মুন্সীগঞ্জ সদর ও গজারিয়া এলাকায় মেঘনা নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে সোমবার (১ ডিসেম্বর) বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছেন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট ওমর ফারুক।

অভিযানে সহযোগিতা করেছেন গজারিয়া সেনাবাহিনী ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার ও তার টিম, চর আব্দুল্লাহপুর এবং মুক্তারপুর নৌ-পুলিশ।

মুক্তারপুর নৌ পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশ পরিদর্শক মো.

আতাউর রহমান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, অভিযানে চারটি ড্রেজার জব্দ করা হয় এবং বালু উত্তোলনে সহযোগিতার অভিযোগে ১১ জন শ্রমিককে প্রাথমিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ড্রেজারের মালিকদের উপস্থিতিতে মোট পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। 

আটক শ্রমিকরা মুচলেকা নিয়ে মালিকের জিম্মায় মুক্তি পান। জনস্বার্থ এবং নদী রক্ষায় এই ধরনের অভিযান চলমান থাকবে বলে জানান নৌ পুলিশের এ কর্মকর্তা।

ঢাকা/রতন/এস

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর

এছাড়াও পড়ুন:

স্বাধীনতার ঘোষণায় বাংলাদেশের উন্মেষ

স্বাধীনতার ঘোষণা, জনযুদ্ধ এবং বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি—১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়পর্বের ৯ মাসের ঘটনাপ্রবাহ মোটাদাগে এটাই। সংগ্রামের শুরুটা অবশ্য হয়েছিল অনেক আগেই।

ফসল ফলাতে কৃষক যেমন খেত তৈরি করেন, বীজ বপন করেন, পরিচর্যা করেন এবং শেষে শস্যদানা ঘরে নিয়ে যান; তেমনি বাংলাদেশের মানুষও দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম করেছেন, তারপর স্বাধীনতার ঘোষণা এসেছে, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে এবং মানুষের বিজয় হয়েছে।

স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা আর পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে নেই। এই বিদ্রোহের মাধ্যমেই জনযুদ্ধের সূচনা।

ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাওয়ার সময় পাকিস্তান নামে যে নতুন রাষ্ট্রটি গঠন করে, সেটির দুই অংশ ছিল ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন। ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি ও সমাজের ভিন্নতার বিষয়টি উপেক্ষা করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টিকে মঈদুল হাসানের মূলধারা ’৭১ বইতে ‘পরিকল্পনার অভিনবত্ব’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিমের একে অপরের ভিন্নতার মধ্যে রাষ্ট্র গঠনের পরই শুরু হয় বাঙালিদের ওপর নানা কিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। পশ্চিম পাকিস্তান শুরুতেই চাইল উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বাংলাদেশের তরুণেরা প্রাণ দিলেন ১৯৫২ সালে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে হারিয়ে যুক্তফ্রন্টের বড় জয়, ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি, ১৯৬২ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের পরও ক্ষমতা হস্তান্তর না করা—এসবই স্বাধীনতার ঘোষণার পটভূমি তৈরি করে।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক জনসভায় দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বললেও সেটি আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল না।

সেদিন শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে বিনা রক্তপাতে দেশ স্বাধীন হয়ে যেত বলে অনেকে মনে করেন। এ বিষয়ে আবুল মনসুর আহমদ আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর বইয়ে বলেছেন, ‘কোনো দিক হইতেই ৭ই মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করা সমীচীন হইত না। যুক্তির দিক হইতে হইত না এই জন্য যে, প্রেসিডেন্টের পক্ষে বেআইনীভাবে পরিষদের বৈঠক বাতিল করাটাই স্বাধীনতা ঘোষণার পক্ষে যথেষ্ট কারণ ছিল না। আর বাস্তবতার দিক হইতে এটা সমীচীন হইত না এই জন্য যে তাতে সভায় সমবেত বিশ লাখ নিরস্ত্র জনতাকে সংগীন উঁচা-করা সুসজ্জিত সামরিক বাহিনীর গুলির মুখে ঠেলিয়া দেওয়া হইত।’

যা-ই হোক, ৭ মার্চের পর দেশ মূলত শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে চলেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনী নিয়েছে হামলার প্রস্তুতি। ২৫ মার্চ নিরস্ত্র মানুষের ওপর গণহত্যা চালানো হয়। তারপরই স্বাধীনতার ঘোষণা এবং শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।

‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি কমান্ডো দল ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১২টার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক করে নিয়ে যায়।

২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক মতভেদ রয়েছে। সেটা আদালত পর্যন্তও গড়িয়েছে।

মঈদুল হাসান মূলধারা ’৭১ বইয়ে লিখেছেন, ‘সশস্ত্র বাহিনীর বিক্ষিপ্ত বিদ্রোহ এবং উদ্ভূত খণ্ডযুদ্ধের মধ্যে চট্টগ্রামের ৮ইবি ও ইপিআর বাহিনীর সশস্ত্র প্রতিরোধ বিশেষ কারণে উল্লেখযোগ্য। স্বল্পকালের জন্য চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র যখন বিদ্রোহীদের দখলে আসে, তখন ২৬ মার্চ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান (এম এ হান্নান) এবং ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় ৮ইবির বিদ্রোহী নেতা মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। মেজর জিয়া তাঁর প্রথম বেতার বক্তৃতায় নিজেকে “রাষ্ট্রপ্রধান” বলে ঘোষণা করলেও পরদিন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পরামর্শে তিনি শেখ মুজিবের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার ঘোষণা দেন। এসব ঘোষণায় লোকের মুখে মুখে বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ে যে শেখ মুজিবের নির্দেশে সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালীরা স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই শুরু করেছে।’

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক তাঁর উইটনেস টু সারেন্ডার বইয়ে ডেভিড লোসাকের পাকিস্তান ক্রাইসিস থেকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, ‘যখন প্রথম গুলি ছোড়া হয়, তখন রেডিও পাকিস্তানের একটি তরঙ্গে ক্ষীণভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠ শোনা যায়। মনে হলো আগে রেকর্ড করা বাণী, যেখানে শেখ পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা করেছেন।’

বিএনপির প্রয়াত নেতা মওদুদ আহমদ বাংলাদেশ: স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা বইয়ে টীকা ও তথ্যপঞ্জি অংশে লিখেছেন, ‘স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় এবং পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ ২৭ মার্চ মেজর জিয়া কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টিকে বিকৃত করে দেখানোর চেষ্টা করেছে। তারা দাবি করেছে যে শেখ মুজিব ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।’ তাঁর মতে, শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেননি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র (তৃতীয় খণ্ড/২০০৪)-এ স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল প্রচারিত বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি ভাষণ সংযুক্ত করা হয়েছে। ‘বাংলাদেশবাসীর উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ’ শিরোনামের এই ভাষণে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘...২৫ মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তাঁর রক্তলোলুপ সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে নরহত্যাযজ্ঞের শুরু করেন, তা প্রতিরোধ করার আহ্বান জানিয়ে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।’

তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণের আরেকটি অংশে বলা হয়, ‘প্রতিদিন আমাদের মুক্তিবাহিনীর শক্তি বেড়ে চলেছে। একদিকে যেমন হাজার হাজার মানুষ মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে, তেমনি শত্রুর আত্মসমর্পণের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। আর একই সঙ্গে আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসছে শত্রুর কেড়ে নেয়া হাতিয়ার। এই প্রাথমিক বিজয়ের সাথে সাথে মেজর জিয়াউর রহমান একটি পরিচালনা কেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং সেখান থেকে আপনারা শুনতে পান বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা। এখানেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়।’

স্বাধীনতার ঘোষণা কে আগে বা কে পরে দিয়েছেন, তার রাজনৈতিক সুরাহা সহজ হবে না বলে ধারণা করা যায়। কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষণা যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ অংশ, সেটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।

তথ্যসূত্র: ১. মূলধারা ’৭১: মঈদুল হাসান; ২. আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর: আবুল মনসুর আহমদ; ৩. উইটনেস টু সারেন্ডার: ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক; ৪. বাংলাদেশ: স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা: মওদুদ আহমদ; ৫. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র (তৃতীয় খণ্ড/২০০৪), মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ