গত মাসে পাঁচ দিন তালা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল রাঙামাটি জেলা পরিষদ ভবনে। চাকরিতে পাহাড়িদের কোটা বাতিলসহ পাঁচ দফা দাবিতে বাঙালিদের কয়েকটি সংগঠন এ কর্মসূচি নিয়েছিল। তার আগে লাঞ্ছিত করা হয় জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজল তালুকদারকে।

রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হয় ১৯৮৯ সালে। এরপর গত তিন যুগে রাঙামাটি বা পার্বত্য অন্য কোনো জেলা পরিষদকে এমন তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখেনি কেউ। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে লাঞ্ছিত করার ঘটনাও এ অঞ্চলে বিরল বলে জানান রাঙামাটির প্রথম নির্বাচিত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষক নিয়োগে এভাবে বাধা সৃষ্টি করে প্রকারান্তরে পার্বত্য চুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দেড় বছরে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো চেষ্টাই হয়নি; বরং চুক্তিটিকেই এখন তালাবদ্ধ করার চেষ্টা চলছে।

গত দেড় বছরে নানা ‘বিরল’ ঘটনারই সাক্ষী হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। এ সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে পাঁচজনের মৃত্যু, জেলা পরিষদ অচলাবস্থা, ভূমি কমিশনের বৈঠক স্থগিত, সশস্ত্র সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া আরও জটিলতায় পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আজ ২ ডিসেম্বর পালিত হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৮তম বার্ষিকী।

মনোনীত ব্যক্তিদের দিয়েই জেলা পরিষদ

দুই দশকের সশস্ত্র আন্দোলনের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সই হয়। স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলনরত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সঙ্গে সরকার এ চুক্তি করে। এর মাধ্যমে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ। তিন জেলা পরিষদ গঠনে ১৯৮৯ সালের আইনকে সংশোধন করা হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের পর এর বেশ কিছু ধারা বাস্তবায়িত হলেও ভূমি সমস্যার সমাধান, জেলা পরিষদের নির্বাচন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কোনো সুরাহা হয়নি। সরকারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) বারবারই বিশেষ করে সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টির অভিযোগ করেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মোট ৭২টি ধারার মধ্যে ৩৫টিই জেলা পরিষদ-সংক্রান্ত। এ চুক্তিকে তাই স্থানীয় মানুষের স্বায়ত্তশাসনের একটি দলিল মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এ পর্যন্ত পাহাড়ের তিন জেলা পরিষদে নির্বাচন হয়নি। সব আমলেই পরিষদ চলেছে সরকারের মনোনীত ব্যক্তিদের মাধ্যমে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিন জেলা পরিষদ ভেঙে দেয়। মাসখানেক নেতৃত্বশূন্য থাকার পর গত বছরের নভেম্বরে তিন জেলা পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। এবারও সেই নিজেদের মনোনীত ব্যক্তিদেরই নিয়োগ দেওয়া হয়।

‘শুভ কিছু বয়ে আনবে না’

রাঙামাটির ১০ উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগে জেলা পরিষদের বিজ্ঞপ্তি নিয়ে বাঙালি সংগঠনগুলো আপত্তি তোলে। তাদের দাবি, অন্যান্য জেলায় যেমন ৯৩% মেধা ও ৭% কোটা ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়, পাহাড়েও তা প্রযোজ্য হোক। ফলে দুই দফা পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেও পরীক্ষা নেওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত পরিষদ ভবনে তালা ঝোলানো হয়।

পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী পাহাড়ে নিয়োগে উপজাতীয় স্থায়ী অধিবাসীদের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করার কথা স্পষ্টভাবে বলা আছে। জেলা পরিষদ আইনও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগের ক্ষমতা পরিষদের হাতে দিয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম সম–অধিকার আন্দোলনের সমন্বয়ক জাহাঙ্গীর কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাহাড়ে সবচেয়ে বঞ্চিত আজ বাঙালিরাই। একই সঙ্গে খুমি, ম্রো, রাখাইনসহ সব জাতিগোষ্ঠী পিছিয়ে। তাই আমরা চাই মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হোক।’

তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, জাতীয় কোটা কাঠামো বজায় থাকলে সংখ্যায় কম পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা আরও পিছিয়ে পড়বে কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, তা নিয়েও আলোচনা হতে পারে।’

পার্বত্য তিন জেলা পরিষদের আইন ও প্রবিধান অনুযায়ী, উপজাতীয় এবং অ-উপজাতীয় (বাঙালি) বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী জেলা পরিষদের সদস্য সংখ্যার অনুপাতে চাকরিতে নিয়োগ পায়। এত দিন ধরে এই রীতি চলে আসছে।

বিষয়টি তুলে ধরে পাহাড়ের মানবাধিকারকর্মী নিরূপা দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলা পরিষদের আইন অনুযায়ীই বাঙালিরা চাকরি পাচ্ছেন। এত দিন এ নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন করেনি। এখন নতুন করে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। চুক্তির চেতনা যারা ধারণ করে না বা চুক্তিকে বাতিল করতে চায়, তারাই নানা প্রশ্ন তুলছে।’

তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কাঠামো দেশের অন্য জেলা পরিষদগুলো থেকে অনেকটা ভিন্ন। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান মনে করেন, এটা সত্যিকার অর্থে স্থানীয় সরকারের একটি মডেল। তাঁর কথায়, পার্বত্য অঞ্চলে এখন এই পরিষদ নিয়ে যে বিতণ্ডা শুরু হয়েছে, তা স্থানীয় সরকারের চেতনার ব্যত্যয়। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ অঞ্চলে স্থানীয় মানুষের ক্ষমতায়নে এভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি শেষ পর্যন্ত শুভ কিছু বয়ে আনবে না।

‘অশুভ’ দুই সেপ্টেম্বর

গত বছর ও চলতি বছর দুই দফা পার্বত্য জেলাগুলোতে সংঘাতে আটজন নিহত হন। এর মধ্যে গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সদর উপজেলায় মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে মো.

মামুন নামের এক বাঙালি যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরদিন জেলার দীঘিনালায় গণপিটুনিতে ধনঞ্জয় চাকমা নামের এক ব্যক্তি নিহত হন। রাতে আবার এ ঘটনায় জেলা সদরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। তাতে নিহত হন দুই পাহাড়ি যুবক। এ ছাড়া চলতি বছরের ২৮ সেপ্টেম্বরে খাগড়াছড়ির গুইমারায় গুলিতে তিন পাহাড়ি যুবক নিহত হন।

১৯৯৭ সালের চুক্তির পর পাহাড়ে সহিংসতা অনেকটা কমে আসে। এর মধ্যেও পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত কয়েকবার হয়েছে। তবে গুলিবর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনা অনেকটাই কমে এসেছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে পুরোনো আতঙ্ক ফিরে এসেছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক বছরে পাহাড়ে দুই দফায় যে সহিংসতা হলো, তা চুক্তির পরবর্তী সময়ে বিরল ঘটনা। সর্বশেষ গুইমারায় যেভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের স্থানীয় মানুষের মুখোমুখি করা হলো, তা আগে দেখিনি। অন্তর্বর্তী প্রশাসনের সামগ্রিক ব্যর্থতার ফসল এটি।’

চুক্তির বাস্তবায়ন কেবল আনুষ্ঠানিকতায়

পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় সমস্যা ভূমি বিরোধ। চুক্তি অনুযায়ী, সাংবিধানিক ক্ষমতাসম্পন্ন ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান হওয়ার কথা। কিন্তু সর্বশেষ গত অক্টোবর মাসে কমিশনের বৈঠক হয়নি। কারণ, স্থায়ীয় বাঙালিদের বাধা। এর আগে গত সরকারের আমলেও এমন বাধার কারণে বৈঠক স্থগিত হয়েছে। এরপরও একাধিকবার কমিশনের সভা হয়েছে। গত ২২ অক্টোবর ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের ১২তম সভা ডাকা হলে স্থানীয় বাঙালিদের হুমকিতে তা-ও স্থগিত করা হয়।

চাকমা সার্কেল প্রধান হিসেবে ভূমি কমিশন ও টাস্কফোর্সের সঙ্গে যুক্ত রাজা দেবাশীষ রায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুটি সভায় আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। দুটোই বাতিল হলো। আগে তো রাজনৈতিক সরকারের আমলে এমন সমস্যা হতো। পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে গঠিত প্রতিষ্ঠান দুটিকে কার্যকর রাখতে এ সরকারের সমস্যা কোথায়? আসলে অন্তর্বর্তী সরকার চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে যা করেছে, তা শুধুই আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনকে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মুহাম্মদ আব্দুল হাফিজকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে রাঙামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির একটি সভা হয়েছে। সেখানে চুক্তি সম্পাদনকারী জেএসএস (জনসংহতি সমিতি) ছিল। দলটি চুক্তির বার্ষিকী উপলক্ষে এক বিবৃতিতে বলেছে, পাঁচ মাস পরও সভার সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি নেই।

চুক্তির বাস্তবায়নে সরকারের অবস্থান জানতে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমার সঙ্গে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রথম আল ক সরক র র অন য য় র ঘটন ক ষমত সমস য

এছাড়াও পড়ুন:

ইউক্রেনের কৌশলগত শহর পোকরোভস্ক দখলের দাবি রাশিয়ার

পূর্ব ইউক্রেনের কৌশলগত শহর পোকরোভস্ক দখলের দাবি করেছে রাশিয়া। শহরটি ইউক্রেন থেকে দনবাস অঞ্চলের প্রবেশদ্বারের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ একটি লজিস্টিক হাব হিসেবেও পরিচিত। দীর্ঘদিনের লড়াই শেষে রুশ বাহিনী এই দাবি করল।

রবিবার (২ ডিসেম্বর) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার খবরে বলা হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ ওই শহর ও হাবটিতে দীর্ঘদিন ধরে তীব্র লড়াই চলছিল। এটির দখল নিতে রাশিয়ার অনেক সেনা নিহত ও আহত হয়েছে। এছাড়া ইউক্রেনের অসংখ্য সেনাও প্রাণ হারিয়েছেন।

আরো পড়ুন:

কৃষ্ণ সাগরে ইউক্রেনের ড্রোন হামলা: রাশিয়ার ২ ট্যাংকারে আগুন

কিয়েভের আবাসিক এলাকায় রাশিয়ার ড্রোন হামলা

যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় বৈঠকে বসেছিলেন মার্কিন ও ইউক্রেনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। এর কয়েক ঘণ্টা পরই গুরুত্বপূর্ণ শহরটি দখলের দাবি করে ক্রেমলিন। 

সোমবার (১ ডিসেম্বর) টেলিগ্রামে দেওয়া এক বিবৃতিতে পোকরোভস্ক শহর দখলের তথ্য জানায় ক্রেমলিন। রুশ সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভকে উদ্ধৃত করে পোস্টে আরো বলা হয়, খারকিভ অঞ্চলের ভভচানস্ক শহরটিও রুশ বাহিনী দখল করেছে।

রাশিয়ার বার্তা সংস্থা তাস-এর খবর অনুসারে, ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, রবিবার গভীর রাতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ফ্রন্টলাইনের একটি কমান্ড সেন্টার পরিদর্শন করার সময় ‘মুক্তির’ খবরটি প্রেসিডেন্টকে জানিয়েছেন পেরাসিমভ। 

পোকরোভস্ক দোনেৎস্ক অঞ্চলের একটি বড় পরিবহন কেন্দ্র। পূর্ব ইউক্রেনের চারটি অঞ্চলের মধ্যে একটি রাশিয়া নিজেদের দখলে নিয়েছে বলে দাবি করেছে।

একসময় ৬০ হাজার মানুষের বাসস্থান এই শহরটিতে দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ান ড্রোন, কামান ও বোমাবর্ষণ ফলে অনেক ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

ইউক্রেন এখনও রাশিয়ার শহর দখলের বিষয়টি নিশ্চিত করেনি। তবে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, মস্কো পোকরোভস্কের রাস্তায় সৈন্যদের মিছিল করে রাশিয়ার পতাকা উড়িয়ে দেওয়ার একটি ভিডিও প্রচার করেছে।

রুশ বার্তা সংস্থা তাস-এর খবর অনুসারে, পুতিন পরে রাশিয়ান বাহিনীকে তাদের বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ