প্রাণীরা কি আসলেই আগেভাগে ভূমিকম্প টের পায়
Published: 9th, December 2025 GMT
ভূমিকম্প এমন এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যা আঘাত হানার আগে নিশ্চিত সংকেত প্রায় কখনোই দেয় না। পৃথিবীর কোথাও এমন প্রযুক্তি এখনো তৈরি হয়নি, যা কয়েক ঘণ্টা আগে নির্ভুলভাবে জানাতে পারে—ভূমিকম্প ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, যুগ যুগ ধরে মানুষ লক্ষ করছে—ভূমিকম্পের আগে নানা প্রাণী অস্বাভাবিক আচরণ করে। কুকুরের হঠাৎ অতিরিক্ত ঘেউ ঘেউ, পাখির দিক পরিবর্তন, সাপ-ব্যাঙের গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে আসা, গরু-ছাগলের উদ্বিগ্ন আচরণ—এমন বহু নজির বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া গেছে।
তাহলে কি সত্যিই প্রাণীরা ভূমিকম্পের আগাম ইঙ্গিত পায়? বিজ্ঞান এ বিষয়ে কী বলে?
ঐতিহাসিক নজিরমানুষ বহু আগেই এই সংকেত দেখেছে। ইতিহাসে বহু নথিতে প্রাণীর আচরণ ও ভূমিকম্পের সম্পর্ক উল্লেখ আছে। খ্রিষ্টাব্দ প্রথম শতকের রোমান লেখায় ভূমিকম্পের আগে প্রাণীদের আচরণ বদলে যাওয়ার বর্ণনা রয়েছে। প্রাচীন চীনা ঐতিহাসিক দলিলেও উল্লেখ আছে—বড় ভূমিকম্পের আগে সাপ ও ইঁদুর হঠাৎ গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে আসে। আধুনিক কালের সবচেয়ে আলোচিত উদাহরণ ১৯৭৫ সালের চীনের হাইচেং ভূমিকম্প। মূল ভূমিকম্পের কয়েক ঘণ্টা আগে বিভিন্ন প্রাণী অস্বাভাবিক আচরণ দেখায় এবং সে অনুযায়ী মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। ফলে প্রাণহানি কম হয়। যদিও বিজ্ঞানীরা এটিকে ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করেন।
বিজ্ঞান অনুযায়ী প্রাণীদের কি বিশেষ অনুভূতি থাকে১.
২. বাতাস ও মাটির বৈদ্যুতিক পরিবর্তন: ভূমিকম্পের আগে বাতাসে আধানযুক্ত কণার পরিমাণ বাড়ে এবং মাটির চৌম্বকক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটে। অনেক প্রাণীর দেহ এসব পরিবর্তনের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল।
৩. ভূগর্ভস্থ রাসায়নিক পরিবর্তন: ভূমিকম্পের আগে ভূগর্ভ থেকে রেডনসহ কিছু গ্যাস নিঃসৃত হতে পারে। ব্যাঙ, মাছ, কাঁকড়া—এ ধরনের প্রাণী পানির রাসায়নিক পরিবর্তন দ্রুত অনুভব করে প্রতিক্রিয়া দেখায়।
প্রাণীর আচরণ নিঃসন্দেহে একটি মূল্যবান প্রাকৃতিক ইঙ্গিত। তবে এটিকে কখনোই নির্ভুল ভূমিকম্প পূর্বাভাস ধরা যায় না। তবু জাপানের অভিজ্ঞতা অনুসরণ করে গবেষণা, ডেটা সংগ্রহ, সেন্সর ব্যবহার এবং মানুষ-খামারি-গবেষকদের যৌথ অংশগ্রহণ—এসব শুরু করতে পারলে বাংলাদেশে প্রাথমিক সতর্কতার একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।আধুনিক গবেষণা: প্রাণীদের আচরণ সত্যিই বদলায়ইউরোপের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভূমিকম্পের ৪ থেকে ২০ ঘণ্টা আগে গরু, ভেড়া ও কুকুরের আচরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। তারা হঠাৎ অস্থির হয়ে পড়ে, চলাফেরার গতি বেড়ে যায়, খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস বদলে যায়। বিশ্বখ্যাত ভূকম্প–গবেষকেরা মনে করেন, প্রাণীরা ভূমিকম্পের আগে পরিবেশে যে সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটে, তা মানুষ অপেক্ষা অনেক আগে অনুধাবন করতে সক্ষম। তবে এটিকে কখনোই নিশ্চিত পূর্বাভাস হিসেবে ধরা যায় না।
জাপানের অভিজ্ঞতা: প্রাণীর আচরণ কীভাবে কাজে লাগানো হয়
এই লেখক দীর্ঘদিন কর্মসূত্রে জাপানে অবস্থান করেছেন। সেখানকার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, জাপানে প্রাণীদের আচরণকে ভূমিকম্প পূর্বসতর্কতার একটি সহায়ক তথ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদিও এটি কোনো আনুষ্ঠানিক পূর্বাভাস নয়, তবে ঝুঁকি বিশ্লেষণে গুরুত্বসহকারে ব্যবহৃত হয়।
১. দীর্ঘমেয়াদি ডেটাবেজ তৈরি: জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়, আবহাওয়া দপ্তর ও প্রাণীবিজ্ঞান গবেষণাপ্রতিষ্ঠান মিলে গরু, কুকুর, বিড়াল, হরিণ, পাখি, ব্যাঙ, কাঁকড়া ইত্যাদি প্রাণীর আচরণ দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণে নথিবদ্ধ করে। ভূমিকম্পের আগের অস্বাভাবিক আচরণ আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়।
২. সেন্সর প্রযুক্তির ব্যবহার: গবাদিপশুর শরীরে চলাফেরা পর্যবেক্ষণের সেন্সর, গতিবেগ নির্ণায়ক যন্ত্র এবং অবস্থান ট্র্যাকিং পদ্ধতি লাগানো হয়। জলজ প্রাণীর জন্য পানির রাসায়নিক পরিবর্তন ধরতে বিশেষ মনিটরিং ব্যবস্থাও রয়েছে।
৩. সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ: জাপানের নাগরিকেরা বিশেষ প্ল্যাটফর্মে রিপোর্ট করেন, ‘কুকুর অস্বাভাবিক অস্থির’, ‘ব্যাঙ হঠাৎ গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে’—এভাবে হাজারো তথ্য সংগ্রহ করে বিশেষজ্ঞরা আচরণগত প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করেন।
৪. সরকারি বিশ্লেষণে প্রাণীর আচরণের সংকেত ব্যবহার: জাপানের ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনায় ব্যবহৃত বিভিন্ন তথ্য, যেমন ভূকম্প পর্যবেক্ষণ, গ্যাস নিঃসরণ, ক্ষুদ্র ভূ-অন্তর্গত পরিবর্তন, প্রাণীর আচরণের অস্বাভাবিকতা—সব একত্রে বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বাংলাদেশে কী করা জরুরি: বাস্তবসম্মত উদ্যোগবাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকির দিক থেকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর অঞ্চল। তবে প্রাণীর আচরণভিত্তিক পর্যবেক্ষণ এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত নয়।
১. বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক গবেষণা প্রকল্প: চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও সংশ্লিষ্ট গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলো মিলে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি, কুকুর-বিড়াল, পাখি, ব্যাঙ, কাঁকড়া ইত্যাদি প্রাণীর আচরণ নিয়ে দেশের প্রথম জাতীয় ডেটাবেজ তৈরি করতে পারে।
২. খামারিদের প্রশিক্ষণ: অস্বাভাবিক আচরণ শনাক্ত ও নথিবদ্ধ করার পদ্ধতি শেখানো জরুরি।
৩. সরকারি পর্যায়ে আচরণ পর্যবেক্ষণ সেল: প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর, আবহাওয়া দপ্তর ও বিশ্ববিদ্যালয় মিলে জাতীয় প্রাণী আচরণ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র গঠন করা যায়।
৪. উভচর প্রাণীর বিশেষ পর্যবেক্ষণ: নদী-হাওর অঞ্চলে ব্যাঙ, মাছ ও কাঁকড়া রাসায়নিক পরিবর্তনে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায়। এ খাতে বড় গবেষণার সুযোগ রয়েছে।
৫. মিডিয়া ও গবেষকদের যৌথ উদ্যোগ: জনসচেতনতার জন্য সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞানভিত্তিক কনটেন্ট তৈরি করা জরুরি।
প্রাণীর আচরণ নিঃসন্দেহে একটি মূল্যবান প্রাকৃতিক ইঙ্গিত। তবে এটিকে কখনোই নির্ভুল ভূমিকম্প পূর্বাভাস ধরা যায় না। তবু জাপানের অভিজ্ঞতা অনুসরণ করে গবেষণা, ডেটা সংগ্রহ, সেন্সর ব্যবহার এবং মানুষ-খামারি-গবেষকদের যৌথ অংশগ্রহণ—এসব শুরু করতে পারলে বাংলাদেশে প্রাথমিক সতর্কতার একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।
ড. এ কে এম হুমায়ুন কবির অধ্যাপক ও গবেষক, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম। [email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প র ণ র আচরণ ব যবহ র কম প প র একট গ রহণ কখন ই
এছাড়াও পড়ুন:
আল্লাহকে সঠিকভাবে চিনব কী করে
আল্লাহর পরিচয় লাভ করা কেবল একটি তত্ত্বীয় জ্ঞান বা গতানুগতিক কিছু উপাসনার নাম নয়, বরং এটি হল হৃদয়, মনন ও আচরণের সম্মিলিত এক অবিচ্ছিন্ন যাত্রা। এই যাত্রার মাধ্যমে একজন মানুষ তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্রষ্টার গভীর প্রভাব উপলব্ধি করতে পারে।
জীবনের অর্থ, উদ্দেশ্য ও প্রশান্তি অর্জনের জন্য আল্লাহর পরিচয় লাভ করা অত্যাবশ্যক। এই পরিচয় লাভের প্রক্রিয়াকে সুগভীর ও ধারাবাহিক কয়েকটি ধাপে ভাগ করা যায়, যা মানবজীবনকে অর্থবহ করে তোলে।
ইহসান হল এমনভাবে ইবাদত করা, যেন তুমি আল্লাহকে দেখছ। যদি তুমি দেখতে নাও পাও, তবে (জেনে রাখো) তিনি তোমাকে দেখছেন।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯১. আত্মসমীক্ষা ও আত্মপর্যালোচনাআল্লাহর পরিচয় জানার প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ হল নিজের ভেতরের জগৎকে জানা। মানুষের বাহ্যিক আচরণ তার ভেতরের অবস্থারই প্রতিফলন। তাই নিজের চিন্তাভাবনা ও অনুভূতিগুলো সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করা জরুরি।
চিন্তা ও অনুভূতির পর্যবেক্ষণ: দৈনন্দিন জীবনে আমাদের মধ্যে যে আবেগ, প্রতিক্রিয়া ও মানসিক অবস্থা তৈরি হয়, সেগুলোর প্রতি গভীরভাবে খেয়াল রাখতে হবে। কেন কোনো নির্দিষ্ট ঘটনায় রাগ হচ্ছে বা খুশি হচ্ছে, তা চিহ্নিত করা প্রয়োজন। এই সচেতন পর্যবেক্ষণ মানুষকে নিজের দুর্বলতা ও শক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে তোলে।
নিয়তের শুদ্ধতা যাচাই: আমাদের প্রতিটি কর্মের চালিকাশক্তি কী? তা কি শুধু কোনো জাগতিক স্বার্থ, লোক দেখানো মনোভাব, নাকি নিঃস্বার্থভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি? নিয়ত হল কাজের মূল ভিত্তি। নিয়ত শুদ্ধ না হলে কর্মের কোনো মূল্য থাকে না। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১)
সতত জবাবদিহিতা: একজন মুমিন সর্বদা নিজের প্রতিটি কাজ, সিদ্ধান্ত এবং অনুভূতির জন্য নিজের কাছে জবাবদিহি করে। কেন এই সিদ্ধান্ত নিলাম? এর ফলাফল কী হতে পারে? এভাবে নিজেকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে ভুল সংশোধনের সুযোগ তৈরি হয়। এই প্রক্রিয়াটি মুসলিম মনীষীদের কাছে ‘মুহাসাবা’ নামে পরিচিত। (ইমাম গাজালি, ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন, ৪/২০৩, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ২০০৫)
ক্রমাগত পরিবর্তন ও পরিমার্জন: আত্মসমীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত দুর্বলতাগুলোকে ধীরে ধীরে উন্নত করার চেষ্টা করতে হবে। খারাপ অভ্যাসগুলো বর্জন করে আত্মাকে বিকশিত করে—এমন ভালো অভ্যাস দ্বারা প্রতিস্থাপন করাই হলো আত্ম-উন্নয়নের পথ। আল্লাহ তায়ালাও এই নিরন্তর প্রচেষ্টার কথাই বলেছেন। (সুরা রাদ, আয়াত: ১১)
আরও পড়ুন‘তোমরাও তো এমনই ছিলে, আল্লাহ তোমাদের অনুগ্রহ করেছেন’১১ নভেম্বর ২০২৫২. স্রষ্টার সৃষ্টিতে গভীর অভিনিবেশআল্লাহর পরিচয় জানার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হল তাঁর মহৎ সৃষ্টি এবং মহাবিশ্বের নিয়ম-শৃঙ্খলা নিয়ে চিন্তা করা। প্রকৃতির দিকে তাকালে আল্লাহর ক্ষমতা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার স্বাক্ষর পাওয়া যায়।
মহাবিশ্ব ও প্রকৃতির পর্যবেক্ষণ: সূর্য ও চন্দ্রের সুনির্দিষ্ট গতিপথ, ঋতু পরিবর্তন, জলচক্রের সূক্ষ্মতা এবং পৃথিবীর জীবজগতের ভারসাম্য নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত। এই নিখুঁত শৃঙ্খলা প্রমাণ করে, এর পিছনে একজন মহাজ্ঞানী, মহাক্ষমতাবান স্রষ্টা রয়েছেন। (সুরা ইয়াসিন, আয়াত: ৩৮-৪০)।
মানব অস্তিত্বে মনোযোগ: মানুষের শরীর, মন এবং তার ক্ষমতা—এগুলো সবই এক সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার উদাহরণ। একজন মানুষের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া, তার চেতনা এবং উপলব্ধির ক্ষমতা নিয়ে চিন্তা করলে স্রষ্টার কারিগরি দক্ষতা উপলব্ধি করা যায়। আল্লাহ বলেন, “আর তোমাদের নিজেদের মধ্যেও; তোমরা কি দেখতে পাও না?” (সুরা যারিয়াত, আয়াত: ২১)
শিক্ষা ও প্রজ্ঞা আহরণ: দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যপটগুলোর সঙ্গে স্রষ্টার সত্যের সম্পর্ক স্থাপন করা। সৃষ্টির প্রতিটি অংশে ভারসাম্য, ন্যায় ও প্রজ্ঞার যে ছাপ রয়েছে, তা থেকে দৈব সত্যকে গ্রহণ করাই হল ‘তাফাক্কুর’ বা গভীরভাবে চিন্তা করা। (আফীফ আব্দুল ফাত্তাহ তাব্বারাহ, আল্লাহ ওয়া উলুম, পৃ. ৭২, মাকতাবা আল-ফাতাহ, দামেস্ক, ১৯৯৮)
কেবল তেলাওয়াত বা মুখস্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, কোরআনের প্রতিটি আয়াতের গভীর অর্থ ও প্রেক্ষাপট বোঝার চেষ্টা করতে হবে।৩. জ্ঞান ও উপলব্ধির অন্বেষণআল্লাহর পরিচয় লাভের তৃতীয় স্তর হলো বিশুদ্ধ জ্ঞান আহরণ এবং উপলব্ধি বৃদ্ধি করা। কেবল ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনাই যথেষ্ট নয়, ঐশী নির্দেশনা থেকেও জ্ঞান লাভ করতে হয়।
কোরআনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করা: কেবল তেলাওয়াত বা মুখস্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, কোরআনের প্রতিটি আয়াতের গভীর অর্থ ও প্রেক্ষাপট বোঝার চেষ্টা করতে হবে। কোরআনের নির্দেশনাগুলোই আল্লাহর পরিচয় লাভের মূল উৎস। (সুরা বাকারা, আয়াত: ২)
ব্যাখ্যা ও প্রেক্ষাপট অধ্যয়ন: কোরআনের ভাষা, ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং আয়াতগুলোর অর্থ বিশদভাবে অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। সমকালীন জীবনের সঙ্গে আসমানী বার্তাগুলোর সংযোগ স্থাপন করার মাধ্যমে জ্ঞানকে ফলপ্রসূ করা যায়।
মানবিক জ্ঞান অর্জন: ফিকহ (আইনশাস্ত্র), তাওহীদ (একত্ববাদ), আখলাক (নৈতিকতা) এবং একই সঙ্গে প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা উচিত। এই জ্ঞানগুলো স্রষ্টা এবং তাঁর সৃষ্টির মধ্যে সম্পর্ককে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করে। ব্যাপক জ্ঞানার্জন স্রষ্টার মহত্বকে উপলব্ধি করার পথ সুগম করে।
আরও পড়ুনআল্লাহ জানেন কিন্তু বাধ্য করেন না০৯ নভেম্বর ২০২৫৪. হৃদয়কে বিনয়ে উজ্জীবিত করাজ্ঞান ও পর্যবেক্ষণের পর আল্লাহর পরিচয় লাভের চতুর্থ ধাপ হলো হৃদয়ের শুষ্কতা দূর করে তাতে বিনয়, ভালোবাসা ও উপস্থিতির ভাব জাগ্রত করা।
পূর্ণ উপস্থিতিতে উপাসনা: নামাজ, জিকির, দোয়া এবং অন্যান্য উপাসনা—এগুলো কেবল রুটিন মাফিক কর্ম নয়, বরং সচেতনভাবে এবং সম্পূর্ণ মনোনিবেশ সহকারে পালন করতে হবে। প্রতিটি রোকন এবং প্রতিটি শব্দে আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করা।
আধ্যাত্মিক অনুভূতির পরিচর্যা: স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং তাঁর প্রতি ভয়ের অনুভূতি হৃদয়ে লালন করতে হবে। এই অনুভূতিগুলো দৈনন্দিন জীবনে মানুষের মনকে প্রভাবিত করে এবং তাকে অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে। (সুরা হাশর, আয়াত: ১৯)
কর্মমুখী আধ্যাত্মিকতা: ধ্যান ও ইবাদতকে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, একে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আধ্যাত্মিক উপস্থিতি বা ইহসান-এর একটি স্থায়ী অবস্থায় রূপান্তর করা। জীবনের প্রতিটি পরিস্থিতিতে স্রষ্টার উপস্থিতি অনুভব করা—এটাই প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা।
রাসুল (সা.) বলেছেন, “ইহসান হল এমনভাবে ইবাদত করা, যেন তুমি আল্লাহকে দেখছ। যদি তুমি দেখতে নাও পাও, তবে (জেনে রাখো) তিনি তোমাকে দেখছেন।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯)
আল্লাহর প্রকৃত পরিচয় লাভ একটি সমন্বিত ও বহুস্তরীয় ভ্রমণ। এটি শুরু হয় নিজের আত্মসমীক্ষা ও জবাবদিহি দিয়ে, এরপর তা প্রসারিত হয় সৃষ্টির নিগূঢ় রহস্য অনুসন্ধানের মাধ্যমে।৫. জ্ঞানকে প্রায়োগিক আচরণে রূপান্তর করাআল্লাহর পরিচয় লাভের চূড়ান্ত এবং সবচেয়ে ফলপ্রসূ ধাপ হলো অর্জিত জ্ঞান এবং হৃদয়ের উপলব্ধিগুলোকে বাস্তব জীবনের কর্মে প্রতিফলিত করা।
ওহিভিত্তিক মূল্যবোধের প্রয়োগ: সত্যবাদিতা, ন্যায়বিচার, দয়া, ক্ষমা, ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা—এইসব গুণাবলি যা আল্লাহর পরিচয়কে প্রকাশ করে, সেগুলোকে দৈনন্দিন জীবনে অনুশীলন করা। প্রকৃত পরিচয় লাভ তখনই হয়, যখন তার প্রভাব জীবনযাত্রায় দেখা যায়। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬০৭২)
সিদ্ধান্ত গ্রহণে দিকনির্দেশনা: আল্লাহর জ্ঞানকে জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এবং সমস্যা সমাধানের জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে ব্যবহার করা। আল্লাহর সন্তুষ্টির ওপর ভিত্তি করে কাজ বেছে নেওয়া একজন পরিচিত মানুষ হিসেবে তাঁর নির্দেশনা মানারই নামান্তর। (আবুল কালাম আজাদ, তাফসিরুল কুরআন, ১/১০, মাকতাবা আশরাফিয়া, ঢাকা, ১৯৯০)
অন্যদের ওপর ইতিবাচক প্রভাব: একজন মানুষের জীবন যখন আল্লাহর পরিচিতি ও জ্ঞান দ্বারা আলোকিত হয়, তখন তার সেই জ্ঞান পরিবার, সমাজ ও পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র যখন ঐশী জ্ঞান দ্বারা পরিচালিত হয়, তখন মানুষ অন্যদের জন্য কল্যাণের উৎস হয়ে ওঠে।
শেষ কথাআল্লাহর প্রকৃত পরিচয় লাভ একটি সমন্বিত ও বহুস্তরীয় ভ্রমণ। এটি শুরু হয় নিজের আত্মসমীক্ষা ও জবাবদিহি দিয়ে, এরপর তা প্রসারিত হয় সৃষ্টির নিগূঢ় রহস্য এবং ওহির জ্ঞান অনুসন্ধানের মাধ্যমে। এই যাত্রার পরিণতি ঘটে বিনয়ী হৃদয় ও বাস্তব জীবনের কাজে ঐশী মূল্যবোধের প্রতিফলনের মাধ্যমে। এই প্রতিটি ধাপই সূক্ষ্ম ও গভীর।
এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণের ফলে একজন মানুষ একটি প্রশান্ত হৃদয়, সচেতন মন এবং একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন লাভ করে, যা জীবনের প্রতিটি বিশদ বিষয়ে তাঁকে আধ্যাত্মিকতার প্রকৃত অভিজ্ঞতা দেয়। এর মাধ্যমে জীবন অর্থবহ হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুনযে ৬ ব্যক্তির দোয়া আল্লাহ ফিরিয়ে দেন না২৮ জুন ২০২৫