মারমা ও রাখাইন লোকসাহিত্যে ‘তা-বং’ বলে একটি শব্দ আছে। এটি একধরনের ভবিষ্যদ্বাণী। এই ভবিষ্যৎবাণীগুলো প্রবাদ প্রবচন, কবিতা বা গানের আকারে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হয়।

কিছু ক্ষেত্রে এগুলোকে আত্মিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের আগাম সতর্কবার্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চাকমা, রাখাইন, মারমা, খিয়াংসহ বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকসাহিত্যে একটি গল্প প্রচলিত আছে।

গল্পে একটি কুনো ব্যাঙের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা বলা হয়েছে, যার দ্বারা একটি রাজনৈতিক দুর্যোগের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়।

রংরাং পাখির আর্তনাদ

এক বনে এক কুনো ব্যাঙ বাস করত। সে একদিন শহরে বেড়াতে যায়। ফিরে এসে ব্যাঙটি তার ছোট পাখি বন্ধুকে জানায়, অচিরেই মহা ঝড় আসবে, ভয়ানক ভূমিকম্প হবে, মাটির নিচের বুনো আলু সাত টুকরা হয়ে যাবে, পাহাড়ের নারীরা সমতলে স্থানান্তরিত হবে এবং সমতলের নারীরা স্থানান্তরিত হবে পাহাড়ে। সর্বোপরি মানবসমাজ চার ভাগে ভাগ হবে। আর এই দুর্যোগে ছোটদের অস্তিত্ব কেবল তখনই রক্ষা পেতে পারে, যদি তারা বড়দের কাছে আশ্রয় পায়।

এদিকে ঝড় শুরু হলে ভয়ার্ত ছোট পাখিটি রংরাং নামক পাখির হাঁ করা মুখ দিয়ে ঢুকে পড়ে আর পশ্চাদ্দেশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এতে রংরাং পাখি বিকট স্বরে আর্তনাদ করে ওঠে। তার আর্তনাদ থেকে কিছু ঘটনাপ্রবাহের জন্ম হয়। চমকে গিয়ে একটি বানর তার হাতে থাকা কুমড়া ফেলে দেয় গাছের নিচে শুয়ে থাকা একটি অজগরের ওপর; এতে অজগর ক্ষিপ্ত হয়ে পার্শ্ববর্তী এক মুরগির ডেরায় গিয়ে তার সব ডিম সাবাড় করে ফেলে; এই ঘটনায় শোকে-দুঃখে মুরগি গিয়ে একদল পিঁপড়ার বাসা লন্ডভন্ড করে দেয়; এতে পিঁপড়ার দল রাগের মাথায় এক শূকরের গোপনাঙ্গে গিয়ে কামড় বসিয়ে দেয়; আর হতবিহ্বল শূকর ছুটে গিয়ে এক বিধবার জুমখেতের সব ফসল নষ্ট করে ফেলে; দুঃখভারাক্রান্ত বিধবাটি রাজার কাছে গিয়ে নালিশ করে। আর রাজা তদন্ত করার পর কুনো ব্যাঙকে দোষী সাব্যস্ত করে। কেননা তার ভবিষ্যদ্বাণী থেকেই এসব দুর্ঘটনার সূত্রপাত।

আরও পড়ুনপার্বত্য চট্টগ্রাম: বাড়ির পাশে আরশিনগর৩০ মার্চ ২০২২

শিশুদের জন্য রচিত বিনোদনমূলক গল্প হলেও এর গভীরে যেন লুকিয়ে আছে একধরনের আগাম বার্তা। এটি পার্বত্য অঞ্চলের রাজনৈতিক সংকটকে নির্দেশ করে, যার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পুনর্বাসন, পাহাড়িদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ, ভূমি বেদখল ও বৈরী রাষ্ট্রীয় নীতির কারণে সৃষ্ট আদিবাসীদের নানা বঞ্চনার গল্প।

কুনো ব্যাঙের ভবিষ্যদ্বাণী, ‘পাহাড়ের নারীরা সমতলে স্থানান্তরিত হবে এবং সমতলের নারীরা স্থানান্তরিত হবে পাহাড়ে’ মূলত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পাহাড়ে পুনর্বাসনপ্রক্রিয়ার প্রতিচ্ছবি।

ভূগর্ভস্থ বুনো আলুর সাত ভাগে বিভাজনের কথা যেন রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ‘ভাগ করো। শাসন করো’ নীতির ফলে পাহাড়ে তৈরি হওয়া বিভিন্ন দল ও উপদলের ভেতর বিভক্তির রাজনীতিকেই নির্দেশ করে।

১৯৭১ সালের পর থেকে পার্বত্য অঞ্চলের ঘটনাপ্রবাহে জাতীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক বঞ্চনার এক স্থায়ী চক্র বিদ্যমান। ১৯৯৭ সালের চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং কাঠামোগত বৈষম্য বেড়েছে। কুনো ব্যাঙের ভবিষ্যদ্বাণী যেন এই রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতীক। ভূমি হারানো, অস্তিত্বের সংকট ও রাজনৈতিক বঞ্চনা যেন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন বাস্তবতা।জনমিতিগত প্রকৌশল

জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে পাহাড়ে সরকারি উদ্যোগে ১৯৭০–৮০ দশকে চার লাখেরও বেশি বাঙালি পরিবারকে পাহাড়ে নিয়ে আসা হয়। এর ফলে পাহাড়ের জনমিতিগত বৈশিষ্ট্য পাল্টে যায় এবং বিপুলসংখ্যক পাহাড়ির ভূমি বেহাত হয়ে যায়। ৭০ হাজারেরও বেশি পাহাড়ি মানুষ ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে। গুচ্ছগ্রাম তৈরি ও স্থানান্তর, ভূমি বেদখল ও ভূমি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ, বিদ্রোহ দমন প্রক্রিয়া, নারীর প্রতি সহিংসতা, গণহত্যা, ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন—সব মিলিয়ে সৃষ্টি হয় এক গভীর রাজনৈতিক সংকট।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি সইয়ের মুহূর্ত.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক প রব হ

এছাড়াও পড়ুন:

যোগাযোগের ঘাটতি বাবা মায়ের সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব তৈরি করে

যোগাযোগের ঘাটতি বাবা–মায়ের সঙ্গে সন্তানের একধরনের দূরত্ব তৈরি করে। এই দূরত্ব প্যারেন্টিংয়ের জন্য নেতিবাচক। সন্তানের মানসিক গঠনের জন্যও এই দূরত্ব ক্ষতিকারক। কারণ, বাবা–মায়ের আচরণ সন্তানের মানসিক গঠনে প্রভাব ফেলে। তাই বয়ঃসন্ধিকালে সন্তান লালনপালনে মা–বাবাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

আজ শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে এক পরামর্শ সভায় এ কথা বলেন মনরোগবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মেখলা সরকার।

প্রথম আলো ট্রাস্টের একটি নিয়মিত আয়োজন বিনা মূল্যে পরামর্শ সহায়তা সভা। আজ এর ১৭৩তম সভা অনুষ্ঠিত হয়।

যেসব ছেলে–মেয়ের মধ্যে একধরনের নাজুকতা আছে, তাদেরই মাদকাসক্তিতে জড়ানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে বলে মনে করেন অধ্যাপক মেখলা সরকার। তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে প্যারেন্টিং একধরনের রোল প্লে করতে পারে।’

বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানের আত্মপরিচয় ও আত্মনির্ভর্শীলতার শুরু হয় বলে উল্লেখ করেন এই মনরোগবিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষের মানসিক গঠন কেমন হবে, তার ভিত কিন্তু কিছুটা শৈশব ও কৈশোরের মধ্যে নির্ধারণ হয়ে থাকে।’ সন্তান যখন কৈশোর থেকে বয়ঃসন্ধিকালে পা রাখে, তখন অনেক মা–বাবা সেটা লক্ষ রাখতে পারেন না বলেও মনে করেন অধ্যাপক মেখলা সরকার। সন্তানের সঙ্গে যাতে বাবা–মায়ের কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত দূরত্ব তৈরি না হয়, তা নিয়ে সচেতন থাকার পরামর্শ দেন তিনি।

পরামর্শ সভায় কথা বলছেন মনরোগবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মেখলা সরকার। ২৯ নভেম্বর

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • যোগাযোগের ঘাটতি বাবা মায়ের সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব তৈরি করে