হাঁসের খামারি মনি বেগমের দিনবদলের গল্প
Published: 2nd, December 2025 GMT
ভোর হলে হাঁসের কোলাহলে ঘুম ভাঙে শেরপুরের মনি বেগমের (৩৭)। ঘুমচোখে দ্রুত দরজা খুলে ছোট্ট ঘরের মেঝেতে চোখ পড়তেই দেখা যায় সারি সারি ডিম। ডিম সংগ্রহ দিয়েই শুরু হয় তাঁর দিনের কর্মযজ্ঞ।
শেরপুরের নকলা উপজেলার ধনাকুশা গ্রামে ভাইয়ের বাড়ির আঙিনায় মনি বেগমের ছোট এই খামারে এখন রয়েছে প্রায় ৫০০ হাঁস। প্রতিদিন ৯০-১০০টি ডিম সংগ্রহ করেন খামার থেকে। হাঁসের খাবার, ওষুধ ও খামারের অন্যান্য খরচ বাদ দিয়েও মাসে ৪০-৫০ হাজার টাকা আয় হয় তাঁর।
মনি বেগমের মতো শেরপুরের নালিতাবাড়ী ও নকলা উপজেলায় অবহেলিত, তালাকপ্রাপ্ত, স্বামী মারা যাওয়া ও স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়া ৭৫৬ জন নারীর জীবনে স্বপ্ন ভাঙা থেকে স্বপ্ন গড়ার কাজ করছে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)। নারীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে গরু-ছাগল পালন, ফুচকা তৈরি, দরজি, চা–দোকান, মুদিদোকান, কাঁথা সেলাই, হাঁস-মুরগি ও কবুতর পালন করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
২০০৫ সালে নকলা উপজেলার অষ্টধর গ্রামের আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে বিয়ে হয় মনি বেগমের। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। কিন্তু ২০১৩ সালে ভেঙে যায় সংসার। দুই সন্তান নিয়ে ফিরে আসেন বাবার বাড়িতে। তখনই শুরু হয় তাঁর টিকে থাকার কঠিন লড়াই।
সন্তানদের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিতে মনির অন্য কোনো পথ ছিল না। তাই ছেলেমেয়েকে মায়ের কাছে রেখে ঢাকায় রওনা দেন কাজের সন্ধানে। অনেক ঘুরে অবশেষে আশুলিয়ার জিরানী বাজারের একটি পোশাক কারখানার কোয়ালিটি বিভাগের সহকারী হিসেবে চাকরি পান। সাত বছর টানা আট ঘণ্টা দাঁড়িয়ে কাজ করেছেন তিনি। নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছিলেন ঠিকই, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতায় চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। ২০২০ সালে ফিরে আসেন গ্রামে—ভাঙা স্বপ্ন, ক্লান্ত শরীর, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে। কিছুটা সুস্থ হয়ে নতুন করে ভাবতে থাকেন, কী করবেন। ঠিক তখন জানতে পারেন, ইউএনডিপির ‘স্বপ্ন পূরণ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’-তে জীবনদক্ষতা ও বাণিজ্যিক হাঁস পালনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সুযোগটি হাতছাড়া করেননি তিনি। দুই দফায় ৯ দিনের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
চাকরির সঞ্চয় থেকে ৫০ হাজার টাকা ও ইউএনডিপির সহায়তা ৫ হাজার টাকায় কেনেন ১০০টি ডিম পাড়া হাঁস। ভাইয়ের বাড়ির আঙিনায় বানিয়ে ফেলেন ছোট একটি খামার। ডিম বিক্রির লাভ থেকে আবার বিনিয়োগ করতে থাকেন। প্রতিদিন হাঁসের খাবার দেওয়া, পানি পরিবর্তন, সন্ধ্যায় ঘরে তোলা—সব কাজ একাই সামলান। এ পরিশ্রমই আজ তাঁকে স্বাবলম্বী করেছে। তাঁর বড় ছেলে এখন একটি কাজে যুক্ত হয়েছেন। মেয়েও স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়ে। বসতভিটা না থাকলেও নিজের গল্প আর অর্জনে আজ তিনি গর্বিত ও আত্মবিশ্বাসী। তিনি বলেন, নিজের উপার্জনে চলতে পারলে পরিবারও সম্মান করে, সমাজও মূল্য দেয়। ছোট এই খামারকে বড় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে চান তিনি। সমাজের অবহেলিত ও প্রতিবন্ধী নারীদের কাজের সুযোগ দিতে চান তাঁর খামারে।
প্রতিদিন খামার থেকে ৯০-১০০টি ডিম সংগ্রহ করা হয়.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব গম র
এছাড়াও পড়ুন:
জাল বেচে জাহাজের মালিক রবিউল
সমুদ্রের অবিরাম গর্জনের ভেতর দাঁড়িয়ে তরুণ রবিউল ইসলাম তখনো বুঝতে পারেননি—এই ঢেউ একদিন তাঁর জীবনের দিকটাই পাল্টে দেবে। একসময় গভীর সাগরের জাহাজে নাবিক ছিলেন তিনি। টানা জাল ওঠানো-নামানোর সময় শরীর ভিজে যেত, হাতের চামড়া উঠে যেত। কিন্তু জালের সঙ্গে অদ্ভুত এক টান তৈরি হয়েছিল। সেই টানই পরে তাঁকে ‘জালের বিশেষজ্ঞ’ বানায়। আর এখন সেই জাল বিক্রি করেই কিনেছেন আস্ত এক গভীর সমুদ্রগামী মৎস্য জাহাজ।
চলতি বছরের মে মাসে রবিউল মাছ ধরার জাহাজটি কিনেছেন। এটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ মিটার, প্রস্থ ৮ মিটার। অর্থাৎ লম্বায় এটি ১২-১৩ তলা ভবনের সমান। জাহাজটি নির্মিত হয়েছে চীনে, তবে কেনা হয়েছে দেশের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে। এই জাহাজে শতাধিক প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ আহরণ করা হয়; কাজ করেন ৪৫ জন কর্মী।
কীভাবে নাবিক থেকে জাহাজমালিক—এই গল্পের শুরুতে ফিরে যেতে হয় ২০০৬ সালে। ওই বছর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী থেকে চট্টগ্রামে ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে এলেন রবিউল। ভাই তখন মাছ ধরার জাহাজে চাকরি করেন। একদিন তাঁর সঙ্গে বেড়াতে গেলেন সাগরে।
সেই প্রথম সমুদ্রদর্শন। জলরাশির গর্জন, হিমেল বাতাস আর অজানা এক টানের ভেতর পড়ে গেলেন তিনি। একই বছর ভাইয়ের সুবাদে ‘এফভি জারান’ জাহাজে চাকরি হয়ে যায় তাঁর। কাজ ছিল জাল দেখাশোনা।
জালের সুই-সুতা থেকে দড়ির টান, কোন নকশায় কোন ফাঁস—এসব তিনি যেন চোখ বুজেই বুঝে ফেলতেন। জাল পানিতে কীভাবে খুলে যায়, কীভাবে তলায় আচরণ করে—এসব নিয়ে তাঁর কৌতূহল বাড়তেই থাকে।
২০০৮ সালের দিকে একটি কোম্পানিতে ‘নেট টেকনিশিয়ান’ হিসেবে চাকরি পান। শুরুতে শুধু মেরামত করলেও কয়েক মাসের মধ্যেই নতুন নকশা ও সংযোজনের দায়িত্ব তাঁর হাতে আসে। জালের কারিগরিতে তখনই খুলে যায় এক নতুন পথ।
সেই প্রথম সমুদ্রদর্শন। জলরাশির গর্জন, হিমেল বাতাস আর অজানা এক টানের ভেতর পড়ে গেলেন তিনি। একই বছর ভাইয়ের সুবাদে ‘এফভি জারান’ জাহাজে চাকরি হয়ে যায় তাঁর। কাজ ছিল জাল দেখাশোনা।যেভাবে ‘উদ্যোক্তা’ রবিউল২০১২ সাল। চাকরি করে হাতে সামান্য কিছু টাকা জমেছে। রবিউল সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজেই কারখানা দেবেন। এরপর কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে ইছানগর মৎস্য বন্দরের এক কোণে ছাউনি ও গুদাম ভাড়া নেন। প্রতিষ্ঠানের নাম দেন—রবিউল মডার্ন ট্রল লিমিটেড। শুরুটা ছিল কঠিন। নকশা, কাটা, সংযোজন—সবটুকুই করতেন একা হাতে।
জাহাজের ইঞ্জিনের অশ্বশক্তি, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ, পানি কত গভীরে ঢুকবে, সব হিসাব করে তবেই শুরু হয় নকশা। এরপর বিদেশ থেকে আনা ফেব্রিকস কাটেন ২২ ধরনের সরঞ্জাম ব্যবহার করে। একটি পরিপূর্ণ ট্রল (টানা জাল) নেট তৈরি হতে সময় লাগে এক থেকে দুই সপ্তাহ। দাম পড়ে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা। দৈর্ঘ্য ৪০৫ থেকে ৪৮০ ফুট। বছরে তিনি অন্তত ১০০টি নতুন জাল তৈরি করেন, মেরামত করেন আরও ৩০০টির মতো।
গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রাম শহরের সদরঘাট প্রান্ত থেকে নৌকায় নদী পেরিয়ে তাঁর কারখানায় গিয়ে দেখা গেল, ব্যস্ততা তুঙ্গে। কেউ জাল বুনছেন, কেউ ভাঁজ করছেন। জাহাজমালিকদের প্রতিনিধিরা আসছেন জাল নিতে। রবিউল নিজে আঙুলে মাপ নিচ্ছেন, দড়ির টান ঠিক করছেন। প্রতিটি জাল তুলে দিচ্ছেন সাবধানে।
এক ক্রেতা বললেন, ‘রবিউলের নকশার জাল পানিতে গতি পায় ভালো। জালগুলো চওড়া হয় বেশি, আবার হালকাও। ফলে মাছ বেশি ধরা পড়ে, ইঞ্জিনে চাপও কম পড়ে।’
বিদেশ থেকে আনা ফেব্রিকস কাটেন ২২ ধরনের সরঞ্জাম ব্যবহার করে। একটি পরিপূর্ণ ট্রল (টানা জাল) নেট তৈরি হতে সময় লাগে এক থেকে দুই সপ্তাহ। দাম পড়ে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা। দৈর্ঘ্য ৪০৫ থেকে ৪৮০ ফুট। বছরে তিনি অন্তত ১০০টি নতুন জাল তৈরি করেন, মেরামত করেন আরও ৩০০টির মতো।রবিউল ইসলামের জাহাজ এফ ভি স্পিড-২