এলসা বার্কার (১৮৬৯-১৯৫৪) ছিলেন একজন আমেরিকান কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও ছোটগল্প লেখক। সাহিত্য, আধ্যাত্মিকতা ও মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন তিনি। তাঁর রচনাগুলো প্রধানত আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান, মৃত্যুর পরের জীবন এবং মানুষের আত্মিক যাত্রাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। খ্রিষ্টান পটভূমি থেকে উদ্ভূত হলেও তাঁর দর্শন ছিল একটি মিশ্রিত বা একলেকটিক প্রকৃতির—থিওসফি, রোজিক্রুসিয়ান মতবাদ ও অকাল্টচর্চার সঙ্গে যুক্ত। তিনি সেক্যুলার চিন্তাধারার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতাকে মেলাতেন, যা তাঁর রচনায় স্পষ্ট।
এলসা বার্কারের জীবন ছিল সংগ্রাম, অনুসন্ধান ও সৃজনশীলতার এক মিশ্রণ। তিনি ১৮৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্মন্টের লেইসেস্টারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা অ্যালবার্ট জি বার্কার ও মাতা লুইস মারি বার্কার। তাঁর মা–বাবা উভয়েই তাঁর কৈশোরকালে মারা যান, যা তাঁর জীবনকে প্রভাবিত করে। এই ক্ষতি তাঁকে স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করতে বাধ্য করে। তিনি শর্টহ্যান্ড রিপোর্টার, শিক্ষক ও সংবাদপত্রের সংবাদদাতা হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। ১৯১০ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত তিনি ইউরোপে বসবাস করেন—প্রথমে প্যারিসে, পরে লন্ডনে। এখানে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা দেখেন। ১৯২৮-১৯৩০ সালে ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরায় থাকেন।
বার্কারের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান। ১৯১২ সালে প্যারিসে থাকাকালীন তিনি অটোম্যাটিক রাইটিংয়ের মাধ্যমে মৃত্যুর পরের জগৎ থেকে বার্তা পান বলে দাবি করেন। এটি তাঁর রচনার একটি মূল অংশ হয়ে ওঠে।
এলসা বার্কার ১৯৫৪ সালের ৩১ আগস্ট মারা যান। তাঁর জীবনকালে তিনি সাহিত্যিক ও আধ্যাত্মিক সমাজে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর রচনায় তার প্রতিফলন রয়েছে।
বার্কারের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান। ১৯১২ সালে প্যারিসে থাকাকালীন তিনি অটোম্যাটিক রাইটিংয়ের মাধ্যমে মৃত্যুর পরের জগৎ থেকে বার্তা পান বলে দাবি করেন।এলসা বার্কারের দর্শন ছিল খ্রিষ্টান, সেক্যুলার ও একলেকটিকের একটি সমন্বয়। তাঁর পিতার প্রভাবে তিনি অকাল্ট বা গুপ্তবিদ্যায় আগ্রহী হন এবং থিওসফিক্যাল সোসাইটির সদস্য হন। তিনি রোজিক্রুসিয়ান অর্ডার অব আলফা এট ওমেগাতে দীক্ষিত হন। তাঁর দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মৃত্যুর পরের জীবন, আত্মার অমরত্ব ও মানুষের আধ্যাত্মিক যাত্রা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে শারীরিক মৃত্যুর পরও আত্মা বা চেতনা জীবিত থাকে এবং তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব, যা তাঁর অটোম্যাটিক রাইটিংয়ের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তাঁর লেখালেখিতে তিনি প্রায়ই পুনর্জন্ম, কর্মফল ও মানবাত্মার গভীর রহস্য নিয়ে আলোচনা করেছেন।
১৯১৫ সাল থেকে তিনি মনোবিশ্লেষণে আগ্রহী হন এবং ১৯১৯ সালে দিনে ১৪ ঘণ্টা এটি অধ্যয়ন করেন। তাঁর দর্শন খ্রিষ্টান ভাবধারার সঙ্গে প্রাচ্য দর্শনের মিশ্রণ। এর লক্ষ্য প্রেম, জ্ঞান ও অজানাকে অনুসন্ধান করা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে মানুষের আত্মা অমর এবং জীবন একটি যাত্রা। তাঁর কবিতা ও অন্যান্য রচনায় এর প্রতিফলন দেখা যায়। তাঁর দর্শন সেক্যুলার। কারণ, তিনি বৈজ্ঞানিক মনোবিশ্লেষণকে অন্তর্ভুক্ত করেন, কিন্তু একলেকটিক। কারণ, এতে অকাল্ট ও থিওসফির প্রভাব রয়েছে। বার্কারের দর্শন ছিল মূলত আধ্যাত্মিক ও রহস্যবাদী।
১৯১২ সালে প্যারিসে থাকাকালে অটোম্যাটিক রাইটিং চর্চাকালে বার্কার একটি রহস্যময় বার্তা লাভ করেন বলে দাবি করেন। বার্কার বিশ্বাস করতেন, এই লেখাগুলো এসেছে বিচারক ডেভিড পি হ্যাচ নামের এক প্রয়াত বন্ধুর আত্মা থেকে। ১৯১০ সালে জাজ হ্যাচ মারা যান। এর কিছুদিন পর এলসা ট্রান্স-অবস্থায় লেখালেখি শুরু করেন এবং একের পর এক চিঠি নেমে আসে তাঁর কলমে।
এই বার্তাগুলো নিয়ে এলসা বার্কার ‘লেটার ফ্রম আ লিভিং ডেড ম্যান’ (১৯১৪) বইটি রচনা করেন। বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এ বই মূলত আত্মার সঙ্গে যোগাযোগের ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছিল এবং এটি তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজগুলোর মধ্যে একটি। এরপর তিনি এই সিরিজের আরও কয়েকটি বই লেখেন, যেমন ‘ওয়ার লেটার ফ্রম আ লিভিং ডেড ম্যান’ (১৯১৫) এবং ‘লাস্ট লেটার ফ্রম দ্য লিভিং ডেড ম্যান’ (১৯১৯)। তিনি ছোটগল্প ও নাটকও লিখেছেন।
১৯১২ সালে প্যারিসে থাকাকালে অটোম্যাটিক রাইটিং চর্চাকালে একটি রহস্যময় বার্তা লাভ করেন বলে দাবি করেন। বার্কার বিশ্বাস করতেন, এই লেখাগুলো এসেছে বিচারক ডেভিড পি হ্যাচ নামের এক প্রয়াত বন্ধুর আত্মা থেকে।কবি হিসাবে এলসা বার্কার বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তাঁর কবিতা আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান, প্রেম, মৃত্যু ও মানুষের জীবনের যাত্রাকে কেন্দ্র করে। তাঁর কবিতায় রহস্যবাদী ও দার্শনিক ছোঁয়া রয়েছে, যা খ্রিষ্টান ও থিওসফিক্যাল প্রভাব দেখায়। তাঁর প্রধান কবিতা সংকলন হলো ‘দ্য ফ্রোজেন গ্রেইল অ্যান্ড আদার পোয়েমস’ (১৯১০)। এতে তিনি মেরু অভিযাত্রী রবার্ট পিয়ারির অভিযানকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করে আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান বর্ণনা করেন। উদাহরণস্বরূপ, ‘দ্য ফ্রোজেন গ্রেইল’ কবিতায় তিনি লেখেন—
কেন গাইব পবিত্র গ্রেইলের কিংবদন্তি,
পবিত্র কবরের মৃত ধর্মযোদ্ধাদের,
যখন এই মানুষেরা জীবিত?
এ কবিতায় বার্কার মানুষের সাহস ও অজানাকে জয় করার দর্শন তুলে ধরেন। অন্যান্য কবিতা যেমন ‘হি হু নোজ লাভ’ প্রেমকে একটি দার্শনিক উপাদান হিসেবে দেখায়—
যে প্রেমকে জানে
যে প্রেমকে জানে—সে নিজেই প্রেম হয়ে ওঠে, আর তার চোখ
প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ে প্রেমকে দেখে,
এমনকি যারা প্রেমহীন তাদেরও।
এটি থিওসফির প্রভাব দেখায়, যেখানে প্রেম সবাইকে এক করে। তাঁর কবিতা সাধারণত ছন্দোবদ্ধ, রূপকময় ও আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানী।
এলসা বার্কারের একগুচ্ছ কবিতাযখন আমি মৃত হব আর ধুলোর বোন
যখন আমি মৃত হব, আর ধুলোর বোন,
যখন আর লালসায় পান করব না
মানবপ্রেমের রসের পেয়ালা;
যখন পাণ্ডুর প্রসারপিনা
আমাকে ঢেকে দেবে পপি ফুলের চাদরে,
আর শীতল মরচে কেটে দেবে
আমার বীণার তারগুলো—
যখন সূর্য আমায় ঠেলে দেবে মাটির নিচে,
বিশ্ব-লতার খাদ্য হতে—
মানুষ খুঁজে পাবে তখন আমার এই পুরোনো গানগুলো
আর বলবে: ‘এই নারী বেঁচেছিল—কবিদের মতোই বাঁচতে হয়!’
এই নারী বেঁচেছিল আর জীবনকে তলোয়ারের মতো পরে নিয়েছিল
জ্ঞান জয় করার জন্য;
এই মৃত নারী পড়েছিল প্রেমের সিল-মোড়ানো গ্রন্থ
আর রেখেছিল দাগে দাগে তার অর্থগুলো।
তারপর সে ছড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্বাসের পাল,
অজানা অঞ্চলের খোঁজে যাত্রা করে
গানের সুরে এগিয়ে গেল মৃতের নদী ধরে।
যে প্রেমকে জানে
যে প্রেমকে জানে, সে নিজেই প্রেম হয়ে ওঠে, আর তার চোখ
প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে প্রেমকে দেখে,
এমনকি যারা প্রেমহীন তাদেরও: যেমন সূর্যের আলো
যাকেই স্পর্শ করে, তারই সঙ্গে এক হয়ে যায়। সে জ্ঞানী
অবিভক্ত প্রজ্ঞায়, কারণ সে শায়িত
প্রজ্ঞার বাহুতে। তার পরিভ্রমণ শেষ হয়েছে,
কারণ, সে খুঁজে পেয়েছে সেই উৎস, যেখান থেকে সবকিছুর উৎপত্তি—
অনুসন্ধানের সেই পুরস্কার, যা তৃপ্তি আনে।
যে প্রেমকে জানে, সে প্রেম হয়ে ওঠে, আর সে জানে
সব প্রাণী তার নিজেরই প্রতিচ্ছবি, প্রেমের যমজ সন্তান।
প্রেমের নিজের আগুনে গলে গিয়ে, তার আত্মা প্রবাহিত হয়
সমস্ত পার্থিব রূপে, নিচে, ওপরে;
সে গোলাপের শ্বাস ও মুগ্ধতা,
সে কবুতরের আশীর্বাদ।
নিদ্রামগ্ন
হে রহস্যময় তুমি, যে ঘুমিয়ে আছ
আমার আত্মার নিঃসঙ্গ কক্ষে!
তুমিই আমার জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য,
তোমারই জন্য রক্ষিত আমার একমাত্র বেদি।
তোমার বিশ্রামের ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে
আমি দেখি তোমার স্থির মুখে সেই মরমি গোলাপ,
যার সুগন্ধ হলো আমার আত্মার কল্পনা,
আর সে সৌন্দর্য, যার মহিমায় আমি কাঁদি
অতিপূর্ণ আনন্দে অভিভূত হয়ে।
তোমার এই নিদ্রা-মহাজাগতিক রহস্য,
সেই মহামডেল সব সুপ্ত বস্তুর,
যাদের নির্দিষ্ট সময়ে সময়ই প্রকাশ করে।
এর প্রতীক হলো—
চন্দ্রালোকে ঢাকা হ্রদের গভীর নীরবতা;
অজন্মা প্রেমের সেই বিস্ময় ও ব্যথা,
যা কাঁপে নিজের ঘুমের ভেতর;
সেই আশা, যা ভারী পৃথিবীকে কাঁপিয়ে তোলে
আগামী জন্মের পূর্বাভাসে;
আর গভীর গুহার অদৃশ্য রহস্য।
মাইক্রোপ্রসোপোস
তোমার চোখের প্রাচ্যের অন্ধকারের আড়ালে
ঈশ্বরের চোখ আমার আত্মাকে জিজ্ঞাসা করে
অগাধ প্রেমে। যে আলোকিত তরঙ্গ ভেসে যায়
তোমার শরীরজুড়ে, তা-ই তার স্বপ্ন।
সে স্বপ্ন তোমার গায়ে ছড়িয়ে থাকে
যেমন চাঁদের আভা আকাশে ঢেকে যায়;
আর চারদিকে তাঁর দীপ্ত অস্তিত্বের
তৃষ্ণার্ত জ্যোতির্বলয় ঘিরে রাখে সমগ্র
মগ্ন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে, যা আমাদের প্রেমেই বিস্তৃত হয়।
হে তুমি, যার মাধ্যমে আমার কাছে অনন্ত প্রকাশিত!
তিক্ত আর লবণাক্ত তোমার অশ্রু,
যেন আবেগময় সব গোলকের হৃদয়জল,
তাদের সমস্ত যন্ত্রণাসহ। আমি তা তৃষ্ণায় পান করি!
আর তোমার হাসিতে আমার কাছে প্রতিফলিত হয়
অগ্নিজ্যোতি-ভরা প্রধান ফেরেশতাদের যুগের আনন্দ।
মরমি গোলাপ
আমি নারী, সেই বিস্ময়-নিশ্বাসী গোলাপ
যা রাজার বাগানে ফোটে।
এই পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর কোনো কিছু নেই,
এবং জ্ঞানী নক্ষত্ররাও কোনো গোপন বিষয় প্রকাশ করতে পারে না
যা আমার চেয়ে গভীর, যা প্রায় কেউই জানে না।
বসন্তে আমার পাপড়ির সুবাস
প্রেরণা হয়ে ওঠে সকল গায়কের কণ্ঠে—
ভালোবাসার গান, আত্মার অশান্ত সুরে।
আমার ঘোমটার আড়ালে লুকানো রয়েছে
অপূর্ণ যুগযুগান্তরের রহস্য,
আর আমার নিশ্বাস পূর্ণ করে তোলে
চিরপ্রেমিকের জীবন।
যে মরণশীল পোশাক আমি পরিধান করি
সময় নামের তাঁত বারবার বুনে তোলে;
আর যখন আমি মরে যাই—
পুরো মহাবিশ্বই মৃত্যুর আস্বাদ পায়।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম ত য র পর র জ ব শ ব স করত ন র জ বন র র র জ বন প রক শ র একট রহস য র রচন
এছাড়াও পড়ুন:
এলসা বার্কারের একগুচ্ছ কবিতা
এলসা বার্কার (১৮৬৯-১৯৫৪) ছিলেন একজন আমেরিকান কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও ছোটগল্প লেখক। সাহিত্য, আধ্যাত্মিকতা ও মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন তিনি। তাঁর রচনাগুলো প্রধানত আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান, মৃত্যুর পরের জীবন এবং মানুষের আত্মিক যাত্রাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। খ্রিষ্টান পটভূমি থেকে উদ্ভূত হলেও তাঁর দর্শন ছিল একটি মিশ্রিত বা একলেকটিক প্রকৃতির—থিওসফি, রোজিক্রুসিয়ান মতবাদ ও অকাল্টচর্চার সঙ্গে যুক্ত। তিনি সেক্যুলার চিন্তাধারার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতাকে মেলাতেন, যা তাঁর রচনায় স্পষ্ট।
এলসা বার্কারের জীবন ছিল সংগ্রাম, অনুসন্ধান ও সৃজনশীলতার এক মিশ্রণ। তিনি ১৮৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্মন্টের লেইসেস্টারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা অ্যালবার্ট জি বার্কার ও মাতা লুইস মারি বার্কার। তাঁর মা–বাবা উভয়েই তাঁর কৈশোরকালে মারা যান, যা তাঁর জীবনকে প্রভাবিত করে। এই ক্ষতি তাঁকে স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করতে বাধ্য করে। তিনি শর্টহ্যান্ড রিপোর্টার, শিক্ষক ও সংবাদপত্রের সংবাদদাতা হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। ১৯১০ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত তিনি ইউরোপে বসবাস করেন—প্রথমে প্যারিসে, পরে লন্ডনে। এখানে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা দেখেন। ১৯২৮-১৯৩০ সালে ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরায় থাকেন।
বার্কারের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান। ১৯১২ সালে প্যারিসে থাকাকালীন তিনি অটোম্যাটিক রাইটিংয়ের মাধ্যমে মৃত্যুর পরের জগৎ থেকে বার্তা পান বলে দাবি করেন। এটি তাঁর রচনার একটি মূল অংশ হয়ে ওঠে।
এলসা বার্কার ১৯৫৪ সালের ৩১ আগস্ট মারা যান। তাঁর জীবনকালে তিনি সাহিত্যিক ও আধ্যাত্মিক সমাজে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর রচনায় তার প্রতিফলন রয়েছে।
বার্কারের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান। ১৯১২ সালে প্যারিসে থাকাকালীন তিনি অটোম্যাটিক রাইটিংয়ের মাধ্যমে মৃত্যুর পরের জগৎ থেকে বার্তা পান বলে দাবি করেন।এলসা বার্কারের দর্শন ছিল খ্রিষ্টান, সেক্যুলার ও একলেকটিকের একটি সমন্বয়। তাঁর পিতার প্রভাবে তিনি অকাল্ট বা গুপ্তবিদ্যায় আগ্রহী হন এবং থিওসফিক্যাল সোসাইটির সদস্য হন। তিনি রোজিক্রুসিয়ান অর্ডার অব আলফা এট ওমেগাতে দীক্ষিত হন। তাঁর দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মৃত্যুর পরের জীবন, আত্মার অমরত্ব ও মানুষের আধ্যাত্মিক যাত্রা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে শারীরিক মৃত্যুর পরও আত্মা বা চেতনা জীবিত থাকে এবং তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব, যা তাঁর অটোম্যাটিক রাইটিংয়ের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তাঁর লেখালেখিতে তিনি প্রায়ই পুনর্জন্ম, কর্মফল ও মানবাত্মার গভীর রহস্য নিয়ে আলোচনা করেছেন।
১৯১৫ সাল থেকে তিনি মনোবিশ্লেষণে আগ্রহী হন এবং ১৯১৯ সালে দিনে ১৪ ঘণ্টা এটি অধ্যয়ন করেন। তাঁর দর্শন খ্রিষ্টান ভাবধারার সঙ্গে প্রাচ্য দর্শনের মিশ্রণ। এর লক্ষ্য প্রেম, জ্ঞান ও অজানাকে অনুসন্ধান করা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে মানুষের আত্মা অমর এবং জীবন একটি যাত্রা। তাঁর কবিতা ও অন্যান্য রচনায় এর প্রতিফলন দেখা যায়। তাঁর দর্শন সেক্যুলার। কারণ, তিনি বৈজ্ঞানিক মনোবিশ্লেষণকে অন্তর্ভুক্ত করেন, কিন্তু একলেকটিক। কারণ, এতে অকাল্ট ও থিওসফির প্রভাব রয়েছে। বার্কারের দর্শন ছিল মূলত আধ্যাত্মিক ও রহস্যবাদী।
১৯১২ সালে প্যারিসে থাকাকালে অটোম্যাটিক রাইটিং চর্চাকালে বার্কার একটি রহস্যময় বার্তা লাভ করেন বলে দাবি করেন। বার্কার বিশ্বাস করতেন, এই লেখাগুলো এসেছে বিচারক ডেভিড পি হ্যাচ নামের এক প্রয়াত বন্ধুর আত্মা থেকে। ১৯১০ সালে জাজ হ্যাচ মারা যান। এর কিছুদিন পর এলসা ট্রান্স-অবস্থায় লেখালেখি শুরু করেন এবং একের পর এক চিঠি নেমে আসে তাঁর কলমে।
এই বার্তাগুলো নিয়ে এলসা বার্কার ‘লেটার ফ্রম আ লিভিং ডেড ম্যান’ (১৯১৪) বইটি রচনা করেন। বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এ বই মূলত আত্মার সঙ্গে যোগাযোগের ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছিল এবং এটি তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজগুলোর মধ্যে একটি। এরপর তিনি এই সিরিজের আরও কয়েকটি বই লেখেন, যেমন ‘ওয়ার লেটার ফ্রম আ লিভিং ডেড ম্যান’ (১৯১৫) এবং ‘লাস্ট লেটার ফ্রম দ্য লিভিং ডেড ম্যান’ (১৯১৯)। তিনি ছোটগল্প ও নাটকও লিখেছেন।
১৯১২ সালে প্যারিসে থাকাকালে অটোম্যাটিক রাইটিং চর্চাকালে একটি রহস্যময় বার্তা লাভ করেন বলে দাবি করেন। বার্কার বিশ্বাস করতেন, এই লেখাগুলো এসেছে বিচারক ডেভিড পি হ্যাচ নামের এক প্রয়াত বন্ধুর আত্মা থেকে।কবি হিসাবে এলসা বার্কার বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তাঁর কবিতা আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান, প্রেম, মৃত্যু ও মানুষের জীবনের যাত্রাকে কেন্দ্র করে। তাঁর কবিতায় রহস্যবাদী ও দার্শনিক ছোঁয়া রয়েছে, যা খ্রিষ্টান ও থিওসফিক্যাল প্রভাব দেখায়। তাঁর প্রধান কবিতা সংকলন হলো ‘দ্য ফ্রোজেন গ্রেইল অ্যান্ড আদার পোয়েমস’ (১৯১০)। এতে তিনি মেরু অভিযাত্রী রবার্ট পিয়ারির অভিযানকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করে আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান বর্ণনা করেন। উদাহরণস্বরূপ, ‘দ্য ফ্রোজেন গ্রেইল’ কবিতায় তিনি লেখেন—
কেন গাইব পবিত্র গ্রেইলের কিংবদন্তি,
পবিত্র কবরের মৃত ধর্মযোদ্ধাদের,
যখন এই মানুষেরা জীবিত?
এ কবিতায় বার্কার মানুষের সাহস ও অজানাকে জয় করার দর্শন তুলে ধরেন। অন্যান্য কবিতা যেমন ‘হি হু নোজ লাভ’ প্রেমকে একটি দার্শনিক উপাদান হিসেবে দেখায়—
যে প্রেমকে জানে
যে প্রেমকে জানে—সে নিজেই প্রেম হয়ে ওঠে, আর তার চোখ
প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ে প্রেমকে দেখে,
এমনকি যারা প্রেমহীন তাদেরও।
এটি থিওসফির প্রভাব দেখায়, যেখানে প্রেম সবাইকে এক করে। তাঁর কবিতা সাধারণত ছন্দোবদ্ধ, রূপকময় ও আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানী।
এলসা বার্কারের একগুচ্ছ কবিতাযখন আমি মৃত হব আর ধুলোর বোন
যখন আমি মৃত হব, আর ধুলোর বোন,
যখন আর লালসায় পান করব না
মানবপ্রেমের রসের পেয়ালা;
যখন পাণ্ডুর প্রসারপিনা
আমাকে ঢেকে দেবে পপি ফুলের চাদরে,
আর শীতল মরচে কেটে দেবে
আমার বীণার তারগুলো—
যখন সূর্য আমায় ঠেলে দেবে মাটির নিচে,
বিশ্ব-লতার খাদ্য হতে—
মানুষ খুঁজে পাবে তখন আমার এই পুরোনো গানগুলো
আর বলবে: ‘এই নারী বেঁচেছিল—কবিদের মতোই বাঁচতে হয়!’
এই নারী বেঁচেছিল আর জীবনকে তলোয়ারের মতো পরে নিয়েছিল
জ্ঞান জয় করার জন্য;
এই মৃত নারী পড়েছিল প্রেমের সিল-মোড়ানো গ্রন্থ
আর রেখেছিল দাগে দাগে তার অর্থগুলো।
তারপর সে ছড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্বাসের পাল,
অজানা অঞ্চলের খোঁজে যাত্রা করে
গানের সুরে এগিয়ে গেল মৃতের নদী ধরে।
যে প্রেমকে জানে
যে প্রেমকে জানে, সে নিজেই প্রেম হয়ে ওঠে, আর তার চোখ
প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে প্রেমকে দেখে,
এমনকি যারা প্রেমহীন তাদেরও: যেমন সূর্যের আলো
যাকেই স্পর্শ করে, তারই সঙ্গে এক হয়ে যায়। সে জ্ঞানী
অবিভক্ত প্রজ্ঞায়, কারণ সে শায়িত
প্রজ্ঞার বাহুতে। তার পরিভ্রমণ শেষ হয়েছে,
কারণ, সে খুঁজে পেয়েছে সেই উৎস, যেখান থেকে সবকিছুর উৎপত্তি—
অনুসন্ধানের সেই পুরস্কার, যা তৃপ্তি আনে।
যে প্রেমকে জানে, সে প্রেম হয়ে ওঠে, আর সে জানে
সব প্রাণী তার নিজেরই প্রতিচ্ছবি, প্রেমের যমজ সন্তান।
প্রেমের নিজের আগুনে গলে গিয়ে, তার আত্মা প্রবাহিত হয়
সমস্ত পার্থিব রূপে, নিচে, ওপরে;
সে গোলাপের শ্বাস ও মুগ্ধতা,
সে কবুতরের আশীর্বাদ।
নিদ্রামগ্ন
হে রহস্যময় তুমি, যে ঘুমিয়ে আছ
আমার আত্মার নিঃসঙ্গ কক্ষে!
তুমিই আমার জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য,
তোমারই জন্য রক্ষিত আমার একমাত্র বেদি।
তোমার বিশ্রামের ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে
আমি দেখি তোমার স্থির মুখে সেই মরমি গোলাপ,
যার সুগন্ধ হলো আমার আত্মার কল্পনা,
আর সে সৌন্দর্য, যার মহিমায় আমি কাঁদি
অতিপূর্ণ আনন্দে অভিভূত হয়ে।
তোমার এই নিদ্রা-মহাজাগতিক রহস্য,
সেই মহামডেল সব সুপ্ত বস্তুর,
যাদের নির্দিষ্ট সময়ে সময়ই প্রকাশ করে।
এর প্রতীক হলো—
চন্দ্রালোকে ঢাকা হ্রদের গভীর নীরবতা;
অজন্মা প্রেমের সেই বিস্ময় ও ব্যথা,
যা কাঁপে নিজের ঘুমের ভেতর;
সেই আশা, যা ভারী পৃথিবীকে কাঁপিয়ে তোলে
আগামী জন্মের পূর্বাভাসে;
আর গভীর গুহার অদৃশ্য রহস্য।
মাইক্রোপ্রসোপোস
তোমার চোখের প্রাচ্যের অন্ধকারের আড়ালে
ঈশ্বরের চোখ আমার আত্মাকে জিজ্ঞাসা করে
অগাধ প্রেমে। যে আলোকিত তরঙ্গ ভেসে যায়
তোমার শরীরজুড়ে, তা-ই তার স্বপ্ন।
সে স্বপ্ন তোমার গায়ে ছড়িয়ে থাকে
যেমন চাঁদের আভা আকাশে ঢেকে যায়;
আর চারদিকে তাঁর দীপ্ত অস্তিত্বের
তৃষ্ণার্ত জ্যোতির্বলয় ঘিরে রাখে সমগ্র
মগ্ন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে, যা আমাদের প্রেমেই বিস্তৃত হয়।
হে তুমি, যার মাধ্যমে আমার কাছে অনন্ত প্রকাশিত!
তিক্ত আর লবণাক্ত তোমার অশ্রু,
যেন আবেগময় সব গোলকের হৃদয়জল,
তাদের সমস্ত যন্ত্রণাসহ। আমি তা তৃষ্ণায় পান করি!
আর তোমার হাসিতে আমার কাছে প্রতিফলিত হয়
অগ্নিজ্যোতি-ভরা প্রধান ফেরেশতাদের যুগের আনন্দ।
মরমি গোলাপ
আমি নারী, সেই বিস্ময়-নিশ্বাসী গোলাপ
যা রাজার বাগানে ফোটে।
এই পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর কোনো কিছু নেই,
এবং জ্ঞানী নক্ষত্ররাও কোনো গোপন বিষয় প্রকাশ করতে পারে না
যা আমার চেয়ে গভীর, যা প্রায় কেউই জানে না।
বসন্তে আমার পাপড়ির সুবাস
প্রেরণা হয়ে ওঠে সকল গায়কের কণ্ঠে—
ভালোবাসার গান, আত্মার অশান্ত সুরে।
আমার ঘোমটার আড়ালে লুকানো রয়েছে
অপূর্ণ যুগযুগান্তরের রহস্য,
আর আমার নিশ্বাস পূর্ণ করে তোলে
চিরপ্রেমিকের জীবন।
যে মরণশীল পোশাক আমি পরিধান করি
সময় নামের তাঁত বারবার বুনে তোলে;
আর যখন আমি মরে যাই—
পুরো মহাবিশ্বই মৃত্যুর আস্বাদ পায়।