নকশিকাঁথার ফোঁড়ে জুড়ে দেন সাহসের রং, ধরছেন সংসারে হাল
Published: 7th, December 2025 GMT
একসময় সংসারে অভাব-অনটন পিছু ছাড়েনি। কোন বেলা কী রান্না হবে, তা নিয়ে ভাবতে হতো। এসব নিয়ে চুলা জ্বালানোর আগে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগেছেন। একদিন মিতু আক্তার হাতে তুলে নিলেন সুই আর সুতা। নকশিকাঁথার প্রতিটি ফোঁড়ে জুড়ে দিতে লাগলেন সাহসের রং।
এখন সেই একই হাতেই জ্বলে ওঠে আলোর প্রদীপ। ছোট্ট ঘরে শুরু হওয়া তাঁর সেই সেলাই এখন ছড়িয়ে পড়েছে শত শত নারীর ঘরে।
‘মিতু এমব্রয়ডারি পল্লী’ এখন শুধু একটি নাম নয়, এটা এক নারীর বর্ণিল স্বপ্ন, অদম্য পরিশ্রমের ফল। প্রতি মাসে ৪৫ হাজার টাকার আয়, নিজের ঘর, নিজের পরিচয়—সবই আজ মিতুর হাতে সেলাইকাজের বাস্তবতা।
৫০ বছর বয়সী মিতু আক্তারের বাড়ি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী পৌরসভার নুনিয়াগাড়ি এলাকায়। সম্প্রতি নুনিয়াগাড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মিতুর বাড়ির আঙিনা, বারান্দা ও ঘরের মেঝেজুড়ে ব্যস্ত একঝাঁক নারী। কারও হাতে কাঁথা, কারও কোলে থ্রি–পিস, কেউ আবার রঙিন সুতায় ফুলের সূক্ষ্ম নকশা তুলছেন কাপড়ে। পাশেই বসে মিষ্টি হাসিতে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন মিতু আক্তার। বাড়ির সামনের দেয়ালে টাঙানো প্ল্যাকার্ডে লেখা, মিতু এমব্রয়ডারি পল্লী। ছোট ঘরের এক পাশে গাদা গাদা কাঁথা, অন্য পাশে অর্ডার করা থ্রি–পিস, শাড়ি, বেডশিট, ওড়না সাজানো।
সেখানে আলাপকালে মিতু বলেন, ‘বাড়ির আঙিনা, বারান্দা ও ঘরের মেঝেই আমার কারখানা, এই নারীরাই আমার শক্তি। একসময় কাজ নিতাম, এখন কাজ দিই।’ তাঁর পাশে বসে থাকা কয়েকজন নারী জানালেন, মিতুর কাছ থেকে কাজ শিখেই এখন তাঁরা সংসারের হাল ধরেছেন। ঘরের মেঝেতে বসেই মিতু বললেন, ২০০৯ সালে সংসারের চরম অভাব আর স্বামীর অপ্রতুল আয়ে যখন জীবন দিশাহারা, তখনই সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। বাড়িতে বসেই থ্রি–পিস, ওড়না, পর্দা, পাঞ্জাবি, বেডশিট ও নকশিকাঁথায় সুই-সুতার নিপুণ কারুকাজে আনেন শিল্পের ছোঁয়া।
মিতুর সেই হাতের নৈপুণ্য ধীরে ধীরে গাইবান্ধা থেকে ছড়িয়ে যায় ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্তে। এখন অনলাইনেই অর্ডার আসে এবং বিক্রি হয় তাঁর তৈরি পোশাক ও কাঁথা। বর্তমানে সব খরচ বাদে তাঁর মাসিক আয় থাকে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। শুধু তা–ই নয়, তাঁর উদ্যোগে এখন কাজ করছেন ৭০০ থেকে ৮০০ জন নারী। তাঁদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ পরিবারে ফিরিয়ে এনেছেন সচ্ছলতা। তাঁর স্বামী মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি মিতুর সেলাইয়ের কাজে সব সময় উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দিই। তাকে নানাভাবে সহায়তা করছি। সে যেন আরও ভালো কিছু করতে পারে, এগিয়ে যেতে পারে।’
মিজানুর রহমান একজন চিত্রশিল্পী। একসময় হাতে সাইনবোর্ড লিখতেন, এখন মিতুর সহযোগিতায় দিয়েছেন ডিজিটাল প্রিন্টিং প্রেস। মিতুর একমাত্র মেয়ে তাজমিন আক্তার গোবিন্দগঞ্জ মহিলা ডিগ্রি কলেজে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী, আর একমাত্র ছেলে মাহি সরকার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। একসময় ছয় শতক ভিটে ছাড়া কোনো সম্পদ ছিল না। কিন্তু এখন মিতুর নিজের পরিশ্রমে পাকা ঘর, কিছু জমি আর নিজের কর্মক্ষেত্র—সবই অর্জন করেছেন।
নিজের কাজের দক্ষতা বাড়াতে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের (বিআরডিবি) সমন্বিত পল্লী দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্পের আওতায় দুই মাসের সেলাই প্রশিক্ষণ নেন মিতু। প্রশিক্ষণের পর কাজের চাপ বেড়ে গেলে আশপাশের নারীদের যুক্ত করেন তাঁর সঙ্গে। শুরু হয় চুক্তিভিত্তিক কাজের সুযোগ। এখন তিনি ফেসবুক পেজে অর্ডার নেন, বিক্রি করেন বিভিন্ন ডিজাইন করা পোশাক ও নকশিকাঁথা। একটি নকশিকাঁথা তৈরি করতে খরচ পড়ে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা। একেকটি কাঁথা তৈরিতে লাগে প্রায় ১৫ দিন। দৈর্ঘ্যে সাড়ে পাঁচ হাত, প্রস্থে সাড়ে চার হাতের কাঁথাগুলো বিক্রি হয় আড়াই হাজার থেকে সাড়ে আট হাজার টাকায়।
শ্রমিকসহ প্রতিটি থ্রি–পিস উৎপাদনে খরচ হয় দেড় হাজার টাকা, বিক্রি ১ হাজার ৮০০ টাকা। শ্রমিকসহ প্রতিটি পাঞ্জাবি উৎপাদনে খরচ ২ হাজার টাকা, বিক্রি আড়াই হাজার টাকা। শ্রমিকসহ প্রতিটি বেডশিট উৎপাদনে খরচ আড়াই হাজার টাকা, বিক্রি তিন হাজার টাকা। প্রতিটি ওড়না উৎপাদনে খরচ ১ হাজার ২০০ টাকা, বিক্রি দেড় হাজার টাকা। প্রতিটি শাড়ি উৎপাদনে খরচ ২ হাজার ৬০০ টাকা, বিক্রি ৩ হাজার টাকা। এসব কাঁথাসহ অন্যান্য তৈরি কাপড় বিক্রি হয় ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে।
অদম্য এই নারী উদ্যোক্তা গত বছর ‘অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী’ ক্যাটাগরিতে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ‘শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার’ পান। মিতু আক্তার শুধু নিজের ভাগ্যই বদলাননি, বদলে দিয়েছেন গাইবান্ধার শত শত নারীর জীবনচিত্র।
পলাশবাড়ী উপজেলার নারীকর্মীদের কণ্ঠে মিতুর নামেই ফুটে ওঠে তাঁদের নতুন জীবনের গল্প। নুনিয়াগাড়ি গ্রামের গৃহবধূ রোজি খাতুন বলেন, ‘আমার স্বামী রিকশা চালায়। তার আয় দিয়ে পাঁচজনের সংসার চলে না। তাই মিতু আপার কাছে সেলাইয়ের কাজ শিখেছি। তিন বছর ধরে সংসারের কাজের ফাঁকে কাঁথা ও থ্রি–পিসে নকশার কাজ করছি। প্রতি মাসে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা উপার্জন হচ্ছে। দুজনের আয়ে এখন সংসার ভালোই চলছে।’
একটি নকশিকাঁথা তৈরি করতে খরচ পড়ে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা। একেকটি কাঁথা তৈরিতে লাগে প্রায় ১৫ দিন। দৈর্ঘ্যে সাড়ে পাঁচ হাত, প্রস্থে সাড়ে চার হাতের কাঁথাগুলো বিক্রি হয় আড়াই হাজার থেকে সাড়ে আট হাজার টাকায়।একই এলাকার গৃহবধূ মঞ্জুরা রানী (২৮) বলেন, ‘আমার স্বামী দিনমজুরের কাজ করেন। এলাকায় সব সময় কাজ হয় না। কাজ না পেলে অনাহারে থাকতে হয়। তাই মিতু আপার কাছে সেলাইয়ের কাজ শিখেছি। এখন পাঞ্জাবি, বেডশিট ও নকশিকাঁথায় সুই-সুতার কাজ করে প্রতি মাসে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা উপার্জন করছি। এই টাকা সংসারে জোগান দিয়ে অভাব অনেকটা কমেছে।
একই এলাকার কলেজছাত্রী বৈশাখী মিম বলেন, পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে সেলাইয়ের কাজ করছেন। প্রতি মাসে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা উপার্জন করছেন। নিজের আয়ে পড়াশোনার খরচ চালাচ্ছেন, সংসারেও করছেন সাহায্য।
জানতে চাইলে পলাশবাড়ী পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের (নুনিয়াগাড়ি) কাউন্সিলর মতিয়ার রহমান বলেন, তাঁরা জনপ্রতিনিধি হয়ে যেটা পারেননি, মিতু আক্তার তা করেছেন। তিনি নিজের চেষ্টায় স্বাবলম্বী হয়েছেন, পাশাপাশি কয়েক শ নারীর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছেন। তাঁর কাজ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
সম্প্রতি মিতু আক্তারের কর্মযজ্ঞ দেখতে যান গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক চৌধুরী মোয়াজ্জম আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মিতু আক্তার নিজে এবং কয়েক শ নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ক জ কর কর ছ ন র কর ম নকশ ক করছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
মাছের চিপস বানিয়ে মাসে লাখ টাকা মুনাফা নাজমা আক্তারের
করোনার শুরুর দিকে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেন অনেকেই। লাভও করেন। সে ভাবনা থেকে ২০২০ সালে উদ্যোক্তা নাজমা আক্তার অনলাইনে মেয়েদের রূপচর্চার সামগ্রীর ব্যবসা শুরু করেন। অনলাইনে ব্যবসার জন্য পালংকি কন্যা নামে একটি প্ল্যাটফর্ম চালু করেন। সে সময় রূপচর্চার সামগ্রী বিক্রি করে দুই মাসে ৫০ হাজার টাকা মুনাফা করেন। এই মুনাফা বদলে দেয় নাজমা আক্তারের জীবন।
পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কক্সবাজারের কলাতলী আদর্শগ্রামে থাকতেন নাজমা আক্তার। অবসরপ্রাপ্ত বাবার পেনশনের টাকা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম অবস্থা। তাই নিজে কিছু করার ইচ্ছা থেকে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেন নাজমা। একসময় নতুন পণ্য দিয়ে ব্যবসা করার পরিকল্পনা করেন। সে সময় বাসার কাছেই একটি ডুমুরের গাছ ছিল। তবে এই ফল খাওয়ার প্রচলন না থাকায় বেশির ভাগ সময় পেকে রাস্তায় পড়ে থাকত। তাই এই ফল দিয়ে আচার বানানোর চেষ্টা করেন তিনি। যদিও পরবর্তী সময়ে ডুমুরগাছটি কেটে ফেলা হয়। তাই কাঁচামালের অভাবে এই পণ্য তৈরি বন্ধ হয়ে যায়।
পরপর দুটি ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হয় নাজমা আক্তারকে। এরপর ইন্টারনেট ও ইউটিউবে নতুন ব্যবসার ধারণা খুঁজতে থাকেন। একপর্যায়ে জোনাকি পোকার গুঁড়া তৈরির একটি ভিডিও দেখেন। তখন ধারণা আসে সামুদ্রিক মাছের গুঁড়া তৈরির। প্রথম চেষ্টায় কয়েক দফায় ব্যর্থ হন। তবে একসময় মাছের গুঁড়া তৈরি ও বিক্রি শুরু করেন। অনলাইনে বিক্রিও বাড়তে থাকে। ব্যবসা করতে গিয়ে এই পণ্যের সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন তিনি। তাই মাছ ধরার নির্দিষ্ট মৌসুম ছাড়া এই পণ্য তৈরি করেন না।
একপর্যায়ে ব্যবসা বড় করতে ২০২৪ সালে মাছের চিপস তৈরির পরিকল্পনা করেন নাজমা আক্তার। নিজের বাসায় বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক ও মিঠাপানির মাছ দিয়ে চিপস তৈরির চেষ্টা করেন। প্রথমে টুনা ও পোয়া মাছের চিপস বানানোর চেষ্টা করেন। কয়েকবারের চেষ্টায় তাতে সফল হন তিনি। তারপর ‘ফিসো ফিস চিপস’ নামে সামুদ্রিক মাছ থেকে তৈরি চিপসের একটি ব্র্যান্ড গড়ে তোলেন।
বর্তমানে তিন রুমের একটি ভাড়া বাসায় কারখানা ও অফিস রয়েছে নাজমার। সেখানেই এই মাছের চিপস তৈরি করেন তিনি। বর্তমানে প্রতি মাসে ৭০০ কেজি মাছের চিপস বিক্রি করেন। সব খরচ বাদ দিয়ে মাসে লাখ টাকার বেশি মুনাফা থাকে নাজমার। তাঁর প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন সাতটি পরিবারের সদস্য। এ ছাড়া ৩০ জন নারীকে মাছের চিপস তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
নাজমা আক্তার বলেন, ‘এই চিপস দিয়ে বাচ্চাদের চিপস খাওয়ার বায়না মেটে। অন্যদিকে পুষ্টির চাহিদাও পূরণ হয়। আমাকে এই চিপস অনেকেই বিদেশে রপ্তানি করার কথা বলে। তবে আমি আগে দেশের চাহিদা মেটাতে চাই। পরে রপ্তানি নিয়ে ভাবব। আগামী কয়েক বছরে আমি আরও বড় পরিসরে চিপস উৎপাদনে যেতে চাই।’