সম্প্রতি শারজাহতে অনুষ্ঠিত মিডল ইস্ট ইনভেস্টমেন্ট ফোরামে ভারত ও উপসাগরীয় দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্পর্কের গভীরতা আবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি ভারতের রপ্তানিকে প্রতিযোগিতামূলক হওয়া থেকে বিরত রাখায়, ভারতীয় কোম্পানিগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে (ইউএই) ব্যবহার করছে আমেরিকান বাজারে প্রবেশের একটি মাধ্যম হিসেবে। এটি আঞ্চলিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করছে।

ফলে আগে যেখানে ভারতের সঙ্গে উপসাগরীয় দেশগুলোর সম্পর্ক ছিল তেল এবং শ্রম বিনিময়ের ওপর, তা এখন প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও নিরাপত্তাজুড়ে বিস্তৃত অংশীদারে পরিণত হয়েছে। উপসাগরীয় অঞ্চল এবং ভারত এখন কেবল বাণিজ্যিক অংশীদার নয়; তারা একসঙ্গে ভূ-অর্থনৈতিক সমন্বয় ঘটাচ্ছে এবং বিশ্ববাণিজ্যের মানচিত্র নতুনভাবে আঁকছে।

ভারত ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সম্পর্কের গভীর ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। শতাব্দী ধরে মসলা ও কাপড় বস্ত্র বহনকারী কাফেলা ও বাণিজ্যিক জাহাজ দুই অঞ্চলের মধ্যে স্থায়ী সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ব্রিটিশ রাজত্বকালে অনেক উপসাগরীয় দেশ দিল্লি থেকে পরিচালিত হতো।

ভারত স্বাধীনতার পর কয়েক দশক ধরে সম্পর্ক মূলত লেনদেনভিত্তিক ছিল। একদিকে ছিল তেল, অন্যদিকে ছিল শ্রম আর ধন উভয় দিকে। সম্প্রতি ভারত ও উপসাগরীয় দেশগুলো তাদের ঐতিহাসিক অংশীদারত্বের কৌশলগত মূল্য পুনরায় খুঁজে পেয়েছে এবং একুশ শতকের জন্য পুনর্বিন্যাস শুরু করেছে।

২০১০-এর দশকের মাঝামাঝি এই দুই পক্ষের কৌশলগত অগ্রাধিকার মিলতে শুরু করে। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথমবারের মতো সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন। এটি ছিল ৩৪ বছর পর কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর। এই সময়ে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান ও সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান তাঁদের অর্থনীতি তেলের বাইরে বৈচিত্র্যপূর্ণ করার পরিকল্পনা চালু করেন।

ভারতের সঙ্গে উপসাগরীয় এলাকার এই মিলন ঘটেছে অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের কারণে। উপসাগরীয় দেশগুলো তেলের ওপর নির্ভরতার ঝুঁকি বুঝতে শুরু করেছে এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি, প্রযুক্তি ও পর্যটনে বিনিয়োগ করেছে। একই সময়ে ভারত দ্রুত শিল্পায়ন ও ডিজিটালাইজেশনে এগোচ্ছে এবং এমন উপসাগরীয় দেশগুলোতে উৎসাহী অংশীদার খুঁজেছে, যাদের পুঁজিও আছে এবং পরিকল্পনাও আছে। ভারত চায় বিনিয়োগ ও দক্ষতা। আর উপসাগরীয় দেশগুলো চায় বড় প্রবৃদ্ধি ও নতুন নতুন সুযোগ।

এই সম্পর্কের শুরুতেই গভীর অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সহযোগিতা গড়ে ওঠে। এর মধ্যে রয়েছে আই২ইউ২ অংশীদারি। এর মধ্যে আছে ভারত, ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্র।

ভারত-গালফ অংশীদার থেকে বোঝা যাচ্ছে, কীভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তি উন্নয়ন চালাতে পারে। ভারতের সাশ্রয়ী ও ওপেন-সোর্স ডিজিটাল সিস্টেমের সঙ্গে উপসাগরীয় এলাকার পুঁজির মিলন আধুনিক অবকাঠামো, অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল পরিচয় এবং পরিবেশ সচেতন প্রকল্পের মাধ্যমে ভালো মজুরির কাজ তৈরি করছে।

এ ছাড়া উপসাগরের নেতারা ভারতের জাতীয় অনুষ্ঠানে সম্মানও পেয়েছেন। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, এই বছর ভারত-ইউএই বাণিজ্য ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। আর ২০২৩-২৪ সালে ভারত-সৌদি বাণিজ্য হয়েছে ৪৩ বিলিয়ন ডলার।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই পুঁজির ব্যবহার। আবুধাবির মুবাদালা ও সৌদি পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড ভারতীয় স্টার্টআপ, অবকাঠামো এবং সবুজ শক্তি প্রকল্পে বড় বিনিয়োগ করেছে। এগুলো এককালীন নয়; বরং দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ।

এই গতিশীলতা ধরে রেখে ভারত-উপসাগরীয় সম্পর্ক এখন আফ্রিকার দিকে বিস্তার করছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত পুরো মহাদেশে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আর সৌদি আরব ৪১ বিলিয়ন ডলার উন্নয়ন উদ্যোগ ঘোষণা করেছে। ভারত আফ্রিকায় শান্তি রক্ষা মিশন, উন্নয়ন প্রকল্প ও প্রসারিত প্রবাসী সম্প্রদায়ের মাধ্যমে গড়ে তোলা ইতিবাচক সম্পর্ক নিয়ে আসে। এটি উপসাগরীয় এলাকার পুঁজিকে সহায়তা করে এবং জোটের প্রভাব বৃদ্ধি করে।

এ ছাড়া নতুন ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পুঁজির মাধ্যমে ভারতীয় কোম্পানিগুলো আফ্রিকায় অবকাঠামো নির্মাণ করছে। এটি বড় শক্তি দেশগুলোর প্রকল্পের বিকল্প, যা প্রায়ই ঋণফাঁদ এবং রাজনৈতিক শর্তের সঙ্গে আসে।

মধ্যম আকারের দেশগুলো, যারা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দ্বন্দ্বের মধ্যে না পড়তে চায়, তাদের জন্য ভারত-গালফ জোট নিরাপদ অবকাঠামো, প্রযুক্তি সহযোগিতা এবং নিরাপত্তা সহায়তা দিচ্ছে।

ভারত-গালফ অংশীদার থেকে বোঝা যাচ্ছে, কীভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তি উন্নয়ন চালাতে পারে। ভারতের সাশ্রয়ী ও ওপেন-সোর্স ডিজিটাল সিস্টেমের সঙ্গে উপসাগরীয় এলাকার পুঁজির মিলন আধুনিক অবকাঠামো, অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল পরিচয় এবং পরিবেশ সচেতন প্রকল্পের মাধ্যমে ভালো মজুরির কাজ তৈরি করছে।

কিন্তু এটি কোনো নতুন ‘নন-অ্যালাইমেন্ট’ নয়। ভারত-গালফ জোট হলো ‘মাল্টি-অ্যালাইনমেন্ট’। এটি একটি বাস্তবধর্মী কৌশল, যা যৌথ স্বার্থ, পারস্পরিক সুবিধা এবং স্বাধীনতার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে।

অবশ্যই এই জোটের সামনে চ্যালেঞ্জ আছে। আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং বৈশ্বিক অস্থিরতা এই জোটের সামনে প্রধান বাধা। তবু দুই পক্ষের আত্মবিশ্বাস স্পষ্ট। ভারত ও উপসাগরীয় দেশগুলো অন্যের কৌশলের ওপর নির্ভর না করে তাদের নিজস্ব পথ তৈরি করছে।

যদি এই অংশীদারি টেকসই হয়, তবে এটি কেবল দ্বিপক্ষীয় সাফল্যই হবে না। ভারত-গালফ জোট দ্রুত বহুমুখী বিশ্বে একটি নতুন শক্তিকেন্দ্র হতে পারে। এটি অন্য উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য একটি উদাহরণ হতে পারে, যেখানে কোনো রাজনৈতিক দাসত্ব ছাড়াই উন্মুক্ত প্রযুক্তি, স্থিতিশীল বাণিজ্য এবং সমৃদ্ধি সম্ভব হবে।

বিবেক আগরওয়াল টনি ব্লেয়ার ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল চেঞ্জ-এ ভারতের কান্ট্রি ডিরেক্টর

আলেক্সান্ডার জর্জ টনি ব্লেয়ার একই সংস্থার সিনিয়র ডিরেক্টর

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রকল প অবক ঠ ম র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের পদক্ষেপ কি কৌশলগত ভুল

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন। এ আদেশে তিনি তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা টিমকে মুসলিম ব্রাদারহুডের কিছু শাখাকে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন (এফটিও) হিসেবে চিহ্নিত করার সম্ভাবনা যাচাই করতে বলেছেন। এটা তাঁর প্রশাসনের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত, যা একটি বেপরোয়া নীতিগত ভুলের প্রতিনিধিত্ব করে। এটি বাস্তবায়িত হলে যুক্তরাষ্ট্রের মূল স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে, মধ্যপ্রাচ্য আরও অস্থিতিশীল হবে এবং যেসব শক্তিকে ওয়াশিংটন মোকাবিলা করার দাবি করে, তাদেরই ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।

এ আদেশে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডি এবং জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ডের সঙ্গে পরামর্শ করে ৩০ দিনের মধ্যে একটি রিপোর্ট দেবেন। এ রিপোর্টে মিসর, জর্ডান ও লেবাননে মুসলিম ব্রাদারহুডের শাখাগুলোকে এফটিও হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা উচিত কি না, সেটি উল্লেখ থাকবে।

এটি প্রথমবারের মতো হলো, তা নয়। গত দশকে বহুবার চেষ্টা হয়েছে; ট্রাম্পের প্রথম আমলে কংগ্রেসের কিছু সদস্য, বিশেষ করে সিনেটর টেড ক্রুজ এমন চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ, মার্কিন সরকারের ভেতরে বাস্তববাদী পেশাদারেরা ছিলেন, যাঁরা মৌলিক সত্যটি বুঝতেন: মুসলিম ব্রাদারহুড একটি আন্দোলন হিসেবে এ ধরনের চিহ্নিতকরণের আইনি মানদণ্ড পূরণ করে না; বরং তা করা হবে ভয়াবহ নীতিগত ভুল।

মার্কিন আইনে কোনো সংগঠনকে এফটিও হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে হলে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয়: সংগঠনটি অবশ্যই বিদেশি হতে হবে; সেটিকে বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতে হবে অথবা তা করার সক্ষমতা ও অভিপ্রায় থাকতে হবে এবং এসব কর্মকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্র বা এর জনগণের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে হবে।

মুসলিম ব্রাদারহুডের ক্ষেত্রে এই তিনটির মধ্যে দুটি শর্ত অনুপস্থিত। মিসর, জর্ডান বা লেবাননে ব্রাদারহুডের কোনো শাখাই বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী সহিংসতার সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্যভাবে যুক্ত নয়। তারা রাজনৈতিক, সামরিক বা অর্থনৈতিক—কোনোভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা বা নাগরিকদের জন্য প্রকৃত হুমকি তৈরি করে না। পরিহাস হলো, আরব স্বৈরশাসকদের সমর্থকেরা প্রায়ই ব্রাদারহুডকে ওয়াশিংটনের দালাল বা এজেন্ট হিসেবে অভিযুক্ত করেন।

সংস্কারবাদী আন্দোলন

মিসরে ব্রাদারহুড এক শতাব্দী পুরোনো একটি সংস্কারবাদী আন্দোলন, যা গামাল আবদেল নাসেরের সময়ের দমন-পীড়নের অভিজ্ঞতার পর ১৯৭০-এর দশকের শুরু থেকে অহিংস অংশগ্রহণের পথে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। দশকের পর দশক তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে, পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং দরিদ্র জনগণের জন্য সামাজিক সেবা প্রদান করেছে। বিশেষভাবে ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে তারা ছিল জঙ্গি জিহাদের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ, যা হাজারো মিসরীয়কে আল-কায়েদা ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে যোগ দেওয়া থেকে বিরত রেখেছিল।

২০১১ সালের বিপ্লবের পর ব্রাদারহুড সংসদীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং মুহাম্মদ মুরসি মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন। কিন্তু ২০১৩ সালের জুলাইয়ে আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানে তাঁকে অপসারণ করা হয়। এরপর ঘটে রাবা হত্যাকাণ্ড, যা আধুনিক মিসরীয় ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। ফলে এক যুগব্যাপী নজিরবিহীন দমন-পীড়নের সূচনা হয়।

আরও পড়ুনমুসলিম ব্রাদারহুড বনাম যুক্তরাষ্ট্র১৮ এপ্রিল ২০১৩

গণহত্যা, কারাবন্দী ও নির্বাসনের মধ্যেও ব্রাদারহুড নেতৃত্ব অহিংস অবস্থানেই অবিচল থাকে, যা সংগঠনের বহু তরুণ সদস্যের হতাশার কারণ ছিল। এখন ব্রাদারহুড সাংগঠনিকভাবে বিভক্ত, রাজনৈতিকভাবে উপেক্ষিত এবং মিসরের ভেতরে তাদের কার্যক্রম প্রায় নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুধু অযৌক্তিকই নয়, বরং অর্থহীন। আইনি ভিত্তি দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ হলেও মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করার পেছনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য একেবারেই স্পষ্ট।

প্রথমত, এই সিদ্ধান্ত ট্রাম্পকে ঘিরে থাকা চরম ডানপন্থী উগ্রপন্থীদের জন্য একটি জয়। যেমন সেবাস্তিয়ান গোরকা, ট্রাম্পের সিনিয়র কাউন্টারটেররিজম পরিচালক, যাঁকে নিয়ে ইউরোপের নব্য নাৎসিগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বহু প্রতিবেদন রয়েছে এবং লরা লুমার, যিনি যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ইসলামবিরোধী প্রচারণার জন্য পরিচিত এক কট্টর ডানপন্থী কর্মী। দুজনই দীর্ঘদিন ধরে ব্রাদারহুডকে বৈশ্বিক ইসলামপন্থী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে উপস্থাপন করে এসেছেন এবং এটিকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্তির জন্য জোরদার লবিং করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপ প্রকৃত সন্ত্রাসী সংগঠন, যেমন আল–কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটকে মোকাবিলার প্রচেষ্টাকে দুর্বল করবে। ঐতিহাসিকভাবে সহিংসতাকে প্রত্যাখ্যান করেছে এমন মধ্যপন্থী ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে দুর্বল করে যুক্তরাষ্ট্র অনিচ্ছাকৃতভাবে আরও উগ্র বিকল্পগুলোর প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়ে দেবে। এভাবে এই সিদ্ধান্ত নিজেই তার পূর্বাভাস সত্যে পরিণত করবে।

দ্বিতীয়ত, আরবের স্বৈরশাসকেরা বহু বছর ধরে ব্রাদারহুডকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য ওয়াশিংটনে লবিং করছেন। কারণ, এটি এখনো তাঁদের সবচেয়ে শক্তিশালী সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। মিসর, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত—যারা আরব বসন্তবিরোধী প্রতিবিপ্লবের স্থপতি—ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে দেখছে এ অঞ্চলের সংগঠিত রাজনৈতিক বিরোধিতার শেষ চিহ্নটুকুও নিশ্চিহ্ন করার সুযোগ হিসেবে। সময়টিও সন্দেহজনক—সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের হোয়াইট হাউস সফরের কয়েক দিনের মধ্যেই এই ঘোষণা এল।

তৃতীয়ত, রাজনৈতিক ইসলামকে ইসরায়েল তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে; আরব সমাজে এর ব্যাপক জনসমর্থন এবং অধিকৃত ভূখণ্ডে ইসরায়েলি নীতির প্রতি এর প্রত্যাখানের কারণে। মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী ঘোষণা করলে ইসরায়েলের অন্যতম প্রভাবশালী আদর্শিক প্রতিপক্ষ দুর্বল হবে, যা ইসরায়েলি স্বার্থের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইসরায়েলপন্থী থিঙ্কট্যাংকের বেশ কিছু প্রতিবেদন ট্রাম্প প্রশাসনকে ব্রাদারহুডের নির্দিষ্ট শাখাগুলোকে এফটিও তালিকাভুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছে।

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মুসলিম দাতব্য ও অধিকার–সংক্রান্ত সংগঠনগুলোর সঙ্গে ব্রাদারহুডকে যুক্ত করার প্রচেষ্টা বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল–সমর্থিত লবিং সংস্থাগুলো, বিশেষত যেসব সংগঠন গাজার গণহত্যার বিরুদ্ধে সক্রিয়। এদের কয়েকটি সংগঠন ফেডারেল ও অঙ্গরাজ্যের সরকারগুলোকে ‘চরমপন্থা মোকাবিলার’ নামে ইসলামি নাগরিক সংগঠনগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার সুপারিশ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট তাঁর রাজ্যে মুসলিম ব্রাদারহুড ও কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনসকে সন্ত্রাসী সত্তা হিসেবে ঘোষণা করেছেন। জাতীয়ভাবে ভবিষ্যতে কী হতে পারে, এটা তার একটি অশুভ ইঙ্গিত।

দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি

মুসলিম ব্রাদারহুডকে এফটিও হিসেবে চিহ্নিত করার বিষযটি মার্কিন নিরাপত্তা স্বার্থকে এগিয়ে নেওয়ার পরিবর্তে ভয়াবহ ও ব্যাপক পরিণতি বয়ে আনবে। এটি যুক্তরাষ্ট্রকে এমন এক ইসলামি আন্দোলনের মুখোমুখি দাঁড় করাবে, যা আরব ও মুসলিম বিশ্বে সবচেয়ে গভীরভাবে প্রোথিত। ব্রাদারহুড কেবল একটি ধর্মীয় বা রাজনৈতিক সংগঠন নয়; এটি একটি ধারণা, যার লাখ লাখ সমর্থক গোটা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা স্থানে রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপ প্রকৃত সন্ত্রাসী সংগঠন, যেমন আল–কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটকে মোকাবিলার প্রচেষ্টাকে দুর্বল করবে। ঐতিহাসিকভাবে সহিংসতাকে প্রত্যাখ্যান করেছে এমন মধ্যপন্থী ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে দুর্বল করে যুক্তরাষ্ট্র অনিচ্ছাকৃতভাবে আরও উগ্র বিকল্পগুলোর প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়ে দেবে। এভাবে এই সিদ্ধান্ত নিজেই তার পূর্বাভাস সত্যে পরিণত করবে।

আরও পড়ুনব্রাদারহুড ফিরবে শক্তিশালী হয়ে২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩

এটি হতাশাগ্রস্ত কিছু তরুণকে আরও চরমপন্থার দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকিও তৈরি করবে। ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করার বিষয়টিকে উগ্রপন্থীরা ব্যবহার করবে এই বার্তা দিতে যে শান্তিপূর্ণ কর্মকাণ্ড অর্থহীন; বিশেষ করে যখন এই তরুণেরা দেখতে পায়, ওয়াশিংটন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমদ আল-শারাকে আলিঙ্গন করছে, যিনি একসময় হায়াত তাহরির আল-শামের নেতা ছিলেন এবং যাঁর মাথার দাম একসময় ১০ মিলিয়ন ডলার ছিল। কিন্তু তাঁকে এখন হোয়াইট হাউসে স্বাগত জানানো হচ্ছে। শান্তিপূর্ণ কার্যকলাপকে অপরাধী বানানো হলে উগ্র গোষ্ঠীই লাভবান হয়।

এফটিও ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যকার অবিশ্বাস আরও গভীর করবে। বিশেষত যখন তাদের নাগরিক ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে মিথ্যা অজুহাতে লক্ষ্যবস্তু করা শুরু হবে। ফলে বিচ্ছিন্নতা বাড়বে এবং রাজনৈতিক বিভাজন তীব্রতর হবে। বিশেষ করে মিশিগান ও পেনসিলভানিয়ার মতো ‘সুইং’ অঙ্গরাজ্যগুলোতে।

শেষত, এই পদক্ষেপের ফলে কাতার ও তুরস্কের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়তে পারে, যে দুটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন মিত্র এবং যারা নির্বাসিত ব্রাদারহুড নেতাদের আশ্রয় দিয়ে থাকে। সবচেয়ে বড় পরিহাস হলো, কয়েক দশকের মধ্যে ব্রাদারহুড এখন সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় রয়েছে: রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত, সাংগঠনিকভাবে দুর্বল এবং অঞ্চলজুড়ে দমন-পীড়নের কারণে সামাজিকভাবে সংকুচিত। এমন এক আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা কেবল বিশ্লেষণগত দিক থেকে অসংগত নয়, কৌশলগত দিক থেকেও আত্মঘাতী।

এই ঘোষণার মাধ্যমে ট্রাম্প উগ্রপন্থীদের দুর্বল করবেন না; বরং আরও শক্তিশালী করবেন। তিনি আমেরিকানদের আরও নিরাপদ করবেন না; বরং যুক্তরাষ্ট্রকে আরও অনিরাপদ করে তুলবেন। আর তিনি মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা আনবেন না; বরং এর ভাঙন আরও ত্বরান্বিত করবেন। সংক্ষেপে, এটি ওয়াশিংটনের নেওয়া সবচেয়ে ভ্রান্ত ও কৌশলগতভাবে ব্যয়বহুল পদক্ষেপগুলোর একটি, যা বছরের পর বছর ধরে মার্কিন স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ঝুঁকি তৈরি করছে।

খালিল আল-আনানি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি দুটি বইয়ের লেখক—ইনসাইড দ্য মুসলিম ব্রাদারহুড: রিলিজিয়ন, আইডেন্টিটি অ্যান্ড পলিটিকস এবং ইসলামিজম অ্যান্ড রেভল্যুশন অ্যাক্রস দ্য মিডল ইস্ট।

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনায় দ্বিগুণ হবে দাকোপের অর্থনীতি
  • ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা নিয়ে চীন-রাশিয়ার যৌথ মহড়া
  • মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের পদক্ষেপ কি কৌশলগত ভুল