যোগ্যদের মধ্যে ১৯% ভাতা সুবিধা পান
Published: 2nd, December 2025 GMT
প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও হতদরিদ্রদের জন্য সরকারের চলমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা। পাঁচটি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলছে, এসব কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা আছে—এমন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে মাত্র ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ এ সুবিধা পান।
এক গবেষণার ভিত্তিতে গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানানো হয়। সেখানে ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক ওই গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারের একটি অঙ্গীকার ছিল কৌশলগত প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। সেটি করা হয়নি। সরকারের অঙ্গীকার ছিল সমতলের আদিবাসীদের জন্য আলাদা ভূমি কমিশন করা, সেটিও করা হয়নি। ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবিসংবাদ সম্মেলনে গবেষণার বিস্তারিত তুলে ধরেন টিআইবির রিসার্চ ফেলো রাজিয়া সুলতানা। তিনি জানান, ২০২৪ সালের জুন থেকে গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত এ গবেষণার কাজ চলে। সমতল থেকে ২২টি ও পাহাড় থেকে ৭টিসহ মোট ২৯টি আদিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর এ গবেষণা পরিচালিত হয়। এসব সম্প্রদায় হলো চাকমা, মারমা, গারো, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়া, গঞ্জু, বাগদু, পাত্র, খাসিয়া, ওঁরাও, রাখাইন, গোরাইত, ম্রো, বম, কোচ, মুন্ডা, মাহাতো, মালপাহাড়ি, রাজোয়ার, ভূমিজ, সাঁওতাল, হুদি, বর্মন, কুরমি মাহাতো, মাহালি, কোরা, মণিপুরি ও বেদিয়া মাহাতো।
গবেষণায় বলা হয়, আদিবাসী অধ্যুষিত ১০টি ইউনিয়নে বয়স্ক ভাতার সুবিধা পাওয়ার যোগ্য ছিলেন ১ হাজার ৬৭৬ জন। এঁদের মধ্যে এ সুবিধা পাচ্ছেন মাত্র ৩৫৫ জন। শতাংশের হিসাবে যা এটি ২১ দশমিক ২ শতাংশ।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ৮টি ইউনিয়নে বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত ভাতা পাওয়ার যোগ্য ছিলেন ৪৯৮ জন। কিন্তু এ সুবিধার আওতায় আছেন মাত্র ৬০ জন। শতাংশের হিসাবে যা ১২ শতাংশ। ৭টি ইউনিয়নে প্রতিবন্ধী ভাতা ও উপবৃত্তির যোগ্য ছিলেন ৫৮৩ জন। কিন্তু দেওয়া হয়েছে ১৮৪ জনকে, যা ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ। ছয়টি ইউনিয়নে মা ও শিশুসহায়তা ভাতার জন্য যোগ্য ৫৯৪ জন। এ সুবিধা পাচ্ছেন ১২৮ জন। শতাংশের হিসাবে এটি ২১ দশমিক ৫ শতাংশ। চারটি ইউনিয়নে ভালনারেবল উইমেন বেনিফিটের (ভিডব্লিউবি) যোগ্য পাওয়া গেছে ১ হাজার ৩৩৮ জন; কিন্তু এ সুবিধা পাচ্ছেন ১৬৬ জন। শতাংশে এটি ১২ দশমিক ৪ শতাংশ।
২০১০ সালের খানা ব্যয় জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে গবেষণায় বলা হয়, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির হার ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ, যেখানে জাতীয় পর্যায়ে অন্তর্ভুক্তির এ হার ২৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
প্রচার-প্রচারণার না থাকায় এসব সুবিধার কথা অনেক আদিবাসী জানতে পারেন না বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। ফলে অনেকে আবেদন করতে পারেন না। আবার যাঁরা আবেদন করেন, আবেদনপ্রক্রিয়ায় হয়রানি, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব ও যাচাই-বাছাই এবং নির্বাচনে অনিয়মের কারণে তাঁদের অনেকে বাদ পড়েন বলে গবেষণায় তথ্য দেওয়া হয়েছে।
২০২২ সালের একটি খানা আয়-ব্যয় জরিপের ফলাফল তুলে ধরে গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে জাতীয় দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটি ৬৫ শতাংশ। অন্যদিকে আদিবাসী অধ্যুষিত সমতল এলাকায় সেটি ৮০ শতাংশ।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সেটা পার্বত্য অঞ্চলে হোক বা সমতলে হোক, তাঁদের অধিকারগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে, তাঁদের ন্যায্য প্রাপ্য নিশ্চিত করতে যে কর্মসূচিগুলো আছে, সেগুলোর সারমর্ম গবেষণায় তুলে ধরা হয়েছে।
এসব বৈষম্যের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যে ৭টি নির্দেশিকার ওপর ভিত্তি করে গবেষণাটি করা হয়েছে, সেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে সুশাসনের ঘাটতি, স্বচ্ছতা, জবাবদিহির ঘাটতি, দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্রই উঠে এসেছে।
বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলেও একই ধরনের সমস্যা রয়েছে জানিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ চিত্রই দীর্ঘকাল যাবৎ প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে দেশে। তার মধ্যেও আদিবাসীদের বিষয়টি আলাদা গুরুত্বের দাবি রাখে। কারণ, তারা প্রান্তিকের মধ্যেও প্রান্তিক। তাদের ন্যায্য প্রাপ্য রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারছে না।
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, খুব পরিষ্কারভাবে এখানে দেখা যাচ্ছে উন্নয়ন, সমাজ পরিবর্তন, সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা, নিরাপত্তার মূলধারা, তার মধ্যে আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারের একটি অঙ্গীকার ছিল কৌশলগত প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। সেটি করা হয়নি। সরকারের অঙ্গীকার ছিল সমতলের আদিবাসীদের জন্য আলাদা ভূমি কমিশন করা, সেটিও করা হয়নি।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির এক্সিকিউটিভ ম্যানেজমেন্টের উপদেষ্টা সুমাইয়া খায়ের, আউটরিচ ও কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম ও টিআইবির রিসার্চ পলিসির পরিচালক মো.
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইফত খ র জ জ ম ন সরক র র জনগ ষ ঠ ট আইব র পর চ ল র জন য দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
কুনো ব্যাঙের ভবিষ্যদ্বাণী ও পাহাড়ে রাজনৈতিক সংকট
মারমা ও রাখাইন লোকসাহিত্যে ‘তা-বং’ বলে একটি শব্দ আছে। এটি একধরনের ভবিষ্যদ্বাণী। এই ভবিষ্যৎবাণীগুলো প্রবাদ প্রবচন, কবিতা বা গানের আকারে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হয়।
কিছু ক্ষেত্রে এগুলোকে আত্মিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের আগাম সতর্কবার্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চাকমা, রাখাইন, মারমা, খিয়াংসহ বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকসাহিত্যে একটি গল্প প্রচলিত আছে।
গল্পে একটি কুনো ব্যাঙের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা বলা হয়েছে, যার দ্বারা একটি রাজনৈতিক দুর্যোগের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়।
রংরাং পাখির আর্তনাদএক বনে এক কুনো ব্যাঙ বাস করত। সে একদিন শহরে বেড়াতে যায়। ফিরে এসে ব্যাঙটি তার ছোট পাখি বন্ধুকে জানায়, অচিরেই মহা ঝড় আসবে, ভয়ানক ভূমিকম্প হবে, মাটির নিচের বুনো আলু সাত টুকরা হয়ে যাবে, পাহাড়ের নারীরা সমতলে স্থানান্তরিত হবে এবং সমতলের নারীরা স্থানান্তরিত হবে পাহাড়ে। সর্বোপরি মানবসমাজ চার ভাগে ভাগ হবে। আর এই দুর্যোগে ছোটদের অস্তিত্ব কেবল তখনই রক্ষা পেতে পারে, যদি তারা বড়দের কাছে আশ্রয় পায়।
এদিকে ঝড় শুরু হলে ভয়ার্ত ছোট পাখিটি রংরাং নামক পাখির হাঁ করা মুখ দিয়ে ঢুকে পড়ে আর পশ্চাদ্দেশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এতে রংরাং পাখি বিকট স্বরে আর্তনাদ করে ওঠে। তার আর্তনাদ থেকে কিছু ঘটনাপ্রবাহের জন্ম হয়। চমকে গিয়ে একটি বানর তার হাতে থাকা কুমড়া ফেলে দেয় গাছের নিচে শুয়ে থাকা একটি অজগরের ওপর; এতে অজগর ক্ষিপ্ত হয়ে পার্শ্ববর্তী এক মুরগির ডেরায় গিয়ে তার সব ডিম সাবাড় করে ফেলে; এই ঘটনায় শোকে-দুঃখে মুরগি গিয়ে একদল পিঁপড়ার বাসা লন্ডভন্ড করে দেয়; এতে পিঁপড়ার দল রাগের মাথায় এক শূকরের গোপনাঙ্গে গিয়ে কামড় বসিয়ে দেয়; আর হতবিহ্বল শূকর ছুটে গিয়ে এক বিধবার জুমখেতের সব ফসল নষ্ট করে ফেলে; দুঃখভারাক্রান্ত বিধবাটি রাজার কাছে গিয়ে নালিশ করে। আর রাজা তদন্ত করার পর কুনো ব্যাঙকে দোষী সাব্যস্ত করে। কেননা তার ভবিষ্যদ্বাণী থেকেই এসব দুর্ঘটনার সূত্রপাত।
আরও পড়ুনপার্বত্য চট্টগ্রাম: বাড়ির পাশে আরশিনগর৩০ মার্চ ২০২২শিশুদের জন্য রচিত বিনোদনমূলক গল্প হলেও এর গভীরে যেন লুকিয়ে আছে একধরনের আগাম বার্তা। এটি পার্বত্য অঞ্চলের রাজনৈতিক সংকটকে নির্দেশ করে, যার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পুনর্বাসন, পাহাড়িদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ, ভূমি বেদখল ও বৈরী রাষ্ট্রীয় নীতির কারণে সৃষ্ট আদিবাসীদের নানা বঞ্চনার গল্প।
কুনো ব্যাঙের ভবিষ্যদ্বাণী, ‘পাহাড়ের নারীরা সমতলে স্থানান্তরিত হবে এবং সমতলের নারীরা স্থানান্তরিত হবে পাহাড়ে’ মূলত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পাহাড়ে পুনর্বাসনপ্রক্রিয়ার প্রতিচ্ছবি।
ভূগর্ভস্থ বুনো আলুর সাত ভাগে বিভাজনের কথা যেন রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ‘ভাগ করো। শাসন করো’ নীতির ফলে পাহাড়ে তৈরি হওয়া বিভিন্ন দল ও উপদলের ভেতর বিভক্তির রাজনীতিকেই নির্দেশ করে।
১৯৭১ সালের পর থেকে পার্বত্য অঞ্চলের ঘটনাপ্রবাহে জাতীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক বঞ্চনার এক স্থায়ী চক্র বিদ্যমান। ১৯৯৭ সালের চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং কাঠামোগত বৈষম্য বেড়েছে। কুনো ব্যাঙের ভবিষ্যদ্বাণী যেন এই রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতীক। ভূমি হারানো, অস্তিত্বের সংকট ও রাজনৈতিক বঞ্চনা যেন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন বাস্তবতা।জনমিতিগত প্রকৌশলজিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে পাহাড়ে সরকারি উদ্যোগে ১৯৭০–৮০ দশকে চার লাখেরও বেশি বাঙালি পরিবারকে পাহাড়ে নিয়ে আসা হয়। এর ফলে পাহাড়ের জনমিতিগত বৈশিষ্ট্য পাল্টে যায় এবং বিপুলসংখ্যক পাহাড়ির ভূমি বেহাত হয়ে যায়। ৭০ হাজারেরও বেশি পাহাড়ি মানুষ ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে। গুচ্ছগ্রাম তৈরি ও স্থানান্তর, ভূমি বেদখল ও ভূমি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ, বিদ্রোহ দমন প্রক্রিয়া, নারীর প্রতি সহিংসতা, গণহত্যা, ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন—সব মিলিয়ে সৃষ্টি হয় এক গভীর রাজনৈতিক সংকট।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি সইয়ের মুহূর্ত