দখলদারত্বের মাধ্যমে ভোট আদায়ের চেষ্টা করলে উভয়েই পরাজিত হবে: নাহিদ ইসলাম
Published: 7th, December 2025 GMT
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আগামী নির্বাচনে যদি কেউ গায়ের জোরে দখলদারত্ব দেখিয়ে ভোট নেওয়ার চেষ্টা করে অথবা ধর্মের নামে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে ভোট আদায় করতে চায়, তাহলে উভয়েই পরাজিত হবে।
এনসিপির এই নেতা বলেন, ‘আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে অতীতে দেখা গেছে, ভোটকেন্দ্র দখল, জবরদস্তি, আধিপত্যমূলক ও ফ্যাসিবাদী আচরণ। উদ্বেগের বিষয় হলো, এ আচরণগুলো আবার শুরু হয়ে গেছে।’
আজ রোববার বিকেলে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) মিলনায়তনে এনসিপি, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ে ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট’ নামে একটি রাজনৈতিক জোটের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে নাহিদ ইসলাম এ কথা বলেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই জোটের প্রার্থীরা একই প্রতীকে নির্বাচন করবেন বলেও প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন তিনি। এ সময় এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু এবং রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি হাসনাত কাইয়ূম উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে নাহিদ ইসলাম বলেন, ঘোষিত ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট’ শুধু নির্বাচনী জোট নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক জোট। এই জোট জাতীয় মর্যাদা ও অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্নকে সামনে রেখে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।
দেশে নতুন করে ‘ফ্যাসিবাদী আচরণ’ শুরু হয়েছে অভিযোগ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফুয়াদকে (আসাদুজ্জামান ফুয়াদ) বরিশালে নির্বাচনী প্রচারণার সময় হেনস্তা করা হয়েছে, তাঁর কাজে বাধা দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্মীপুরে আ স ম আবদুর রবের নির্বাচনী এলাকায় তাঁর স্ত্রী তানিয়া রবের প্রচারণায়ও বাধা দেওয়া হয়েছে, এমনকি অফিস ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের যে প্রত্যাশা, যেখানে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দেবে এবং মত প্রকাশ করবে, সেই পরিবেশেরই যে ব্যত্যয় ঘটছে, তার প্রমাণ দেখা যাচ্ছে।
নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, ভিন্নমতকে দমনের যে অহংকার, গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেই অহংকারের পতন ঘটেছিল। আগামী নির্বাচনে যদি কেউ গায়ের জোরে দখলদারত্ব দেখিয়ে ভোট নেওয়ার চেষ্টা করে, অথবা ধর্মের নামে মানুষকে প্রতারণা করে ভোট আদায় করতে চায়—তাহলে উভয়েই পরাজিত হবে।
২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তনের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, তা বাস্তবায়নে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চললেও ‘ঐক্যমত কমিশনের প্রক্রিয়া’ বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে অভিযোগ করেন এনসিপির এই নেতা। তিনি বলেন, ‘আমরা যারা পরিবর্তনের পক্ষে এবং গণ–অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে সফল করতে চাই, তারা আজ ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। এই ঐক্যপ্রক্রিয়া এখন শুরু হলো, এটি চলমান থাকবে। পুরোনো ধাঁচের রাজনীতিতে ফিরে যাওয়ার যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, সেই হতাশা কাটাতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
মানুষ নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রত্যাশায়এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, গণ–অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রকে নতুন পথে নেওয়ার যে স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, নানা কারণে তা ব্যাহত হয়েছে। বিশেষ করে তরুণদের বহু প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমরা যারা নতুন রাজনীতি করতে এসেছি, আমরাও মানুষের আচরণে কষ্ট পেয়েছি, কখনো দিশা হারিয়েছি। আমাদের ভুলত্রুটিও ছিল। কিন্তু একটা বিষয় আমরা স্পষ্ট দেখেছি—পুরোনো রাজনীতির প্রতি মানুষের গভীর হতাশা। মানুষ নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রত্যাশায় আছে।’
মজিবুর রহমান বলেন, পুরোনো রাজনীতির সহিংসতা, পরস্পরের প্রতি বিষোদ্গার, পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, মিছিলে ভাঙচুর, সন্ত্রাস—এসব রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন রাজনৈতিক জোট কাজ করবে। এই জোটে আরও রাজনৈতিক দল যুক্ত হতে পারে। এ বিষয়ে আলোচনা চলছে।
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি হাসনাত কাইয়ূম বলেন, বাংলাদেশের দীর্ঘ ৫০-৫৫ বছরের ইতিহাসে সবচাইতে বড় মূল্য পরিশোধ করা সত্ত্বেও জনগণের আকাঙ্ক্ষিত অর্জন পূরণ হয়নি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যাঁরা যুক্ত আছেন, তাঁদের ব্যর্থ থাকার কোনো অধিকার নেই, বরং তাঁদের সফল হতেই হবে। এই ব্যর্থতা থেকে মুক্তি এবং সফল হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই নতুন রাজনৈতিক জোট গঠন করা হয়েছে।
আগামীকাল আরকেটি রাজনৈতিক জোটের আত্মপ্রকাশজাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় পার্টির (জাপা) একাংশের চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে আগামীকাল সোমবার নতুন রাজনৈতিক জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটতে যাচ্ছে। জোটের মুখপাত্র করা হচ্ছে জাপা মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে। এই জোটের সম্ভাব্য নাম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক জোট’।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক জ ট ন হ দ ইসল ম ম বল ন প রক শ এনস প
এছাড়াও পড়ুন:
ডা. জুবাইদার আগমন: ভিউয়ের প্রতিযোগিতা ও সাংবাদিকতার নৈতিক সংকট
সাংবাদিকদের বলা হয় ‘জাতির বিবেক’আর সাংবাদিকতাকে বলে ‘ফোর্থ পিলার অব স্টেট’। সমাজ ও রাষ্ট্রের দর্পণ হিসেবে কাজ করাই যার মূল লক্ষ্য; কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের একটি অংশের আচরণ সাধারণ মানুষের মনে গভীর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
নিউজের চেয়েও ভিউজের দিকে মনোযোগ বাড়াতে গিয়ে সাংবাদিকতাকে হাসির খোরাক বানিয়েছে কিছু অত্যুৎসাহী সংবাদমাধ্যম। অবাক করা বিষয় হলো এই তালিকায় শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমও রয়েছে।
যার সর্বশেষ উদাহরণ পাওয়া গেল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমানের বাংলাদেশে আগমনে। তাঁর লন্ডন থেকে ঢাকায় আগমন এবং তৎপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহকে কেন্দ্র করে কিছু সংবাদমাধ্যম যে অতি উৎসাহ ও অপরিণামদর্শী আচরণ প্রদর্শন করেছে, তা সাংবাদিকতার নীতিনৈতিকতার সংজ্ঞাকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
কৌতূহল মেটানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতাডা. জুবাইদা রহমান তাঁর অসুস্থ শাশুড়ি, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দেখতে গত শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) দেশে ফিরেছেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় এই মুহুর্তের জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। ফলে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং জিয়া পরিবারের সদস্য হিসেবে তাঁর দেশে ফেরা সাধারণ মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে; কিন্তু সমস্যাটা সংবাদ প্রকাশে নয়, সংবাদ পরিবেশনের ধরন ও বাড়াবাড়ি নিয়ে। কিছু সংবাদমাধ্যম এটি করেছে, যা নিয়ে সচেতন নাগরিক সমাজেও সমালোচনা তৈরি হয়েছে।
ডা. জুবাইদার লন্ডনে বিমানে ওঠা থেকে শুরু করে ঢাকার বিমানবন্দরে অবতরণ, ইমিগ্রেশন পার হওয়া, ভিআইপি গেট দিয়ে বের হওয়া, কোন গাড়িতে উঠলেন, কোন পথ দিয়ে হাসপাতালে গেলেন, কোন ফ্লাইওভার ব্যবহার করলেন, কখন এভারকেয়ার হাসপাতালে পৌঁছালেন—প্রতিটি মুহূর্তের এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ কি আসলেই জনগুরুত্বপূর্ণ সংবাদ? নাকি এটি নিছকই কৌতূহল মেটানোর এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা?
একটি গাড়ি কোন ফ্লাইওভার দিয়ে যাচ্ছে, তা জানা জাতির জন্য কতটা জরুরি, তা গবেষণার বিষয়। এই ধরনের লাইভ ট্র্যাকিং বা ‘ধাওয়া করা সাংবাদিকতা’ কেবল হাস্যকরই নয়; বরং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্যও হুমকিস্বরূপ। সাংবাদিকতা যখন ‘গোয়েন্দাগিরি বা ‘পাপারাজ্জি’ সংস্কৃতির স্তরে নেমে আসে, তখন তথ্যের চেয়ে সস্তা বিনোদনই মুখ্য হয়ে ওঠে।
ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশঘটনার এখানেই শেষ নয়, বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার উদ্দেশ্যে বিদেশযাত্রার সম্ভাব্য সফরসঙ্গীদের তালিকা প্রকাশের নামে কিছু সংবাদমাধ্যম নজিরবিহীন দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গীদের নাম, পাসপোর্টের নম্বর এবং মুঠোফোনের নম্বরের মতো অত্যন্ত সংবেদনশীল ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ্যে চলে এসেছে। এর জন্য বিএনপির দায়িত্বশীল মহল দায় এড়াতে পারে না। এ তথ্যগুলো ব্যবহার করে যে কেউ সাইবার অপরাধ বা জালিয়াতির আশ্রয় নিতে পারে। কিন্তু খবরের জৌলুশ বাড়াতে গিয়ে এমন সংবদেনশীল ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করেছে কিছু সংবাদমাধ্যম।
সাংবাদিকতার নীতিমালায় স্পষ্ট বলা আছে, জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট না হলে কারও ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। কারও পাসপোর্ট নম্বর বা ব্যক্তিগত মুঠোফোন নম্বর প্রকাশ করা কি জনস্বার্থের অন্তর্ভুক্ত? এটি সরাসরি ডেটা প্রাইভেসি বা ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা লঙ্ঘন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসা সব খবর বা তথ্যই কি প্রকাশ করা পেশাদারির মধ্যে পড়ে?
হাসপাতালের পরিবেশ বিঘ্নডা. জুবাইদা রহমান যখন এভারকেয়ার হাসপাতালে পৌঁছান, তখন সেখানকার দৃশ্য ছিল আরও করুণ। শত শত ক্যামেরা, ইউটিউবার ও মূলধারার মিডিয়াকর্মীদের ভিড় হাসপাতালের প্রবেশপথকে কার্যত এক জনসভায় পরিণত করেছিল। হাসপাতালের মতো স্পর্শকাতর জায়গা, যেখানে নীরবতা ও শৃঙ্খলা কাম্য, সেখানে সংবাদমাধ্যমের এই হুলুস্থুল আচরণ হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, স্টাফ, অন্যান্য রোগী ও তাঁদের স্বজনদের জন্য চরম ভোগান্তির কারণ হয়েছে।
হাসপাতালের সামনে অ্যাম্বুলেন্সের পথ আটকে, অন্যান্য রোগীর স্বজনদের চলাচলে বিঘ্ন ঘটিয়ে ডা. জুবাইদার গাড়ির পেছনে দৌড়ানোর দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে, এটি কোনো সংবাদ সংগ্রহ নয় বরং কোনো অ্যাকশন সিনেমার শুটিং চলছে। যেসব সাংবাদিক এমনটা করছেন তাঁরা কি ভুলে গেছেন, হাসপাতালে মুমূর্ষু রোগীরা থাকেন? তাঁদের এই হট্টগোল মুমূর্ষু রোগী ও হাসপাতালের স্বাভাবিক কাজকর্মে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে? ‘ব্রেকিং নিউজ’ দেওয়ার নেশায় মানবিক বোধটুকু বিসর্জন দেওয়া কোন ধরণের সাংবাদিকতা!
ডা. জুবাইদার ঘটনাই একমাত্র উদাহরণ নয়, ভিউয়ের নেশায় মত্ত হয়ে আমাদের অনেক সংবাদমাধ্যম এমন অত্যুৎসাহী লাইভ, ব্রেকিং ও এক্সক্লুসিভ দেওয়াকে রুটিনে পরিণত করেছে।
কেন এমন আচরণপ্রশ্ন হলো, অনেক সাংবাদিক কেন এমন আচরণ করছেন? এর উত্তর লুকিয়ে আছে বর্তমান সময়ের সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘রিচ বাড়ানো’ বা ভিউ–বাণিজ্যের মধ্যে। এখন খবরের মান যাচাই করা হয় সত্যতা বা গভীরতা দিয়ে নয়; বরং কত দ্রুত সেটি ফেসবুকে ভাইরাল হলো এবং কত বেশি ভিউ পেল, তার ওপর ভিত্তি করে।
অনলাইন পোর্টাল এবং কিছু টেলিভিশন চ্যানেল টিআরপি ও ভিউ বাড়ানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। মানুষের আবেগ, কৌতূহল এবং ব্যক্তিগত বিষয়কে পুঁজি করে তারা চটকদার শিরোনাম তৈরি করছে। জুবাইদা রহমানের গাড়ির পেছনে দৌড়ানোর ভিডিও হয়তো ইউটিউবে লাখ লাখ ভিউ এনে দিচ্ছে, বিজ্ঞাপন থেকে আয় বাড়াচ্ছে; কিন্তু এতে সাংবাদিকতার মর্যাদা ধুলা মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যখন সাংবাদিকতা বাণিজ্যের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে, তখন পেশার নীতি–নৈতিকতার বালাই থাকে না। সাংবাদিকেরা তখন আর ‘ওয়াচডগ’ থাকেন না, হয়ে ওঠেন কনটেন্ট ক্রিয়েটর।
দেশে কি সংবাদের সত্যিই অভাব? উত্তর হলো ‘না’। জাতীয় নির্বাচন ঘিরে রাজনীতি, ডেঙ্গু পরিস্থিতি, পরীক্ষা বন্ধ রেখে শিক্ষকদের আন্দোলন, অর্থনৈতিক সংকট, ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মতো অসংখ্য জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় যখন মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে, তখন মিডিয়ার একটি বড় অংশ ব্যস্ত একজন ব্যক্তির গাড়ির রুটম্যাপ তৈরিতে। এটি কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মূল সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টি সরানোর কৌশল? নাকি এটি কেবলই মেধা ও মননশীলতার সংকট?
মিডিয়া যখন জনগণের কথা না বলে চটকদার বিষয় নিয়ে মেতে থাকে, তখন তারা জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। ডা. জুবাইদা রহমানের আগমন অবশ্যই একটি ঘটনা; কিন্তু সেটিই একমাত্র বা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু হতে পারে না। তাই এখনই সময় এই অপসাংবাদিকতার লাগাম টেনে ধরার। ‘জাতির বিবেক’খ্যাত সাংবাদিকদের আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখা প্রয়োজন। মাইক্রোফোন বা ক্যামেরা হাতে নিলেই যা খুশি তা করা যায় না, এই বোধোদয় জরুরি। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন পক্ষের কিছু করণীয় রয়েছে।
প্রথমত, সাংবাদিকদেরই বুঝতে হবে পাপারাজ্জি আর সাংবাদিকতা এক নয়। সাংবাদিকতা মানে দায়িত্বশীলতা। সংবাদমাধ্যমগুলোকে তাদের কর্মীদের নিয়মিত নীতিনৈতিকতা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তাবিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সম্পাদক ও বার্তাকক্ষের নীতিনির্ধারকদের আরও কঠোর হতে হবে। ভিউ বাড়ানোর জন্য যেকোনো সংবাদ প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করার আগে সম্পাদকীয় নীতি অনুসারে যাচাইপ্রক্রিয়া জোরদার করতে হবে।
এ ছাড়া সরকারের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইনের কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে, প্রয়োজনে ক্যাম্পেইন করা যেতে পারে। তবে এ আইন যেন গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করে বরং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষায় ঢাল হিসেবে কাজ করে। পাশাপাশি হাসপাতাল বা স্পর্শকাতর এলাকায় মিডিয়ার আচরণের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।
গণমাধ্যমকর্মী ও সরকারের পাশাপাশি পাঠকদেরও দায়িত্ব রয়েছে। চটকদার ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনকারী সংবাদ বর্জন করার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। ভিউ না পেলে তখন মিডিয়াও তাদের পলিসি বদলাতে বাধ্য হবে।
ডা. জুবাইদা রহমানের দেশে ফেরাকে কেন্দ্র করে আমাদের কিছু সংবাদমাধ্যমের যে আচরণ দেখা গেল, তা আমাদের সাংবাদিকতার রুগ্ণ দশাটিই প্রকট করে তুলেছে। সংবাদমাধ্যমগুলো যদি এখনই নিজেদের সংশোধন না করে, তবে তারা কেবল হাসির খোরাকই হবে না; বরং সমাজের চোখে অবিশ্বাস আর বিরক্তির প্রতীক হয়ে উঠবে। আমরা চাই না আমাদের সাংবাদিকেরা সত্যের পেছনে দৌড়াক। তাঁরা যেন তথ্যের ফেরিওয়ালা হন, গুজবের নয়। দায়িত্বশীল সাংবাদিকতাই পারে এই পেশার হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে।
ইয়াসির সিলমী সভাপতি, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। ই-মেইল: [email protected]