হাটহাজারীতে তিন দিনে চার লাশ উদ্ধার, জনমনে আতঙ্ক
Published: 14th, November 2025 GMT
চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে তিন দিনের ব্যবধানে চারজনের লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। গত মাসে এই উপজেলায় প্রকাশ্যে তিনটি খুনের ঘটনা ঘটেছিল। পরপর এসব ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। এলাকার নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বাসিন্দারা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
গত সোমবার সকাল থেকে বুধবার রাত পর্যন্ত উপজেলার তিন ইউনিয়ন থেকে লাশ চারটি উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে দুটি ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা ও দুটিতে হত্যা মামলা হয়েছে। পুলিশ জানায়, হাটহাজারীতে সোমবার উদ্ধার হয় দুটি লাশ। তাঁদের পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে একজন তরুণী। মঙ্গলবার সকালে উপজেলার ধলই ইউনিয়নের মুনিয়া পুকুরপাড় এলাকার খাল থেকে এক বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ বুধবার রাতে ফতেয়াবাদ ইউনিয়নের চৌধুরীহাট ঠাণ্ডাছড়ি এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে আরেক বৃদ্ধের লাশ। এ ঘটনায় দুই নারীসহ তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ।
অক্টোবরেও পরপর চার খুনএর আগে গত ৭ অক্টোবর হাটহাজারীর মদুনাঘাট এলাকায় চলন্ত গাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয় বিএনপি কর্মী আবদুল হাকিমকে (৫২)। এর এক সপ্তাহ পর উপজেলার চৌধুরীহাট এলাকায় প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় অপু দাশ (৩০) নামের ছাত্রদলের এক নেতাকে। তিনি উপজেলার চিকনদণ্ডী ইউনিয়ন ছাত্রদল সভাপতি ছিলেন। একই সময়ে ছুরিকাঘাতে আহত হন ছাত্রদলের কর্মী মুহাম্মদ তামিম (৩২)। তিনিও পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ২১ অক্টোবর পৌরসভার পাশে নবম শ্রেণির ছাত্র মুহাম্মদ তানভীরকে (১৫) পিটিয়ে হত্যা করা হয়। স্কুলশিক্ষার্থীদের একটি অংশ এতে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
এক মাসে চারটি লাশ উদ্ধার ও প্রকাশ্যে খুনের ঘটনা মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করছে। অনেকেই মানসিক ট্রমায় ভুগছেন। সামনে নির্বাচন ঘিরে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হতে পারে। কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে সামনে এসব ঘটনা বাড়বে।—লোকমান হাকিম, বাসিন্দা, হাটহাজারী উপজেলানিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগপরপর এসব খুন ও লাশ উদ্ধারের ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এ ধরনের ঘটনা বাড়ার পেছনে পুলিশের দায়সারা ভাব ও যথাযথ বিচার না হওয়াকেই দায়ী করছেন বাসিন্দারা। জানতে চাইলে উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নের প্রবীণ বাসিন্দা লোকমান হাকিম প্রথম আলোকে বলেন, এক মাসে চারটি লাশ উদ্ধার ও প্রকাশ্যে খুনের ঘটনা মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করছে। অনেকেই মানসিক ট্রমায় ভুগছেন। সামনে নির্বাচন ঘিরে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হতে পারে। কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে সামনে এসব ঘটনা বাড়বে।
পুলিশের দাবি, এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জানতে চাইলে হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনজুর কাদের ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি ঘটনায় তাৎক্ষণিক আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অজ্ঞাতনামা লাশের পরিচয় শনাক্ত ও ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে পুলিশ কাজ করছে।
হাটহাজারী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তারেক আজিজ বলেন, এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। একটি ঘটনার সঙ্গে আরেকটি ঘটনার যোগসূত্র নেই। সাম্প্রতিক চারটি ঘটনার দুটি হত্যা মামলা ও দুটি অপমৃত্যু মামলা হিসেবে নেওয়া হয়েছে। অপমৃত্যু দুটিতে প্রাথমিকভাবে ধারণা পাওয়া গেছে—একজন পানিতে ডুবে এবং আরেকজন গাড়ির ধাক্কায় মারা গেছেন। সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। পুলিশও মাঠে সক্রিয় রয়েছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ল শ উদ ধ র এসব ঘটন প রক শ য পর স থ ত উপজ ল র ন র ঘটন ঘটন র আতঙ ক ঘটন য়
এছাড়াও পড়ুন:
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বাড়তি নজর দিন
চট্টগ্রাম ও ঢাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা এবং বাসে আগুন ও ককটেল বিস্ফোরণকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে জনমনে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। একদিকে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা ঘিরে খুনোখুনি, অন্যদিকে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের অনলাইনে ঘোষিত কর্মসূচি কেন্দ্র করে এমন উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা রাস্তার পাশে জ্বালানি তেল বিক্রি কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখা এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের কথা বললেও তাতে কতটা আস্থা রাখা যাবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
গত ১৪ মাসে সরকার বারবার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা গেছে। ‘অপারেশন ডেভিল হান্টের’ মতো কিছু জনতুষ্টিবাদী পদক্ষেপ নেওয়া হলেও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তা কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আগে-পরে ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা-ব্যবস্থার সুযোগে অনেক অপরাধী জেল থেকে পালিয়ে যান, এর মধ্যে জঙ্গি ও শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও ছিলেন। ভঙ্গুর প্রশাসনিক ব্যবস্থার সুযোগে জামিনেও অনেকে বের হয়ে যান। তাঁদের অনেককেই আর গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। এ সময় থানা ও কারাগার থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদও খোয়া যায়, যার অনেকটাই উদ্ধার করা যায়নি।
এ ধরনের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও খোয়া যাওয়া অস্ত্রের কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হতে পারে বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা নানা সময়ে সরকারকে সতর্ক করেছেন। তা সত্ত্বেও অস্ত্র উদ্ধার ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো অভিযান দেখা যায়নি। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জেল থেকে বের হওয়ার পর অপরাধজগতে আবারও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন, তা নিয়েও প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রায়ই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এসব সন্ত্রাসী খুন, চাঁদাবাজি, অপহরণের মতো ভয়াবহ অপরাধে যে জড়িত হয়ে পড়েছেন, তারও সুনির্দিষ্ট তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বরাতে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এরপরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি শীর্ষ সন্ত্রাসী ও খোয়া যাওয়া অস্ত্র উদ্ধারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাদের সদিচ্ছা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে।
৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর নির্বাচনী জনসংযোগে অংশ নেওয়া সারোয়ার হোসেনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একসময় তালিকাভুক্ত ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ সাজ্জাত আলীর অনুসারী সারোয়ারের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, অস্ত্র, হত্যাসহ ১৫টি মামলা ছিল। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে সোমবার পুরান ঢাকায় মোটরসাইকেলে করে আসা অস্ত্রধারীরা এলোপাতাড়ি গুলি করে পুলিশের তালিকায় থাকা ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ তারিক সাইফকে হত্যা করে। পুলিশের ধারণা, আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের অনুসারীরা ঢাকার অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ নিতে পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
দুটি হত্যাকাণ্ডের ভিডিওই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। একের পর এ ধরনের হত্যাকাণ্ড জনমনে যেমন আতঙ্ক তৈরি করে, একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি করে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ দলের অনলাইনে ঘোষিত কর্মসূচি ঘিরে ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা নিলেও সোমবার কয়েকটি স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ এবং বাস ও প্রাইভেট কারে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় একটি বাসে আগুন দেওয়া হলে এক ব্যক্তি পুড়ে মারা যান।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং ককটেল হামলা ও যানবাহনে আগুন দেওয়ার মতো নাশকতামূলক ঘটনায় জনমনে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, তা নিরসনের দায়িত্ব সরকারের। বর্তমান বাস্তবতায় জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নাশকতা বন্ধে সরকারের বাড়তি মনোযোগ জরুরি। এটা শুধু মুখে বলার বিষয় নয়, নাগরিকেরা এ ব্যাপারে কার্যকর ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখতে চান।