বঙ্গোপসাগর থেকে গত তিন বছর বাংলাদেশের মাছ আহরণ ধারাবাহিকভাবে কমছে। ব্যাপকভাবে কমেছে সামুদ্রিক ইলিশ, কাঁকড়া ও চিংড়ি আহরণ। সাগর থেকে মাছ ধরার পরিমাণ কমতে থাকায় সার্বিকভাবে দেশের মাছের জোগানের গতিও কমে গেছে। যদিও ভিন্ন চিত্র প্রতিবেশী দেশগুলোর। বছর বছর সাগর থেকে মাছ ধরা বাড়িয়ে মাছ আহরণে বিশ্বের শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে ভারত। এমনকি গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত মিয়ানমারেও প্রতিবছর বাড়ছে সামুদ্রিক মাছ আহরণ।

সাগর থেকে বাংলাদেশের মাছ আহরণ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও ঘূর্ণিঝড়কে দায়ী করছেন এ দেশের মৎস্য কর্মকর্তারা। তা ছাড়া অতিরিক্ত মাছ আহরণের কারণেও মাছের মজুত কমে আসছে বলে জানান তাঁরা।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোট সামুদ্রিক মাছ আহরণের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৬ হাজার টন। পরের অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৭৯ হাজার টনে। সর্বশেষ গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা আরও কমে দাঁড়ায় ৬ লাখ ২৮ হাজার টনে। অর্থাৎ ২০২২–২৩ অর্থবছরের চেয়ে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে সাগর থেকে মাছ আহরণ প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ কমেছে। গত জুনে শেষ হওয়া ২০২৪–২৫ অর্থবছরে এই পরিমাণ আরও কমেছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে এখনো অনুষ্ঠানিকভাবে গত অর্থবছরের তথ্য প্রকাশ করেনি সংস্থাটি।

সমুদ্র খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশ কয়েক বছর ধরে সাগরে অতিরিক্ত মাছ আহরণের কারণে মাছের মজুত কমে গেছে। এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের সামুদ্রিক শাখার সহকারী পরিচালক মো.

আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ২০ বছর আগেও সাগরে বাণিজ্যিক ট্রলারের সংখ্যা ছিল এক শর কম। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬৫টিতে। তিনি জানান, সাগরের ৪০ মিটারের ভেতরে মাছ না ধরার কথা থাকলেও এসব নৌযান তা মানছে না। আবার ছোট নৌযানের সংখ্যা এখন ২৯ হাজার ছাড়িয়েছে। এসব নৌযানেও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, যা তাদের ব্যবহার করার কথা নয়। পাশাপাশি অবৈধ জালও ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি উপকূলের ৫ থেকে ১০ মিটারের মধ্যে মাছ ধরা হচ্ছে। এতে ডিম থেকে নতুন পোনা তৈরির সুযোগ নষ্ট হচ্ছে।

বিশ্বে সমুদ্র থেকে মাছ আহরণে নেতৃত্ব দিচ্ছে চীন। এ ছাড়া শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে ভারত ৬ষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে। ভারতের মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১–২২ সালে সাগর থেকে দেশটির মাছ আহরণের পরিমাণ ছিল ৪১ লাখ ২৭ হাজার টন, যা আগের বছরের তুলনায় ১৮ শতাংশ বেশি। সর্বশেষ ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ৪৪ লাখ ৯৫ হাজার টন মাছ আহরণ করেছে ভারত।

মিয়ানমারের মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে ২০২০-২১ সালে সাগর থেকে মাছ আহরণের পরিমাণ ছিল ৩২ লাখ ৯৫ হাজার। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই পরিমাণ আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪ লাখ ১৪ হাজার টনে। অর্থাৎ গৃহযুদ্ধের মধ্যেও দেশটির সাগর থেকে মাছ আহরণ বাড়ছে।

এদিকে বাংলাদেশে সাগরে সবচেয়ে বেশি আহরণ কমছে ইলিশ ও চিংড়ির। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে সাগর থেকে ইলিশ আহরণ তার আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ কমেছে। আর চিংড়ির আহরণ কমেছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। কাঁকড়া আহরণও কমেছে ১৬ শতাংশের বেশি।

সাগর থেকে মাছ আহরণ কমে যাওয়া এবং এ বিষয়ে করণীয় প্রসঙ্গে সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের উপপরিচালক মোহাম্মদ শরিফুল আজম প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৯ সাল থেকেই চিংড়ি আহরণ কমে যাওয়ার তথ্য পাচ্ছিলাম। তাই সামুদ্রিক মৎস্য বিধিমালায় চিংড়ি ধরার ট্রলারের লাইসেন্স আর না বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করি। ২০২৮ সাল পর্যন্ত এসব ট্রলাররের লাইসেন্স নবায়ন করা হবে না।’

সাগর থেকে মাছ আহরণ বাড়াতে হলে বঙ্গোপসাগরের নিয়ন্ত্রণহীন মৎস্য আহরণকে নজরদারির মধ্যে আনার কথা বলছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. জিয়া হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে পাঁচটি ট্রলারে স্যাটেলাইট ট্রেকার বসিয়ে নজরদারি করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সব ট্রলার ডিজিটাল নজরদারির আওতায় আনার পরামর্শ তাঁর।

এদিকে মাছ আহরণ কমতে থাকায় সাগরের ওপর নির্ভরশীল জেলেরাও বিপাকে পড়ছেন। ঋণের দাদনের টাকা শোধ করে লাভের অঙ্ক মিলছে না তাঁদের। কক্সবাজারে পাঁচ হাজারের বেশি মাছ ধরার কাঠের নৌযান আছে। এসব নৌকায় এখন মাছ ধরা পড়ছে কম। কক্সবাজার ফিশিংবোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, টানা ছয় থেকে সাত মাস তেমন মাছ ধরা পড়ছে না। কয়েক বছর ধরেই মাছ কম পাওয়া যাচ্ছে। এক সপ্তাহের জন্য সাগরে গেলে দুই থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। কিন্তু মাছ কম পাওয়ায় দাদন পরিশোধ করাই এখন কষ্টকর হয়ে গেছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য অধিদপ্তরের ব্লু ইকোনমি সেলের পরিচালক মো. সাজদার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সাগরে এখন ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। সাগরের তাপমাত্রাও বেড়ে গেছে। তা ছাড়া জেলিফিশের প্রকোপ বেড়েছে। আর অতিরিক্ত মৎস্য আহরণের কারণে মাছের মজুত কমছে। তাই মাছ আহরণ আরও কমিয়ে আনতে হবে।

এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির এক সভায় গণমাধ্যমে সঙ্গে কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি বলেন, ‘ভারতের জেলেরা যাতে বাংলাদেশে এসে মাছ ধরতে না পারেন, সেটা আমাদের বন্ধ করতে হবে।’

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে সারা বিশ্বে সাগর থেকে ৭ কোটি ৯৭ লাখ টন মাছ ধরা হয়। যার মধ্যে অর্ধেক মাছ আহরণ করেছে এশিয়ার দেশগুলো। ওই বছর বিশ্বের মোট সামুদ্রিক মাছের ১৪ দশমিক ৮ শতাংশই আহরণ করেছিল চীন, যার পরিমাণ ১ কোটি ১৮ লাখ ১৯ হাজার টন। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়া ওই বছর আহরণ করেছে ৬৮ লাখ ৪৩ হাজার টন মাছ। আর ভারত আহরণ করেছে ৩৫ লাখ ৯৭ হাজার টন। যেখানে বাংলাদেশের হিস্যা ছিল বৈশ্বিক মাছ আহরণের মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রথম আল ক ম ছ আহরণ র ক ম ছ আহরণ র চ লক ম র পর ম ণ হ জ র টন র মৎস য বছর ব বছর র

এছাড়াও পড়ুন:

অর্থনীতিতে তিনটি চ্যালেঞ্জ আছে: আইএমএফের বিবৃতি

অর্থনীতিতে এখনো তিনটি চ্যালেঞ্জ আছে বলে মনে করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এগুলো হলো দুর্বল কর রাজস্ব, আর্থিক খাতের দুর্বলতা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি।

আইএমএফ বলেছে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা ও সংস্কারের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তবে দুর্বল কর রাজস্ব, আর্থিক খাতের দুর্বলতা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অর্থনীতি এখনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

আইএমএফ আজ সন্ধ্যায় একটি বিবৃতি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। সেখানে এসব কথা বলা হয়েছে।

গত ২৯ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে সফর করেছে। এই দলের নেতৃত্ব দেন ক্রিস পাপাজর্জিও। সফরকালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও আর্থিক নীতি নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিনিধিদলটি।

আইএমএফ আরও বলেছে, রাজস্ব ও আর্থিক খাতের সমস্যা মোকাবিলায় সাহসী নীতি গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। যাতে টেকসই আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করে শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার করা যায়। ঝুঁকিও এখনো প্রবল। বিশেষ করে যদি নীতি প্রণয়নে বিলম্ব হয় কিংবা অপর্যাপ্ত নীতি গ্রহণ করা হয়, তাহলে ঝুঁকি থাকবে।

আইএমএফ মনে করে, মধ্য মেয়াদে শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী করা, যুব বেকারত্ব হ্রাস এবং অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে ব্যাপক কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন, যা বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনাকে বাড়াবে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।

আইএমএফের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ সরকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় প্রশংসনীয় অগ্রগতি করেছে। তবে দুর্বল কর রাজস্ব এবং আর্থিক খাতের মূলধন ঘাটতির কারণে এখনো আর্থিক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। কারণ, গত বছরের গণ-অভ্যুত্থানের কারণে উৎপাদনে বিঘ্ন হয়। অন্যদিক মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্ক থেকে ৮ শতাংশে নেমেছে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কর ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। যাতে সহজ, ন্যায্য ও কার্যকর রাজস্ব পরিবেশ গড়ে ওঠে এবং আর্থিক খাতের দুর্বলতাগুলো সমাধান করা যায়। এসব নীতি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে ২০২৫-২৬ ও ২০২৬-২৭ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রায় ৫ শতাংশে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। ২০২৬-২০২৭ অর্থবছরে সাড়ে ৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে।

ব্যাংক খাত সংস্কার জরুরি

ব্যাংক খাত নিয়ে আইএমএফ বলেছে, ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধানে আর্থিক সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। দুর্বল ব্যাংকগুলো চিহ্নিত করে একটি বিশ্বাসযোগ্য কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। সেখানে মূলধন ঘাটতি, প্রয়োজনীয় সরকারি সহায়তা, আইনি কাঠামোয় পুনর্গঠন এবং অর্থের উৎস নির্ধারণ করা থাকবে। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সম্পদ মান পর্যালোচনা প্রয়োজন। ব্যাংক পরিচালনা, স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা এবং খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া উন্নয়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

আইএমএফের সহায়তা কর্মসূচির পঞ্চম পর্যালোচনা আলোচনা ভবিষ্যতেও চলবে বলে বিবৃতিতে জানানো হয়। বাংলাদেশের জনগণের জন্য টেকসই সামষ্টিক স্থিতিশীলতা ও শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার প্রয়াসে আইএমএফ অংশীদার হিসেবে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবে বলে জানানো হয়েছে।

আইএমএফের দলটি সফরকালে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার, এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান প্রমুখ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পে স্কেল হচ্ছে না, কী হওয়া দরকার ছিল
  • অর্থনীতিতে তিনটি চ্যালেঞ্জ আছে: আইএমএফের বিবৃতি
  • পেঁয়াজের দাম কমেনি, কেজিপ্রতি দাম ১০০–১২০ টাকা
  • নারী শ্রমিকের প্রতি বৈষম্য আর কত দিন
  • ফুটেজ প্রকাশ শুধু অনৈতিক নয়, অপেশাদার আচরণের চূড়ান্ত নিদর্শন: শাবনূর
  • যুবককে দুবাই নিয়ে বিক্রি, বরিশালে ২ জনের যাবজ্জীবন
  • শর্ষের চাহিদা বাড়ায় তিন বছরে উৎপাদন বেড়ে দ্বিগুণ
  • তিন মাসে ৩৮ কোটি টাকা মুনাফা এনভয় টেক্সটাইলের