন এক মানবিক আর্তি নিহিত আছে, সেটি খুব ভেতর থেকে না এলে এতটা চিরায়ত হতো কি? মানুষ প্রাচীনকাল থেকে অনেক বাড়িঘর বা স্থাপত্য-স্থাপনা তৈরি করে এসেছে। কালের ধুলায় মুছে গেছে অনেক বাড়িঘর-স্থাপনা। পাশপাশি কালের ক্ষয় এড়িয়েও কিছু বাড়ি বা স্থাপনা এখনও টিকে আছে। এসব কীসের জোরে টিকে আছে? জর্ডানের পেত্রাতে আল-খাজনেহ’র মতো স্থাপনার দিকে তাকালে কী মনে হয় না, বা যে কোনো তেমন প্রাচীন স্থাপনার দিকে তাকালে: মিশরে ইরাকে ইরানে বা হরপ্পা মহেঞ্জোদারো বা অজন্তা ইলোরা কোনারকের স্থাপনাগুলি কালের ক্ষয় এড়িয়ে টিকে রইল কেন? নিশ্চিয়ই তাতে এমন এক প্রতœশক্তি আছে যা ভেতর থেকে জারিত। বাহিক্য যতœ ওসব দেশের প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরগুলি নিক বা না নিক, নিজের জোরে বা নিহিত শক্তিটি হারিয়ে যায়নি বলেও এগুলি টিকে আছে।
শরৎচন্দ্রের টিকে থাকার একটা দিক হলো গণমানুষের আর্তিকে ভাষা দেওয়ার কাজটি তিনি ঘটিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের সহজতা সরলতা স্বতঃস্ফূর্ততার প্রতœরূপই আসলে শরৎচন্দ্রের সাহিত্যের ভাস্বর হয়েছে। তলস্তয়ের যুদ্ধ ও শান্তি উপন্যাসে মূল যে বিষয়টি অভিব্যক্ত হয়েছে, তা হলো: একক কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে নয়, ইতিহাসের পরিবর্তন ঘটে সম্মিলিত মানুষ বা জনগণের হাতে। বারবার তাই হয়েছে, কিন্তু সেই পরিবর্তন হাতছাড়া হয়েছে কায়েমি স্বার্থবাদীদের হাতেই। ফলে একটি সত্য উদ্ভাসিত হলেও পরের যে বাস্তবতা, এই যে ইতিহাসের বাঁক বদলের পরের ফের নতুন করে জনগণ ফাঁদে পড়ে, নতুন বোতলে পুরানো ‘মদ’ই তাদের পান করতে বাধ্য করা হয়― এর হাত থেকে বেরুনোর নতুন চেতনা তৈরি করতেই নতুন একজনকে দায়িত্ব নিতে হবে। নতুন যুদ্ধ ও শান্তি হয়ত তাকে লিখতে হতে পারে। ব্যাপার হলো এই যে, তলস্তয় ছিলেন বলেই জগতে আরো লেখার প্রবাহ তৈরি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টমাস পিঞ্চন বা পেরুর মারিও ভার্গাস ইয়োসা বা তুরস্কের ওরহান পামুকরা তো তলস্তয়-ঘরানারই পরম্পরা। বাংলা সাহিত্যে অন্নদাশঙ্কর রায়, দেবেশ রায়ও তাই। কিন্তু কোনোভাবেই তারা হুবহু তলস্তয়-অনুকরণকারী নন। তলস্তয়ের তিন লক্ষ শব্দের বিরাট উপন্যাস যুদ্ধ ও শান্তিতে একটি বাক্য পাওয়া যাবে না যা দুর্বোধ্য বা অস্পষ্ট। অথচ তার ভাবশিষ্যদের লেখা মোটেও তার মতো সহজ সাবলীল নয়। তাহলে? তাহলে তো এটা বলতেই হয়: জটিল গ্রন্থিল গম্ভীর হওয়া মানেই আধুনিক সাহিত্য নয়; অন্যদিকে সহজ সাবলীল স্বতঃস্ফূর্ত হওয়া কখনোই অনাধুনিক নয়; তেমন হওয়াটা কখনোই কারো সাহিত্যের দোষ হতে পারে না।
শরৎচন্দ্রের বিপক্ষে দাঁড়ানোর সূত্র হলো, তিনি নাকি বাংলা গদ্য লেখাটাকে একদম সহজ করে দিয়েছেন। মোদ্দা কথা হাটে নামিয়ে দিয়েছেন, বাজারে বসিয়ে দিয়েছেন। তার লেখা এমন এক মধুরচাক, যাকে ঘিওে নির্বোধ ভাবনা-বুদ্ধিহীন পাঠক মাছির মতো ভনভন করছে।
আমরা জানি, পাঠকের জন্ম নতুন নতুনভাবে নানান পর্যায়ে ঘটে থাকে। লেখকের জন্মও হয় পাঠক হওয়ার ভিত্তিতে। কিন্তু এর ভেতরে সব পাঠকই প্রকৃত পাঠক হয়ে ওঠেন না, তেমন সব লেখকই প্রকৃত লেখক হয়ে উঠতে পারেন না। সর্বোপরি লেখালেখির যে শৈল্পিক ও নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, সেখানে লেখকের খামতি ঘাটতি থাকলে সমূহ বিপদ। এখন শিল্প যদি হয় সঞ্চার করা, শিল্প যদি হয়, মানবিক আর্তিকে বেদনাবোধকে বুকের মাঝখানে বা গলার ভেতরে দলা পাকানোর অনুভূতি তৈরি করে দেওয়া, সেখানে আদতে খুব দোষণীয় কিছু ঘটবে কি?
দস্তয়েভস্কির মতো লেখকও প্রবল আবেগ অনুভূতিরই প্রতিনিধিত্ব করেছেন। প্রেম বাসনা একদম থরথর করেছে তার উপন্যাসের চরাচরজুড়ে। ফরাসি পাঠকরা প্রথমদিকে দস্তয়েভস্কিকে মার্কি দ্য সাদের মতোই একজন মনে করতেন। এখন যারা মার্কি দ্য সাদের লেখা পড়েন, সাদের দগদগে ইরোটিসিজমের সামনে বেতসলতা হয়ে যান, তারাও কি স্বীকার করবেন দস্তয়েভস্কি আর মার্কি দ্য সাদ হুবহু এক শ্রেণি বা এক জাতের লেখক? হ্যাঁ, সাদ যেখানে বাহ্যিকভাবে সরাসরি আক্রমণ শানাচ্ছেন; দস্তয়েভস্কির সেখানে ভেতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছেন পাঠককে। আক্রমণে মিল আছে তাদের, কিন্তু তার মানে কেউ কারো নকল তো ননই, বরং দার্র্শনিকভাবেই সাদের দর্শন আর দস্তয়েভস্কির দর্শন আলাদা―যথাক্রমে ধর্ষকামপীড়িত আর আত্মনিপীড়নবাদী; এতে পীড়নে মিল থাকতে পারে, কিন্তু ধরন একদমই আলাদা। সাদের আক্রমণ শরীরে-যৌনতায়, আর দস্তয়েভস্কি আক্রান্ত করেন মনে, মননে ও বোধনের আদি-অন্তে।
বাংলা সাহিত্যে শরৎচন্দ্রের অভিঘাত বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথের পর অভিনব বৈকি। কারণ সাহিত্য রচনার জন্য যে প্রগাঢ় শিল্পদক্ষতা, নন্দনিকতা ও উচ্চমানের রুচি আভিজাত্যের বালাই ছিল, শরৎচন্দ্র সেটি ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছেন। বা তিনি না চাইলেও সেটি ভেঙে গেছে। তার পূর্বপর্যন্ত আমরা দেখি, যারাই সাহিত্য করতে এসেছেন, তারা উচ্চ শ্রেণির বা ইংরেজের বড় চাকুরে। তাদের কাজ ছিল লেখাকে শখের লেখা নয়, বরং দেশ-জাতির কল্যাণে কাজে লাগানো। ইতিহাস সমাজ জাতি জনগোষ্ঠীর প্রতি, সাহিত্যের প্রতি তো বটেই, গভীর দায় তারা বোধ করেছেন। রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী অব্দি। সাহিত্যের এই আভিজাত্যের হাঁড়ি হাটে ভেঙে গেল শরৎচন্দ্রের মাধ্যমে। এটা এক অর্থে বিপ্লবই। আমূল বদলে গেল সাহিত্যচর্চা প্রত্যয় ও প্রেরণা। সাহিত্যচর্চাকে পেশা হিসেবেও নিলেন শরৎচন্দ্র। আর পরবর্তীকালে বেকার ভবঘুরে তাদের অদম্য প্রতিভায় আত্মবিশ^াসী হয়ে উঠল। সেটি নজরুল থেকে মানিক, সমরেশ বসু অব্দি আমরা টেনে নিয়ে একেবারে হাল আমল অব্দি আনতে পারি। মানে হলো, যে কেউ সাহিত্য করতে পারে। এর জন্য অত শিক্ষিত মার্জিত অভিজাত হওয়ার দরকার নেই। বাংলা সাহিত্যচর্চার বাহ্যিক দিকে এটা শরৎচন্দ্রেরই দান বটে।
কিন্তু ভেতরের দিকেও শরৎচন্দ্রের দানটি ন্যূন নয়। বাংলা কথাসাহিত্যে গদ্যের মেজাজ বদল হলো তার হাতে। আমরা জানি, বিদ্যাসাগরের কঠিন নীরেট তৎসম-তদ্ভবনির্ভর গদ্যের (থিসিস) বিপরীতে প্যারীচাঁদ মিত্র কালীপ্রসন্ন সিংহরা যে দিশি/কথ্য-গদ্য(অ্যান্টিথিসিস) হাজির করলেন, বঙ্কিমের হাতে এর সমন্বয় (সিন্থেসিস) ঘটল। শরতের বেলায় বলতে হয়, তিনি সাধু ভাষায় লিখেছেন অথচ মেজাজে তা একেবারেই চলিত ভাষার। তুলনাটা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের গদ্যের সঙ্গে করলেই আরো স্পষ্ট হবে। সুধীন দত্ত চলিত গদ্যে লিখেছেন, কিন্তু মেজাজে সেই গদ্য সাধুরও অধিক। ফলে শরৎচন্দ্রের এ ক্ষেত্রে মারাত্মক ভূমিকা আছে। বাংলা কথা-কাহিনিচর্চার গদ্যকে তিনি এক অর্থে ধ্বসিয়ে দিলেন। আকাশ থেকে মাটিতে নামিয়ে আনলেন। আর মাটিবর্তী গদ্যের সুফল ফলল তার পরের প্রজন্মের সাহিত্যিকদের হাতে― এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
৩.
আজও ভারতে যে কোনো ভাষায় অনূদিত শরৎচন্দ্রই যেন প্রধান লেখক। সে দেশের যে কোনো ভাষার চলচ্চিত্রে তার কাহিনি রূপ পেলে তা সুপারহিট হওয়ার সম্ভবনা বাস্তবতা পেয়ে যায়। প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুবোধ ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র থেকে বিমল করকে শরৎচন্দ্র ছাড়া কি ভাবা যায়? তা তারা যতই আলাদা মনের ও মানের হোন না কেন!
আমাদের প্রজন্মের আশি-নব্বইয়ের দশকে যারা বেড়ে উঠছিলাম, বাল্যবয়স থেকে শরৎচন্দ্র সম্পর্কে একটা অভিধা খুব শুনেছি― অমর কথাশিল্পী। বিশেষ করে তার গল্প-উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত কোনো চলচ্চিত্র মুক্তি পেলেই, বেবিট্যাক্সি বর্তমানে সিএনজি বা অটো যেগুলো বলা হয়, বা কোনো রিকশায় মাইক বাজিয়ে বলা হচ্ছে: ঢাকা নারায়ণগঞ্জসহ সারাদেশে প্রেক্ষাগৃহী মুক্তি পেয়েছে অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের বৈকুণ্ঠের উইল বা শুভদা।
শরৎচন্দ্র সম্পর্কে এখন খুব জোরের সঙ্গে ‘অমর কথাশিল্পী’ বলা হয় না বোধ করি। অভিধা-উপাধি প্রিয় বাঙালি এসব থেকে খারিজ করে দেওয়ার ক্ষেত্রেও অনন্য। নতুন বয়ান তৈরি করে করে বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথ ও শরতের ভূমিকাকে বদলে তো দেওয়াই যায়। কিন্তু তাদের সাহিত্যিক নিবিষ্টতা, তাদের রচনাবলির ভেতরগত শক্তিকে তাতে কোনোমাত্রই হেয়প্রতিপন্ন করা যায় না।
বাংলা ভাষা সাহিত্য ও বাঙালি জীবনের অবিচ্ছিন্নভাবে নিরবচ্ছিন্ন হয়ে আছে পূর্ববর্তী লেখকশিল্পীদের সাধনা। দু’চারটি দুর্বল এবং আদতে নন্দনবোধহীন কিছু অর্বাচীন ‘করতেসিলাম, পারতেসিলাম’, মে বি সো বাট-এর মতো অনর্থক বাংলা-ইংরেজি ‘শহুরে অশিক্ষায় কুশিক্ষিত’; এক আনা সাধ্য নেই কবিতা গল্প প্রবন্ধ লেখার কিন্তু ষোল আনা খায়েসওয়ালা; তারওপর ঘোর সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির কিছু ঊন-মানুষ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শক্তিশালী ¯্রােতপ্রবাহে এতটুকু চিড় ধরাতে পারেনি। কারণ এখনো বঙ্কিম রবীন্দ্রনাধ প্রমথ চৌধুরী শরৎচন্দ্র নজরুল জসীমউদ্দীন থেকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সৈয়দ শামসুল হক হাসান আজিজুল হক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস শহীদুল জহিরদের লেখা দেদীপ্যমান। এক ফুঁতে এতগুলি প্রদীপ নিভিয়ে দেওয়ার মতো দম তাদের যে নেই, সে কথা বলাবাহুল্য।
ঢাকা/তারা//