আমরা আত্মাকে ডেকেছিলাম।
পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর হাতে বন্দী ঢাকার অসহায় মানুষ আমরা।
ওরা ২৫ মার্চ রাতে অতর্কিত আক্রমণে আমাদের ঘেরাও করে ফেলল। ট্যাংক, কামান আর মেশিনগানে ওরা ঢাকার বুকে সে রাতে রাজারবাগ পুলিশ ঘাঁটিতে, পিলখানায়, ইকবাল হল (জহুরুল হক হল) আর জগন্নাথ হলে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করল।
পুরো ২৬ তারিখ ওরা সান্ধ্য আইন জারি রেখে চালাল হত্যালীলা। ২৭ মার্চ কয়েক ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য আইন তুলে নিতেই হাজার নয়, প্রায় এক লাখ অসহায় মানুষ কাপড়চোপড়ের একটি করে পুঁটুলি নিয়ে অবোধ শিশুদের কোলে, কাঁখে, মাথায় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল ঢাকা শহর ছাড়ার জন্য। সন্ধ্যা হয়–হয়, তবু অসহায় ভয়ার্ত মানুষের বিরাম নেই। বুদ্ধি দিয়ে খুঁজে পেলাম না, কোথায় যাবে ওরা? কেমন করেই বা যাবে? হানাদার বাহিনী বিনা অজুহাতে গুলি করছে, আগুন দিচ্ছে।
২৬ তারিখ বিকেলে মতিঝিল কলোনির বাসা থেকে দেখলাম, দক্ষিণ দিকে ঊর্ধ্বগতি কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলিতে আকাশ অন্ধকার হয়ে গেছে। সেদিন বুঝিনি। পরে শুনেছি, সেদিন ওরা ইত্তেফাককে আগুন জ্বালিয়ে ধ্বংস করেছে।
কিন্তু এত মানুষ কেমন করে বেরিয়ে যাবে এই অবরুদ্ধ ঢাকা শহর থেকে? খবর পেলাম, শহর ছাড়ার সময়ও বহু মানুষকে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে। জিঞ্জিরা বাজারের নৃশংস হত্যাকাণ্ড তো কয়েক দিন পরের ঘটনা। ২ কিংবা ৩ এপ্রিল ওরা চারদিক ঘেরাও করে সকাল থেকে গুলি করতে আরম্ভ করেছে জিঞ্জিরায় আশ্রয় নেওয়া হাজার হাজার মানুষের ওপর। জাহাজের ওপর কামান বসিয়ে জিঞ্জিরা বাজার তাক করে ওরা গোলাবর্ষণ করেছে। চারদিকে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ভয়ার্ত মানুষ কোরআন খুলে বসেছে, কালিমা পড়েছে আর পাকিস্তানি বাহিনী হাসতে হাসতে মেশিনগানের ঝড় তুলে ভয়ার্ত মানুষকে ভূলুণ্ঠিত করে দিয়েছে আর ব্যঙ্গ করে বলেছে, ‘কালিমা পড় লিয়া তো আব শাহিদ হো যাও!’
এই ভয়ংকর অবস্থায় ছোট্ট তিনটি ছেলেমেয়ে নিয়ে আমি আর আমার স্ত্রী কোথায় যাব, কোথায় পাড়ি জমাব? তাই আমরা প্রায় মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করলাম। বন্দী ঢাকাতেই রয়ে গেলাম।
তারপরের জীবন? সে তো মৃত্যুর পরে মৃতের জীবন। তার আকুতি আর অসহায়তার কথা কোনো দিন সত্যি কাউকে শোনাতে পারব, এমন কথা সাহস করে ভাবতে পারিনি। যে অযুত প্রাণের সংগ্রাম আর রক্তের বিনিময়ে আমাদের মতো হতভাগ্য মানুষ বেঁচে থাকতে পেরেছে আর সেই ভয়ংকর দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করতে পারছে, তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সে ঋণের কোনো প্রতিদান নেই। আজ মনের চোখে যখন এপ্রিল, মে, জুন, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বরের মাসগুলোর প্রতিদিনের, প্রতিমুহূর্তের পাতা উল্টেপাল্টে দেখি, তখন সে জীবনকে কী করুণ আর অসহায় বোধ হয়!
গ্রাফিকস: প্রথম আলো.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অসহ য়
এছাড়াও পড়ুন:
সকালেই পড়ুন আলোচিত ৫ খবর
ফাইল ছবি: রয়টার্স