‘জালিয়াতি রাষ্ট্রের’ যুগে প্রবেশ করেছে বিশ্ব
Published: 2nd, December 2025 GMT
বিস্ফোরণ শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে থেকেই মিয়ানমারে অবস্থিত বিজনেস পার্কটি খালি হয়ে যাচ্ছিল। বোমা বিস্ফোরণের পর কর্তৃপক্ষ খালি অফিস ব্লকগুলো ভেঙে ফেলে। ডিনামাইট একটি চারতলা হাসপাতাল, নীরব কারাওকে কমপ্লেক্স, জনশূন্য জিম এবং ডর্ম রুমগুলিকে ধ্বংস করে দিয়েছিল।
মিয়ানমারের জান্তার প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে কুখ্যাত ‘স্ক্যাম কেন্দ্র’ গুলোর মধ্যে অন্যতম কে কে পার্কের সমাপ্তি ঘটেছে। এই কেন্দ্রটিতে হাজার হাজার মানুষকে আটকে রাখা হয়েছিল, বিশ্বজুড়ে মানুষকে নিরলসভাবে প্রতারণা করা হয়েছিল। এখন।
কিন্তু বিজনেস পার্কের পরিচালকরা অনেক আগেই পালিয়ে গিয়েছিলেন: স্পষ্টতই একটি অভিযান শুরু হওয়ার খবর পেয়ে তারা অন্যত্র সরে গিয়েছিলেন। এছাড়া এক হাজারেরও বেশি কর্মী সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। অবশ্য এরপরেও দুই হাজার জনকে আটক করা হয়েছিল। কিন্তু ২০ হাজার কর্মী, সম্ভবত পাচার এবং নির্মমভাবে নির্যাতনের শিকারের পরে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল। এই মুহূর্তে জান্তার নজর এড়িয়ে শত শত জালিয়াতি কেন্দ্র মিয়ানমারে বিকশিত হচ্ছে।
বহু বিলিয়ন ডলারের বিশ্বব্যাপী জালিয়াতি শিল্প এতটাই প্রকট হয়ে উঠেছে যে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমরা ‘জালিয়াতি রাষ্ট্র’ এর যুগে প্রবেশ করছি। মাদকরাষ্ট্রের মতো, এই শব্দটি এমন দেশগুলোকে বোঝায় যেখানে একটি অবৈধ শিল্প বৈধ প্রতিষ্ঠানের গভীরে প্রবেশ করেছে, অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করেছে, সরকারকে দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে এবং একটি অবৈধ নেটওয়ার্কের উপর রাষ্ট্রীয় নির্ভরতা প্রতিষ্ঠা করেছে।
কে কে পার্কে অভিযান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে জালিয়াতি কেন্দ্রগুলির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারিত অভিযানের সর্বশেষ ঘটনা। তবে আঞ্চলিক বিশ্লেষকরা জানাচ্ছেন, এগুলো মূলত পারফর্মিং বা মধ্যম খেলোয়াড়দের লক্ষ্য করে, যা কর্মকর্তাদের ‘রাজনৈতিক নাটক।’ কারণ কর্মকর্তারা জালিয়াতি চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে রয়েছে। অবশ্য অত্যন্ত লাভজনক খাতকে নির্মূল করার ক্ষেত্রে তাদের খুব কম আগ্রহ রয়েছে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়া সেন্টারের ভিজিটিং ফেলো এবং মেকং-এ ট্রান্সন্যাশনাল ও সাইবার অপরাধের বিশেষজ্ঞ জ্যাকব সিমস বলেছেন, “এটি হ্যাক-এ-মোল খেলার একটি উপায়, যেখানে আপনি কোনো তিল মারতে চান না।”
সিমস জানান, গত পাঁচ বছরে জালিয়াতি ‘ছোট অনলাইন জালিয়াতির চক্র থেকে শিল্প-স্তরের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে।’
তিনি বলেন, “মোট জিডিপির দিক থেকে, এটি সমগ্র মেকং উপ-অঞ্চলের জন্য প্রভাবশালী অর্থনৈতিক ইঞ্জিন। এর অর্থ হল এটি প্রভাবশালী - যদি প্রভাবশালী না হয় - রাজনৈতিক ইঞ্জিনগুলির মধ্যে একটি।”
বর্তমানে এই স্ক্যাম বা জালিয়াতি শিল্পের বিশ্বব্যাপী আকারের আনুমানিক পরিমাণ ৭০ বিলিয়ন ডলার থেকে শুরু করে শত শত বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত। এটি এমন একটি মাত্রা যা একে বিশ্বব্যাপী অবৈধ মাদক ব্যবসার সমান করে তুলছে। কেন্দ্রগুলো সাধারণত আন্তর্জাতিক অপরাধী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, প্রায়শই চীন থেকে উদ্ভূত হয়, তবে তাদের মূল অবস্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়।
২০২৪ সালের শেষের দিকে মেকং দেশগুলো- মিয়ানমার, কম্বোডিয়া ও লাওসে সাইবার জালিয়াতি কার্যক্রম বছরে আনুমানিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার আয় করছিল, যা সম্মিলিত আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির প্রায় ৪০ শতাংশের সমান। এই সংখ্যাটি রক্ষণশীল বলে মনে করা হয় এবং ক্রমবর্ধমান।
ট্রান্সন্যাশনাল অর্গানাইজড ক্রাইমের বিরুদ্ধে গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের জেসন টাওয়ার বলেছেন, “এটি একটি বিশাল প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্র। এটি ২০২১ সাল থেকে একটি বিশ্বব্যাপী অবৈধ বাজারে পরিণত হয়েছে এবং আমরা এখন প্রতি বছর ৭০ বিলিয়ন ডলারের বেশি অবৈধ বাজারের কথা বলছি।”
ঢাকা/শাহেদ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব শ বব য প
এছাড়াও পড়ুন:
দক্ষিণ এশিয়ায় কেন ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়ছে
ভারত দক্ষিণ এশিয়ার ‘নিরাপত্তার রক্ষাকর্তা’ হিসেবে পরিচিত হতে চায়। দেশটি ধীরে ধীরে একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ প্রতিবেশী অঞ্চলের স্বাভাবিক নেতা হয়ে উঠতে চায়। কিন্তু বঙ্গোপসাগর থেকে শুরু করে হিমালয় পর্যন্ত ভারতের হস্তক্ষেপ ও নীতির কারণে বিভিন্ন দেশে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে।
পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু পানিচুক্তি একতরফাভাবে স্থগিত করা, নেপালের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ চাপানো এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের মতো কঠোর চাপ সৃষ্টির কৌশল ছোট দেশগুলোর মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়াচ্ছে।
ভারতের আধিপত্যবাদ এবং তার বিপরীতে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে, তার সবচেয়ে পরিষ্কার উদাহরণ দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে।
জটিল সম্পর্কদশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশ ও ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অংশীদার হিসেবে তুলে ধরত নয়াদিল্লি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ভারত সহযোগিতা করে। জনপ্রিয় আওয়ামী লীগকে তারা রাজনৈতিকভাবে সমর্থন দেয়। বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণেও ভারতের বড় প্রভাব ছিল।
কিন্তু ২০২৪ সালে সেই ‘কৌশলগত সম্পর্ক’ ভেঙে পড়ে। তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (যাঁকে এই অঞ্চলে ভারতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসেবে দেখা হতো) একটি ছাত্র নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। সেই আন্দোলন ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত ও দমনমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন।
বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানোর বদলে নয়াদিল্লি বাংলাদেশিদের ভিসা স্থগিত করে, কূটনৈতিক তৎপরতা কমিয়ে দেয় এবং শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেয়। আন্দোলনের সময় মানুষ হত্যার দায়ে শেখ হাসিনাকে পরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
কেন্টাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. নাজমুস সাকিব এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে বলেন, ‘বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে প্রকাশ্য স্বৈরতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে ভারতই ভূমিকা রেখেছে।’ তাঁর মতে, এর ফলে বাংলাদেশে ভারতের বিরুদ্ধে জনমত আরও শক্ত হয়েছে।
সাকিব আরও বলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত একজন পলাতককে আশ্রয় দিয়ে রাখায় ভারতের ওপর দ্বিপক্ষীয় প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী তাঁকে ফেরত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।’
আরও পড়ুনশেখ হাসিনার পরিণতি থেকে কি দিল্লি শিক্ষা নেবে১১ আগস্ট ২০২৪বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যেই শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার জন্য ভারতের কাছে আবেদন জানিয়েছে। জাতিসংঘের হিসাবে, ২০২৪ সালের সেই অভ্যুত্থান দমনে ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হন।
অতীতে বাংলাদেশ ভারতের কিছু স্পর্শকাতর অনুরোধ মেনে নিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল—ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা)-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ২০১৫ সালে ভারতে হস্তান্তর করা। তখন এটিকে দুই দেশের মধ্যে একটি বড় ‘সদিচ্ছার নিদর্শন’ হিসেবে দেখা হয়েছিল।
কিন্তু সাকিব মনে করেন, ভারত এখন শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে একই রকম সদিচ্ছা দেখাবে, এমন সম্ভাবনা খুবই কম। তিনি বলেন, ‘ভারত যদি এই চুক্তির শর্ত মানতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেটি প্রমাণ করবে যে ভারত একটি অবিশ্বাসযোগ্য মিত্র।’
এর ফলে ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও তিনি মনে করেন। সাকিব বলেন, ‘বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ অংশীদার দেশগুলো ভারতের এই আচরণ দেখবে এবং সেই অনুযায়ী তাদের অবস্থান ঠিক করবে।’
পশ্চিম সীমান্তেও পরিস্থিতি ভালো নয়ভারত ও পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই পরস্পরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। এই দুই পরমাণু শক্তিধর দেশ কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত তিনটি বড় যুদ্ধ করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, যদিও ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক অনেক আগে থেকেই উত্তপ্ত ও অচল, তবে বর্তমানে পরিস্থিতি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি অবনতি হয়েছে।
২০২৫ সালে নয়াদিল্লি সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করে। এই চুক্তিটি ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর মধ্যে তিনটি যুদ্ধ হলেও এই চুক্তি কখনো ভাঙা হয়নি। তাই এটি স্থগিত হওয়ার সিদ্ধান্ত দুই দেশের বিশেষজ্ঞদেরই চমকে দেয়।
ভারতের দিক থেকে সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয় কাশ্মীরের পেহেলগামে একটি ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর। ভারতের অভিযোগ, এই হামলার পেছনে পাকিস্তানের হাত রয়েছে। এরপর ভারত সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানের ভেতরে একাধিক স্থানে হামলা চালায়। ভারত দাবি করে, তারা সেখানকার জঙ্গি ঘাঁটি টার্গেট করেছে।
পাকিস্তান অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। তারা ভারতের এই হামলার নিন্দা জানায় এবং পাল্টা হামলা চালায়। পাকিস্তান কয়েকটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করে। এর মধ্যে একটি ছিল রাফাল। পাকিস্তানের দাবি ছিল—এটি তারা আত্মরক্ষার স্বার্থেই করেছে।
উভয় পক্ষের এই পাল্টাপাল্টি হামলায় পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠছিল। এমন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন, তিনি দুই দেশের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি করাতে পেরেছেন।
এই ঘটনার পর কূটনৈতিক যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। দুই দেশের বাণিজ্যও থেমে পড়ে। এমনকি ‘ভদ্রলোকের খেলা’ হিসেবে পরিচিত ক্রিকেট সম্পর্কও স্থগিত হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কোনো তাগিদ অনুভব করছে না।
আরও পড়ুনভারত ‘তুমি রিয়েলিটি মাইন্যে ন্যাও’০৪ ডিসেম্বর ২০২৪সীমান্ত বিরোধের জটিলতাভারতের প্রতিবেশী প্রভাবের ওঠানামা সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে দেখা যায় নেপালের ক্ষেত্রে। ইতিহাসে নেপাল ছিল একটি হিন্দুরাষ্ট্র এবং ভারতের সঙ্গে তাদের সীমান্ত খোলা ছিল। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সম্পর্কও ছিল গভীর। কিন্তু ১৯৯৬-২০০৬ সালের গৃহযুদ্ধ, মাওবাদী শক্তির উত্থান এবং ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হওয়ার পর এই সম্পর্ক বদলে যায়। এর পর থেকে নেপাল আরও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে থাকে, যা নয়াদিল্লির জন্য বিরক্তির কারণ হয়।
২০১৫ সালে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। তখন নেপালের দক্ষিণ সীমান্তে বসবাসকারী মাধেসি জনগোষ্ঠী নতুন সংবিধান নিয়ে আন্দোলন করছিল। তাদের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সেই সময় ভারত একটি ‘অঘোষিত অবরোধ’ সৃষ্টি করেছে বলে নেপাল অভিযোগ করেছিল।
এই অবরোধের কারণে নেপালে জ্বালানি, ওষুধ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ভয়াবহ সংকট দেখা দেয়। ভারত বলে, তারা কোনো অবরোধ দেয়নি। কিন্তু নেপালে ভারতের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই ক্ষতি আজও কাটেনি।
২০২৫ সালে নেপালে নতুন করে রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হলে সেই পুরোনো ক্ষোভ আবার জেগে ওঠে। যেসব নেতা ভারতের খুব কাছের বলে মনে করা হতো, তাঁরা ক্ষমতাচ্যুত হন। নতুন সরকার আবারও চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই)-এর প্রকল্পগুলো চালু করে, যেগুলো আগে বন্ধ ছিল।
একই সঙ্গে নেপাল কালাপানি অঞ্চল ও লিপুলেখ গিরিপথ নিয়ে ভারতের সঙ্গে নতুন করে বিরোধের বিষয়টি সামনে আনে।
বিশেষ করে লিপুলেখ গিরিপথ পর্যন্ত ভারতের তৈরি ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তা নিয়ে নেপালের ক্ষোভ সবচেয়ে বেশি। এই পথটি হিমালয়ের একটি কৌশলগত রুট। এটি ভারত-চীন-নেপাল সীমান্তের কাছাকাছি। এটি বাণিজ্য ও কৈলাস পর্বতে তীর্থযাত্রার জন্য ব্যবহৃত হয়।
নেপালের দাবি, এই রাস্তা ১৮১৬ সালের সুগৌলি চুক্তি লঙ্ঘন করে এবং তাদের ভূখণ্ডে ভারতের অনুপ্রবেশের শামিল।
এই বিরোধ থেকেই নেপালে ‘#BackOffIndia’ নামে একটি অনলাইন প্রচারণা শুরু হয়। এটিকে পরে মালদ্বীপে দেখা দেওয়া ‘#IndiaOut’ আন্দোলনের পূর্বাভাস হিসেবেই ধরা হয়।
আরও পড়ুনগণ–অভ্যুত্থানে বাংলাদেশ–নেপালে যে ৫টি জায়গায় বিস্ময়কর মিল ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫‘#IndiaOut’ আন্দোলনের প্রতিধ্বনিভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ঘনিষ্ঠ কৌশলগত, সামরিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে চিত্র বদলে যায়। সে বছর মালদ্বীপে মোহাম্মদ মুইজ্জু নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। তাঁর নির্বাচনী প্রচারণার মূল বার্তা ছিল—মালদ্বীপকে ভারতের প্রভাববলয় থেকে সরিয়ে আনতে হবে।
মালদ্বীপে ‘#IndiaOut’ আন্দোলন ২০২২-২৩ সালের দিকে সবচেয়ে জোরালো হয় এবং মুইজ্জুর ক্ষমতায় আসার পর আবার গতি পায়। এই আন্দোলনের মূল অভিযোগ ছিল—মালদ্বীপের মাটিতে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাদের মাধ্যমে ভারত দেশটির প্রতিরক্ষা ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অযথা প্রভাব বিস্তার করছে।
বাস্তবে মালদ্বীপে ভারতীয় সেনাসদস্যের সংখ্যা খুব কম ছিল। তাদের বেশির ভাগই ছিল হেলিকপ্টার ও বিমান রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা টেকনিশিয়ান। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক প্রভাব ছিল অনেক বড়।
মুইজ্জু এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগান। তিনি প্রকাশ্যে মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের দাবি তোলেন। একই সঙ্গে অবকাঠামো উন্নয়ন ও নিরাপত্তা বিষয়ে তিনি চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং তাদের সঙ্গে অংশীদারত্ব গড়ে তোলেন।
আরও পড়ুনশ্রীলঙ্কায় ভ্রমণ: অভ্যুত্থানের আগে–পরে বাংলাদেশের সঙ্গে মিল–অমিল২৬ নভেম্বর ২০২৫রাজনৈতিক ভারসাম্যের খেলাশ্রীলঙ্কায় নির্বাচন সামনে থাকলে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী রাজনীতিবিদেরা প্রায়ই ভারতবিরোধী বক্তব্য ব্যবহার করেন। এর ফলে অতীতেও ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে।
২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ভয়াবহভাবে ভেঙে পড়ে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফুরিয়ে যায়। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। দেশজুড়ে জ্বালানি ও ওষুধের সংকট দেখা দেয়। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষেকে পদ ছেড়ে পালাতে হয়। এটিকে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে ধরা হয়।
এই পরিস্থিতিতে ভারত প্রথম দেশ হিসেবে শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়ায়। ভারত প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণসুবিধা দেয়। জ্বালানি ও প্রয়োজনীয় পণ্য পাঠায়।
কলম্বোর ভেরিতে রিসার্চের সিনিয়র প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর মালিন্দা মিগোদা বলেন, ‘সেই কঠিন সময়ে মানুষ ভারতকে প্রথম সাড়া দেওয়া দেশ হিসেবে দেখেছে। তাদের ভূমিকা কোনোভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।’ তবে কিছুদিনের মধ্যেই বিতর্ক শুরু হয়।
আরও পড়ুনদক্ষিণ এশিয়ায় নতুন রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা ও কূটনীতির টানাপোড়েন০১ জানুয়ারি ২০২৫আদানি প্রকল্প নিয়ে বিতর্কসবচেয়ে বড় বিতর্ক তৈরি হয় মান্নার ও পুনেরিন এলাকায় আদানির উইন্ড পাওয়ার (বায়ুবিদ্যুৎ) প্রকল্প নিয়ে। শ্রীলঙ্কার সমালোচকদের অভিযোগ, এই চুক্তির জন্য নয়াদিল্লি অনেক চাপ দিয়েছে। তাঁরা আরও বলেন, এই প্রকল্পের বিদ্যুৎমূল্য স্থানীয় বিকল্পগুলোর তুলনায় অনেক বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরোধীরা অভিযোগ করেন, গৌতম আদানির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক প্রায় ২০ বছরের পুরোনো। মোদি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন থেকেই এই সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গুজরাটই তাঁদের দুজনের রাজ্য।
আরও অভিযোগ করা হয়, মোদি সরকার আদানি ও তাঁর ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যকে ঘুষ ও জালিয়াতির অভিযোগ থেকে রক্ষা করেছে। তবে মোদি ও আদানি—দুজনই এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
আরও একটি অভিযোগ উঠে আসে। সেটি হলো, শ্রীলঙ্কা আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণখেলাপি হওয়ার আগে ভারতের কাছ থেকে পাওয়া কিছু ঋণ ব্যবহার করে ভারতেরই কিছু প্রতিষ্ঠানের আগের ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে কলম্বো সরকার কোনো স্পষ্ট মন্তব্য করেনি।
মিগোদা বলেন, এসব ঘটনা মানুষের মনে বিভ্রান্তি ও সন্দেহ তৈরি করেছে। তবে তিনি এটাও বলেন, আদানির প্রকল্প নিয়ে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, তার পেছনে শুধু ভারতবিরোধিতা কাজ করেনি, স্বচ্ছতার অভাব ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কাও বড় কারণ ছিল।
মিগোদার ভাষায়, ‘ভারত ও চীন—দুই দেশই শ্রীলঙ্কায় স্বচ্ছতা ছাড়া অর্থায়ন, নিজেরাই প্রস্তাব চাপিয়ে দেওয়া এবং দুর্বল তদারকির জন্য সমালোচনার মুখে পড়েছে। এর ফলে অনেক প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে বা মাঝপথে আটকে গেছে, আর জনগণের আস্থা নষ্ট হয়েছে।’
আরও পড়ুনকাবুল–দিল্লির সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা পাকিস্তানকে যে উদ্বেগে ফেলল১৭ অক্টোবর ২০২৫ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সম্পর্কের অতীতভারত ও শ্রীলঙ্কার সম্পর্ক কখনো উষ্ণ, কখনো আবার টানাপোড়েনপূর্ণ ছিল। তবে গৃহযুদ্ধ এই সম্পর্কে সবচেয়ে বড় ছায়া ফেলেছে।
আশির দশকের শেষ দিকে, তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে একটি চুক্তি করিয়ে দিয়ে ভারত শ্রীলঙ্কায় শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠায়। কিন্তু এতে ভারত নিজেই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে এবং দুই দেশের মধ্যে আস্থার বড় ক্ষতি হয়।
২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর পরিস্থিতি বদলায়।
২০০৬ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে শ্রীলঙ্কা যখন গৃহযুদ্ধ শেষ করার চেষ্টা করে, তখন ভারত গোপনে গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে এবং কূটনৈতিকভাবে সাহায্য করে। তবে একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের ক্ষতির বিষয়ে সতর্কও করে।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর শ্রীলঙ্কা যখন চীনের অর্থায়নে বড় অবকাঠামো প্রকল্প নিতে শুরু করে, তখন ভারত আবার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ভারত মনে করে, এতে ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাব বাড়ছে।
এখনো দড়ির ওপর হাঁটছে শ্রীলঙ্কাএখনো শ্রীলঙ্কা খুব সতর্কভাবে চলার চেষ্টা করছে।
ভারত-শ্রীলঙ্কা স্থল সেতু (ল্যান্ড ব্রিজ) প্রকল্প বাতিল করা এবং আবার আদানির উইন্ড পাওয়ার প্রকল্প পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত থেকে বোঝা যায়, কলম্বো তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষা করতে চায়।
অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা নীরবে চীনের গবেষণা জাহাজ আসার সংখ্যা সীমিত করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগকে প্রশমিত করার কৌশল।
মিগোদা বলেন, ‘শ্রীলঙ্কা কোনো পক্ষ নিতে চায় না। কিন্তু তাদের সক্ষমতা সীমিত, অর্থনীতির ওপর নির্ভরতা বেশি এবং কূটনৈতিক বার্তায় একধরনের অস্পষ্টতা রয়েছে। তাই তাদের নিরপেক্ষ অবস্থান অনেক সময় দুর্বল ও বিভ্রান্তিকর হয়ে পড়ে।’
‘ধসে পড়া ট্রেনের মতো অবস্থা’ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু, কলম্বো থেকে মালেতে একটি বিষয় খুব স্পষ্ট। সেটি হলো, ভারত যত বেশি চাপ দিচ্ছে, তার প্রতিবেশী দেশগুলো তত দ্রুত বিকল্প কোনো শক্তির দিকে ঝুঁকছে।
এই প্রতিক্রিয়া আসছে এমন একসময়, যখন ভারত বিশ্বমঞ্চে নিজের প্রভাব বাড়াতে চাচ্ছে।
ভারত নিজেকে বেইজিংয়ের (চীনের) বিপরীতে একটি শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। সেই সঙ্গে জি-২০, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বড় ভূমিকা নিতে চায়।
ভারত বিদেশে মানবিক সহায়তা, সমুদ্র টহল এবং শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের কথা তুলে ধরে। কিন্তু দেশটির ভেতরের সমালোচকেরা বলেন, নিজের প্রতিবেশীদের ক্ষেত্রে ভারত একটি দাদাগিরিমূলক শক্তির মতো আচরণ করে। তারা ছোট দেশগুলোর রাজনীতি, প্রতিরক্ষা এবং বাণিজ্যিক সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করতে চায়।
ড. সাকিব বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিবেশী অঞ্চলে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি পুরোপুরি একটি “ট্রেন রেক” বা রেল দুর্ঘটনার মতো হয়ে গেছে।’
উমর বিন জামাল টিআরটি ওয়ার্ল্ড–এর প্রযোজক
টিআরটি ওয়ার্ল্ড থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ