বছরের পর বছর ধরে তাজমহলের নেপথ্যের চিরন্তন প্রেমকাহিনি বর্ণনা করে আসা অভিজ্ঞ ভ্রমণ গাইড বিষ্ণু দাস দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন। পাশের ভবনের ছাদ থেকে উৎকণ্ঠার দৃষ্টিতে তাজমহলের দিকে তাকিয়ে তিনি বলে ওঠেন, ‘যে গল্প আমরা এত বছর ধরে বলে আসছি, যদি সেটা মিথ্যা হয়?’

এ প্রশ্নের উত্তর জানতে বিষ্ণু দাস এতটাই মরিয়া হয়ে ওঠেন যে তিনি প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘আমরা কি তাজমহলের ওপর ডিএনএ পরীক্ষা করতে পারি না?’ পরমুহূর্তেই তিনি বলে ওঠেন, ‘আমরা একটা মিথ্যা প্রচার করছি।’

বিষ্ণু বা এসব কথাবার্তা কোনো বাস্তব ঘটনা নয়। ভারতীয় পরিচালক তুষার গোয়েলের বিতর্কিত চলচ্চিত্র ‘দ্য তাজ স্টোরি’-এর একটি দৃশ্য এটি। চলচ্চিত্রটি গত অক্টোবর মাসে মুক্তি পেয়েছে। ‘দ্য তাজ স্টোরি’-তে বিশ্বের অন্যতম প্রেমের স্মৃতিসৌধ তাজমহলের পেছনের ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।

চলচ্চিত্রে ভ্রমণ গাইড চরিত্র বিষ্ণু দাস এমন একটি তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন, যা ইতিহাসবিদেরা ব্যাপকভাবে খণ্ডন করেছেন। তিনি বলেন, ১৭ শতকের তাজমহল কোনো মুসলিম সমাধি নয়, বরং এটি একটি হিন্দু প্রাসাদ। চলচ্চিত্রে বিষ্ণু দাস আরও বলেন, ইসলামি শাসকেরা তাজমহল দখল করে এটিকে নিজেদের ব্যবহার উপযোগী করে সাজিয়েছে।

সমালোচকেরা বলছেন, ‘দ্য তাজ স্টোরি’-এর মতো চলচ্চিত্রগুলো প্রায়ই মুসলিমদের ইতিহাসকে নিন্দিত বা মুছে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ইতিহাসকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।

সমালোচকেরা আরও বলেছেন, প্রকল্পটি ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আদর্শের সঙ্গে মিলে যায়। এ দলটির বিরুদ্ধে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতে ইসলামফোবিয়া ছড়ানো এবং দেশটিতে বসবাসকারী বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করার অভিযোগ রয়েছে।

চলচ্চিত্রটিতে বিষ্ণু দাসের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেতা পরেশ রাওয়াল। তিনি একসময় বিজেপির আইনপ্রণেতা ছিলেন। যদিও পরিচালক তুষার গোয়েল সিএনএনকে বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের অর্থায়ন বা সমর্থন নিয়ে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়নি।

চলচ্চিত্রটিতে বিষ্ণু দাসের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেতা পরেশ রাওয়াল। তিনি একসময় বিজেপির আইনপ্রণেতা ছিলেন। যদিও পরিচালক তুষার গোয়েল সিএনএনের কাছে দাবি করেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের অর্থায়ন বা সমর্থন নিয়ে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়নি।

চলচ্চিত্রটির কাহিনি ভারত সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের দীর্ঘদিনের অনুসন্ধানে পাওয়া ফলাফলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এখানে যে দাবি করা হয়েছে, তা ভারতের গণমাধ্যম ও শিক্ষাবিদদের অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে।

দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে চলচ্চিত্রটি নিয়ে একটি পর্যালোচনা প্রকাশ করেছে। সেখানে ‘দ্য তাজ স্টোরি’-কে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সংকলন’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

তাজমহল.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: চলচ চ ত র ত জমহল র কর ছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

ভারতে ইতিহাস মুছে ফেলার রাজনীতি: এবার টার্গেট তাজমহল

মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী নিয়ে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি ১২০৪ সালে লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে বাংলা জয় করেন। স্কুলে আমার পাশে বসত আমার বন্ধু নারায়ণ। আমার মনে আছে ইতিহাস শিক্ষক এই বিষয়টা যখন পড়াচ্ছিলেন, নারায়ণ খুব মন খারাপ করেছিল।

ইতিহাসের ক্লাসে আমাদের আরেক দিন পড়ানো হলো পলাশীর যুদ্ধ। নবাব সিরাজউদ্দৌলা তাঁর বিরাট বাহিনী নিয়েও হেরে গেলেন রবার্ট ক্লাইভের অল্প কয়জন সৈন্যের কাছে, অস্তমিত হলো বাংলার স্বধীনতা। এবার আমি ও নারায়ণ দুজনেই ক্লাসে খুব মন খারাপ করলাম।

ক্লাস থেকে বের হয়ে আবার আমরা স্বাভাবিকভাবে খেলাধুলা করলাম। কী আর আমরা করতে পারতাম? নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে তো আর ফিরিয়ে আনা যেত না!

ইতিহাসের এসব দুঃখবোধ সবার থাকবে, যার যেমন আবেগ। কিন্তু ইতিহাসের ঘড়ি ও ঘটনা তো পাল্টানো যাবে না, সবাইকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে হয়। পুরোনো ইতিহাসকে টেনে এনে নিজের মনে ও অন্যদের মনে জ্বালা সৃষ্টি করা কোনো কাজের কাজ নয়। আর সমাজে প্রতিহিংসা সৃষ্টি করা তো আরও জঘন্য কাজ।

ঠিক এই জিনিসটাই হচ্ছে আজকের ভারতে। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন নিয়ে কিছু লোক এমনিতেই অন্তর্জ্বালায় ভুগছেন, নরেন্দ্র মোদির উত্থানের পর তাঁরা ক্রমান্বয়ে প্রতিহিংসার বারুদ ছড়াচ্ছেন। এই প্রতিহিংসা ভারতের হিন্দু উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে মিশে ধ্বংসাত্মক আকার ধারণ করছে। ইতিহাসের প্রতিহিংসার প্রথম বড় বলি ছিল অযোধ্যার বাবরি মসজিদ, যেটাকে ভেঙে গড়া হলো রামমন্দির।

ভারতের অসাম্প্রদায়িক ও উদারপন্থী জনগণ অবশ্য সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কার্যক্রমকে নিন্দা জানিয়ে আসছে। এমনকি গত সাধারণ নির্বাচনে রামমন্দির এলাকার সংখ্যাগুরু হিন্দু জনগণ ভোট দিয়ে বিজেপির লোকসভা প্রার্থীকে হারিয়ে জানান দেন—তারা এসব উগ্রতার বিরুদ্ধে।

লাভ হতে পারে ভারতীয় ডানপন্থী রাজনীতিবিদদের এবং মোদির দল বিজেপির। তারা আশা করবে তাদের ভোটব্যাংকে যোগ হবে আরও অনেক বেশি হিন্দু ভোট। সংখ্যালঘুদের অপদস্থ করে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ভোট বাড়ানোই এসব প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মূল উদ্দেশ্য। তবে হিতে বিপরীতও হতে পারে, যেমন করে মোদির দল গত নির্বাচনে হারিয়েছিল রামমন্দির এলাকার লোকসভা আসনটি।

তাই বলে কি উগ্রবাদীদের দমানো যায়? তাঁরা মুসলমান বিদ্বেষ ছড়াবার জন্য নতুন নতুন কৌশল বের করা শুরু করলেন।

এইসব ‘সংশোধনবাদী ইতিহাসবিদেরা’, কেউ কেউ ‘স্থপতিবিদ’ সেজে মোগল স্থাপত্যের সমালোচনা করছেন। আবার কেউবা ‘প্রত্নতাত্ত্বিক’ সেজে কোন মসজিদের নিচে কয়টা মন্দির আছে এবং তাজমহল কোন মন্দির দখল করে গড়া হয়েছে, এসব নিয়ে ‘ইতিহাস’ গড়ছেন। এই উগ্রবাদীরা রাজনৈতিক কারণে ইতিহাসকে টেনেহিঁচড়ে অপ-ইতিহাস তৈরি করে জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন এবং সমাজে ধর্মীয় বিভাজন ছড়াচ্ছেন।

তাঁরা এসব অপ-ইতিহাস প্রচার করতে বিভিন্ন উপায় বের করছেন এবং আরও বেশি লোককে ক্রুদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে এই ইতিহাসের বিকৃতি আরও বড় আকারে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য দক্ষিণপন্থী চিত্র প্রযোজক-পরিচালক ও সিনেমাকর্মীদের একটা গ্রুপ ইতিহাসকে বিকৃত করে নতুন নতুন চলচ্চিত্র তৈরি করছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন মিঠুন চক্রবর্তী, অনুপম খের ও পরেশ রাওয়ালের মতো নামকরা অভিনেতারা।

এবার কল্পকাহিনির ভিত্তিতে সিনেমা বানানো হয়েছে তাজমহলকে নিয়ে, নাম—‘দ্য তাজ স্টোরি’।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভারতে ইতিহাস মুছে ফেলার রাজনীতি: এবার টার্গেট তাজমহল