কোরআনে পুরুষকে কেন নারীর ‘তত্ত্বাবধায়ক’ বলা হয়েছে
Published: 2nd, December 2025 GMT
পারিবারিক জীবন মানব সমাজের ভিত্তি। একটি সুস্থ ও স্থিতিশীল পরিবার গঠনে স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকা এবং তাদের মধ্যকার সম্পর্কের সুনির্দিষ্ট বিন্যাস প্রয়োজন। ইসলাম এই সম্পর্কের কাঠামো নির্ধারণে ‘কাওয়ামাহ’ বা পুরুষের তত্ত্বাবধানের ধারণা পেশ করেছে, যা নিয়ে অনেক সময় ভুল ব্যাখ্যা বা বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা এই কাওয়ামাহ-এর মূলনীতি বর্ণনা করেছেন, “পুরুষরা নারীদের তত্ত্বাবধায়ক (কাওয়ামূন) হবে, কারণ আল্লাহ তাদের একজনকে অন্যজনের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন এবং যেহেতু তারা তাদের ধন-সম্পদ থেকে ব্যয় করে।” (সুরা নিসা, আয়াত: ৩৪)
এই আয়াতটি কাওয়ামাহ-এর প্রকৃতি ও কারণ উভয়কেই পরিষ্কার করে। এর সঠিক অর্থ অনুধাবন করা অপরিহার্য, যাতে এটিকে পুরুষের আধিপত্য বা নারীর অসম্মান হিসেবে ভুল না করা হয়।
ইসলাম স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকা এবং তাদের মধ্যকার সম্পর্কের কাঠামো নির্ধারণে ‘কাওয়ামাহ’ বা পুরুষের তত্ত্বাবধানের ধারণা পেশ করেছে, যা নিয়ে অনেক সময় বিতর্কের সৃষ্টি হয়।কাওয়ামাহ-এর প্রকৃত অর্থকাওয়ামাহ-এর আরবি মূল ‘কা-মা’ ধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ দাঁড়ানো, রক্ষা করা, তত্ত্বাবধান করা। ইসলামি পরিভাষায় কাওয়ামাহ বলতে পুরুষের সেই দায়িত্বশীল ভূমিকা বোঝায়, যেখানে সে তার পরিবার (স্ত্রী ও সন্তান) এবং সংসারের দেখাশোনা, নিরাপত্তা বিধান, পরিচালনা ও অর্থনৈতিক ভার বহন করে।
কাওয়ামাহ হল:
দায়িত্ব ও গুরুভার: এটি কোনো সম্মান বা শ্রেষ্ঠত্বের সনদ নয়, বরং এটি একটি আমানত ও গুরুদায়িত্ব।
তত্ত্বাবধায়ক ও রক্ষক: স্বামী তার স্ত্রীর আমানতদার। এবং তত্ত্বাবধায়ক এই অর্থে যে সে তার দেখভাল করবে, তার বিষয়াদি পরিচালনা করবে এবং প্রয়োজনে তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে—যেমনটি বিয়ের আগে তার অভিভাবক করতেন।
পরিচালনা ও সংশোধন: একজন কাওয়াম, পারিবারিক বিষয়ে নির্দেশ ও নিষেধের দায়িত্ব পালন করেন, যেন পরিবারের কল্যাণ নিশ্চিত হয়।
ইসলামে কাওয়ামাহ-এর উদ্দেশ্য কোনোভাবেই দাসত্ব, শোষণ বা বর্ণবৈষম্যের মতো পুরুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা নয়, বরং এর উদ্দেশ্য হল পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এই কর্তৃত্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এবং জীবনের কঠিন ভার বহনের ক্ষমতা থেকে জন্ম নেয়।
আরও পড়ুনফকিহদের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষের মধ্যকার প্রেম–ভালোবাসা২৬ জুলাই ২০২৫কাওয়ামাহ-এর ভিত্তি এবং প্রকৃতিগত পার্থক্যআল্লাহ তায়ালা কাওয়ামাহ নির্ধারণের দুটি মৌলিক কারণ উল্লেখ করেছেন:
১.
প্রকৃতিগত বা জৈবিক প্রাধান্য: আল্লাহ তায়ালা নারী ও পুরুষকে ভিন্ন ভিন্ন কাজ সম্পাদনের জন্য প্রকৃতিগতভাবে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে সৃষ্টি করেছেন। পুরুষের শারীরিক শক্তি সাধারণত বেশি, আর নারীর মানসিক ও স্নায়বিক গঠন সন্তান ধারণ, জন্মদান ও লালন-পালনের জন্য উপযোগী।
নারীর ওপর আল্লাহ তায়ালা মাসিক ঋতুচক্র, গর্ভাবস্থা, প্রসব-জনিত কষ্ট ও সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর মতো প্রাকৃতিক বিষয়গুলি নির্ধারণ করেছেন। এই সময়ে নারী শারীরিক দুর্বলতা এবং মানসিক চঞ্চলতার সম্মুখীন হন।
ইসলাম নারীর এই বিশেষ মানসিক, সামাজিক ও শারীরিক পরিস্থিতি পুরোপুরি বিবেচনা করেছে। এই সময়গুলোতে নারীর আবেগ ও অনুভূতির প্রতি সম্মান জানানো হয়েছে।
আল্লাহ নারীকে মাতৃত্বের মতো সবচেয়ে মহৎ ও সম্মানিত দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত করেছেন। তাই পরিবারের বাইরের গুরুদায়িত্ব পুরুষের ওপর অর্পণ করা হয়েছে।
এই প্রাধান্য নারীর মর্যাদা বা বুদ্ধিমত্তাকে ক্ষুণ্ণ করে না। নারীর কাজ করার ক্ষেত্র আছে, পুরুষেরও কাজ করার ক্ষেত্র আছে।সাইয়েদ মুহাম্মদ আলি নিমর, ই’দাদুল মারআতিল মুসলিমাহএটি কোনো শ্রেষ্ঠত্বের বিষয় নয়, বরং এটি দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্বের সুষ্ঠু বণ্টন। আল্লাহ তায়ালা নারী ও পুরুষের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য জানেন এবং সেই অনুসারে বিধান দিয়েছেন, যা তাদের প্রত্যেকের অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
২. অর্থনৈতিক দায়িত্ব: পুরুষের কাওয়ামাহ-এর দ্বিতীয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল তার অর্থনৈতিক দায়িত্ব। ইসলাম পরিবার প্রতিপালনের আর্থিক দায়িত্ব একচেটিয়াভাবে পুরুষের ওপর অর্পণ করেছে।
পুরুষ তার স্ত্রীর জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে বাধ্য, এমনকি স্ত্রী যদি সচ্ছল ও কর্মজীবীও হন।
তবে নারী তার উপার্জিত অর্থ নিজের ইচ্ছানুসারে ব্যবহার করার সম্পূর্ণ অধিকার রাখে। স্বামীর সম্পদে স্ত্রীর অধিকার আছে, কিন্তু স্ত্রীর সম্পদে স্বামীর কোনো অধিকার নেই।
পুরুষের এই অনন্য আর্থিক দায়িত্বের কারণেই তাকে পরিবারের তত্ত্বাবধানের ভার দেওয়া হয়েছে। এটি একটি ন্যায়সঙ্গত বিনিময়: যেহেতু পুরুষ আর্থিক ভার বহন করে, তাই তাকে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুননারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে কী বলে ইসলাম২৮ আগস্ট ২০২৫কাওয়ামাহ কি নারীর অসম্মানঅনেক সময় কাওয়ামাহ-কে নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার কারণ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে এটি কোনোভাবেই নারীকে ছোট করা বা পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যম নয়, বরং এটি হল আল্লাহর পক্ষ থেকে দায়িত্বের ন্যায্য বণ্টন।
সাইয়েদ মুহাম্মদ আলি নিমর তাঁর ই’দাদুল মারআতিল মুসলিমাহ গ্রন্থে বলেছেন, “এই প্রাধান্য নারীর মর্যাদা বা বুদ্ধিমত্তাকে ক্ষুণ্ণ করে না। নারীর কাজ করার ক্ষেত্র আছে, পুরুষেরও কাজ করার ক্ষেত্র আছে। পুরুষের ক্ষেত্রটি বিস্তৃত ও ব্যাপক, কেননা সে শারীরিকভাবে শক্তিশালী এবং আবেগের দিক থেকে তুলনামূলক কম দুর্বল। তাই ঘরের বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তার বেশি।”
ইসলাম নারীকে তার স্বকীয়তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করেছে। ইসলামের ছায়ায় নারী তার ব্যক্তিত্বের স্বাধীনতা ভোগ করে, তার মতামত প্রকাশের অধিকার রাখে এবং শান্তি ও যুদ্ধ উভয় ক্ষেত্রেই অংশ নিয়েছে। ইতিহাসে যেখানে নারী কেবল দাসী হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, ইসলাম সেখানে তাকে যথার্থ মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছে।
নারীদের ওপর পুরুষের যেমন অধিকার আছে, তেমনি পুরুষদের ওপরও নারীদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে।কোরআন, সুরা বাকারা, আয়াত: ২২৮আল্লাহ তায়ালা নারী ও পুরুষের আমলের প্রতিদান সমানভাবে দেওয়ার ঘোষণা করেছেন, “যে সৎকাজ করবে—পুরুষ হোক বা নারী, যদি সে মুমিন হয়, তবে আমি অবশ্যই তাকে দান করব এক পবিত্র জীবন এবং তারা যা করত, আমি অবশ্যই তাদেরকে তার চেয়েও উত্তম প্রতিদান দেব।” (সুরা নাহল, আয়াত: ৯৭)
পারস্পরিক অধিকার ও দায়িত্বের সমতাকোরআনে বলা হয়েছে, “নারীদের ওপর পুরুষের যেমন অধিকার আছে, তেমনি পুরুষদের ওপরও নারীদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে। তবে পুরুষের তাদের ওপর এক স্তর বেশি মর্যাদা রয়েছে। আর আল্লাহ মহা ক্ষমতাশালী, প্রজ্ঞাময়।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ২২৮)
এই ‘এক স্তর বেশি মর্যাদা’ হল সেই কাওয়ামাহ, যা অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দায়িত্বের কারণে পুরুষকে দেওয়া হয়েছে। এটি কোনোভাবেই নারীর ব্যক্তিত্বকে বিলীন করে পুরুষের ব্যক্তিসত্তায় মিশিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয় না। বরং এটিই নিশ্চিত করে যে, নারীর অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষিত থাকবে। (সুরা বাকারা, আয়াত: ২২৮)
পুরুষের কাওয়ামাহ হল আল্লাহর পক্ষ থেকে পারিবারিক ব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য নির্ধারিত একটি বিশেষ ভূমিকা ও দায়িত্ব। এর ভিত্তি হল পুরুষের প্রকৃতিগত ও আর্থিক দায়বদ্ধতা।
এই কাওয়ামাহ-এর মাধ্যমে ইসলাম নারীকে জীবনের গুরুদায়িত্ব থেকে সুরক্ষা দিয়েছে, যাতে সে মাতৃত্বের মতো মহৎ ও মূল্যবান দায়িত্ব পালনে মনোনিবেশ করতে পারে।
কাওয়ামাহ মানে কর্তৃত্ব বা আধিপত্য নয়, বরং তা হল যত্নশীলতা, প্রতিপালন ও সুরক্ষার আমানত। একজন মুমিনের দায়িত্ব হল এই কাওয়ামাহ-কে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা ও প্রজ্ঞার আলোকে গ্রহণ করে একটি সুখী, স্থিতিশীল ও ইসলামি পরিবার গড়ে তোলা।
আরও পড়ুনতথাকথিত পৌরুষের বদলে ইসলাম থেকে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার ১০ উপায়২৭ জুলাই ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আল ল হ ত য় ল দ র ওপর আর থ ক পর ব র ম হ এর কর ছ ন র জন য পর চ ল ক রআন ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য শুধু নির্বাচনই যথেষ্ট নয়: বদিউল আলম মজুমদার
বিগত সময়ে দেশে কয়েকবার সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও গণতান্ত্রিক উত্তরণ ঘটেনি বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেছেন, গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য শুধু নির্বাচনই যথেষ্ট নয়। এর জন্য প্রয়োজন আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কার।
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণ: নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বদিউল আলম মজুমদার এ কথা বলেন। গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজক সুজন। এতে সভাপতিত্ব করেন সুজনের সহসভাপতি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন।
নির্বাচন অবশ্যই গণতান্ত্রিক যাত্রার প্রথম পথ বলে মন্তব্য করেন বদিউল আলম মজুমদার। এ প্রসঙ্গে বলেন, কিন্তু নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়। অতীতে বেশ কয়েকটা নির্বাচন হয়েছে, যেগুলোকে সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ বলা যায়। কিন্তু এর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উত্তরণ ঘটেনি।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গণতান্ত্রিক উত্তরণ মানে টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। যেন প্রতিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয় এবং এর মাধ্যমে সুশাসন কায়েম হয়। মানুষের যে নাগরিক অধিকারগুলো, যে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো, সেগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু কয়েকটি সুষ্ঠু নির্বাচন সত্ত্বেও টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরি হয়নি।
সুষ্ঠু নির্বাচনের পর গণতান্ত্রিক উত্তরণ করতে হলে আরও অনেকগুলো বিষয়ের প্রতি নজর দেওয়া দরকার বলে মনে করেন বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, এর জন্য দরকার পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক অঙ্গন।
রাজনৈতিক অঙ্গন অপরিচ্ছন্ন হয়ে পড়ার কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বদিউল আলম মজুমদার উল্লেখ করেন, নির্বাচনী ব্যবস্থায় দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। অনেক খারাপ ব্যক্তি সংসদে গিয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কলুষিত করেছেন। এসব কারণে রাজনৈতিক অঙ্গন অপরিচ্ছন্ন হয়েছে।
দেশে এখন যত বড় বড় দুর্নীতি হয়, তার সবগুলো রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় হয় বলে মন্তব্য করেন বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, রাজনীতিবিদ, একশ্রেণির আমলা ও ব্যবসায়ী—এই তিন শক্তির আঁতাতে বড় দুর্নীতি হয়। এমন অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কারের ওপর জোর দেন তিনি।
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, নির্বাচনবিশেষজ্ঞ জেসমীন টুলী প্রমুখ।