এক কনের বাড়ি ছিল ধাড় দেশে। আর বরের শিলদাতে। বড় একটি জঙ্গলের পাশেই একত্রে এসে মিশেছে ধাড় দেশের নদী ও শিলদার নদীটি। কনের বাড়ি থেকে বরের বাড়িতে যাওয়ার একমাত্র পথটি ছিল সে জঙ্গলের ভেতর দিয়েই। ও পথেই কনেপক্ষের ঘটক প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছিল বরের বাড়িতে। ওই জঙ্গলে বাঘের উপদ্রব হতো প্রায়ই। জঙ্গলের পাশ দিয়ে চলে গেছে আরেকটি ছোট্ট নদী। ঘটক বরের বাড়ি যাচ্ছিল নদীর ধার দিয়েই।
দূর থেকে ঘটককে যেতে দেখে এক বাঘিনী। সে হুংকার দিয়ে লাফিয়ে পড়ে তার সামনে। হঠাৎ বাঘিনীকে দেখে ঘটকের প্রাণ যায় যায়। বাঘিনী ঘটককে দুই থাবার মধ্যে নিয়ে খেলা করতে থাকে। এটাই তাদের নিয়ম। শিকারকে সঙ্গে সঙ্গে খায় না।
সে সময় বাঘিনী ঘটককে জিজ্ঞেস করল, কে হে তুমি? কোথায় যাচ্ছিলে?
বাঘিনীর কথায় ঘটক একটু সাহস পেল। ভয়ে ভয়ে সে বলল, মহারানি, আমি ধর্মের কাজে যাচ্ছিলাম, আমাকে তুমি মেরো না।
বাঘিনীর বেশ কৌতূহল হলো। সে বলল, কেমন ধর্মের কাজ হে?
ঘটক বলল, আমি দুটি পরিবারকে একত্র করি। দুজন আলাদা লোককে একজনে পরিণত করি।
বাঘিনী বলে, তাহলে আমার জন্যও স্বামী জোগাড় করে দাও। এক যুগ আগে আমার স্বামীকে দুষ্ট লোকেরা মেরে ফেলেছে। সেই থেকে আমি একা। সুযোগ বুঝে ঘটক বলল, তাহলে তো আমাকে কিছু সময়ের জন্য ছেড়ে দিতে হবে মহারানি।বাঘিনী বলল, কেমন করে সেটা করো?
ঘটক বলে, যার বউ নেই তাকে বউ জোগাড় করে দিই। যার স্বামী নেই তার জন্য স্বামী জোগাড় করে দিই।
ঘটকের উত্তর শুনে বাঘিনী বলে, তাহলে আমার জন্যও স্বামী জোগাড় করে দাও। এক যুগ আগে আমার স্বামীকে দুষ্ট লোকেরা মেরে ফেলেছে। সেই থেকে আমি একা।
সুযোগ বুঝে ঘটক বাঘিনীর কথায় রাজি হলো। সে বলল, তাহলে তো আমাকে কিছু সময়ের জন্য ছেড়ে দিতে হবে মহারানি।
আরও পড়ুনচন্দ্র কেন কম আলো দেয়২৯ নভেম্বর ২০২৫তাকে বিশ্বাস করে বাঘিনী তাকে ছেড়ে দিল। ঘটকের ছিল তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। ছাড়া পেয়ে সে গেল সেই গ্রামে। অনেক খুঁজে গ্রামের ভেতর পেল একটা দোকান। দোকান থেকে দুটো নতুন বস্তা কিনে নিল। তা সেলাই করার জন্য কিনল একটি সুই ও দড়ি। ওই গ্রামের শেষ প্রান্তের বাড়িতে থাকত দুজন বুড়ো ও বুড়ি। গ্রামের যেকোনো বিয়েতে তারাই হলুদ ও পাতা বাছাই করে দিত।
ঘটক তাদের কাছে গিয়ে খুশিমনে বলল, যাও, একটু হলুদ বেটে এবং পাতা বেছে পরগাছার সরু কাঠি দিয়ে শালপাতার চার কোণের থালা তৈরি করো। সেই থালায় দিয়ে দাও বাটা হলুদ ও তেলটুকু। বুড়ো-বুড়ি তা–ই করল।
ঘটক এবার নতুন বস্তা, সুই, শনের দড়ি ও তেল-হলুদ নিয়ে ফিরে গেল বাঘিনীর কাছে।
বাঘিনীকে সে বলল, মহারানি, তোমার জন্য পাত্রের সন্ধান পেয়েছি।
শুনে বাঘিনী তো মহাখুশি।
বিয়ের আনন্দে বাঘিনী ঘটকের কথামতো বস্তার ভেতর ঢুকে পড়ল। ঘটক তখন থালাটি বাঘিনীর হাতে দিয়ে ভালো করে ধরে থাকতে বলল। সরল বিশ্বাসে বাঘিনীও তা–ই করল। ঘটক দড়ি দিয়ে ওই বস্তাটি ভালো করে সেলাই করে দিল।ঘটক বলল, যদি আমাকে বিশ্বাস করো এবং বিয়ে করতে চাও তবে তুমি এই বস্তার ভেতর প্রবেশ করো।
বিয়ের আনন্দে বাঘিনী ঘটকের কথামতো বস্তার ভেতর ঢুকে পড়ল। ঘটক তখন সেই তেল-হলুদের থালাটি বাঘিনীর হাতে দিয়ে ভালো করে ধরে থাকতে বলল। সরল বিশ্বাসে বাঘিনীও তা–ই করল। ঘটক এবার সেই শনের দড়ি দিয়ে ওই বস্তাটি ভালো করে সেলাই করে দিল।
অতঃপর ঘটক বাঘিনীকে বলল, মহারানি, নড়াচড়া কোরো না। তোমাকে এই নদীর জলে নামিয়ে দিচ্ছি। এই জলের নিচেই তোমার স্বামী তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সে যখন তোমাকে নদীর জল থেকে তুলে নেবে, তুমি তখন হাতে থাকা তেল-হলুদ তার মুখে মাখিয়ে দিয়ো। এ কথা বলেই ঘটক বস্তাটি নদীর জলে ভাসিয়ে দিল।
সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। নদীতেও বান দেখা দিয়েছে। অন্য একটি গ্রামে ছিল একটি বাঘ। তার স্ত্রীকেও মানুষেরা মেরে ফেলেছে ১২ বছর আগে। সেই বাঘটি প্রতিদিন বান দেখতে নদীর ধারে এসে বসে থাকত। মাঝেমধ্যে বানের জলে গরু, ছাগল, মহিষ ভেসে এলেই নদী থেকে সে তা তুলে এনে খেত। সেদিনও সে নদীর ধারে বসে ছিল। একটি বস্তা ভেসে আসতে দেখেই সে জলে নেমে সেটাকে ওপরে তুলে আনল। দাঁত দিয়ে বস্তাটি ছিঁড়তে যাবে, অমনি বস্তার ভেতর থেকে বাঘিনীর গর্জন।
বাঘ তাড়াতাড়ি বস্তাটি ছিঁড়ে ফেলল। ঠিক তখনই বাঘিনী আস্তে আস্তে বস্তা থেকে বেরিয়ে এল। সে হাতের তেল-হলুদ বাটা ভালো করে মাখিয়ে দিল বাঘটির মুখে এবং তাকে চুমু খেতে থাকল। অতঃপর তাদের বিয়ে হয়ে গেল। সুখে-শান্তিতে কাটতে থাকল বাঘ-বাঘিনীর জীবন।
সাঁওতালরা মনে করে, সেই থেকে বাঘেরা ঘটকদের ওপর খুব খুশি। ফলে তারা ঘটককে খায় না।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম র জন য ত ল হল দ জ গ ড় কর বস ত ট ঘটক ব ঘটক র
এছাড়াও পড়ুন:
ঘটককে বাঘে খায় না
এক কনের বাড়ি ছিল ধাড় দেশে। আর বরের শিলদাতে। বড় একটি জঙ্গলের পাশেই একত্রে এসে মিশেছে ধাড় দেশের নদী ও শিলদার নদীটি। কনের বাড়ি থেকে বরের বাড়িতে যাওয়ার একমাত্র পথটি ছিল সে জঙ্গলের ভেতর দিয়েই। ও পথেই কনেপক্ষের ঘটক প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছিল বরের বাড়িতে। ওই জঙ্গলে বাঘের উপদ্রব হতো প্রায়ই। জঙ্গলের পাশ দিয়ে চলে গেছে আরেকটি ছোট্ট নদী। ঘটক বরের বাড়ি যাচ্ছিল নদীর ধার দিয়েই।
দূর থেকে ঘটককে যেতে দেখে এক বাঘিনী। সে হুংকার দিয়ে লাফিয়ে পড়ে তার সামনে। হঠাৎ বাঘিনীকে দেখে ঘটকের প্রাণ যায় যায়। বাঘিনী ঘটককে দুই থাবার মধ্যে নিয়ে খেলা করতে থাকে। এটাই তাদের নিয়ম। শিকারকে সঙ্গে সঙ্গে খায় না।
সে সময় বাঘিনী ঘটককে জিজ্ঞেস করল, কে হে তুমি? কোথায় যাচ্ছিলে?
বাঘিনীর কথায় ঘটক একটু সাহস পেল। ভয়ে ভয়ে সে বলল, মহারানি, আমি ধর্মের কাজে যাচ্ছিলাম, আমাকে তুমি মেরো না।
বাঘিনীর বেশ কৌতূহল হলো। সে বলল, কেমন ধর্মের কাজ হে?
ঘটক বলল, আমি দুটি পরিবারকে একত্র করি। দুজন আলাদা লোককে একজনে পরিণত করি।
বাঘিনী বলে, তাহলে আমার জন্যও স্বামী জোগাড় করে দাও। এক যুগ আগে আমার স্বামীকে দুষ্ট লোকেরা মেরে ফেলেছে। সেই থেকে আমি একা। সুযোগ বুঝে ঘটক বলল, তাহলে তো আমাকে কিছু সময়ের জন্য ছেড়ে দিতে হবে মহারানি।বাঘিনী বলল, কেমন করে সেটা করো?
ঘটক বলে, যার বউ নেই তাকে বউ জোগাড় করে দিই। যার স্বামী নেই তার জন্য স্বামী জোগাড় করে দিই।
ঘটকের উত্তর শুনে বাঘিনী বলে, তাহলে আমার জন্যও স্বামী জোগাড় করে দাও। এক যুগ আগে আমার স্বামীকে দুষ্ট লোকেরা মেরে ফেলেছে। সেই থেকে আমি একা।
সুযোগ বুঝে ঘটক বাঘিনীর কথায় রাজি হলো। সে বলল, তাহলে তো আমাকে কিছু সময়ের জন্য ছেড়ে দিতে হবে মহারানি।
আরও পড়ুনচন্দ্র কেন কম আলো দেয়২৯ নভেম্বর ২০২৫তাকে বিশ্বাস করে বাঘিনী তাকে ছেড়ে দিল। ঘটকের ছিল তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। ছাড়া পেয়ে সে গেল সেই গ্রামে। অনেক খুঁজে গ্রামের ভেতর পেল একটা দোকান। দোকান থেকে দুটো নতুন বস্তা কিনে নিল। তা সেলাই করার জন্য কিনল একটি সুই ও দড়ি। ওই গ্রামের শেষ প্রান্তের বাড়িতে থাকত দুজন বুড়ো ও বুড়ি। গ্রামের যেকোনো বিয়েতে তারাই হলুদ ও পাতা বাছাই করে দিত।
ঘটক তাদের কাছে গিয়ে খুশিমনে বলল, যাও, একটু হলুদ বেটে এবং পাতা বেছে পরগাছার সরু কাঠি দিয়ে শালপাতার চার কোণের থালা তৈরি করো। সেই থালায় দিয়ে দাও বাটা হলুদ ও তেলটুকু। বুড়ো-বুড়ি তা–ই করল।
ঘটক এবার নতুন বস্তা, সুই, শনের দড়ি ও তেল-হলুদ নিয়ে ফিরে গেল বাঘিনীর কাছে।
বাঘিনীকে সে বলল, মহারানি, তোমার জন্য পাত্রের সন্ধান পেয়েছি।
শুনে বাঘিনী তো মহাখুশি।
বিয়ের আনন্দে বাঘিনী ঘটকের কথামতো বস্তার ভেতর ঢুকে পড়ল। ঘটক তখন থালাটি বাঘিনীর হাতে দিয়ে ভালো করে ধরে থাকতে বলল। সরল বিশ্বাসে বাঘিনীও তা–ই করল। ঘটক দড়ি দিয়ে ওই বস্তাটি ভালো করে সেলাই করে দিল।ঘটক বলল, যদি আমাকে বিশ্বাস করো এবং বিয়ে করতে চাও তবে তুমি এই বস্তার ভেতর প্রবেশ করো।
বিয়ের আনন্দে বাঘিনী ঘটকের কথামতো বস্তার ভেতর ঢুকে পড়ল। ঘটক তখন সেই তেল-হলুদের থালাটি বাঘিনীর হাতে দিয়ে ভালো করে ধরে থাকতে বলল। সরল বিশ্বাসে বাঘিনীও তা–ই করল। ঘটক এবার সেই শনের দড়ি দিয়ে ওই বস্তাটি ভালো করে সেলাই করে দিল।
অতঃপর ঘটক বাঘিনীকে বলল, মহারানি, নড়াচড়া কোরো না। তোমাকে এই নদীর জলে নামিয়ে দিচ্ছি। এই জলের নিচেই তোমার স্বামী তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সে যখন তোমাকে নদীর জল থেকে তুলে নেবে, তুমি তখন হাতে থাকা তেল-হলুদ তার মুখে মাখিয়ে দিয়ো। এ কথা বলেই ঘটক বস্তাটি নদীর জলে ভাসিয়ে দিল।
সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। নদীতেও বান দেখা দিয়েছে। অন্য একটি গ্রামে ছিল একটি বাঘ। তার স্ত্রীকেও মানুষেরা মেরে ফেলেছে ১২ বছর আগে। সেই বাঘটি প্রতিদিন বান দেখতে নদীর ধারে এসে বসে থাকত। মাঝেমধ্যে বানের জলে গরু, ছাগল, মহিষ ভেসে এলেই নদী থেকে সে তা তুলে এনে খেত। সেদিনও সে নদীর ধারে বসে ছিল। একটি বস্তা ভেসে আসতে দেখেই সে জলে নেমে সেটাকে ওপরে তুলে আনল। দাঁত দিয়ে বস্তাটি ছিঁড়তে যাবে, অমনি বস্তার ভেতর থেকে বাঘিনীর গর্জন।
বাঘ তাড়াতাড়ি বস্তাটি ছিঁড়ে ফেলল। ঠিক তখনই বাঘিনী আস্তে আস্তে বস্তা থেকে বেরিয়ে এল। সে হাতের তেল-হলুদ বাটা ভালো করে মাখিয়ে দিল বাঘটির মুখে এবং তাকে চুমু খেতে থাকল। অতঃপর তাদের বিয়ে হয়ে গেল। সুখে-শান্তিতে কাটতে থাকল বাঘ-বাঘিনীর জীবন।
সাঁওতালরা মনে করে, সেই থেকে বাঘেরা ঘটকদের ওপর খুব খুশি। ফলে তারা ঘটককে খায় না।