Risingbd:
2025-12-09@09:18:43 GMT

রোকেয়ার নারী ও সমাজ-ভাবনা

Published: 9th, December 2025 GMT

রোকেয়ার নারী ও সমাজ-ভাবনা

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত। যিনি প্রথাবদ্ধ সমাজে নারীর জন্য কেবল স্বপ্নই নন; মুক্তির আলোকবর্তিকা। কেবলই আশাহত বস্তু নন; তীব্র ভরসার আশ্রয় ভূমি। যিনি তাঁর কর্মে বিশ শতকের নারী সমাজের উন্নতির জন্য নিজের মেধা, মনন ও সামর্থকে উৎসর্গ করে গিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নারীদের জন্য স্কুল ও বিভিন্ন সভা-সমিতি। বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়াসে কলম ধরেছিলেন সাহিত্য রচনায়। তাঁর সাহিত্যজুড়ে আছে নারী মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। যা এখনো বর্তমান বাংলাদেশের বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সময় ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনামল বিদ্যমান ছিল। সদ্য বাংলার সামন্তবাদের ভগ্নাবশেষের শেষ স্তরে দাঁড়িয়ে তিনি নারী মুক্তির আওয়াজ তুলেছিলেন। বাংলার শাসনকাঠামো থেকে আরম্ভ করে রাজস্ব, ভূমি, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও উৎপাদন প্রণালীর সর্বত্র যখন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ প্রভাব প্রতিপত্তি প্রচন্ড দাপটের সঙ্গে অনুসৃত হতে থাকল; তখনও বাংলার মুসলিম সমাজে নারীর অবস্থান ছিল পিছিয়ে। অন্যদিকে সমাজ ও হিন্দু নারীরা রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ সমাজসংস্কারকের বদৌলতে মুসলমান নারীদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন। কৌলিণ্য, সতীদাহ, বিধবাবিবাহ নানান প্রথা থেকে বের হয়ে হিন্দু নারী-পুরুষ যখন সবক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান তৈরি করছিলেন তখন আমাদের মুসলিম সমাজ সামাজিক গোঁড়ামি, কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রথায় ছিল বিপর্যস্ত। রোকেয়া সমকাল সমাজমনস্ক হিসেবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, মুসলিম সমাজের উন্নতি সাধন করতে হলে নারী-পুরুষ সমকক্ষ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে মুসলিম নারীদের তৎকালীন প্রথাবদ্ধ সমাজ কাঠামো ও পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য থেকে তাদের বের করা ছিল জরুরি। সমাজ সচেতন রোকেয়া তাই মুসলিম নারীদের জন্য ভাগলপুরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্কুল। গৃহস্থ নারীদের জন্য নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম মুসলিম নারী সমিতি। 

আরো পড়ুন:

ব্রাকসু নির্বাচনের কারণে শীতকালীন ছুটি পেছাল

ব্রাকসুর তফসিল প্রত্যাখান শিক্ষার্থীদের

রোকেয়ার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে রংপুরের মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দে। গ্রামের মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম হওয়ায় তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল উদার। বড় ভাই ও বোনের সাহচর্যে বাংলা ভাষা,  ইংরেজি শিক্ষা এবং বিবাহ পরবর্তী স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের আনুকূল্যে জ্ঞান অর্জন তাঁর চিন্তার পথ আরোও বিকশিত হতে সাহায্য করেছিল। কিশোরী রোকেয়া তাঁর রংপুরের জীবন অভিজ্ঞতায় ও আধুনিক জ্ঞানের আলোয় নিজের মধ্যে আরও অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, ‘ইসলামে নারী শিক্ষার প্রতি জোর দেওয়া হলেও আমাদের বাঙালি মুসলিম সমাজে নারী শিক্ষাকে অবহেলা করা হয়। পুরুষদের হাতে তৈরি নানা প্রথায় আবদ্ধ করা হয় নারীদের। ইসলামের ইতিহাসে যেখানে হযরত খাদিজা (রা.

) ছিলেন সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী সেখানে আমাদের নারীদের ঘর থেকে বের হওয়ার অনুমতি ছিল না। বরং পদে পদে সৃষ্ট বাঁধায় নারীরা হতো বিপর্যস্ত। অবজ্ঞা, অবহেলা আর নিদারুণ নিষ্ঠুর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনে তারা নির্যাতিত। ঘরকুনো থাকতে থাকতে তারা নিজেরাও মানসিকভাবে দেউলিয়াপনার শিকার। মনন ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ তাদের একেবারেই নেই। দীর্ঘদিন এ অচলাবস্থায় থাকতে থাকতে তাদের সৃজনশীল সত্তা অলস হয়ে পড়েছে।’

এর মূল কারণ কী? রোকেয়া এর পেছনে দায়ী করেছেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার জোরে সৃজিত আইন, প্রথাসমূহকে। যে অবরুদ্ধ প্রথা নিয়ে রোকেয়া তাঁর লেখায় বলেন ‘আমাদের আত্মা লোপ পাওয়ায় আমরাও অনুগ্রহ গ্রহণে আর সংকোচ বোধ করি না। সুতরাং আমরা আলস্যের, প্রকারান্তরে পুরুষের দাসী হইয়াছি। ক্রমশঃ আমাদের মন পর্যন্ত দাস হইয়া গিয়াছে।’১ আর সেজন্য দরকার নারীকে সমাজে পুরুষের মতো সমান মানবিক অধিকার ও গুণাবলি অর্জন করা; তাদের সমকক্ষ হওয়া, সহযোগী হিসেবে এবং সমাজ সংগঠনে নারীদের অর্ধেক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। সেজন্য নারীকে প্রথমে শিক্ষিত হতে হবে। কেননা শিক্ষিত মা-ই পারে শিক্ষিত সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণ করতে। তাই নারীকে বাদ দিয়ে, নারী মুক্তিকে অবহেলা করে সমাজের সর্বাঙ্গীন উন্নতি আদৌ সম্ভব না। রোকেয়া অন্যত্র তাঁর এক প্রবন্ধ সাহিত্য লিখেছেন:

‘আমরা এমন জড় অচেতন পদার্থ হইয়া গিয়াছি যে, তাহাদের গৃহসজ্জা বই আর কিছুই নহি। আমরা পুরুষের ন্যায় সুশিক্ষা ও অনুশীলনের সম্যক সুবিধা না পাওয়ায় পশ্চাতে পড়িয়া আছি। সমান সুবিধা পাইলে আমরাও কি শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিতে পারিতাম না?’২

অর্থাৎ বিশ শতকে রোকেয়ার এমন সমান অধিকার চাওয়া মোটেই অমূলক নয়। বরং তা বাস্তবিক, মানবিক ও সামাজিক অধিকার। কিন্তু তিনি যে সময়ে বসে এই সমান অধিকার চেয়েছিলেন সেই সময়টা ছিল অত্যন্ত প্রতিকূল। নারীর জন্য ঘরে কিংবা বাইরে সব জায়গায় ছিল বাধা। তাদের বেঁধে দেওয়া হতো প্রথায়। বিশেষ করে উনিশ শতকে বাঙালি মুসলিম সমাজে নারীর বাইরে বের হয়ে আসতে চাওয়া, পুরুষের সমান অধিকার চাওয়া ছিল দুঃসাধ্য ও দুষ্কর। এখন এই সময়ে একজন নারী যতো সহজে তার মতামত, চাওয়া-পাওয়া সমাজের সামনে তুলে ধরতে পারেন ঐ সমাজে তা কল্পনা করাও ছিল দুষ্কর। ফলে রোকেয়াই বাঙালি মুসলিম নারী সমাজে সর্বপ্রথম নারী ব্যক্তিত্ব যিনি ‘উপমহাদেশে নারী স্বাধীনতার পথ-প্রদর্শক  এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন রক্ষণশীল সময়ে আলোর প্রতীক’৩ হিসেবে আমাদের নিকট সুপ্রতিষ্ঠিত চেতনার নাম। শুধু অধিকার চেয়েই তিনি বসে থাকেননি; রোকেয়া তাঁর প্রবন্ধে নারী-পুরুষের মানসিক উন্নতিও কামনা করেছেন। যে মানসিক উন্নতির জন্য প্রয়োজন যথোপোযুক্ত শিক্ষা। মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন শিক্ষাই পারে সচেতনাবোধকে জাগ্রত করতে। মানুষকে মানবিক ও মননশীলরূপে গড়ে তুলতে। রোকেয়া তাঁর এক রচনায় লিখেছেন:

‘বলি প্রেমিক হও, ধার্ম্মিক হও বা যাই হতে চাও, তাহাতেই মানসিক উন্নতির (সবহঃধষ) প্রয়োজন। রমণীর জন্য আজ পর্যন্ত যে সব কর্তব্য নির্ধারিত আছে, তাহা সাধন করিতেও বুদ্ধির প্রয়োজন। অর্থ উপার্জনের নিমিত্ত পুরুষদের যেমন মানসিক শিক্ষা আবশ্যক, গৃহস্থালীর জন্য গৃহিণীদেরও মানসিক শিক্ষা প্রয়োজনীয়। এখন সাধনা দ্বারা সিদ্ধিলাভ করা আপনাদের কর্তব্য। যদি সুগৃহিণী হওয়া আপনাদের জীবনের উদ্দেশ্য হয়, তবে পাত্রীলোকের জন্য সুশিক্ষার আয়োজন করিবেন। আমাদের বিশ্বাস যে অবরোধের সহিত উন্নতির বেশী বিরোধ নাই। উন্নতির জন্য অবশ্য উচ্চশিক্ষা চাই।’৪ 

বস্তুত, জগত সংসারে সুগৃহিণী হবার পরও নারী অবহেলিত। গৃহে নারী যে শ্রম দেয় তার কোনো মূল্য নেই। কিংবা যে নারী চাকরিজীবী মা হিসেবে কাজ করেন; তাকে একই সাথে সংসার, অফিস, পরিবার সব জায়গায় নিজেকে বিলিয়ে দেবার পরও থাকতে হয় উপেক্ষিত। শিক্ষিত নারীর দোষকে যেভাবে সমাজ কটাক্ষ করে; সে তুলনায় অশিক্ষিত, দাসানুগ্রাহী নারীর দোষ কমই গণ্য করা হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই মূল্যবোধ ‘আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় এই মানসিক বিষয়গুলো স্বামী-স্ত্রী বা নারী-পুরুষের মধ্যে অনির্দিষ্ট সম্পর্কের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’৫ এই সম্পর্ক কেবল মুসলিম সমাজেই নয়; আমাদের ‘সামাজিক বিন্যাসে পুরুষের অবস্থান এবং হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে আপামর নারী সমাজেই’৬ পরিলক্ষিত হয়।

বিশ শতকে রোকেয়া আক্ষেপের সুরে লিখেছিলেন, ‘আমাদের শয়নকক্ষে যেমন সূর্য্যালোক প্রবেশ করে না, তদ্রুপ মনোকক্ষেও জ্ঞানের আলোক প্রবেশ করিতে পারে না। যেহেতু আমাদের উপযুক্ত স্কুল, কলেজ এক প্রকার নাই।’৭ এই না থাকার সে পরিস্থিতির খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি দরুণ নারীর মন সেভাবে বিকশিত হতে পারছে না। পূর্বে যেমন নারীকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে এখনও ঠিক তেমনি। ফলে আমাদের সমাজে নারীর স্কুল, কলেজে গমন করার অগ্রসরমান কিছু চিত্র দেখা গেলেও প্রকৃতপক্ষে বয়স আঠারো হবার আগেই ঝরে পড়ার হার বেশি। বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথা থেকে এখনো নারীকে মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। প্রতিনিয়ত নারী নির্যাতনের চিত্রের সঙ্গে যৌন নির্যাতনের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। আইন যদিও আছে কিন্তু বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের দীর্ঘসূত্রিতা অপরাধ ও অপরাধীকে আরও বেপরোয়া করে তুলছে। রোকেয়া অন্যত্র তাঁর এক রচনায় লিখেছেন যা এই সময়ের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেন:

‘‘পতঙ্গ ভীতি দূর করিবার জন্য প্রকৃত সুশিক্ষা চাই- যাহাতে মস্তিষ্ক ও মন উন্নত (নৎধরহ সরহফ পঁষঃঁৎবফ) হয়। আমরা উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত না হইলে সমাজও উন্নত হইবে না। যতদিন আমরা আধ্যাত্মিক জগতে পুরুষদের সমকক্ষ না হই, ততদিন পর্যান্ত উন্নতির আশা দুরাশা মাত্র। আমাদিগকে সকলপ্রকার জ্ঞানচর্চা করিতে হইবে। শিক্ষার অভাবে আমরা স্বাধীনতা লাভের অনুপযুক্ত হইয়াছি। অযোগ্য হইয়াছি বলিয়া স্বাধীনতা হারাইয়াছি। অদূরদর্শী পুরুষেরা ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষার জন্য এতদিন আমাদিগকে শিক্ষা হইতে বঞ্চিত রাখিতেন। এখন দূরদর্শী ভ্রাতাগণ বুঝিতে পারিয়াছেন যে ইহাতে তাঁহাদের ক্ষতি ও অবনতি হইতেছে। তাই তাঁহারা জাগিয়া উঠিতে ও উঠাইতে ব্যস্ত হইয়াছেন। আমি ইতঃপূর্বেও বলিয়াছি যে ‘নর ও নারী উভয়ে মিলিয়া একই বস্তু হয়। তাই একটিকে ছাড়িয়া অপরটি সম্পূর্ণ উন্নতি লাভ করিতে পারিবে না।’ এখনও তাহাই বলি। এবং আবশ্যক হইলে ঐ কথা শতবার বলিব।’’৮ 

অর্থাৎ রোকেয়া একদিকে যেমন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের গঠনমূলক সমালোচনা করেছেন; সেইসঙ্গে স্ত্রী বা নারী জাতিকেও সমালোচনায় নিবদ্ধ করেছেন। শুধু পুরুষ মানুষকে বা সমাজকে দোষারোপ করাও অনুচিত। কারণ কেউ যদি নিজ থেকে চেষ্টা না করে তাহলে জগতের অন্য কেউ এসে তাকে সাহায্য করবে না। নিজের উন্নতির জন্য সবার আগে নিজেকে অগ্রসর হতে হয়। আসন্ন বিপদ, ঝুঁকি সামলানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। পাশ্চাত্য সমাজে বিশেষ করে উনিশ শতকের গোঁড়ার দিকে সেই সমাজের নারীরা সবার আগে নিজেদের অধিকার আদায়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল। রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে নিজেদের দাবি-দাওয়া পেশ করে নিজেদের প্রাপ্য এবং সামাজিক অধিকার অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু পক্ষান্তরে বাঙালি মুসলিম নারী সমাজ সেই সাহস ও দাবি-দাওয়া চাইতে পারে না। উল্টো নিজেদের অধিকার প্রাপ্তিতে পুরুষের উপর নির্ভরশীলতা বাড়ায়। রোকেয়া সেই প্রসঙ্গে বলেন, ‘নারীদের চিন্তা ও বুদ্ধি বিকাশের জন্য হলেও সুশিক্ষা দেওয়া দরকার। শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকের গঁৎবাধা বই পড়া এর জন্য যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা।’

যার বদৌলতে নারীরা প্রকৃতভাবে নিজেদের অবস্থান ও পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারবে। সচেতন হতে পারবে নিজেদের অধিকার সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। নারীদের উদ্দেশ্য করে রোকেয়া তাঁর এক প্রবন্ধ রচনায় লিখেছেন: 

‘ভগিনীগণ। চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন-অগ্রসর হউন। বুক ঠুকিয়া বল মা। আমরা পশু নই; বল ভগিনী। আমরা আসবাব নই; বল কন্যে। আমরা জড়াউ অলঙ্কাররূপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বল, আমরা মানুষ। শিক্ষা বিস্তারই এইসব অত্যাচার নিবারণের একমাত্র মহৌষধ। অন্ততঃপক্ষে বালিকাদিগকে প্রাথমিক শিক্ষা দিতেই হইবে। শিক্ষা অর্থে আমি প্রকৃত সুশিক্ষার কথাই বলি; গোটা কতক পুস্তক পাঠ করিতে বা দু’ছত্র কবিতা লিখিতে পারা শিক্ষা নয়। আমি চাই সেই শিক্ষা-যাহা তাহাদিগকে নাগরিক অধিকার লাভে সক্ষম করিবে, তাহাদিগকে আদর্শ কন্যা, আদর্শ ভগিনী, আদর্শ গৃহিণী এবং আদর্শ মাতারূপে গঠিত করিবে। শিক্ষা-মানসিক এবং শারীরিক উভয়বিধ হওয়া চাই।’ 

অর্থাৎ উদ্ধৃতাংশে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন যা বলতে চেয়েছেন তা অত্যন্ত সময়োপযোগী। তিনি শিক্ষাকে কেবলই চাকরি পাওয়ার বস্তু হিসেবে দেখেননি। শিক্ষাকে মানবিক ও মানসিক বিকাশের অন্যতম কার্যকরী উপাদান হিসেবেও বিবেচনা করেছেন। কারণ আজকের আধুনিক সমাজে আমাদের শিক্ষাবিদরা বলতে আরম্ভ করেছেন, শিক্ষা যদি শুধু জ্ঞানের পরিমাপেই সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তা মানুষকে কেবল দক্ষ কর্মী তৈরি করতে পারে, কিন্তু মানবিক গুণে সমৃদ্ধ, নৈতিকতায় দৃঢ় আদর্শ মানুষ গড়ে তুলতে পারে না। তাই আজকের বাস্তব প্রেক্ষাপটে শিক্ষার সঙ্গে নৈতিকতার সমন্বয় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এই সমন্বয়ই পারে আগামী প্রজন্মকে আলোকিত ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে। 

প্রাচীন যুগে শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল কেবল জ্ঞানার্জন নয়, বরং চরিত্র গঠন। তৎকালীন গুরু-শিষ্য সম্পর্ক, মাদ্রাসা ও পাঠশালাগুলোতে শিক্ষার পাশাপাশি শিষ্টাচার, সততা, শৃঙ্খলা ও পরোপকারের মূল্যবোধ শেখানো হতো। আধুনিক যুগে এসে আমরা সেই মূল উদ্দেশ্য থেকে অনেকটাই সরে গেছি। এখন শিক্ষা অনেক ক্ষেত্রে কেবল ভালো নম্বর, চাকরি বা আর্থিক সাফল্যের প্রতিযোগিতায় সীমাবদ্ধ। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা সেই, যা মানুষকে সত্যবাদী, সহানুভূতিশীল ও নৈতিকভাবে দৃঢ় করে তোলে। মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘শিক্ষা মানে মানুষের মধ্যে সেরা গুণাবলির বিকাশ।’ অর্থাৎ শিক্ষা যদি কেবল তথ্য প্রদান করে, কিন্তু সেই তথ্য ব্যবহারের নৈতিক নির্দেশনা না দেয়, তবে তা সমাজের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। আজকের বিশ্বে যুদ্ধ, দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য এবং পরিবেশ ধ্বংস সব কিছুর মূলে কোথাও না কোথাও এই নৈতিক শিক্ষার শূন্যতাই দায়ী। 

তাছাড়া বর্তমান সমাজে নৈতিক অবক্ষয় একটি দৃশ্যমান সমস্যা। অনেক শিক্ষিত ব্যক্তি ক্ষমতা, অর্থ বা স্বার্থের প্রলোভনে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। শিক্ষার আলো থাকা সত্ত্বেও সমাজে দুর্নীতি, মিথ্যাচার, হিংসা ও নারী নির্যাতন কিংবা প্রতারণার মতো ঘটনা বেড়েই চলেছে। ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হতাশা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও মূল্যবোধের সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। যখন কোনো সমাজে নৈতিকতা হারিয়ে যায়, তখন সেখানে শিক্ষার মর্যাদা টেকে না। রোকেয়ার সেই বিশ শতকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে উদার ও নৈতিক শিক্ষার প্রতি এমন গুরুত্বারোপ তাঁর আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক এবং প্রগতিশীল চিন্তা সত্যিই বিমোহিত করে।

লেখক: উপাচার্য বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
 

ঢাকা/তারা//

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র অবস থ ন উদ দ শ য ব শ শতক কর ছ ল ম নব ক আম দ র ক প রব অর থ ৎ প রক ত কর ছ ন আদর শ হইয় ছ ব যবস অবহ ল রচন য়

এছাড়াও পড়ুন:

শরীরে লুকিয়ে রেখেছিলেন গোপন নথি

জীবন এখন শেষ বেলায়, পেছনে ফিরে তাকালে কত ছবি ভেসে আসে! কত মানুষ আর তাদের কত রকমের সংগ্রাম! আরও কত স্মৃতি বিস্মরণের অতলে হারিয়ে গেছে, তার ঠিক নেই। মুক্তিযুদ্ধের সাথে আমার আবেগ, সত্তা, অস্তিত্ব জড়িয়ে আছে। আজ আমি ৭০ উত্তীর্ণ, কোষগ্রন্ধি ক্ষয়ে এসেছে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ আমার জীবনে অতীত হয় না। 

রওশন জাহান সাথী কাছ থেকে দেখা এক মুক্তিযোদ্ধা। তিনি  উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন, সত্তরের নির্বাচিত সংসদ সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফ হোসেন। মাতা বেগম নুরুন্নাহার। রওশন জাহান সাথীর জন্ম ৮ মে ১৯৫১ সালে যশোর জেলায়।

আরো পড়ুন:

৮ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয়েছিল কুষ্টিয়ার যেসব স্থান

ঝালকাঠি পাক হানাদার মুক্ত দিবস আজ 

স্কুলজীবন থেকে পারিবারিক সূত্রে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন সাথী। যশোর জেলায় ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনে নেতৃবৃন্দের সহযোগী হিসাবে ভূমিকা রাখেন। হয়ে ওঠেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সদস্য’। সাথী মাগুরা, ঝিনাইদহ, নড়াইল, যশোর ঘুরে ঘুরে ছাত্রীদের সংগঠিত করতেন। হেনস্তার শিকার হলেও দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াননি। 

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালে রওশন জাহান সাথীদের যশোরের বাড়িতে পাক আর্মি দুইবার রেড দিয়েছিল। বাড়ি তল্লাশি করেছিল। পাক-বাহিনীর ধারণা ছিল আগরতলা মামলার বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফাইল তাদের ঘরে আছে। সত্যিই ছিল, সেই গোপন ফাইল রওশন জাহান সাথী শরীরে লুকিয়ে রেখেছিলেন। 

ওই ঘটনার পর তিনি হয়ে উঠেছিলেন আরও অদম্য। একাত্তরে আবু জাহিদ পাকিস্তান এয়ারফোর্সে কর্মরত ছিলেন।অবকাশ যাপনে এসে সাথীকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন আবু জাহিদ। তার আগেই বন্দুক চালাবার প্রথম শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন বাবা মোশাররফ হোসেনের কাছে। তাদের দোতলা বাড়ির বারান্দা থেকে নিশানা ঠিক করে চোখের পাতার সাথে মিলিয়ে ট্রিগার টেপা ও বন্দুক কাঁধে রাখার বিষয়টি কত গুরুত্বপূর্ণ তা বাবা তাকে শিখিয়েছিলেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যশোর জেলায় পাক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে, বিভিন্ন নেতা, এমপি, এমএনএ এবং ছাত্র নেতাদের বাড়িতে হামলা হয়। সাথী ঘটনা বুঝতে পেরে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। তারপরেও পাক বাহিনী রওশন আরা সাথীদের বাড়িতে হামলা চালায়। কয়েকদিন বিভিন্ন স্থানে থেকে মামার বাড়িতে আশ্রয় নেন সাথী। অন্যদিকে তার বাবা অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন স্থানীয় অনেককে নিয়ে ভারত চলে যান। মামা বাড়ি গিয়েও রেহাই পাননি সাথী। 

যশোর সেনানিবাস থেকে কর্নেল তোফায়েলের নেতৃত্বে পাঁচ-ছয়টি গাড়ি নিয়ে পাক বাহিনী বাড়িটি ঘিরে ফেলে। রওশন জাহান সাথীকে গ্রেপ্তার করে সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়, সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয় তার মা, খালাকেও। পাকসেনারা তাদের অস্ত্রের মুখে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং অশ্লীল ইঙ্গিত দেয়। উত্তাল মার্চের মিছিলের ছবি দেখিয়ে বলে, ‘তোমরা পাকিস্তান ভাঙতে চাচ্ছো, তোমাদের শাস্তি পেতে হবে।’

সাথী তখনও অদম্য। কোনো তথ্যই দেননি। বরং বলেছেন, ‘আমি মিছিল করেছি, আর কোনো তথ্য জানি না।’ কর্নেল তোফায়েল রাতে তাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে সেনা পাহারায়, বাড়িতে বন্দী করে রাখে। মামার বাড়িতে সেনা পাহারায় বন্দী থাকার চার-পাঁচদিন পরে এক সকালে সাথী দেখতে পান তাদের বাড়িতে পাহারারত পাকসেনা নেই। তিনি জানতে পারেন জরুরি বৈঠকে সব পাকসেনাকে যশোর সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই সুযোগে বাড়ি থেকে বের হয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন তারা। 

শুরুতে বেশ কিছুদিন বিভিন্ন গ্রামে পালিয়ে থাকার পর বেনাপোল সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করেন। এমনই একদিন সীমান্তের দিকে যাওয়ার পথে সেনানিবাস থেকে অগ্রসর হওয়া পাকিস্তানি সেনা ভ্যানের দূর থেকে নজর পড়ে তাদের দিকে। ব্যক্তিগত গাড়ি দেখে গুলি শুরু করে। চাচাত ভাই মাসুকুর রহমান তেজো গাড়ি চালাচ্ছিলেন। গুলি এসে লাগে গাড়ির চাকায়, গাড়িটি পাক খেয়ে গ্রান্ডট্রাঙ্ক রোডের বড় গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে যশোর চৌগাছার মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে এসে তাদের উদ্ধার করে বেনাপোল সীমান্ত পার করে দেয়।

ভারত পৌঁছে বনগাঁ কোরিডোর অফিসের মাধ্যমে শরণার্থী শিবিরে কাজ শুরু করেন সাথী। এই কাজে তিনি যুক্ত ছিলেন মুক্তি আসার আগ পর্যন্ত। 

ঢাকা/রাহাত//

সম্পর্কিত নিবন্ধ