বেগম রোকেয়া: মৃত্যুর প্রায় এক শ বছর পরেও কেন প্রাসঙ্গিক
Published: 9th, December 2025 GMT
আজ ৯ ডিসেম্বর ‘বেগম রোকেয়া দিবস’। সমাজে নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা, সামাজিক অধিকার, সুবিচার নিশ্চিতকরণ ও মানবিক মর্যাদার সংগ্রামে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) এক বিদ্রোহী সত্তার প্রতীক। নারীর প্রতি সমকালীন সমাজব্যবস্থা, সামাজিক বৈষম্য, অবরুদ্ধ, প্রথাবদ্ধ সামন্তীয় মূল্যবোধের সংস্কৃতিতে তাঁর ক্ষোভ তীব্র বিক্ষোভে পরিণত হয়েছিল।
শত প্রতিকূল বাধা সত্ত্বেও তিনি যেমন ভেঙে পড়েননি। তেমনি হতাশও হননি। ছিলেন আশাবাদী। স্বপ্ন দেখেছিলেন নারী একদিন পুরুষের সমকক্ষ হিসেবে সমাজকাঠামোর মূল স্রোতে প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই দৃপ্ত শক্তিতে বলীয়ান রোকেয়া কলম ধরেছিলেন সাহিত্যের প্রান্তরে। লিখেছেন ‘মতিচূর’, ‘অবরোধবাসিনী’-এর মতো বিখ্যাত সব রচনা।
রোকেয়ার দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল নারীশিক্ষা ও সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন। সচেতনভাবে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে নারীরা আমাদের সমাজের অর্ধাঙ্গ। এই অর্ধাঙ্গকে উন্নত না করে গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। সে জন্য নারীকে প্রথমত শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। কারণ, অর্থনীতি হলো সমাজকাঠামোর মূল ভিত্তি। যে ভিত্তির ওপর সমাজে নারী-পুরুষের অন্যান্য সম্পর্কগুলোর ভিত মজবুত হয়।
সে জন্য রোকেয়া ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কি রূপে? কোনো গৃহের এক পার্শ্ব বাঁধিয়া রাখিলে সেই গৃহ কি সুন্দর দেখায়? যদি উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা থাকে, তবে আমাদেরও শিক্ষা দিয়া কর্মক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও। নিজের অন্ন-বস্ত্র নিজে উপার্জন করিতে শিখুক।’
অর্থাৎ এ অধিকার ও সুযোগ দেওয়ার অর্থ হলো নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। রোকেয়া জানতেন, যথোপযুক্ত শিক্ষা ব্যক্তিসত্তার আর্থসামাজিক বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর সমাজসত্তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ব্যক্তিসত্তা বিকাশের পূর্বশর্ত।
২.বাংলাদেশের মোট বসবাসকৃত জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশি ৫০.৪৩ শতাংশ নারী। তাই দেশকে উন্নয়নের পথে এগোতে হলে আজকে আমাদের নারী সমাজকে সঙ্গে নিয়েই এগোতে হবে। এ নারী সমাজকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সম্ভব না।
দেখা যাচ্ছে ২০২৩ মাধ্যমিক স্তরে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার ৩৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ। ২০২২ সালে এই হার ছিল ৪০ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এদিকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়ার মোট হার মেয়েদের ক্ষেত্রে ২২ দশমিক ৪৫ শতাংশ (ব্যানবেইস-২০২৪)। অন্যদিকে গত ১০ বছরের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৩ সালে ছাত্রী ভর্তির হার ছিল প্রায় ৩৮ শতাংশ। সেখানে গত বছর (২০২৪) তা বেড়ে হয়েছে ৫০.৪১ শতাংশ। চিকিৎসা শিক্ষায় ৬৩ শতাংশই নারী। এ ছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫৫ শতাংশের বেশি ছাত্রী। তবে কারিগরি শিক্ষায় ছাত্রীদের হার ২৯ শতাংশের একটু বেশি। (প্রথম আলো, ১২ মে, ২০২৫)।
অথচ গত শতাব্দীতেই রোকেয়া লিখেছিলেন, ‘আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কি করিয়া।’
রোকেয়া পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে গত শতাব্দীতে ক্ষোভের উদ্রেকে বলেছিলেন, ‘সমাজ আমাদের উচ্চশিক্ষা লাভ করা অনাবশ্যক মনে করে। এবং স্বীকার করি যে শারীরিক দুর্বলতাবশত নারী জাতি অন্যের সাহায্য কামনা করে। তাই বলিয়া পুরুষ আমাদের প্রভু হইতে পারে না।’ (স্ত্রীজাতির অবনতি, রোকেয়া রচনাবলী)।ওই পরিসংখ্যান আসলে সমাজের গড় হিসাব। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মোট জনগোষ্ঠীর নারীর ক্ষেত্রে তা অপ্রতুল। কারণ, শিক্ষায় নারীর যে অংশ ঝরে পড়ছে বা মূল স্রোতে আসতে পারছে না তাদের আসলে প্রকৃত চিত্র বা সামাজিক অবস্থান কি? তাদের বেশির ভাগ যৌতুক ও বাল্যবিবাহের মতো প্রথার শিকার হন। আবার যাঁরা শেষ পর্যন্ত টিকে আছেন, তাঁদের কজন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন, তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই।
সব মিলিয়ে আমাদের সমাজে এখনো নারীরা পিছিয়ে। শিক্ষা, চাকরি জীবনে বিভিন্ন বৈষম্য, সম্পত্তির উত্তরাধিকার ক্ষেত্রে, পরিবারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে, যৌন হয়রানি ও হেনস্তার শিকার। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা তাঁর অধিকার সম্পর্কে আরও বেশি অসচেতন।
আরও পড়ুনরোকেয়া-স্মরণ: নারী জাগরণের অগ্রদূত, লও সালাম০৯ ডিসেম্বর ২০২১পর্যালোচনায় দেখা যায় উচ্চশিক্ষিত মেয়েদের সামাজিকভাবে বিয়ে, সন্তান জন্মদান, চাকরি ও সংসার চালাতে গিয়ে মানসিক বৈকল্যতার শিকার হতে হচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের সামন্তীয় মূল্যবোধে প্রোথিত শহর ও গ্রামীণ সমাজে উচ্চশিক্ষিত নারীরা কটাক্ষ, হেনস্তার শিকার হন। এসবের প্রতিবাদ করলে তাঁরা হয়ে পড়েন সামাজিক ভাষায় ‘বেয়াদব’।
রোকেয়া এ ধরনের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে গত শতাব্দীতে ক্ষোভের উদ্রেকে বলেছিলেন, ‘সমাজ আমাদের উচ্চশিক্ষা লাভ করা অনাবশ্যক মনে করে। এবং স্বীকার করি যে শারীরিক দুর্বলতাবশত নারী জাতি অন্যের সাহায্য কামনা করে। তাই বলিয়া পুরুষ আমাদের প্রভু হইতে পারে না।’ (স্ত্রীজাতির অবনতি, রোকেয়া রচনাবলী)।
সাম্প্রতিক ব্র্যাকের গবেষণা আরও বলছে এ আধুনিক সময়ে এসেও বাংলাদেশের সমাজে ৬০ শতাংশ বাল্যবিবাহ চর্চা হচ্ছে। যেখানে মাধ্যমিকের আগে ৫৬ শতাংশ মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়। সব মিলিয়ে বিশ্বে বাল্যবিবাহে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। গ্রামীণ সমাজ, শহরের বস্তি, নিম্নমধ্যবিত্ত ছাড়াও শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও আধুনিক পরিবারগুলোতে বাল্যবিবাহ ইদানীং সময়ে চোখে পড়ার মতো।
অন্যদিকে এক সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ৩৬৪ জন ধর্ষণের শিকার, এর মধ্যে ২২০ জন কন্যা ও ১৪৪ জন নারী। ১৪৮ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, যার মধ্যে ৪৯ জন কন্যা ও ৯৯ জন নারী। ১৩৪ জন কন্যা ও ৭৭ জন নারী ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন (বাংলাদেশে নারী ও কন্যা নির্যাতন: ২০২৪ সমীক্ষা)।’ নারীর প্রতি এ অমানবিক নির্যাতনকে রোকেয়া বলেছিলেন পতঙ্গ-ভীতি। যে ভীতি দূর করার জন্য নারী-পুরুষের প্রকৃত সুশিক্ষা কামনা করেছেন। যে শিক্ষায় মানসিক বিকাশ ঘটবে। দূর হবে এসব সমস্যা।
শারীরিক নির্যাতনের বাইরে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে করুণ চিত্র দেখা গেল দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু, রাকসু, চাকসু, জাকসু নির্বাচনের সময় কি ভয়ংকরভাবে নারী শিক্ষার্থী ও কিছু নারী শিক্ষককে চরমভাবে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হতে হলো। ভুয়া অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ফেক আইডি থেকে সুনির্দিষ্ট টার্গেট করে এসব অপকর্ম চালানো হয়েছে। এর পেছনেও ‘নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীদের মূল সমাজ স্রোতে’ আসতে দিতে চায় না এসব সামন্তীয় ভেদবুদ্ধিসম্পন্নতা লালন করে সংঘচক্র জোরালোভাবে কাজ করেছে। এমনকি নির্বাচনের পরও এসব কাজ থেমে নেই। নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিদের প্রতিপক্ষ হয়ে এখনো ওরা সক্রিয়। মানসম্মানের ভয়ে অনেকে নারী শিক্ষার্থী অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে এখন নিজেরাই অপারগ প্রকাশ করছেন।
ইতালির দার্শনিক অ্যান্থোনিও গ্রামসি লিখেছিলেন, ‘সমাজ স্তরে নাগরিকদের ছোট ছোট ক্ষোভ বিক্ষোভে পরিণত হয়।’ যা বাংলাদেশে ১৮’র ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে জুলাই ২৪’র গণ-অভ্যুত্থানে নারী শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ বিস্ফোরণে আন্দোলনে অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। যখন পুরুষ শিক্ষার্থীরা অত্যাচারের শিকার হতে থাকল, তখন নারী শিক্ষার্থীরাও হলের তালা ভেঙে আন্দোলনে নেমে এসেছে। প্রতিবাদ করেছে। নির্যাতনের শিকার হয়েছে। শহীদও হয়েছে কয়েকজন নারী।
তাদের এ আন্দোলনে সম্পৃক্ততা কেবলই কোটা সংস্কার নিয়েই ছিল না। তা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সমাজকাঠামোতে নারী-পুরুষের প্রতি চলমান সব বৈষম্য, নির্যাতন, অত্যাচার, সাইবার বুলিং বন্ধ এবং মানুষ হিসেবে মানবিক মর্যাদা অধিকারের জন্যও ছিল। আজকে ‘রোকেয়া দিসব-২৫’-এ এসেও আমাদের কাছে নারীদের নিয়ে এসব যাবতীয় অপকর্ম ও সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা একধরনের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক চ্যালেঞ্জই বটে।
মনির হোসেন প্রভাষক বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
*মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অর ধ ঙ গ র অর ধ জন ন র আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতি দমনে কতটা সফল
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে। কয়েক দিনের মধ্যেই সরকার অনেকগুলো সংস্কার কমিটি গঠন করে। দুর্নীতি দমনে সরকারের করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ দেওয়ার দায়িত্ব প্রদান করা হয় ড. ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন কমিটিকে। ওই বছরের ডিসেম্বরে কমিটি তাদের সুপারিশমালা সরকারের কাছে জমা দেয়।
আমার কাছে মনে হয়েছিল, এই কমিটি দুর্নীতি সমস্যাটির সমাধানে খুব সাহসী সুপারিশ প্রণয়ন করতে পারেনি। এরপরও সরকার সুপারিশগুলোর বাস্তবায়নে নিষ্ঠার সঙ্গে এগিয়ে যাবে বলেই আশা করেছিলাম। কিন্তু প্রতিবেদন জমা দেওয়ার এগারো মাস পার হওয়ার পর সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকার ডাহা ফেল করেছে বলেই মনে করি।
দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জনে ব্যর্থতার জন্য প্রধানত দায়ী। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মাধ্যমে স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছে। আর ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রকে চরম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাজিত করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে যাত্রা শুরু করেছে ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে।
আরও পড়ুনরাজনীতি ও আমলাতন্ত্রে সংস্কার ছাড়া দুর্নীতি দমন অসম্ভব০৮ ডিসেম্বর ২০২৪লজ্জাজনক পরাজয় মেনে নিয়ে দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে ১৯৭৫ সালে পালাতে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রকে। দুই দশকের বিধ্বংসী যুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর ভিয়েতনাম বাংলাদেশের মতো বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হিসেবে বিবেচিত হতো। ১৯৭৫ সালে সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম যখন বিজয়ী দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল, তখন ‘জ্বলে পুড়ে–মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়’—সুকান্তের এই অবিস্মরণীয় কবিতার লাইনটি আক্ষরিকভাবে প্রযোজ্য ভিয়েতনামের জনগণের ক্ষেত্রে। এতৎসত্ত্বেও ভিয়েতনাম কখনোই কোনো দেশের কাছে মাথানত করেনি, ভিক্ষার জন্য হাত পাতেনি। এমনকি অনুদান ও ‘সফট লোনের’ আশায় জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত হতেও আবেদন করেনি।
অথচ কী নিদারুণ কষ্টকর ছিল ১৯৭৫-পরবর্তী বছরগুলোয় ভিয়েতনামের জনগণের জীবন! ভিয়েতনামের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি ১৯৭৪ সালে ছিল মাত্র ৬৫ ডলার। ১৯৮৬ সালে ‘দোই মোই’ সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণের আগে ১৯৮৫ সালে তা ছিল ২৮৫ ডলার। অথচ ২০২৫ সালে আইএমএফের প্রাক্কলন অনুযায়ী, ভিয়েতনামের মোট জিডিপি ৪৯০ বিলিয়ন ডলার। দেশটির মাথাপিছু প্রকৃত জিডিপি ৪ হাজার ৮০৬ ডলারে পৌঁছে গেছে, যেটা ‘মিরাকল’ বলা হচ্ছে। ক্রয়ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে ভিয়েতনামের মাথাপিছু জিডিপি পৌঁছে গেছে ১৭ হাজার ৪৮৪ পিপিপি ডলারে।
২০২৪ সালে ভিয়েতনামের মাত্র ২ শতাংশ জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। অথচ ২০২৫ সালের জুনে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ২ হাজার ৮২০ ডলার, আর ২০২৫ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের ২৪ শতাংশ জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ২০২২ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে এই অনুপাত ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ।
আরও পড়ুনসরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি কি সরকার নিজেই ঠেকাতে চায়০৬ জুলাই ২০২৪প্রাইমারি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক (ভোকেশনাল) শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে ভিয়েতনাম ২০০০ সালের মধ্যেই তার পুরো জনসংখ্যাকে শতভাগ শিক্ষিত করে তুলেছে। জনগণের বিশাল একটি অংশকে প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনে সফল করে তুলেছে। দেশটির জনগণের শতভাগ ২০২৫ সালে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় সেবা পেয়ে চলেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফলকে কয়েকটি নগরে কেন্দ্রীভূত না করে দেশটি গ্রামীণ জনগণের মধ্যে উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দিতে পেরেছে। এখন ভিয়েতনামে প্রতিবছর বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রবাহ দাঁড়াচ্ছে ২০-২৫ বিলিয়ন ডলার।
এই ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক গতিশীলতার পেছনের চাবিকাঠি হলো, ভিয়েতনামে দুর্নীতির প্রকোপ অনেক কম, দেশটির শ্রমশক্তি বাংলাদেশের চেয়ে অনেক শিক্ষিত, দক্ষ ও পরিশ্রমী। ভিয়েতনামের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন চমকপ্রদ। বন্দর, মহাসড়ক ও সুলভ গণপরিবহনের ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম দ্রুত আধুনিকায়নে সফল একটি দেশ।
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে দেশটি এখন বাংলাদেশকে হটিয়ে মাঝেমধ্যে চীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থান দখল করে নিচ্ছে। ইলেকট্রনিকস পণ্য রপ্তানিতে এখন সিঙ্গাপুরের পর ভিয়েতনাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। চাল রপ্তানিতে থাইল্যান্ডকে হটিয়ে ভিয়েতনাম ভারতের পর বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। ব্রাজিলের পর কফি রপ্তানিতে দেশটি বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। সাড়ে ৯ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভিয়েতনামের মোট রপ্তানি আয় বাংলাদেশের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। ২০২৪ সালে ভিয়েতনামের রপ্তানি আয় ছিল ৪০৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
সাধারণ জনগণ তাদের দৈনন্দিন জীবনে এখনো দুর্নীতির প্রকোপে জর্জরিত। আওয়ামী লীগের পতনের পর অনেক জায়গায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা চাঁদাবাজিতে মেতে ওঠায় জনগণের নাভিশ্বাস উঠছে। ভূমিসংক্রান্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রকোপ আগের মতোই রয়ে গেছে। কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিতে কোনো আঁচড়ই পড়েনি। সরকারি অনেক অফিসেই সেবা পেতে হলে আগের মতো ঘুষ দিতে হচ্ছে। বিচার বিভাগের ঘুষ-দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা আগের মতোই বহাল রয়ে গেছে।ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক মিরাকলের যে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো, তার প্রধান উদ্দেশ্যই হলো এই কথা বলা যে বাংলাদেশের তুলনামূলক পশ্চাৎপদতার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী এখানকার দুর্নীতির অব্যাহত তাণ্ডব। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল বাংলাদেশ বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতি গবেষণা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে পরপর পাঁচবার বিশ্বে চ্যাম্পিয়ন ছিল। ২০২৪ সালেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তানের পর সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বাংলাদেশ। অতএব অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার মিশনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া সমীচীন ছিল দুর্নীতি দমন।
কিন্তু জনমনে ইতিমধ্যে ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে সরকার সাংবিধানিক সংস্কার কিংবা নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কারে যতখানি আন্তরিক, তার তুলনায় দুর্নীতি দমনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে অনীহা দেখিয়ে চলেছে। আমরা বুঝতে পারি, দেড় বছরের শাসনকালে অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে খুব বেশি সফলতা দেখাতে পারবে না। কিন্তু সংগ্রাম শুরু করতে বাধা কোথায়? দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারা কঠোর সংগ্রাম শুরু করে এগিয়ে নিয়ে গেলে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসে ওই সংগ্রাম চালিয়ে নিতে বাধ্য হবে না? বাংলাদেশে শেখ হাসিনার আমলে বেপরোয়া দুর্নীতি, পুঁজি–লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের সংস্কৃতি চালু হয়েছিল।
আরও পড়ুনপরস্পর যোগসাজশে যেভাবে দুর্নীতি হয়ে থাকে২০ আগস্ট ২০২৪শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের একটি শ্বেতপত্রে দাবি করা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মোট ২৩৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। কিন্তু শুধু শেখ হাসিনার দুর্নীতির ভয়াবহতা বর্ণনা করলেই হবে না, গত ১৫ মাসে সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করতে অন্তর্বর্তী সরকার কী কী ‘সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ’ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে, সেই প্রশ্নটাও আসবে?
সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং বেশির ভাগ উপদেষ্টা দুর্নীতি করেন না বলে জনমনে বিশ্বাস জন্মেছে; কিন্তু প্রত্যেক উপদেষ্টার নিয়ন্ত্রণাধীন মন্ত্রণালয়গুলোয় দুর্নীতি দমনে কী কী পদক্ষেপ গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়েছে, সেই ব্যাপারে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি বলে মনে করি।
সাধারণ জনগণ তাদের দৈনন্দিন জীবনে এখনো দুর্নীতির প্রকোপে জর্জরিত। আওয়ামী লীগের পতনের পর অনেক জায়গায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা চাঁদাবাজিতে মেতে ওঠায় জনগণের নাভিশ্বাস উঠছে।
ভূমিসংক্রান্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রকোপ আগের মতোই রয়ে গেছে। কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিতে কোনো আঁচড়ই পড়েনি। সরকারি অনেক অফিসেই সেবা পেতে হলে আগের মতো ঘুষ দিতে হচ্ছে। বিচার বিভাগের ঘুষ-দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা আগের মতোই বহাল রয়ে গেছে।
ঘুষ-দুর্নীতির জন্য কোনো স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরি গত ১৫ মাসে যাওয়ার কোনো খবর পত্রপত্রিকায় পড়েছি বলে মনে পড়ছে না। দুর্নীতি দমন কমিশন সাবেক সরকারের অনেক কর্তাব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা শুরু করলেও কর্মরত কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা শুরু করেছে বলে খবর প্রকাশিত হচ্ছে না।
দেশের সংবিধানে কিছু ত্রুটি থাকার কারণে শেখ হাসিনা স্বৈরাচারী শাসন জারি করতে পেরেছিলেন, দুর্নীতি-পুঁজি লুণ্ঠন-পুঁজি পাচার যার প্রধান বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু দেশের ‘এক নম্বর সমস্যা’ দুর্নীতি, তাই দুর্নীতি দমনকে অগ্রাধিকার না দেওয়াটা অন্তর্বর্তী সরকারের বড় ভুল বলে মনে করি।
● মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
* মতামত লেখকের নিজস্ব