সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ মহাবিপন্ন বেঙ্গল টাইগার। কিন্তু বর্তমানে এর থেকেও বিলুপ্তপ্রায় হয়ে পড়েছে আরেকটি প্রাণী (পাখি)। কয়েক বছর আগেও বিশ্বব্যাপী মহাবিপন্ন পাখিটির সংখ্যা ছিল ৬০০ থেকে ১ হাজার ৭০০। কিন্তু বর্তমানে ১০৮ থেকে ৩০৪টিতে এসে ঠেকেছে, যার ৮০ থেকে ১৬০টিই আমাদের সুন্দরবনের বাসিন্দা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এই পাখি যদি সুন্দরবন থেকে হারিয়ে যায়, তাহলে পৃথিবী থেকেই হারিয়ে যাবে। কারণ, বাংলাদেশ ছাড়াও আরও যে দুটি দেশে ওরা নিশ্চিতভাবে বেঁচে আছে, তার মধ্যে কম্বোডিয়ায় ১২ থেকে ৬০টি ও মিয়ানমারে ১২ থেকে ৪০টি পাখি রয়েছে। যদিও ইদানীং সহজে চোখে পড়ছে না।
২৯ বছর ধরে সুন্দরবনে ঘুরলেও গোলবনের রহস্যময় মহাবিপন্ন পাখিটিকে খুঁজছি ২০১৪ সাল থেকে। কিন্তু ২০১৮ সালের ২৭ জানুয়ারির আগে ওকে খুঁজে পাইনি। সেদিন বাঘের বৈঠকখানাখ্যাত কচিখালী থেকে সকাল ১০টায় ‘বাঘের বাড়ি’খ্যাত কটকা রওনা হলাম। অভিজ্ঞ সারেং সগির ও মাঝি গাউসের পরামর্শে বড় কটকা খাল দিয়ে না গিয়ে ছিটা কটকা নামের ছোট খাল দিয়ে এগোতে থাকলাম। এই খালেই কয়েক বছর ধরে ওকে দেখা যাচ্ছে।
তখন ভাটা চলছিল। ক্যামেরা হাতে আমরা সাতজন টান টান দাঁড়িয়ে। খালের দুই পাশে গোলগাছের সারি, দৃষ্টি সবার গোলবনের পলিময় কাদার দিকে। কিন্তু ভারী ক্যামেরা তাক করে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়? পরিশ্রান্ত সবাই কিছুক্ষণের জন্য ক্যামেরা নামালেন। তবে আমার দৃষ্টি গোলবনের কাদা থেকে সরল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে হাঁসের মতো কিন্তু অদ্ভুত এক পাখির চেহারা ভেসে উঠল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। আর আমার আঙুল অজান্তেই শাটারে ক্লিক করে গেল। হঠাৎ বলে উঠলাম হাঁসপাখি! হাঁসপাখি!! পাখিটি দ্রুত গোলবনের কাদাময় পাড় থেকে পানিতে নেমে গেল। আমি এবং আরেকজন ছাড়া কেউ ওর ছবি তুলতে পারল না।
খানিক পর আরও দুটির দেখা পেলাম। পরদিন ভোরে কটকার কাছে সুন্দরী (হোমরা) খালে আরও চারটিকে দেখলাম। একযাত্রায় সাতটি হাঁসপাখির দেখা পাওয়া মহাভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু এরপর যতবার সুন্দরবনে গেছি, পলিমাটিতে পায়ের ছাপ দেখলেও পাখি দেখিনি। তিন বছর ধরে পায়ের ছাপও দেখছি না।
বাঘের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ সুন্দরবনের এই হাঁসপাখি কে? এ দেশের এক অতিবিরল ও মহাবিপন্ন পাখি সুন্দরী, গেইলো বা বাইলা হাঁস। জেলে-বাওয়ালি-মৌয়ালদের কাছে এ নামেই পরিচিত। তবে নামে হাঁসপাখি হলেও আদতে হাঁসের ধারেকাছের পাখিও নয় এটি; বরং জলমুরগি, অর্থাৎ ডাহুক-কোড়াদের নিকটাত্মীয়। ইংরেজি নাম মাস্কড/এশিয়ান ফিনফুট। গোত্র Helornithidae, বৈজ্ঞানিক নাম Heliopais personata। অতিলাজুক পাখিটিকে একসময় বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় দেখা গেলেও বর্তমানে শুধু বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া ও মিয়ানমারে দেখা যায়।
সুন্দরবনের খালপাড়ে জেলেদের পাতা চরপাটা জাল.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ন দরবন র গ লবন র
এছাড়াও পড়ুন:
লোনাপানির সুন্দরবনের নিচে লুকিয়ে আছে মিঠাপানির ভান্ডার
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে পানি মানেই একরাশ তিক্ততার গল্প। নোনাজল, আর্সেনিক দূষণ, নদীর লবণাক্ততার বিস্তার—সব মিলিয়ে এই অঞ্চলের মানুষ বছরের বেশির ভাগ সময়ই নিরাপদ পানির সংকটে ভোগেন। খুলনা, সাতক্ষীরা আর বাগেরহাটজুড়ে চিংড়িঘের, ভাঙন, খরা ও লবণাক্ত নদীর পানি যেন জীবনের স্থায়ী সঙ্গী।
এই বাস্তবতার মধ্যে আন্তর্জাতিক একদল গবেষকের নতুন দাবি যেন উপকূলের বুকেই এক অচেনা আশার ঝরনা বইয়ে দিয়েছে। তাঁদের গবেষণায় দেখা গেছে, মাটির বহু গভীরে লুকিয়ে আছে দুটি বিশাল মিঠাপানির ভান্ডার। হাজার বছর আগের সেই পানি আজও প্রায় অক্ষত অবস্থায় টিকে আছে।
গবেষণাটি গত শুক্রবার খ্যাতনামা বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার কমিউনিকেশনসে প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, নিউ মেক্সিকো ইনস্টিটিউট অব মাইনিং অ্যান্ড টেকনোলজি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা খুলনা শহর থেকে সুন্দরবনের দক্ষিণ সীমানা পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে আধুনিক ভূ-তড়িৎ-চৌম্বকীয় প্রযুক্তি, ম্যাগনেটোটেলুরিক ব্যবহার করে ভূগর্ভের অভ্যন্তরীণ গঠন পরীক্ষা করেন।
সুন্দরবনে প্যালিও ওয়াটারের দুটি উৎস পাওয়া গেছে। প্যালিও ওয়াটার হলো প্রাচীন ভূগর্ভস্থ জল, যা হাজার বছরের বেশি সময় ধরে আটকে থাকে। এটি প্রাচীন সুন্দরবনের বয়স ও গঠনের ধারণাকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। ইসমে আজম, সুন্দরবনবিষয়ক লেখক ও গবেষকগবেষকদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, খুলনার উত্তরের অংশে প্রায় ২০০ থেকে ৮০০ মিটার গভীরে বিস্তৃত আছে বিশাল এক মিঠাপানির স্তর। এটি প্রায় ৪০ কিলোমিটার বিস্তৃত এবং পানির লবণাক্ততা এত কম যে সরাসরি মিঠাপানি হিসেবে চিহ্নিত করা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই পানি তৈরি হয়েছিল শেষ বরফযুগে, যখন সমুদ্রপৃষ্ঠ আজকের তুলনায় প্রায় ১২০ মিটার নিচে ছিল। তখন নদীগুলো গভীর উপত্যকা তৈরি করে সমুদ্রের দিকে ছুটে যেত এবং সেই বালুমিশ্রিত নদীপথে প্রবেশ করা বৃষ্টির পানি হাজার বছর ধরে ভূগর্ভে সঞ্চিত থাকত।
সুন্দরবনের ভেতরে পাওয়া গেছে দ্বিতীয় আরেকটি মিঠাপানির ভান্ডার। এটি আকারে তুলনামূলক ছোট এবং গভীরতাও কম, কিন্তু লবণাক্ততার মাত্রা এতটাই নিচে যে এ অঞ্চলেও নিরাপদ পানির আরেকটি সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। এই দুটি ভান্ডারের মাঝখানে আছে একটি প্রশস্ত লবণাক্ত পানির স্তর, যা গঙ্গার প্রাচীন নদীখাত ভরাট হয়ে তৈরি হয়েছে। বরফযুগের পর সমুদ্রপৃষ্ঠ বাড়তে শুরু করলে এই এলাকাগুলো লবণাক্ত কাদা-মাটিতে ঢেকে যায় এবং এখন তা স্থায়ী লবণাক্ত স্তর হিসেবে ভূগর্ভে রয়ে গেছে।
গুগল স্যাটেলাইট মানচিত্রে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ