আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থায় প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে ২৫ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকলে তাঁরাও এখন থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডি বা শীর্ষ নির্বাহী হতে পারবেন। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগের ক্ষেত্রে এমন বিধান যুক্ত করেছে। কয়েকটি বড় কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করা যায় না। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি, মন্ত্রণালয়সহ আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোতে বেশ কিছু সত্যিকারের মেধাবী মানুষ রয়েছেন। এসব সংস্থায় এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা বাণিজ্যিক  ব্যাংকের এমডি ও সিইও হওয়ার যোগ্য। কিন্তু বিষয়টা যোগ্যতার প্রশ্ন নয়।

বিষয়টা এমন এক দেশে এমন এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আইনি ভিত্তি তৈরির, যে দেশে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে রাজনৈতিক বিবেচনায় গভর্নর হওয়ার সুযোগ এখনো পুরোপুরি বিদ্যমান। পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমাদের কোথায়? ভেবে দেখুন, বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর তাঁর এই দায়িত্বে নেই, ওদিকে আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনও আসেনি। তখন গভর্নর পদে চলে এলেন বিশেষ রাজনৈতিক এজেন্ডার কেউ। ওই অবস্থায় বাণিজ্যিক ব্যাংকার নন, এমন মানুষ কোনো ব্যাংকে এমডি হিসেবে বসবার আইনি সুযোগ থাকলে কী কী খারাপ হতে পারে একবার ভাবুন! অনেকেই বলবেন, সরকার যদি কোনো কিছুর খারাপ চায় তো ঠেকাবে কে? কিন্তু সেটা এক কথা, আর খারাপ হওয়ার আইনি ভিত্তি তৈরি করে দেওয়াটা আরেক কথা।

এ ছাড়া আরও কিছু প্রশ্নও আছে। একজন মানুষ কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকে কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি শুরু করে দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় নিজেকে গড়ে তোলেন। স্বপ্ন থাকে একদিন তিনি শীর্ষ নির্বাহীর পদে বসে ব্যাংকের ও দেশের ভালো করবেন। সবারই ইচ্ছা থাকে যাঁর যাঁর পেশার সিঁড়ির শেষ ধাপ পর্যন্ত যাওয়ার। তো স্বপ্ন দেখা সেই ব্যাংকার ডিএমডি হলেন, অতিরিক্ত এমডি হলেন আর ঠিক তাঁর এমডি হওয়ার সময়ে পদটা নিয়ে নিলেন বাইরের কেউ? সেটা কি নৈতিকভাবে ঠিক হবে?

আবার ব্যাংক খাতের বাইরের কেউ এসে হঠাৎ এমডি হয়ে পরিচালনা পর্ষদের বিশ্বাস অর্জন এবং একসঙ্গে মিলে ভালো ব্যাংক গড়ে তোলার কাজগুলো করতে পারবেন? এ ছাড়া বিধানটি কার্যকর হলে এমডি নির্বাচনের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্বেরও সম্ভাবনা থাকবে। নির্বাচনী সাক্ষাৎকারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা তাঁদের এত বছরের চেনা ও কাছের সহকর্মীর কাছে বাড়তি সহানুভূতি পেলেও পেতে পারেন। সব সময় কি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ে এখনকার মতো সৎ ও যোগ্য কর্মকর্তার দল থাকবে? রাজনৈতিক সরকারের সময়ে যদি সেটা না থাকে? সেই অবস্থায় আবার কোনো ব্যাংকের কোনো অসৎ পর্ষদ যদি বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসিকে খুশি রাখতে চেয়ে অযোগ্য মানুষকে এমডি করার দিকেই এগিয়ে যায়?

আরেকটা বড় দুশ্চিন্তার বিষয়, এমডিরা মূলত ব্যাংকের মুনাফা ও লোকসান (পি অ্যান্ড এল) হিসাবের ওনার। ব্যাংক একটা ব্যবসা—নানা ঝুঁকির ব্যবসা। এমডি সেই ব্যবসার নেতৃত্ব দেন। আমি এমডি হওয়ার আগে আমার এই ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা ছিল ২৪ বছরের। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তাদের সাধারণভাবে এই ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতা নেই। তাঁরা মূলত কমপ্লায়েন্স বা নিয়মকানুন পরিপালনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। হঠাৎ করে তারা ব্যাংকের এমডি হয়ে স্থিতিপত্র বা ব্যালান্সশিট, পি অ্যান্ড এল, নতুন পণ্য তৈরি ও বাজারজাত এবং সবশেষে মুনাফার ফসল ঘরে তোলার প্যারাডাইমে তাঁদের মন ও মাথা ঢোকাবেন কীভাবে?

এর আগে সোনালী, জনতা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত এমডি দেখেছি। মহবুবুর রহমান খান বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর থেকে সোনালী ব্যাংকের এমডি হয়ে পরে আবার ডেপুটি গভর্নর হয়েছিলেন। এ রকম মানুষ পাওয়া গেলে তো ভালো। কিন্তু এই দু-একটা ভালো ব্যতিক্রমের উল্টো দিকে সরকারি হস্তক্ষেপে কী পরিমাণ খারাপ জিনিস হয়েছে এই দেশে?

আবার বলা হচ্ছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সাবেকরাও ব্যাংকের এমডি হতে পারবেন। অথচ বর্তমানে একজন ব্যাংক এমডিকে অবসরের পর অন্য কোনো ব্যাংকের পরিচালক হতে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হয়। সেখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাবেকরা যোগ্য হবেন তাঁদের অবসর শেষ করেই? এটাও এক ধরনের বৈষম্য।  

শেষ কথা, আমি গভর্নর মহোদয়ের মনোভঙ্গি জানি। আইএমএফের সাবেক শীর্ষ এই কর্মকর্তা চিন্তাচেতনায় অনেক আধুনিক। তিনি চান সমাজের সব খাতের দরজা সব মেধাবী মানুষের জন্য খোলা থাকবে। আমিও তা-ই চাই। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন আসার আগে এই ‘অপ্রচলিত’ ধারণা আলিঙ্গন করাটা বিরাট বিপজ্জনক। কারণ, আমাদের সমাজ না ভালো, না খারাপ—আমাদের সমাজ মূলত বিপজ্জনক এক সমাজ।

মাসরুর আরেফিন, চেয়ারম্যান এবিবি এবং এমডি ও সিইও, সিটি ব্যাংক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন ত রক স স থ কর মকর ত র জন ত ক ক র এমড ব যবস হওয় র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

বিএসইসির সিদ্ধান্তহীনতায় লেনদেন বন্ধ এক ব্রোকারেজ হাউসের, বিপাকে ২২ হাজার বিনিয়োগকারী

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সিদ্ধান্তহীনতায় এক সপ্তাহ ধরে বন্ধ রয়েছে একটি ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেন। তাতে ওই ব্রোকারেজ হাউসের প্রায় ২২ হাজার বিনিয়োগকারী বিপাকে পড়েছেন। হঠাৎ করে ব্রোকারেজ হাউসটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁরা লেনদেনে অংশ নিতে পারছেন না।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে জানা যায়, ডিলার ও লেনদেন সনদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় ২৪ নভেম্বর ট্রেডক্যাপ স্টক ব্রোকারেজের লেনদেন স্থগিত করে দেয়। ব্রোকারেজ হাউসটির আগের নাম ছিল আনোয়ার খান মর্ডাণ সিকিউরিটিজ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এটি মালিকানা বদল হয়। প্রতিষ্ঠানটির সব দায়দেনা ও সম্পদ কিনে নেয় ট্রেডক্যাপ স্টক ব্রোকারেজ। মালিকানা বদলের পর ডিএসইতে ব্রোকারেজ হাউসটির নাম বদলে হয় ট্রেডক্যাপ স্টক ব্রোকারেজ। মালিকানা বদলের পরপর নতুন প্রতিষ্ঠানটি নাম বদল ও লাইসেন্স নবায়নের আবেদন করে ডিএসইতে। ডিএসইর পক্ষ থেকে সেই আবেদন অনুমোদনের জন্য বেশ কয়েক মাস আগে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিতে পাঠানো হয়।

কিন্তু বিএসইসিতে প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স নবায়ন ও নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত ঝুলে থাকায় এরই মধ্যে লাইসেন্সটি মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। তাতে হঠাৎ করেই ডিএসইর পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানটির লেনদেন স্থগিত করে দেওয়া হয়। তাতে বিপাকে পড়েছেন এই ব্রোকারেজ হাউসে লেনদেনকারী ২২ হাজার বিনিয়োগকারী। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন বিনিয়োগকারী তাঁদের অসুবিধার কথা জানিয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে আবেদন করেছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স নবায়ন ও নাম বদলের ছাড়পত্রের বিষয়ে বিএসইসির কোনো সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় ডিএসইও এটির লেনদেন চালুর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এ অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসইর সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দিক থেকে সব ধরনের কাগজপত্র বিএসইসিতে পাঠানো হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রয়োজনীয় ফিও প্রতিষ্ঠানটি পরিশোধ করেছে। আর কোনো কাগজপত্রের দরকার আছে কি না, সে বিষয়ে বিএসইসির পক্ষ থেকে আমাদের কিছু জানানো হয়নি। এদিকে লাইসেন্সের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় লেনদেন বন্ধ করা ছাড়া আমাদের কাছে কোনো উপায়ও নেই। আবার কবে লেনদেন চালু করা যাবে, তা বিএসইসির সিদ্ধান্ত না পেলে আমরাও বলতে পারছি না। এমন এক পরিস্থিতিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ভোগান্তিতে পড়লেও আমাদের করণীয় কিছু নেই।’

নিয়ম অনুযায়ী, শেয়ারবাজারে লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান ব্রোকারেজ হাউসের লাইসেন্স বা সনদ নির্ধারিত সময় পরপরই নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে নবায়ন করতে হয়। এর মধ্যে কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিকানা বদল বা নাম বদল হলেও সেটি বিএসইসিকে অবগত করতে হয়। সেই সঙ্গে নতুন নামে ব্রোকারেজ হাউসটি লাইসেন্স স্থানান্তরের আইনি বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। সেটি পালন করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটি এখন ভোগান্তিতে পড়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা পৃথক্‌করণ সংক্রান্ত ডিমিউচুয়ালাইজেশন আইন অনুযায়ী এখন কোনো ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেনস্বত্ব বিক্রির সুযোগ নেই। তবু মালিকানা বদলের পাশাপাশি কেউ কেউ সেটি করছেন। তবে কী কারণে উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানটির সনদ নবায়ন আটকে আছে, সেটি সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে কথা না বলে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না।’

ডিএসই–সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেনস্বত্ব বিক্রির ক্ষেত্রে ডিমিউচুয়ালাইজেশন আইন বিধিনিষেধ থাকলেও কেউ যদি প্রতিষ্ঠানের সব দায়দেনা ও সম্পদ কিনে নেয়, সে ক্ষেত্রে আইনে কোনো বাধা নেই। আনোয়ার খান মডার্ন সিকিউরিটিজের মালিকানা বদলের ক্ষেত্রে সব দায়দেনা ও সম্পদ একসঙ্গে বিক্রি হয়েছে। এ কারণে এখানে আইনগত কোনো বিধিনিষেধ নেই। তাই আমরা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো এটির নাম বদল ও লেনদেনের অনুমোদন দিয়েছি। এখন বিএসইসির নবায়ন সনদ আটকে যাওয়ায় লেনদেন স্থগিত করতে হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিএসইসির সিদ্ধান্তহীনতায় লেনদেন বন্ধ এক ব্রোকারেজ হাউসের, বিপাকে ২২ হাজার বিনিয়োগকারী