পরিবেশ বিপর্যয় কীভাবে মানুষের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে, তা আমরা প্রতিদিন রাস্তায় বের হলে বায়ুদূষণ থেকেই টের পাই। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বড় দুর্যোগ তো রয়েছেই। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, অস্বাভাবিক তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত, ভয়াবহ বন্যা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি থেকে শুরু করে নানা আঙ্গিকে মানুষের অস্তিত্বসংকটের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তাই প্রথম আলো পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে সব সময় সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে।

এক বছর ধরে প্রথম আলো আরও বিস্তৃত পরিসরে পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে কাজ শুরু করেছে। এখন আর শুধু ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রতিবেদন নয়, পরিবেশবিষয়ক সাংবাদিকতাকে নিয়মিত করার লক্ষ্যে সংবাদপত্রটি নিয়েছে এক প্রশংসনীয় উদ্যোগ। প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার প্রথম পাতা থেকে শুরু হয়ে এ বিষয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এক পাতাজুড়ে ছাপা হচ্ছে। এই উদ্যোগ থেকে পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে প্রথম আলোর ভূমিকার বিষয়টি সামনে আসে।

বিগত এক বছরে প্রথম আলোর বিশেষ এই উদ্যোগে ৩৪টি বড় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশে প্রথম আলোর সাংবাদিকেরা এই কাজে যুক্ত হয়েছেন। প্রথম আলোর সারা দেশের প্রতিনিধিরা নিজেরাই উৎসাহী হয়ে পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে তাঁদের আগ্রহের কথা জানিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পরিকল্পনা পাঠাচ্ছেন। এর বাইরে নিয়মিত জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ–সংক্রান্ত প্রতিবেদনও প্রকাশিত হচ্ছে।

এসব প্রতিবেদনে আমরা তুলে আনতে চেষ্টা করেছি জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে মানুষের জীবনের ওপর ভয়াবহ প্রভাবের নানা দিক। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা ফায়দা লুটছে। স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতির মাধ্যমে সংকটে থাকা দরিদ্র মানুষকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। মুনাফার লোভে বন-জঙ্গল, নদী-খাল-বিল ও প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এসব ঘটনা তুলে আনার সময় ভুক্তভোগী মানুষেরা তাঁদের দুর্দশার কথা বলার পাশাপাশি বলেছেন, সাংবাদিকেরা গেলে তাঁরা একটু ভরসা পান। জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে যাঁরা অন্যায়-অনাচার করছেন, তাঁরা সাময়িকভাবে হলেও ভয় পান। সন্দেহ নেই, এর ফলে আমরাও অনেক অনুপ্রাণিত হয়েছি, নতুন কাজ ও উদ্যোগ নিতে সাহস পেয়েছি।

সব সময় যে পরিকল্পনামাফিক কাজ হয়েছে, এমন নয়। হয়তো দেখা গেছে একটা বিষয় নিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করে আমরা মাঠে গিয়েছি। গিয়ে দেখা গেছে নানা দিক থেকে যে ধরনের তথ্য-উপাত্ত পেয়েছি, পরিস্থিতি তার চেয়েও খারাপ বা চিত্রটাই ভিন্ন। এমনও হয়েছে একটা পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে যাওয়ার পর সম্পূর্ণ নতুন ও ভিন্ন একটি প্রতিবেদনের রসদ পেয়েছি।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে বলা হয় পৃথিবীর অভিযোজন রাজধানী। অর্থাৎ মানুষ এখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারদর্শী। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সব হারিয়ে আবার নতুন করে শুরু করার সাহস ও সহিষ্ণুতার এসব গল্প আমরা পরম যত্ন ও আন্তরিকতার সঙ্গে তুলে আনার চেষ্টা করেছি।

এ ছাড়া নতুন বৈজ্ঞানিক ফলাফলের ভিত্তিতে আমরা নির্দিষ্ট বিরতিতে পরিবেশ নিয়ে প্রতিবেদন ছাপিয়ে যাচ্ছি। দেশের তিন দ্বীপের বিশাল ভূখণ্ড এক হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির সম্পর্ক, ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার বৈজ্ঞানিক সতর্কতা, ইলিশের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতিতে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি ইত্যাদি বহু বৈজ্ঞানিক ফলাফলভিত্তিক প্রতিবেদন ছাপিয়ে মানুষকে সচেতন করা এবং নীতিনির্ধারকদের নজরে আনার চেষ্টা আমাদের ছিল, সামনেও তা চলমান থাকবে।

আমাদের এই উদ্যোগের বেশ কিছু ইতিবাচক প্রভাবও পড়েছে। কক্সবাজারের খুরুশকুলে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য নির্মিত বহু ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল প্রভাবশালীদের নামে। এ নিয়ে প্রথম আলোতে প্রতিবেদন প্রকাশের পর পুরো বরাদ্দই বাতিল হয়েছে।

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সুন্দরবন হিসেবে পরিচিত চকরিয়ায় চিংড়ি চাষের নামে বন ধ্বংসের প্রতিবেদনের ফলে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। বন গবেষকেরা এই বন আবারও উজ্জীবিত করতে পারবেন বলে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছেন। মহেশখালীর প্যারাবন কেটে চিংড়িঘের করা নিয়ে প্রতিবেদনের পরদিনই স্থানীয় প্রশাসন নৌবাহিনীর সহায়তায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বনের জায়গা পুনরুদ্ধার করেছে। টাঙ্গুয়ার হাওরে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের কারণে জীববৈচিত্র্যের হুমকি নিয়ে প্রতিবেদনের পর প্রশাসন থেকে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

গত এক বছরে প্রথম আলো পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে এমন আরও বেশ কিছু প্রভাব সৃষ্টিকারী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেমন বলা যায় সন্দ্বীপের কৃষির দুরবস্থা নিয়ে দুই কিস্তির প্রতিবেদনের পর কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান সরেজমিন পরিদর্শন করেন। কৃষি সেচের সুবিধার্থে তাঁরা ৭টি পুকুর ও ৩০ কিলোমিটার খাল খনন করার প্রতিশ্রুতি দেন। এর মধ্যে ৫টি পুকুর আর দেড় কিলোমিটারের মতো খাল ইতিমধ্যে খনন করা হয়েছে।

সবশেষে বলব, প্রথম আলোর সাংবাদিকতায় তারুণ্য সব সময় বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। আমরা জানি, পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে গ্রেটা থুনবার্গসহ সারা দুনিয়ার তরুণদের মধ্যে একধরনের সচেতনতা, আন্দোলন শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও তরুণদের মধ্যে এ বিষয়ে কর্মতৎপরতা লক্ষ করা যায়। পরিবেশ-জলবায়ুবিষয়ক সাংবাদিকতার মাধ্যমে তরুণদের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটাতে প্রথম আলো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

খলিলউল্লাহ্: জলবায়ু প্রকল্প ব্যবস্থাপক, প্রথম আলো

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রথম আল র প রক শ ব দ কত উদ য গ

এছাড়াও পড়ুন:

ছাত্রদের যৌন হয়রানির অভিযোগে ঢাবি শিক্ষক কারাগারে

ছাত্রদের যৌন হয়রানি ও মারধরের অভিযোগে করা মিরপুর মডেল থানার মামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. এরশাদ হালিমকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত।

শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাকে হাজির করে পুলিশ। এরপর মামলার সুষ্ঠু তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসামিকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা মিরপুর মডেল থানার এসআই মেহেদী হাসান মিলন।

আরো পড়ুন:

ঢাবিতে ‘আর্ট ফর ইক্যুয়ালিট` ওয়ার্কশপ

ঢাবি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ভর্তির আবেদন ফি জমা দেওয়ার সময় বৃদ্ধি

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী শ্যামল কুমার রায় জামিনের আবেদন করেন। এ সময় রাষ্ট্র পক্ষ থেকে জামিনের বিরোধিতা করা হয়। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুব আলম জামিনের আবেদন নাকচ করে এ আদেশ দেন।

এর আগে গত ১৩ নভেম্বর রাত প্রায় ১১টার দিকে শেওড়াপাড়ায় তার বাসায় অভিযান চালিয়ে মিরপুর মডেল থানার পুলিশ তাকে হেফাজতে নেয়।

মামলার অভিযোগ বলা হয়, অধ্যাপক শিক্ষার্থীদের তার বাসায় ডেকে নিয়ে রুমের আলো নিভিয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে অনাকাঙ্ক্ষিত শারীরিক স্পর্শ ও চাপ সৃষ্টি করতেন। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, পরীক্ষায় সহায়তার আশ্বাস দিয়ে তাকে বাসায় ডেকে শারীরিকভাবে আক্রমণাত্মক আচরণ করা হতো। এছাড়া ঘটনাগুলো গোপন রাখার জন্য ভয়ভীতি প্রদানসহ মারধর করেন।

এ অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) রসায়ন বিভাগের এক ছাত্র মিরপুর মডেল থানায় বাদী হয়ে মামলা করেন।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, “বৃহস্পতিবার ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে একদল শিক্ষার্থী অভিযোগ জানিয়েছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে তাকে সব একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দিয়েছি। আর অভিযোগটি যৌন নিপীড়ন সেলে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

ঢাকা/সৌরভ/সাইফ

সম্পর্কিত নিবন্ধ