সমতার স্বপ্নদ্রষ্টা বেগম রোকেয়াকে স্মরণে রংপুরে নানা আয়োজন
Published: 9th, December 2025 GMT
সমতার স্বপ্নদ্রষ্টা ও নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ১৪৪তম জন্ম ও ৯২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। মর্যাদার সঙ্গে দেশজুড়ে আজ পালিত হচ্ছে রোকেয়া দিবস। দিনটি স্মরণে রংপুরের মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দে তাঁর জন্মভিটায় শ্রদ্ধা নিবেদন, আলোচনা সভাসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা বন্ধে ঐক্যবদ্ধ হই, ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করি’।
মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) সকালে ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে চারজনের হাতে রোকেয়া পদক তুলে দেওয়া হবে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
এ বছর পদক পেতে যাচ্ছেন- নারীশিক্ষা শ্রেণিতে (গবেষণা) রুভানা রাকিব, নারী অধিকার শ্রেণিতে (শ্রম অধিকার) কল্পনা আক্তার, মানবাধিকার শ্রেণিতে নাবিলা ইদ্রিস ও নারী জাগরণ শ্রেণিতে (ক্রীড়া) ঋতুপর্ণা চাকমা। নারীশিক্ষা, নারী অধিকার, মানবাধিকার ও নারী জাগরণে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাদের এই পদক দেওয়া হবে।
পদক প্রদান ও আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ।
রোকেয়ার আদর্শ অনুসরণে নারী অধিকার ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদানের জন্য যারা পদক পেয়েছেন তাদের অভিনন্দন জানান প্রধান উপদেষ্টা।
ঊনবিংশ শতাব্দীর খ্যাতিমান বাঙালি সাহিত্যিক ও এই সমাজ সংস্কারকের জন্ম রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার অর্ন্তগত পায়রাবন্দ গ্রামে। তার প্রকৃত নাম ‘রোকেয়া খাতুন’।
১৮৮০ সালের আজকের এই দিনে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার। তাঁর মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। রোকেয়ার দুই বোন করিমুননেসা ও হুমায়রা, আর তিন ভাই যাদের একজন শৈশবে মারা যায়। পরিবারের সবার অগোচরে বড় ভাইয়ের কাছে উর্দু, বাংলা, আরবি ও ফারসি পড়া ও লেখা শেখেন তিনি।
১৮৯৮ সালে ১৮ বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয় ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে। বিয়ের পর তিনি ‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন’ নামে পরিচিত হন। তাঁর স্বামী মুক্তমনের মানুষ ছিলেন, রোকেয়াকে তিনি লেখালেখি করতে উৎসাহ দেন এবং একটি স্কুল তৈরির জন্য অর্থ আলাদা করে রাখেন।
১৯০২ সালে পিপাসা নামে একটি বাংলা গল্প লিখে সাহিত্যজগতে তার অবদান রাখা শুরু হয়। স্কুল পরিচালনা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রোকেয়া নিজেকে সাংগঠনিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত রাখেন। ১৯১৬ সালে তিনি মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন সভায় তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া মৃত্যুবরণ করেন। সেসময় তিনি ‘নারীর অধিকার’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখছিলেন।
তার স্বপ্ন ছিল সমাজে নারী-পুরুষ সমান মর্যাদা আর অধিকার নিয়ে বাঁচবে। সেই স্বপ্নের কথাই তিনি লিখে গেছেন তার গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধগুলোতে। নারীশিক্ষার প্রসারে কাজ করে গেছেন আমৃত্যু।
২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জরিপে ষষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছিলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তার উল্লেখযোগ্য রচনা হলো, মতিচূর, সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী।
এদিকে, আজ সকালে রংপুরের মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দে রোকেয়া সাখাওয়াতের জন্মভিটার বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, দুপুরে আলোচনা সভা এবং বিকেলে শিশু কিশোরদের চিত্রাঙ্কন, সংগীত ও নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হবে।
এছাড়া, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে দিনব্যাপী কর্মসূচিতে রয়েছে র্যালি, আলোচনা সভা, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর শওকাত আলীর সভাপতিত্বে আলোচনা সভা ও প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন করবেন কবি আব্দুল হাই শিকদার।
রোকেয়া দিবস উপলক্ষে রংপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে নারী সংগঠনগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও সংগঠন থেকে নানান কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। একই সাথে তার জন্মভিটাতে আয়োজন করা হয়েছে তিন দিনব্যাপী মেলা।
ঢাকা/আমিরুল/ইভা
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর অন ষ ঠ ন ব গম র ক র বন দ র জন ম
এছাড়াও পড়ুন:
অন্তঃসত্ত্বার আস্থার নাম হোসনেয়ারা
কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার চন্দ্রশেখরদী গ্রামে থাকেন হোসনেয়ারা বেগম। ১৯৯০ সালে তিনি অন্তঃসত্ত্বা নারীদের স্বাভাবিক প্রসব করানোর বিষয়ে সরকারি প্রশিক্ষণ শুরু করেন। টানা ৩৬ মাস চলে সেই প্রশিক্ষণ। তখন থেকে উপজেলার নানা গ্রামে গিয়ে কাজ করেন তিনি।
৩৫ বছর ধরে হোসনেয়ারা বেগম বিনা মূল্যে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের স্বাভাবিক প্রসব করান। এই কাজের উৎসাহ পেয়েছিলেন তাঁর শাশুড়ি জয়বাহার আক্তারের কাছ থেকে। তিনি বিনা মূল্যে প্রসব করানোর কাজ করতেন। মা ও নবজাতকের হাসি দেখে আনন্দ পান, তাই কাজটি করে যাচ্ছেন বলে জানালেন হোসনেয়ারা।
বিপদের বন্ধু হোসনেয়ারা
২০০২ সালের আগস্ট মাসের কথা। এক রাতে দাউদকান্দির এক অন্তঃসত্ত্বা রহিমা আক্তারের প্রসবব্যথা ওঠে। হাসপাতালে নেওয়ার পথে দুর্ঘটনায় তাঁকে বহন করা নৌকার সামনের অংশ ভেঙে যায়। ওই অবস্থায় তাঁকে বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। খবর দেওয়া হয় হোসনেয়ারা বেগমকে।
খবর পেয়ে হোসনেয়ারা অন্তঃসত্ত্বা রহিমা বেগমের বাড়িতে যান। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যমজ সন্তান প্রসব করান। তাদের শারীরিক অবস্থা নাজুক ছিল। নবজাতকদের মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করেন। তাদের নাম রাখা হয় সালমা আক্তার ও আমেনা আক্তার। জন্মের ছয় মাস পর আমেনার মৃত্যু হয়। আর সালমা বর্তমানে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরি করছেন।
সেই ঘটনা গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। এর পর থেকে নিজের গ্রাম ও আশাপাশের গ্রামে হোসনেয়ারার কাজ বেড়ে যায়। সবাইকে তিনি হাসিমুখে সেবা দেন। নিজের আন্তরিক চেষ্টা ও কর্মগুণে অল্প দিনেই অন্তঃসত্ত্বা নারীদের বিপদের বন্ধু হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রতি অন্তঃসত্ত্বা নারীদের আস্থা ও ভরসা বাড়তে থাকে।
৩৫ বছর ধরে হোসনেয়ারা বেগম বিনা মূল্যে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের স্বাভাবিক প্রসব করান। এই কাজের উৎসাহ পেয়েছিলেন তাঁর শাশুড়ি জয়বাহার আক্তারের কাছ থেকে। তিনি বিনা মূল্যে প্রসব করানোর কাজ করতেন।মাতৃমৃত্যুর ঘটনা নেই
হোসনেয়ারা বেগম একা কৃতিত্ব নিতে চান না। তিনি তাঁর শাশুড়ি ও পরিবারকল্যাণ সহায়িকা রৌশনারা আক্তারের কৃতিত্বের কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, টানা ৩৫ বছরে তাঁর হাতে কমপক্ষে ১১ হাজার নবজাতকের স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে। একটি মাতৃমৃত্যুর ঘটনাও ঘটেনি।
নিজে অসুস্থ থাকলেও খবর পেলে অন্তঃসত্ত্বার কাছ ছুটে যান। এমন একটি ঘটনা স্মরণ করে তিনি বলেন, ২০১৫ সালের জুলাই মাসের ঝড়বৃষ্টির রাতে তিনি অসুস্থ ছিলেন। খবর পান, তাঁর গ্রামের সুলতান মিয়ার মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা জোসনা আক্তারের ভীষণ প্রসবব্যথা। ঝড়বৃষ্টির কারণে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তখন তিনি অসুস্থ শরীরে ওই বাড়িতে যান। সুস্থভাবে প্রসব করান।
আরেকটি ঘটনা ২০১৮ সালের ঈদুল আজহার দিনের। হোসনেয়ারা সকাল থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঈদের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় খবর আসে পাশের মাইথারদিয়া গ্রামের ইউনুস মিয়ার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী শান্তি আক্তার প্রসবব্যথায় ছটফট করছেন। খবর পেয়ে তিনি সেখানে গিয়ে স্বাভাবিক প্রসব করান। সেখান থেকে পাশের পাঁচভিটা গ্রামে মনি নামের আরেক অন্তঃসত্ত্বা নারীর প্রসব করাতে যান। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেলা গড়িয়ে যায়।
হোসনেয়ারা বেগমের ভাষ্য, মানবসেবার মধ্যেই তিনি ঈদের আনন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন। স্বাস্থ্যসেবায় অবদানের জন্য তিনি এখন পর্যন্ত কোনো পুরস্কার পাননি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তিন ছেলে ও তিন মেয়ের মা। তাঁর স্বামী হযরত আলী ২০২৪ সালের ৬ মার্চ মারা যান। যত দিন সুস্থভাবে বেঁচে থাকবেন, তত দিন আনন্দ নিয়ে কাজটি করে যেতে চান তিনি।