ব্যাপক এক নৌ হামলা অপারেশন জ্যাকপট
Published: 9th, December 2025 GMT
এক ব্যান্ডের রেডিও ঘিরে প্রতীক্ষা করছিলেন শতাধিক সাহসী যুবক। কখন বেজে উঠবে সেই গান, আসবে সেই সংকেত। সবাই এক জায়গায় নয়। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও দাউদকান্দি নৌবন্দরে তাঁদের সতর্ক অবস্থান। প্রতিটি দলের কাছেই আছে রেডিও। সেই রেডিওতে আসবে অভিযান শুরুর সংকেত।
একদিকে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার প্রতীক্ষা, অন্যদিকে অনিশ্চয়তা। সামান্য গড়বড় হলেই নিশ্চিত মৃত্যু।
১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট সকালে আকাশবাণী কলকাতার গানের অনুষ্ঠানে বেজে উঠল ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান, তার বদলে চাই নে কোনো দান।’ এই গানই সংকেত। শুরু হয়ে গেল প্রস্তুতি। এরপর ১৫ আগস্ট আরেকটি গান বাজলেই পাওয়া যাবে অভিযানে নামার চূড়ান্ত সংকেত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই অভিযান ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামে খ্যাত।
১৫ আগস্ট আকাশবাণী কলকাতা ‘খ’ কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হলো সেই গান, যার অপেক্ষায় ছিল পুরো কমান্ডো দল। গানটি হলো, ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি।’ নৌ কমান্ডোরা অভিযানে নামতে শুরু করলেন। চারটি বন্দরে একই দৃশ্যের মঞ্চায়ন। মধ্যরাতের পর নৌ কমান্ডোরা গামছা দিয়ে বুকে মাইন বেঁধে নেমে গেলেন পানিতে। পায়ে ফিনস, কোমরে ছুরি। মাঝপথে শত্রুর মুখে পড়লে আত্মরক্ষার জন্য ছিল শুধু ওই ছুরি, কোনো আগ্নেয়াস্ত্র নয়। তবে গেরিলা যোদ্ধাদের সমর্থনে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন।
সেই অভিযানে কমান্ডোরা প্রায় একই সময়ে চারটি বন্দরে ২৬টি জাহাজ ডুবিয়ে দেন। যুদ্ধের ইতিহাসে এটা অনন্য নজির।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাঞ্চলকে যে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়, তার মধ্যে ১০ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল নৌ কমান্ডো। মূলত সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা, নদী ও সমুদ্রবন্দরসহ বাংলাদেশের সমগ্র জলপথ নিয়ে সেক্টরটি গঠিত হয়। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রপথে পাকিস্তানের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া ছিল নৌ কমান্ডো আক্রমণের অন্যতম উদ্দেশ্য।
অপারেশন জ্যাকপটের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান সরকারের প্রচারণা ভন্ডুল করে দেওয়া। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অবস্থা স্বাভাবিক বলে বহির্বিশ্বে প্রচারণা চালাচ্ছিল পাকিস্তান সরকার। কিন্তু নৌ কমান্ডোদের সফল অভিযানের মাধ্যমে তা মিথ্যায় পর্যবসিত হয়। বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয় এই নৌ অভিযানের খবর। মুক্তিযুদ্ধ বহির্বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি পায়।
১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে ১৪৮ জন নৌ কমান্ডোকে চারটি দলে ভাগ করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল। ১৫ আগস্ট রাত ১২টার পর শুরু হয় অপারেশন জ্যাকপট।
১৫ আগস্ট রাত ১টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম বন্দর কেঁপে ওঠে। বন্দরে এমভি হরমুজ এবং এমভি আল-আব্বাস নামে দুটি পাকিস্তানি জাহাজসহ বেশ কয়েকটি বিদেশি বার্জ ও জাহাজ ধ্বংস হয়। এমভি হরমুজে ৯ হাজার ৯১০ টন এবং এমভি আল-আব্বাসে ১০ হাজার ৪১৮ টন সামরিক সরঞ্জাম ছিল। চট্টগ্রাম বন্দর অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী।
অন্যদিকে সাবমেরিনার আহসানউল্লাহর নেতৃত্বে ৪৮ জন নৌ কমান্ডো মোংলা বন্দরে অভিযান চালান। বন্দরের ছয়টি জাহাজ মাইনের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়।
চাঁদপুর নৌবন্দর অভিযানে সাবমেরিনার বদিউল আলমের নেতৃত্বে ২০ জন নৌ কমান্ডো সফল হন। তাঁরা ১৫ আগস্ট রাতে একই সময় চাঁদপুর বন্দরে মাইন দিয়ে কয়েকটি জাহাজ ধ্বংস করেন। সেই সঙ্গে সাবমেরিনার আবদুর রহমানের নেতৃত্বে ২০ জনের কমান্ডো দল নারায়ণগঞ্জ এবং শাহজাহান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ৯ জন কমান্ডো দাউদকান্দি নদীবন্দরে সফল অভিযান পরিচালনা করেন।
পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তান নৌবাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তারা দলত্যাগ শুরু করেন। সেই বাস্তবতায় ভারতীয় নৌবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের তৎকালীন পরিচালক মিহির কুমার রায় নৌ কমান্ডো গঠনের পরিকল্পনা করেন। সেটা এপ্রিল মাসের প্রথম দিকের কথা। ফ্রান্সের তুঁল নৌবন্দর থেকে পালিয়ে আসা আটজন বাঙালি নৌসেনাকে নিউক্লিয়াস ধরে তিনি মুক্তিবাহিনীর নৌ কমান্ডো দল গঠনের চিন্তা করেন।
আট বাঙালি নৌসেনা হলেন খুলনার সন্তান চিফ পেটি অফিসার গাজী মো.
নৌ কমান্ডো বাহিনীর অন্যতম সদস্য মো. খলিলুল রহমান নৌ কমান্ডো গঠনের স্মৃতিচারণা করেছেন। নিজের মুক্তিযুদ্ধে নৌ–অভিযান বইয়ে লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই আটজন অসমসাহসী নাবিকের যুদ্ধে অংশগ্রহণ এক বিশিষ্ট ঘটনা। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ফ্রান্স থেকে ভারত পর্যন্ত যাত্রাপথের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা শুনে সত্যই শিহরিত হতে হয়।’
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পলাশীতে প্রশিক্ষণরত নৌ কমান্ডোউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স বম র ন র ১৫ আগস ট কম ন ড
এছাড়াও পড়ুন:
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বাংলাদেশ প্রীতি
আর্জেন্টিনার একজন প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী, লেখিকা ও নারীবাদী নেত্রী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের কারণে তিনি বাংলাভাষী মানুষের কাছে বিশেষভাবে আলোচিত ও সমাদৃত। বলা হয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কাব্যিক ও আত্মীক সম্পর্ক ছিলো। ওকাম্পো শুধু রবীন্দ্রনাথকেই ভালোবাসতেন তা কিন্তু নয়, না, তিনি ভালোবাসতেন বাংলা ভাষা ও বাঙালিকেও। ভিক্টোরিয়া সেই প্রমাণ রাখেন একাত্তুরে। সেই কারণেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই গুরুত্ববহ।
১৯৭১-এ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ না নিলেও তিনি ছিলেন হয়ে উঠেছিলেন একজন শুভাকাঙ্ক্ষী ও সমর্থক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ওকাম্পোর বয়স ছিল ৮১ বছর। বয়সের ভারে তিনি তখন দুর্বল, কিন্তু এরপরেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে তিনি পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেসে একটি মিছিলের আয়োজন করেছিলেন, শুধু তাই না ওকাম্পো ছিলেন মিছিলের পুরোভাগে। সেদিনের সেই মিছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছাড়াও আরও ছিলেন— হোর্হে লুইস বোর্হেস, এদুয়ার্দো সাবাতো, এদোলফো ওবোইতাসহ আরও অনেকে।
আরো পড়ুন:
আজ শত্রুমুক্ত ফেনীতে প্রথম উড়েছিল লাল সবুজের পতাকা
বাংলাদেশের এক পাগলাটে বন্ধু জঁ ক্যা
একাত্তরের ১১ জুন আর্জেন্টাইন লেখক, বুদ্ধিজীবী, মানবতাবাদী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের শরণার্থীদের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুইস মারিয়া ডি পাবলো পারডোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে একটি স্মারকলিপি দেন। সেই দাবিনামায় যারা স্বাক্ষর করেছিলেন, তাদের মধ্যে প্রথমেই ছিল ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর নাম।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি গণহত্যার প্রতিবাদে আর্জেন্টাইন সরকারের কাছে তিনি আবেদন জানান এবং বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখেন।
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো শুধু প্রতিবাদ করেই থেমে থাকেননি, বরং নিজের প্রভাব খাটিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরিতে সহায়তা করেন। তার সম্পাদিত বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা ‘সুর’-এর মাধ্যমে তিনি বিশ্ব সাহিত্য অঙ্গনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার খবর তুলে ধরেন, যা ছিল তার সমর্থনেরই একটি প্রকাশ।
ঢাকা/লিপি