কড়াইলের বস্তির ঘটনাটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু আমরা যেন প্রতিটা ট্র্যাজেডির পর একই জায়গা থেকে শুরু করি, যেন কিছুই শিখিনি। আসল সমস্যাটা হলো, কোনো ঘটনা ঘটার পর আমরা খুব কমই ‘রুট কজ অ্যানালাইসিস’ করি। নিজেদের কাছে প্রশ্ন করি না, কড়াইলের বস্তি তৈরি হলো কেন? মানুষ সেখানে আশ্রয় নিচ্ছে কেন? রাষ্ট্র হিসেবে আমরা কেন সুবিধাবঞ্চিতদের ন্যূনতম সাপোর্ট দিতে পারছি না? ব্যাপারটা এমন নয় যে আমাদের রিসোর্স নেই। সমস্যা হচ্ছে আমরা রাষ্ট্র চালানোর জন্য যে মানসিক পরিপক্বতা দরকার, সেই শিক্ষা এখনো ঠিকমতো শিখিনি।

ধরুন, অ্যাফোর্ডেবল হাউজিং (সাধ্যের মধ্যে আবাসনসুবিধা)—পৃথিবীর অনেক দেশে এটা সরকারই দেয় একটা মৌলিক অধিকার হিসেবে। নিউইয়র্কের নির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানি তাঁর নির্বাচনী প্রচারণার শুরুই করেছেন এই সুবিধার বিষয়টি সামনে এনে। কিন্তু আমরা কেন সেটা পারছি না? সোশ্যাল সেফটি নেট প্রোগ্রাম বা সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো কেন ঠিকমতো কাজ করছে না? বাজেট আছে, প্রকল্প আছে, অথচ তা যাদের কাছে পৌঁছানোর কথা বা যাদের সুবিধাভোগ করার কথা তা কেন হচ্ছে না।

কারণ খুব সহজ। আমাদের কাছে সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য একটা শক্তিশালী আইডেনটিফিকেশন সিস্টেম বা তাঁদের শনাক্ত করার সুযোগ নেই। মানুষটা কে, তার আয় কত, সে আসলে কতটা সুবিধাবঞ্চিত—এসব জানার জন্য যে ডেটা লাগে, সেটা বছরের পর বছর কেউ বানায়নি। অথচ এটা একটা প্রায়োরিটি। বর্তমান প্রযুক্তি দিয়ে এটা করা সম্ভব কম খরচে।

বাংলাদেশকে নিয়ে বহু কোম্পানি, অনেক ইউনিভার্সিটি আমাদের কাছ থেকে ডেটা নিয়ে প্রচুর কাজ করেছে, কিন্তু সেটা আমরা কখনো গ্রহণ করিনি। আমাদের দেশে অনেক ডেটা আছে, কিন্তু সেটাকে কখনো প্লটিং করে দেখিনি। গুগল যদি বিদেশি কোম্পানি হয়ে আপনার গাড়ির বাম্পার থেকে আগের গাড়ির বাম্পারের হিসাব অথবা ভূমিকম্পের হিসাব রাখতে পারে, তাহলে আমরা পারছি না কেন?

আজকে ইউটিউবে একটা ডকুমেন্টারি দেখছিলাম—গুগল ডিপমাইন্ডের ‘দ্য থিংকিং গেম’। সেখানে দেখাচ্ছে, কীভাবে পৃথিবী এখন যন্ত্রকে ব্যবহার করছে চিন্তা করার জন্য, সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য, কাজকে আরও স্মার্ট করার জন্য। আর আমরা? সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যন্ত্রকে ব্যবহার করা তো দূরের কথা, যে বেসিক সিস্টেমটা দরকার, সেটাও তৈরি করছি না যন্ত্রের সাহায্যে। ফলে মানুষ রোজকার জীবনে প্রাকৃতিক সমস্যা, দুর্ঘটনা, ভূমিকম্প, আগুন, বন্যা—এসবের সামনে বারবার হেরে যাচ্ছে।

এটা ঠিক যে মানুষের একটা ইগো আছে। সে ভাবছে, যন্ত্র আমাদের থেকে বুদ্ধিমান হতে পারে না। কিন্তু যন্ত্রকে ব্যবহার করে আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে ১০০ গুণ বাড়িয়ে যে বড় বড় সমস্যা মানে ড্রাগ ডিসকভারির মতো কাজ করা যায়, সেটা আমরা দেখেছি কোভিডের সময়। একই কাজ হয়েছে প্রোটিন ফোল্ডিং সমাধানে। এটা চিন্তাই করা যেত না কয়েক বছর আগে। কারণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সহযোগী বানিয়েছে অনেক দেশ ও কোম্পানি। আমাদের বিশ্বাস করতে হবে বর্তমান প্রযুক্তিকে।

কড়াইলে আগুন লাগার পর মানুষ দৌড়াদৌড়ি করছে, বাচ্চাদের কোলে নিয়ে পানি খুঁজে আনছে, জিনিসপত্র বাঁচাচ্ছে, তারা শুধু বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। তারা শহরে এসেছে, কারণ গ্রামে কাজ নেই। বস্তিতে এসেছে, কারণ তার সাধ্য অনুসারে শহরে থাকার মতো জায়গা নেই। তাদের দোষটা কোথায়?

আমাদের সমস্যা হলো আমরা ইভেন্ট দেখি, কিন্তু সিস্টেম দেখি না। আমরা আগুন দেখি, কিন্তু আগুন কেন বারবার লাগে, সেটা দেখি না। কড়াইলে অনেক ঘরে ইলেকট্রিক লাইন নিজেরাই টানতে হয়, ওগুলো নিরাপদ নয়। কিন্তু কেন নিরাপদ নয়? কারণ, একজন নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সিস্টেম বানানোই হয়নি। কেউ তাদের ‘ইউজার’ ধরে ডিজাইনই করেনি।

একটা উদাহরণ দিই। সিঙ্গাপুরে হাউজিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বোর্ড আছে। তারা নিশ্চিত করে যে সব নাগরিকের সাশ্রয়ী মূল্যে বাসস্থান আছে। এটা কোনো দাতব্য কাজ নয়, এটা একটা পলিসি। একটা ভিশন। তারা বুঝেছে, একজন মানুষ যদি নিরাপদ ঘরে না থাকতে পারে, তাহলে সে কখনো উৎপাদনশীল নাগরিক হতে পারবে না। কিন্তু আমরা এই সহজ জিনিসটা বুঝি না। আমরা ভাবি, বস্তিবাসীরা সমস্যা। কিন্তু আসলে তারা সমস্যার শিকার।

‘ডেটা-ড্রিভেন ডিসিশন মেকিং’—এই শব্দবন্ধ আমরা শুনি, কিন্তু কাজে লাগাই না। আমাদের হাতে অনেক ডেটা আছে—মোবাইল ব্যাংকিং, সিডিআর থেকে শুরু করে জাতীয় পরিচয়পত্র পর্যন্ত। কিন্তু এই ডেটাগুলোকে একসঙ্গে করে, পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ করে যারা সত্যিই দরিদ্র তাদের খুঁজে বের করে সাহায্য পৌঁছানোর সিস্টেম আমাদের নেই। ফলে দেখা যায়, যারা সত্যিই সাহায্য পাওয়ার কথা, তারা বাদ পড়ে যায়। আর যারা একটু বেশি স্মার্ট, তারা সব সুবিধা নিয়ে নেয়।

প্রযুক্তি এখন এতটাই এগিয়েছে যে আমরা চাইলে প্রতিটা সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের একটা প্রোফাইল তৈরি করতে পারি। তাদের আয়, পরিবারের সদস্যসংখ্যা, বাসস্থানের অবস্থা—সবকিছু। এরপর মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে আমরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোকে চিহ্নিত করতে পারি। তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রোগ্রাম করতে পারি। কিন্তু সেটা করতে হলে প্রথমে আমাদের মানসিকতা পাল্টাতে হবে। বুঝতে হবে যে প্রযুক্তি শুধু ফেসবুক চালানো বা ই-কমার্স করার জন্য নয়, এটা রাষ্ট্র চালানোর জন্যও দরকার।

এভাবে আর কত দিন চলবে? আমরা কি তাহলে কখনো শিখব না? প্রতিবছর আগুন লাগবে, আমরা টিভিতে দেখব, দুই দিন আলোচনা হবে, তারপর আবার চুপ। কিন্তু সেই মূল প্রশ্নটা থাকবে— রাষ্ট্র কেন তার সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত নাগরিকদের পাশে দাঁড়াতে পারে না? এ প্রশ্নই আমাদের শেখা উচিত। কারণ, যত দিন না শেখার মনোভাব আসে, তত দিন প্রতিবার বস্তির আগুন নিভবে আপাতত। কিন্তু সমস্যার আগুন নিভবে না।

রকিবুল হাসান টেলিকম, অটোমেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় মানবিক রাষ্ট্র’ বইয়ের লেখক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর ব দ ধ মত ত আম দ র র জন য সমস য

এছাড়াও পড়ুন:

স্মার্টফোনে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাপ বাধ্যতামূলক করেছে মোদি সরকার, এ নিয়ে কেন এত উদ্বেগ

ভারতে স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক সব প্রতিষ্ঠানকে উৎপাদনের সময় স্মার্টফোনে সরকারি সাইবার নিরাপত্তা অ্যাপ ইনস্টল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপের কারণে নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও সরকারি নজরদারি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

গত সপ্তাহে পাস হওয়া আদেশটি গতকাল সোমবার প্রকাশ্যে আসে। এতে স্মার্টফোন প্রস্তুতকারকদের ৯০ দিনের মধ্যে সব নতুন ডিভাইসে সরকারের ‘সঞ্চার সাথি’ অ্যাপটি যুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। আদেশে আরও বলা হয়েছে, অ্যাপটির ‘কার্যকারিতা নিষ্ক্রিয় বা সীমাবদ্ধ করা যাবে না।’

ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নাগরিকেরা যেন ফোন যাচাই করতে পারেন এবং টেলিকম সম্পদের অপব্যবহারের সন্দেহ হলে অভিযোগ জানাতে পারেন, সে জন্য এই অ্যাপ প্রয়োজন। তবে সরকারের এই উদ্যোগ সমালোচনার মুখে পড়েছে। সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারে হস্তক্ষেপ।

অ্যাপটির গোপনীয়তা নীতিমালায় বলা হয়েছে, এটি ফোনকল করা ও পরিচালনা, বার্তা পাঠানো, কল ও বার্তার লগ, ছবি, ফাইল এবং ফোনের ক্যামেরায় প্রবেশ করতে পারবে।

ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশন নামের স্থানীয় একটি অ্যাডভোকেসি গ্রুপ বলেছে, ‘সহজ কথায়, এই নির্দেশ ভারতে বিক্রি হওয়া প্রতিটি স্মার্টফোনকে রাষ্ট্র-নির্ধারিত সফটওয়্যার রাখার মাধ্যমে পরিণত করবে, যা এই সফটওয়্যার ব্যবহারকারীরা চাইলেও প্রত্যাখ্যান, নিয়ন্ত্রণ বা সরাতে পারবেন না।’

ব্যাপক সমালোচনার মুখে ভারতের যোগাযোগমন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া অবশ্য জানিয়েছেন, মুঠোফোন ব্যবহারকারীরা চাইলে অ্যাপটি মুছে (আন-ইনস্টল) ফেলতে পারবেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে তিনি লিখেছেন, ‘এটি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবী ও গণতান্ত্রিক একটি ব্যবস্থা। ব্যবহারকারীরা চাইলে অ্যাপটি সক্রিয় করে এর সুবিধা নিতে পারেন। আর না চাইলে যেকোনো সময় মোবাইল ফোন থেকে সহজেই এটি মুছে ফেলতে পারেন।’

তবে সরকারি আদেশে যেখানে বলা হয়েছে অ্যাপটির কার্যকারিতা ‘নিষ্ক্রিয় বা সীমাবদ্ধ করা যাবে না’, সেখানে কীভাবে এটি মুছে ফেলা সম্ভব, সেই বিষয় তিনি স্পষ্ট করেননি।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে চালু হওয়া ‘সঞ্চার সাথি’ অ্যাপের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা ডিভাইসের আইএমইআই (ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি) নম্বর পরীক্ষা, হারানো বা চুরি যাওয়া ফোন সম্পর্কে অভিযোগ জানাতে এবং সন্দেহজনক প্রতারণামূলক যোগাযোগ চিহ্নিত করতে পারছেন।

ভারতের টেলিকম বিভাগের এক বিবৃতিতে বলা হয়, নকল বা পরিবর্তিত আইএমইআই নম্বরযুক্ত মোবাইল হ্যান্ডসেট সাইবার নিরাপত্তার জন্য ‘গুরুতর হুমকি’ তৈরি করে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘ভারতে ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের একটি বড় বাজার রয়েছে। সেখানে চুরি যাওয়া বা কালো তালিকাভুক্ত ফোনও বিক্রি হতে দেখা যায়।’

নতুন নিয়ম অনুযায়ী, উৎপাদনের সময় ইনস্টল করা অ্যাপটি ডিভাইস চালুর সময় ব্যবহারকারীর কাছে ‘সহজে দৃশ্যমান ও ব্যবহারযোগ্য’ হতে হবে। স্মার্টফোন প্রস্তুতকারকদের কারখানায় থাকা, কিন্তু এখনো বিক্রি হয়নি, এমন ডিভাইসেও সফটওয়্যার আপডেটের মাধ্যমে অ্যাপটি যুক্ত করার ‘চেষ্টা’ চালাতে বলা হয়েছে। সব কোম্পানিকে ১২০ দিনের মধ্যে এই আদেশ পালনের বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।

ভারতের সরকার বলছে, এই পদক্ষেপ টেলিকম খাতের সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করবে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অ্যাপটি ইতিমধ্যে সাত লাখের বেশি হারানো ফোন উদ্ধার করতে সাহায্য করেছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যাপটির বিস্তৃত পরিসরে নানা অনুমতি নজরদারির সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

প্রযুক্তি বিশ্লেষক প্রশান্ত কে রায় বলেন, মূল উদ্বেগ হলো, ভবিষ্যতে অ্যাপটিকে ডিভাইসে কতটুকু প্রবেশাধিকার দেওয়া হতে পারে, তা নিয়ে। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি না, অ্যাপটি কী কাজ করছে। তবে এটি টর্চলাইট থেকে শুরু করে ক্যামেরা পর্যন্ত, প্রায় সবকিছুর অনুমতি চাইছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটি নিজেই একটি উদ্বেগের বিষয়।’

প্রশান্ত কে রায় আরও বলেন, এই আদেশ মেনে চলা ফোন নির্মাতাদের জন্য কঠিন হবে। কারণ, এটি অ্যাপলসহ বেশির ভাগ কোম্পানির নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

অ্যাপল এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে রয়টার্স জানিয়েছে, কোম্পানিটি এই নির্দেশ মানতে চায় না এবং ‘দিল্লিকে তাদের উদ্বেগের কথা জানাবে।’

অবশ্য ডিভাইস যাচাই–সংক্রান্ত নিয়ম কঠোর করার ক্ষেত্রে ভারতই একমাত্র দেশ নয়। গত আগস্টে রাশিয়া সব ফোন ও ট্যাবলেটে রাষ্ট্রসমর্থিত ‘ম্যাক্স মেসেঞ্জার’ অ্যাপ আগে থেকে ইনস্টল করা বাধ্যতামূলক করেছে। সেটি নিয়েও একই ধরনের গোপনীয়তা ও নজরদারির উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল।

সম্পর্কিত নিবন্ধ