শার্ল বোদলেয়ারের ‘প্রেমিক-প্রেমিকার মৃত্যু’ কবিতাটির প্রথম প্রকাশ ৯ এপ্রিল ১৮৫১, ‘ল্য মেসাজে দ্য লাসঁব্লে’ পত্রিকায়। কবি বুদ্ধদেব বসু ১৯৫৩ সালে ‘প্রেমিক-প্রেমিকার মৃত্যু’ শিরোনামে কবিতাটি অনুবাদ করেন এবং ‘বোদলেয়ার: তাঁর কবিতা’ গ্রন্থে স্থান দেন।
কবিতাটি বোদলেয়ারের ‘লে ফ্ল্যর দ্যু ম্যাল’-এর অন্যতম প্রতীকবাদী কবিতা। এখানে প্রেম ও মৃত্যুকে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে দেখানো হয়েছে। এখানে প্রেমের চূড়ান্ত মিলন ঘটে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে, যেখানে দেহগত সীমা অতিক্রম করে আত্মা ও স্মৃতির অনন্ত মিলন ঘটে। মূল কবিতায় বোদলেয়ারের ভাষা একই সঙ্গে সংবেদনশীল ও গূঢ় প্রতীকধর্মী; ‘যমজ আয়না’, ‘জ্বলন্ত মশাল’, ‘অদ্ভুত ফুল’ প্রভৃতি চিত্রকল্পে প্রেমের রহস্যময় রূপ ও মৃত্যুর সৌন্দর্য যেন একাকার হয়ে গেছে।
বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে ‘প্রেমিক-প্রেমিকার মৃত্যু’‘কবরের মতো গভীর ডিভানে লুটিয়ে
মৃদু বাসে ভরা রবে আমাদের শয্যা,
সুন্দরতর দূর আকাশেরে ফুটিয়ে
দেয়ালের তাকে অদ্ভুত ফুলসজ্জা।
যুগল হৃদয়, চরম দহনে গলিত,
বিশাল যুগল-মশালের উল্লাসে
হবে মুখোমুখি–দর্পণে প্রতিফলিত
যুগ্ম প্রাণের ভাস্বর উদ্ভাসে।
গোলাপি এবং মায়াবী নীলের সৃষ্টি
এক সন্ধ্যায় মিলবে দুয়ের দৃষ্টি,
যেন বিদায়ের দীর্ণ দীর্ঘশ্বাস;
পরে, দ্বার খুলে, মলিন মুকুরে রাঙাবে
এক দেবদূত, সুখী ও সবিশ্বাস;
আমাদের মৃত আগুনের ঘুম ভাঙাবে।’
বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদের ৭২ বছর পর কবি সলিমুল্লাহ খান অন্য আরও তিনটি কবিতার সঙ্গে ওই কবিতাটিও একই শিরোনামে অনুবাদ করেছেন। গত ৩১ অক্টোবর প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকী ‘অন্য আলো’তে কবিতাগুলো পড়ার পরে মনে হলো একই কবিতার দুটি অনুবাদের একটি পাঠ পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
সলিমুল্লাহ খানের অনুবাদে ‘প্রেমিক-প্রেমিকার মৃত্যু’‘আমাদের বিছানা হবে হালকা আতরমাখা,
কবরের মতো গাড়া তাকিয়া আমাদের,
তাকে তাকে থাকবে সুন্দরতর আকাশের তলে
ফোটা বিদেশি ফুলের তোড়া।
জীবনের শেষ উমটুকু খরচা করবে বলে
আমাদের দুই হৃৎপিণ্ড হবে গোটা দুই বিশাল
মশাল, তাদের দ্বিগুণ আলো পড়ে ফিরবে
আমাদের দুই মনে, এক জোড়া আয়নার ওপর।
মায়াবী নীল আর গোলাপি কোনো সন্ধ্যায় আমরা,
একে অপরকে দেব সুদীর্ঘ বিদায়ভরা
ফোঁপাকান্নার মতন মাত্র এক বিদ্যুচ্চমক;
বহুদিন পর পুরোনা দর্পণ আর মরা অগ্নিশিখা
আবার জ্বালাতে সন্তর্পণে, দরজা ঠেলে,
আসবেন দ্বীনদার, সহাস্যবদন, ফেরেশতাপ্রবর।’
প্রথমে আসি বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ প্রসঙ্গে। তাঁর অনুবাদটিকে ধ্রপদি সৌন্দর্যের মিতবাক অনুবাদ বলাই ভালো। তাঁর ভাষা সংযত, সুরেলা ও ছন্দময়। যেমন ‘কবরের মতো গভীর ডিভানে লুটিয়ে/ মৃদু বাসে ভরা রবে আমাদের শয্যা.
বুদ্ধদেবের অনুবাদে সংযম, শৃঙ্খলা ও রোমান্টিক ব্যঞ্জনা আছে। ‘গোলাপি এবং মায়াবী নীলের সৃষ্টি এক সন্ধ্যায়...’—এই পঙ্ক্তি ইঙ্গিত দেয় এক পরাবাস্তব সন্ধ্যার, যেখানে প্রেম মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। শেষে ‘এক দেবদূত, সুখী ও সবিশ্বাস’—এমন অনুবাদ মূল ফরাসি ‘ফিদেল এ জোয়্যো’র যথাযথ বাংলা বলা চলে। তিনি ধর্মীয় প্রতীকটি রেখে দিয়েছেন, কিন্তু অতিরিক্ত আধ্যাত্মিকতা দেননি।
এখন আসি সলিমুল্লাহ খানের অনুবাদ প্রসঙ্গে। তাঁর অনুবাদে ভাষা যেন আরও জীবন্ত, কথ্য এবং ব্যাখ্যামূলক হয়ে উঠেছে, ‘আমাদের বিছানা হবে হালকা আতরমাখা,/ কবরের মতো গাড়া তাকিয়া আমাদের,...’—এখানে ‘আতরমাখা’ শব্দটি ফরাসি ‘ওদ্যর লেজেয়ার’-এর প্রাণবন্ত অনুবাদ। ‘তাকে তাকে থাকবে সুন্দরতর আকাশের তলে/ ফোটা বিদেশি ফুলের তোড়া।’—এই পঙ্ক্তিতে তিনি মূলের ‘দে সিয়ু প্ল্যু বো’-কে চিত্রায়িত করেছেন, যেখানে সৌন্দর্য এক মায়াময় জগতের ইঙ্গিত। এ ছাড়া তাঁর অনুবাদে নাটকীয় আবেগ ও স্বকীয়তা বিশেষভাবে লক্ষণীয়: ‘বিদায়ভরা ফোঁপাকান্নার মতন মাত্র এক বিদ্যুচ্চমক’—মূলের ‘কোম উঁ লঁ সঁগ্লো, তু চার্জে দ্যাদিউ’-এর বেশ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুবাদ এটি। এখানে অনুভূতি স্পষ্ট, কিছুটা নাটকীয় হলেও অতি মানবিক। শেষ স্তবকে তিনি শেষে বোদলেয়ারের ‘আঁজ ফিদেল এ জোয়্যো’-কে ভাষা দিতে ‘ফেরেশতাপ্রবর’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। বুদ্ধদেব বসু যেখানে ‘দেবদূত’ লিখেছেন। এখানে ‘আঁজ’ শব্দটি যেমন ইংরেজি ‘অ্যাঞ্জেল’-এর কাছাকাছি, অন্যদিকে ‘দেবদূত’-এর পরিবর্তে ক্যাথলিক বিশ্বাস অনুযায়ী ‘ফেরেশতা’ শব্দটি ‘আঁজ’-এর বেশি কাছাকাছি।
ওপরের দুটি অনুবাদ পাশাপাশি রেখে পড়লে মনে হয়, বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদটি বেশি স্বপ্নময়, নান্দনিক ও চিত্রসম্ভব রূপে ফুটে উঠেছে। তাঁর অনুবাদে কবিতাটির প্রতীকী প্রেমমৃত্যুর দৃশ্যকল্প সহজেই ধরা পড়ে। যেমন ‘দেয়ালের তাকে অদ্ভুত ফুলসজ্জা’, ‘চরম দহনে গলিত যুগল হৃদয়’, এসব চিত্রকল্পে দার্শনিক বিষণ্নতা ও প্রেমের আভিজাত্য মিলেমিশে আছে। বুদ্ধদেব বসুর ভাষা এখানে মসৃণ ও ধ্রুপদি।
অন্যদিকে সলিমুল্লাহ খানের অনুবাদে কবিতাটির ভাব অনেক বেশি নাটকীয় ও দার্শনিক। তাঁর অনুবাদে ‘প্রেমিক-প্রেমিকার মৃত্যু’ কেবল কাব্যিক মৃত্যুবোধে সীমাবদ্ধ না থেকে, বরং এক অস্তিত্ববাদী পরিণতির দিকনির্দেশক হয়ে উঠেছে। জনাব খানের শব্দচয়ন যেমন ‘বিদায়ভরা ফোঁপাকান্নার মতন মাত্র এক বিদ্যুচ্চমক’—আমাদের অনুভূতিকে আরও আধুনিক করে তোলে। এখানে মৃত্যু ও প্রেম যতটা না রোমান্টিক, ততোধিক বাস্তব।
বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে যেখানে আবেশ ও সৌন্দর্যের আধিক্য, সেখানে সলিমুল্লাহ খানের অনুবাদে বাস্তবতা ও দার্শনিক টান অনেক বেশি স্পষ্ট। বুদ্ধদেব বসু যেমন বোদলেয়ারের ‘সিম্বোলিস্ট ডেলিকাসি’-কে রক্ষা করেছেন; জনাব খান তেমনই বোদলেয়ারের ‘এক্সিস্টেনশিয়াল ডার্কনেস’-কে প্রকট করে তুলেছেন। একজন যেন ‘পোয়েট-ট্রান্সলেটর’, অন্যজন ‘ফিলোসফার-ট্রান্সলেটর’।
বুদ্ধদেব বসুর ছন্দ সুষম, মিতবাক এবং সংগীতময়। বাক্যরীতিতে কবিত্বের ঘনত্ব বেশি। যেমন ‘মৃদু বাসে ভরা রবে আমাদের শয্যা’র মতো পঙ্ক্তি একেবারেই লিরিক্যাল, যা আমাদের মনে গভীর ভাবকল্প তৈরি করে।
অন্যদিকে জনাব খানের অনুবাদ গদ্যছন্দে হলেও তিনি এটাকে ছন্দময় করে তুলেছেন ভাব ও অনুষঙ্গ দিয়ে। তাঁর ভাষা এখানে স্বতঃস্ফূর্ত ও বাস্তববাদী। যেমন ‘আমাদের বিছানা হবে হালকা আতরমাখা’—এ রকম বাক্যে আছে এক ঘন বাস্তবতা। তাই তাঁর ছন্দে কাব্যিকতা কম থাকলেও ভাবানুভূতির কোনো ঘাটতি নেই।
বুদ্ধদেব বসু কবিতাটির প্রতীকগুলোকে (দর্পণ, মশাল, ফুল, দেবদূত) ফরাসি কাব্যিক ধাঁচেই রেখেছেন। অন্যদিকে সলিমুল্লাহ খানের প্রতীকচয়ন রূপান্তরমূলক, ফলে কবিতাটির যেন সাংস্কৃতিক রূপান্তর ঘটেছে।
সবশেষে বলতে চাই, তাঁদের দুজনার অনুবাদই অনন্য—বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ ধ্রুপদি সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ, আর সলিমুল্লাহ খানের অনুবাদ আধুনিকতাবোধ, বাস্তবতা ও দার্শনিকতাযোগে নতুন মাত্রা পেয়েছে। বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদটি অনেক বেশি সংগীতময় ও ঐতিহ্যনিষ্ঠ; আর সলিমুল্লাহ খানেরটি বেশি ভাবানুগ, চিন্তাশীল ও পুনর্নির্মিত—অর্থাৎ, প্রথমটি পোয়েট্রি অ্যাজ ট্রান্সলেশন, দ্বিতীয়টি ট্রান্সলেশন অ্যাজ পোয়েট্রি।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব দল য় র র স ন দর য সন ধ য দ বদ ত কর ছ ন আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
দুটি অনুবাদের পাঠ পর্যালোচনা
শার্ল বোদলেয়ারের ‘প্রেমিক-প্রেমিকার মৃত্যু’ কবিতাটির প্রথম প্রকাশ ৯ এপ্রিল ১৮৫১, ‘ল্য মেসাজে দ্য লাসঁব্লে’ পত্রিকায়। কবি বুদ্ধদেব বসু ১৯৫৩ সালে ‘প্রেমিক-প্রেমিকার মৃত্যু’ শিরোনামে কবিতাটি অনুবাদ করেন এবং ‘বোদলেয়ার: তাঁর কবিতা’ গ্রন্থে স্থান দেন।
কবিতাটি বোদলেয়ারের ‘লে ফ্ল্যর দ্যু ম্যাল’-এর অন্যতম প্রতীকবাদী কবিতা। এখানে প্রেম ও মৃত্যুকে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে দেখানো হয়েছে। এখানে প্রেমের চূড়ান্ত মিলন ঘটে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে, যেখানে দেহগত সীমা অতিক্রম করে আত্মা ও স্মৃতির অনন্ত মিলন ঘটে। মূল কবিতায় বোদলেয়ারের ভাষা একই সঙ্গে সংবেদনশীল ও গূঢ় প্রতীকধর্মী; ‘যমজ আয়না’, ‘জ্বলন্ত মশাল’, ‘অদ্ভুত ফুল’ প্রভৃতি চিত্রকল্পে প্রেমের রহস্যময় রূপ ও মৃত্যুর সৌন্দর্য যেন একাকার হয়ে গেছে।
বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে ‘প্রেমিক-প্রেমিকার মৃত্যু’‘কবরের মতো গভীর ডিভানে লুটিয়ে
মৃদু বাসে ভরা রবে আমাদের শয্যা,
সুন্দরতর দূর আকাশেরে ফুটিয়ে
দেয়ালের তাকে অদ্ভুত ফুলসজ্জা।
যুগল হৃদয়, চরম দহনে গলিত,
বিশাল যুগল-মশালের উল্লাসে
হবে মুখোমুখি–দর্পণে প্রতিফলিত
যুগ্ম প্রাণের ভাস্বর উদ্ভাসে।
গোলাপি এবং মায়াবী নীলের সৃষ্টি
এক সন্ধ্যায় মিলবে দুয়ের দৃষ্টি,
যেন বিদায়ের দীর্ণ দীর্ঘশ্বাস;
পরে, দ্বার খুলে, মলিন মুকুরে রাঙাবে
এক দেবদূত, সুখী ও সবিশ্বাস;
আমাদের মৃত আগুনের ঘুম ভাঙাবে।’
বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদের ৭২ বছর পর কবি সলিমুল্লাহ খান অন্য আরও তিনটি কবিতার সঙ্গে ওই কবিতাটিও একই শিরোনামে অনুবাদ করেছেন। গত ৩১ অক্টোবর প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকী ‘অন্য আলো’তে কবিতাগুলো পড়ার পরে মনে হলো একই কবিতার দুটি অনুবাদের একটি পাঠ পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
সলিমুল্লাহ খানের অনুবাদে ‘প্রেমিক-প্রেমিকার মৃত্যু’‘আমাদের বিছানা হবে হালকা আতরমাখা,
কবরের মতো গাড়া তাকিয়া আমাদের,
তাকে তাকে থাকবে সুন্দরতর আকাশের তলে
ফোটা বিদেশি ফুলের তোড়া।
জীবনের শেষ উমটুকু খরচা করবে বলে
আমাদের দুই হৃৎপিণ্ড হবে গোটা দুই বিশাল
মশাল, তাদের দ্বিগুণ আলো পড়ে ফিরবে
আমাদের দুই মনে, এক জোড়া আয়নার ওপর।
মায়াবী নীল আর গোলাপি কোনো সন্ধ্যায় আমরা,
একে অপরকে দেব সুদীর্ঘ বিদায়ভরা
ফোঁপাকান্নার মতন মাত্র এক বিদ্যুচ্চমক;
বহুদিন পর পুরোনা দর্পণ আর মরা অগ্নিশিখা
আবার জ্বালাতে সন্তর্পণে, দরজা ঠেলে,
আসবেন দ্বীনদার, সহাস্যবদন, ফেরেশতাপ্রবর।’
প্রথমে আসি বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ প্রসঙ্গে। তাঁর অনুবাদটিকে ধ্রপদি সৌন্দর্যের মিতবাক অনুবাদ বলাই ভালো। তাঁর ভাষা সংযত, সুরেলা ও ছন্দময়। যেমন ‘কবরের মতো গভীর ডিভানে লুটিয়ে/ মৃদু বাসে ভরা রবে আমাদের শয্যা...’ । এখানে তিনি মূলের ‘বেডস ফুল অব লাইট পারফিউম’-কে ‘মৃদু বাসে ভরা’ হিসেবে অনুবাদ করে অনুভূতিকে সুবাসের দিক থেকে চিহ্নিত করেছেন, তবে অতিরিক্ত অলংকার প্রয়োগ করেননি। ‘দর্পণে প্রতিফলিত যুগ্ম প্রাণের ভাস্বর উদ্ভাসে’—এই পঙ্ক্তিতে তিনি প্রেমিক-প্রেমিকার আত্মিক মিলনকে ‘দর্পণ’ প্রতীকে ধরেছেন, যা বোদলেয়ারের ‘মিরোয়ার ঝ্যুমো’র যথাযথ প্রতিফলন বলা যেতে পারে।
বুদ্ধদেবের অনুবাদে সংযম, শৃঙ্খলা ও রোমান্টিক ব্যঞ্জনা আছে। ‘গোলাপি এবং মায়াবী নীলের সৃষ্টি এক সন্ধ্যায়...’—এই পঙ্ক্তি ইঙ্গিত দেয় এক পরাবাস্তব সন্ধ্যার, যেখানে প্রেম মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। শেষে ‘এক দেবদূত, সুখী ও সবিশ্বাস’—এমন অনুবাদ মূল ফরাসি ‘ফিদেল এ জোয়্যো’র যথাযথ বাংলা বলা চলে। তিনি ধর্মীয় প্রতীকটি রেখে দিয়েছেন, কিন্তু অতিরিক্ত আধ্যাত্মিকতা দেননি।
এখন আসি সলিমুল্লাহ খানের অনুবাদ প্রসঙ্গে। তাঁর অনুবাদে ভাষা যেন আরও জীবন্ত, কথ্য এবং ব্যাখ্যামূলক হয়ে উঠেছে, ‘আমাদের বিছানা হবে হালকা আতরমাখা,/ কবরের মতো গাড়া তাকিয়া আমাদের,...’—এখানে ‘আতরমাখা’ শব্দটি ফরাসি ‘ওদ্যর লেজেয়ার’-এর প্রাণবন্ত অনুবাদ। ‘তাকে তাকে থাকবে সুন্দরতর আকাশের তলে/ ফোটা বিদেশি ফুলের তোড়া।’—এই পঙ্ক্তিতে তিনি মূলের ‘দে সিয়ু প্ল্যু বো’-কে চিত্রায়িত করেছেন, যেখানে সৌন্দর্য এক মায়াময় জগতের ইঙ্গিত। এ ছাড়া তাঁর অনুবাদে নাটকীয় আবেগ ও স্বকীয়তা বিশেষভাবে লক্ষণীয়: ‘বিদায়ভরা ফোঁপাকান্নার মতন মাত্র এক বিদ্যুচ্চমক’—মূলের ‘কোম উঁ লঁ সঁগ্লো, তু চার্জে দ্যাদিউ’-এর বেশ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুবাদ এটি। এখানে অনুভূতি স্পষ্ট, কিছুটা নাটকীয় হলেও অতি মানবিক। শেষ স্তবকে তিনি শেষে বোদলেয়ারের ‘আঁজ ফিদেল এ জোয়্যো’-কে ভাষা দিতে ‘ফেরেশতাপ্রবর’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। বুদ্ধদেব বসু যেখানে ‘দেবদূত’ লিখেছেন। এখানে ‘আঁজ’ শব্দটি যেমন ইংরেজি ‘অ্যাঞ্জেল’-এর কাছাকাছি, অন্যদিকে ‘দেবদূত’-এর পরিবর্তে ক্যাথলিক বিশ্বাস অনুযায়ী ‘ফেরেশতা’ শব্দটি ‘আঁজ’-এর বেশি কাছাকাছি।
ওপরের দুটি অনুবাদ পাশাপাশি রেখে পড়লে মনে হয়, বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদটি বেশি স্বপ্নময়, নান্দনিক ও চিত্রসম্ভব রূপে ফুটে উঠেছে। তাঁর অনুবাদে কবিতাটির প্রতীকী প্রেমমৃত্যুর দৃশ্যকল্প সহজেই ধরা পড়ে। যেমন ‘দেয়ালের তাকে অদ্ভুত ফুলসজ্জা’, ‘চরম দহনে গলিত যুগল হৃদয়’, এসব চিত্রকল্পে দার্শনিক বিষণ্নতা ও প্রেমের আভিজাত্য মিলেমিশে আছে। বুদ্ধদেব বসুর ভাষা এখানে মসৃণ ও ধ্রুপদি।
অন্যদিকে সলিমুল্লাহ খানের অনুবাদে কবিতাটির ভাব অনেক বেশি নাটকীয় ও দার্শনিক। তাঁর অনুবাদে ‘প্রেমিক-প্রেমিকার মৃত্যু’ কেবল কাব্যিক মৃত্যুবোধে সীমাবদ্ধ না থেকে, বরং এক অস্তিত্ববাদী পরিণতির দিকনির্দেশক হয়ে উঠেছে। জনাব খানের শব্দচয়ন যেমন ‘বিদায়ভরা ফোঁপাকান্নার মতন মাত্র এক বিদ্যুচ্চমক’—আমাদের অনুভূতিকে আরও আধুনিক করে তোলে। এখানে মৃত্যু ও প্রেম যতটা না রোমান্টিক, ততোধিক বাস্তব।
বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে যেখানে আবেশ ও সৌন্দর্যের আধিক্য, সেখানে সলিমুল্লাহ খানের অনুবাদে বাস্তবতা ও দার্শনিক টান অনেক বেশি স্পষ্ট। বুদ্ধদেব বসু যেমন বোদলেয়ারের ‘সিম্বোলিস্ট ডেলিকাসি’-কে রক্ষা করেছেন; জনাব খান তেমনই বোদলেয়ারের ‘এক্সিস্টেনশিয়াল ডার্কনেস’-কে প্রকট করে তুলেছেন। একজন যেন ‘পোয়েট-ট্রান্সলেটর’, অন্যজন ‘ফিলোসফার-ট্রান্সলেটর’।
বুদ্ধদেব বসুর ছন্দ সুষম, মিতবাক এবং সংগীতময়। বাক্যরীতিতে কবিত্বের ঘনত্ব বেশি। যেমন ‘মৃদু বাসে ভরা রবে আমাদের শয্যা’র মতো পঙ্ক্তি একেবারেই লিরিক্যাল, যা আমাদের মনে গভীর ভাবকল্প তৈরি করে।
অন্যদিকে জনাব খানের অনুবাদ গদ্যছন্দে হলেও তিনি এটাকে ছন্দময় করে তুলেছেন ভাব ও অনুষঙ্গ দিয়ে। তাঁর ভাষা এখানে স্বতঃস্ফূর্ত ও বাস্তববাদী। যেমন ‘আমাদের বিছানা হবে হালকা আতরমাখা’—এ রকম বাক্যে আছে এক ঘন বাস্তবতা। তাই তাঁর ছন্দে কাব্যিকতা কম থাকলেও ভাবানুভূতির কোনো ঘাটতি নেই।
বুদ্ধদেব বসু কবিতাটির প্রতীকগুলোকে (দর্পণ, মশাল, ফুল, দেবদূত) ফরাসি কাব্যিক ধাঁচেই রেখেছেন। অন্যদিকে সলিমুল্লাহ খানের প্রতীকচয়ন রূপান্তরমূলক, ফলে কবিতাটির যেন সাংস্কৃতিক রূপান্তর ঘটেছে।
সবশেষে বলতে চাই, তাঁদের দুজনার অনুবাদই অনন্য—বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ ধ্রুপদি সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ, আর সলিমুল্লাহ খানের অনুবাদ আধুনিকতাবোধ, বাস্তবতা ও দার্শনিকতাযোগে নতুন মাত্রা পেয়েছে। বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদটি অনেক বেশি সংগীতময় ও ঐতিহ্যনিষ্ঠ; আর সলিমুল্লাহ খানেরটি বেশি ভাবানুগ, চিন্তাশীল ও পুনর্নির্মিত—অর্থাৎ, প্রথমটি পোয়েট্রি অ্যাজ ট্রান্সলেশন, দ্বিতীয়টি ট্রান্সলেশন অ্যাজ পোয়েট্রি।