আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে জাহান্নামবাসীদের খাদ্য হিসেবে এক ভয়ংকর গাছের উল্লেখ করেছেন, যার নাম জাক্কুম।

এর বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, অর্থাৎ ‘এটা উত্তম আতিথেয়তা, নাকি জাক্কুমগাছ? নিশ্চয় আমি উহাকে জালেমদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ করেছি। নিশ্চয় তা এমন এক গাছ, যা প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের তলদেশ থেকে উৎপন্ন হয়। এর ফল যেন শয়তানের মাথা।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত: ৬২-৬৫)

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেখানে দাবি করা হচ্ছে, ভয়ংকর চেহারার এক গাছের ফলই হলো কোরআনে বর্ণিত সেই জাক্কুম গাছ। এই ফলের আকৃতি মানুষের মাথার খুলির মতো হওয়ায় অনেকে একে শয়তানের মাথার সঙ্গে তুলনা করে প্রচার করছেন।

এই প্রচারণার ফলে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে—সত্যিই কি এটি সেই জাক্কুমগাছ, আর কেনই বা এর ফলকে ‘শয়তানের মাথা’র মতো বলা হলো?

জাক্কুম গাছের বাস্তবতা: দুনিয়া নাকি আখেরাত

কোরআনে বর্ণিত এই জাক্কুম গাছকে নিয়ে ছবি প্রচার হওয়ার পর অনেকেই এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ইসলামি পণ্ডিতদের মতে, এই গাছের ছবি সত্য হলেও, একে আখেরাতের জাক্কুম মনে করার কোনো কারণ নেই।

সৌদি আরবের ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সাউদ ইসলামিক ইউনিভার্সিটির শরিয়াহ অনুষদের সাবেক ডিন ড.

সাউদ আল-ফুনায়সান স্পষ্ট করে বলেন, “জাক্কুমগাছের যে ছবিগুলো সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে, তা সম্ভবত কৃত্রিমভাবে তৈরি করা বা ফটোশপ করা।

“এমনকি যদি ধরেও নেওয়া হয় যে এই ধরনের গাছ পৃথিবীতে সত্যি সত্যিই আছে, তবু অবাক হওয়ার কিছু নেই। কেননা আল্লাহ সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দুনিয়া ও আখেরাতের জিনিসের মধ্যে নামের মিল থাকা অস্বাভাবিক নয়।

পৃথিবীতে যেমন ‘দুধ’, ‘মধু’, ‘নদী’, ‘গাছপালা’ ইত্যাদি আছে, আখেরাতেও জান্নাতে একই নামের জিনিস থাকবে (যেমন জান্নাতের নহর), কিন্তু স্বাদ ও প্রকৃত স্বরূপের দিক দিয়ে দুটোর মধ্যে কোনো মিল থাকবে না। এটি কেবল নামের সাদৃশ্য। আখেরাতের জান্নাত বা জাহান্নামের বাস্তব রূপ মানুষের পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব নয়।” (ইসলাম অনলাইন ডট নেট)

আরও পড়ুনগাছ লাগানো সদকায়ে জারিয়া০৬ নভেম্বর ২০২০সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ‘জাক্কুম’ গাছের ছবি

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শয়ত ন র ম থ

এছাড়াও পড়ুন:

গাজীপুরের মহাসড়কে নরকের সাজা কমানোর কেউ নেই?

ময়মনসিংহ গিয়েছিলাম। প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি প্রথম আলো কৃতী শিক্ষার্থী উৎসবে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় যারা জিপিএ-৫ পেয়েছে, তাদের সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে বিভাগীয় শহরগুলোতে।

৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ছিল ময়মনসিংহ পর্ব। নগরের টাউন হলে কৃতী শিক্ষার্থীদের সমাবেশে যোগ দিয়ে অনেক আশা আর আনন্দ নিয়েই ফিরেছি।

শিক্ষার্থীদের চোখেমুখে বুদ্ধির দীপ্তি, কথাবার্তায় মেধার ঝলক, পদক্ষেপে আত্মবিশ্বাসের ছাপ।

হ্যাঁ, ওরা এখন ব্যস্ত আসন্ন ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে। কেউ ডাক্তার হতে চায়, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ শিক্ষক, কেউ পড়তে চায় বিজনেস, কেউবা বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরিতে যেতে চায়। বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করার স্বপ্ন দেখে অনেকে।

এই ছেলেমেয়েরা প্রকৃতই মেধাবী, কারণ মাধ্যমিকের চেয়ে উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম, আর এবার তো বেশ কম। ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে ক্রিমগুলোকেই পাওয়া গেছে।

এই ধরনের সমাবেশে তিনটা গল্প বলেই থাকি।

১.

এ পি জে আবদুল কালামের (১৯৩১-২০২৫) বিমানবাহিনীর পাইলট হতে চাওয়া আর ব্যর্থতার গল্প। তিনি বিমানবাহিনীর পাইলট হওয়ার পরীক্ষায় নবম স্থান অধিকার করেন। নেওয়া হবে আটজন। তিনি মন খারাপ করে নদীর ধারে বসে ছিলেন।

সেই সময় একজন সাধু তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার মন কেন খারাপ?’ তিনি বলেন, ‘আমার স্বপ্ন ভেঙে গেছে, আমি বিমানবাহিনীতে যোগ দিতে পারছি না।’

সাধু বলেন, ‘এই কথার একটাই মানে, নিয়তি তোমার জন্য বিমানবাহিনীতে যোগ দেওয়া নির্ধারণ করে রাখেনি। তুমি ওঠো, অন্বেষণ করো। নিয়তি তোমার জন্য কী ঠিক করে রেখেছে।’

এ পি জে আবদুল কালাম বাড়ি ফিরে গেলেন, পদার্থবিজ্ঞান পড়লেন, ভারতের নামকরা স্যাটেলাইট বিজ্ঞানী হলেন এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেন। কাজেই ডাক্তার হতেই হবে, ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে, এই ধরনের ধনুর্ভঙ্গ পণ করে রাখার দরকার নেই।

২.

আমাদের এফ আর খানকে (১৯২৯-১৯৮২) বলা হয় আইনস্টাইন অব স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং। শিকাগোতে সবচেয়ে উঁচু ভবনটা ছিল তাঁর ডিজাইন করা, সিয়ার্স টাওয়ার, যেটি এখন উইলিস টাওয়ার। এফ আর খানের একটা কথা সেই ভবনের নিচে এফ আর খান লেনে খোদিত ছিল।

কথাটা হলো, একজন প্রযুক্তিবিদের আপন প্রযুক্তিতে হারিয়ে যাওয়া উচিত নয়। তাকে অবশ্যই জীবনকে উপভোগ করতে জানতে হবে। আর জীবন হলো শিল্প, সংগীত, নাটক আর সবচেয়ে বড় কথা জীবন হলো মানুষ।

৩.

বিল গেটস বলেছেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার ছিল অনেক স্বপ্ন। এই সব স্বপ্ন আমি পেয়েছি বই থেকে। তোমরা যদি আমার ঘরে যাও, দেখবে আমার সঙ্গে আছে বই, আমি যখন অফিসে থাকি, আমার সঙ্গে থাকে বই, আমি যখন গাড়িতে থাকি, আমার সঙ্গে থাকে বই, আমি প্লেনে চড়ি যখন, আমার সঙ্গে থাকে বই।’

দুই.

ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের দূরত্ব কমবেশি ১২০ কিলোমিটার। কেউবা বলে ১২৫ কিলোমিটার। ৭৮ মাইল।

এই পথ, হাইওয়ে বা মহাসড়কে দুই ঘণ্টার বেশি লাগা উচিত নয়। কিন্তু আসার সময় বিকেল পৌনে চারটায় গাড়িতে উঠে ঢাকায় পৌঁছালাম রাত সোয়া নয়টায়। ১২৫ কিলোমিটার গাড়িতে আসতে সাড়ে ৫ ঘণ্টা লাগবে কেন?

হাইওয়ে বা মহাসড়ক হাইওয়ে নয়। এতে অনেক ধীরগতির যানও চলে। আমাদের দেশে সব মহাসড়কের পাশেই হাট-বাজার-গঞ্জ গড়ে ওঠে।

ওই সব এলাকায় এমনিতেই গাড়ি ধীর হয়ে যায়। তারওপর বাসগুলো রাস্তায় দাঁড়িয়েই যাত্রী ওঠানো-নামানোর কাজ সারে।

হাটবাজার, বন্দর-গঞ্জ ধরনের এলাকায় স্থানীয় যানবাহনগুলোও রাস্তা দখল করে রাখে। লোকজন রাস্তা পার হয়। রিকশা রাস্তায় ভিড় করে।

উন্নত দেশে হাইওয়েতে মানুষ চলবে, রাস্তা পার হবে, এটা অকল্পনীয়। আমাদের দেশে যেমনটা আছে পদ্মা সেতুমুখী হাইওয়েতে।

এর মধ্যে সমস্যা হলো ভাঙাচোরা রাস্তা। ভালুকার কাছে রাস্তায় নির্মাণকাজ চলছে। সেখানে একদিকে এক লেন খোলা। ওইখানে যানজট লেগে আছে।

সেটা এড়াতে উল্টোদিকে গাড়ি চলেছে। ফলে ওই জায়গায় যানজট লেগেই থাকে।

ওই একটা জায়গায় যানজটে পড়ে মনে হলো, এই দেশের মহাসড়কগুলোর কোনো অভিভাবক নেই। রাস্তায় কংক্রিট বসানো হচ্ছে, এটা তো রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে জেনেশুনেই করছে। তারা দুপাশে সুরকি ফেলে বিকল্প লেনগুলো আগে চালু করে নিল না কেন?

এইখানে অনেক ছোট-বড় যানবাহন উল্টোদিকে চলতে গিয়ে যানজট বাধায়, সেটাও তো জানা সবার। তাহলে তা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ট্রাফিক পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, স্থানীয় পুলিশ, দরকার পড়লে আনসার, দরকার পড়লে স্থানীয়ভাবে নিয়োগকৃত কমিউনিটি পুলিশ রাখা হয় না কেন?

আরও পড়ুনবিআরটি ট্র্যাজেডি: জীবনের ঘণ্টাধ্বনি কি শুনতে পাও২৫ আগস্ট ২০২২তিন.

আরেকটা অমার্জনীয় অপরাধ আমরা করেছি ঢাকা ম্যাস র‍্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পের নামে। ২০১৩ সাল থেকে কাজ শুরু হয়েছে।

হাজার হাজার কোটি টাকা এর পেছনে ঢালা হয়েছে। নির্মাণের সময় দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।

কিন্তু যেই পাপের ক্ষমা নেই, তা হলো গাজীপুর, ময়মনসিংহগামী কোটি কোটি মানুষকে বছরের পর বছর ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তেল পুড়েছে। কার্বন দূষণ ঘটেছে। নির্মাণকাজে দূষণ হয়েছে, বাতাস বালুকণায় থিকথিকে। মানুষের আকাশ ঢাকা পড়েছে।

বাংলাদেশের মানুষের ধৈর্যশক্তি অসীম, এতটা বছর ধরে এটা সহ্য করে এসেছে। এইটা একটা ত্রুটিপূর্ণ নকশা, এটা এখন সবাই জানে। বাসের দরজা ডান পাশে লাগবে।

এক লেনের পথ, একটা বাস নষ্ট হলে কোটি কোটি টাকার প্রকল্পের সুফল কুফল দেবে।
এই নকশা যাঁরা করেছেন, এই প্রকল্প যাঁরা অনুমোদন করেছেন, তাঁদের বিচার হওয়া উচিত। এবং প্রতীকী হলেও দণ্ড দেওয়া উচিত।

বছরের পর বছর কোটি কোটি মানুষের কোটি কোটি শ্রমঘণ্টা নষ্ট করার যে দাম, তা দিয়ে অন্তত এক বছরের জাতীয় বাজেটের টাকা উঠে আসত বলে মনে করি।

এই বিষয়ে বাংলাদেশের স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গুরু শামীমুজ্জামান বসুনিয়ার মত তুলে ধরি।

তিনি অভিজ্ঞতার আলো শীর্ষক সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেছেন, প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে, ‘আমি তো গাজীপুরে যাই। গাজীপুরে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রিন্টিং প্রেস, সেটার একটা কাজ আমাদের দিয়ে দিয়েছে। আমি যাই তো সেখানে। দেখি তো কী কষ্ট! এটা (বিআরটি) আমার একেবারে চোখের কাঁটা! ইট শুড বি ইমিডিয়েটলি স্টপড। ইট শুড বি ইমিডিয়েটলি ব্রোকেন আউট। যা হওয়ার হয়েছে। আমরা তো বহু জায়গায় বহু টাকাপয়সা (নষ্ট) করছি।’ (প্রথম আলো ডটকম, ১০ অক্টোবর ২০২৫)

২০২২ সালে প্রথম আলোয় আনোয়ার হোসেন প্রতিবেদন লিখেছিলেন: ‘বিআরটি: একটি “মহাদুর্ভোগের” প্রকল্প।’

কর্তৃপক্ষ হতাশা প্রকাশ করেই দায় সারছে। প্রকল্পের পদে পদে অব্যবস্থাপনা। কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

২০২২ থেকে ২০২৫। পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। লেনগুলো কোনো চিহ্ন ও সিদ্ধান্ত ছাড়া খুলে দেওয়া হয়েছে অথবা বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

দুই পাশ থেকেই বাস, ট্রাক, গাড়ি, মোটরবাইক ছুটে আসে। কোনটা ওয়ান ওয়ে কোনটা টু ওয়ে কোনো চিহ্ন নেই, মা-বাপ নেই, সিদ্ধান্তও নেই।

যে বাস কেনার কথা, এই সরকার আর তাতে বরাদ্দ দেবে না বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে যা বানানো হয়েছে, তার একটা আশু সমাধান প্রস্তাব করি। ওই বিশেষায়িত লেনের মাঝখান বরাবর ডিভাইডার দিন।

আর দুই পাশে যে ডিভাইডারগুলো এই লেন দুটোকে আলাদা করেছে, সেগুলো ভেঙে দিন। মানে পুরো সুবিধাটা সব যানবাহনের জন্য উন্মুক্ত করে দিন।

পুরো রাস্তা বা ফ্লাইওভার দুই ভাগে ভাগ করা থাকবে। গাড়িগুলো বাধাহীনভাবে প্রবাহিত হতে থাকবে।

তারপর নতুন সরকার এসে যদি বিশেষায়িত বাস কিনে ওই প্রকল্প চালু করতে চায়, করবে। যত দিন তা না হচ্ছে, তত দিনের কোটি শ্রমঘণ্টা অপচয় তো কমবে। মানুষের দুর্ভোগ কমবে।

এখন ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যাতায়াত করলে মনে হয় মহাসড়কে কোনো সরকার নেই। কর্তৃপক্ষ নেই। মা-বাপ নেই। আছে যে, সেটা দেখান।

আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ