‘সাইবার হয়রানি’ ও ‘মানহানি’র কথিত অভিযোগে ১৮ ব্যক্তি, ব্যঙ্গাত্মক প্ল্যাটফর্ম ‘ইয়ার্কি’ এবং অন্তত ১৫টি ফেসবুক পেজের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি (ভিপি) আবু সাদিক কায়েমের করা ফৌজদারি মামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে আর্টিকেল নাইনটিন। আজ মঙ্গলবার নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটি এ নিন্দা জানায়।

অনলাইনে ‘অপপ্রচার’ ও নারী নেত্রীদের সাইবার বুলিং করার অভিযোগে ১ ডিসেম্বর এসব ফেসবুক পেজ ও আইডির বিরুদ্ধে মামলা করেন ডাকসুর ভিপি আবু সাদিক কায়েম।

বিবৃতিতে আর্টিকেল নাইনটিন বলেছে, মামলার লিখিত অভিযোগে তিনি (সাদিক কায়েম) কোনো নির্দিষ্ট আইন বা দণ্ডবিধির ধারা উল্লেখ না করলেও বিষয়টি সদ্য প্রণীত ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’–এর আওতায় পড়ার কথা। এই অধ্যাদেশ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এবং সাইবার সুরক্ষা আইন, ২০২৩–এর বদলে প্রণয়ন করা হয়েছে। ওই আইন দুটি ভিন্নমত ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানি এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিল।

ডাকসুর ভিপিকে মামলাটি প্রত্যাহার করার অনুরোধ জানিয়েছে আর্টিকেল নাইনটিন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারকে অনলাইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সুরক্ষা দেওয়া আহ্বান জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাটি।

বিবৃতিতে বলা হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য বা সমর্থক, যাঁদের অধিকাংশই বিএনপির সঙ্গে যুক্ত এবং শিক্ষার্থীরা রয়েছেন। এতে আরও বলা হয়, অভিযোগকারী আবু সাদিক কায়েম বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠনের একজন সদস্য। ‘ইয়ার্কি’ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ব্যঙ্গশিল্পী সিমু নাসের পরিচালিত একটি প্ল্যাটফর্ম। এ ছাড়া এই মামলায় রাজনৈতিক বিষয়সহ বিভিন্ন ব্যঙ্গাত্মক বিষয়বস্তু, মিম এবং মন্তব্য প্রকাশকারী ফেসবুক পেজগুলোকেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

আর্টিকেল নাইনটিন বলছে, বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদের (আইসিসিপিআর) ১৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য, মিম, কার্টুন এবং সমালোচনামূলক মন্তব্য, হোক সেটা হাস্যরস, রাজনৈতিক অথবা প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করে; সেটি মতপ্রকাশের ধরন হিসেবে সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষিত। মানবাধিকার সংস্থাটি আরও বলেছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সুস্পষ্ট যে সরকারি কর্মকর্তা বা প্রতিনিধিদের প্রতি করা ব্যঙ্গত্মক মন্তব্য বা সমালোচনা দমনে কখনোই ফৌজদারি বিধিবিধান প্রয়োগ করা উচিত নয়।

বিষয়বস্তুভিত্তিক মতপ্রকাশকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করাকে ‘অতিরিঞ্জন, অপ্রয়োজনীয় এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পরিপন্থী’ হিসেবে উল্লেখ করেছে আর্টিকেল নাইনটিন। মানবাধিকার সংস্থাটি বলেছে, এটি ডিজিটাল নাগরিক পরিসরে একটি ভীতিকর পরিবেশ তৈরির ঝুঁকি সৃষ্টি করে, যা সাংবাদিক, শিল্পী, ব্যঙ্গশিল্পী এবং সাধারণ নাগরিকদের ব্যাপকভাবে সেলফ সেন্সরশিপের (নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার) দিকে ঠেলে দেয়।

এই মামলা ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের পর দেখা দেওয়া গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ও মুক্ত পরিবেশের গণদাবির সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক বলে মনে করে আর্টিকেল নাইনটিন। এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, মৌলিক অধিকার সুরক্ষা, নাগরিক পরিসর পুনরুদ্ধার এবং ডিজিটাল আইনের অপব্যবহার রোধে অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত প্রতিশ্রুতিরও পরিপন্থী এই মামলা।

আর্টিকেল নাইনটিন মনে করে, ভীতি প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসেবে ছাত্রনেতাদের, বিশেষ করে যাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক পদে রয়েছেন, তাঁদের ফৌজদারি আইনের আশ্রয় না নিয়ে অবশ্যই সংযম প্রদর্শন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে হবে।

এ জন্য ‘ইয়ার্কি’সহ ১৫টি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের বিরুদ্ধে করা মামলাটি অবিলম্বে প্রত্যাহার এবং ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য ও অনলাইনে মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে সাইবার, মানহানি ও হয়রানি–সংক্রান্ত আইনের অব্যাহত অপব্যবহার রোধ করতে কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আর্টিকেল নাইনটিন।

এ ছাড়া ফৌজদারি ব্যবস্থার মুখোমুখি হওয়ার ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি সত্ত্বেও মতপ্রকাশের অধিকারচর্চা অব্যাহত রাখা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম, কার্টুনিস্ট, ব্যঙ্গশিল্পী এবং ডিজিটাল নির্মাতাদের প্রতি পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করেছে আর্টিকেল নাইনটিন।

আরও পড়ুনবিভিন্ন ফেসবুক পেজ ও আইডির বিরুদ্ধে সাদিক কায়েমের মামলা০১ ডিসেম্বর ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম নব ধ ক র স স থ ট প ল য টফর ম ফ সব ক প জ র জন ত ক র স রক ষ

এছাড়াও পড়ুন:

ইরাক যুদ্ধে ভূমিকার কারণে গাজা ‘পিস বোর্ডে’ রাখা হচ্ছে না টনি ব্লেয়ারকে

ফিলিস্তিনের গাজার অন্তর্বর্তী প্রশাসনের ওপর তদারকির দায়িত্ব পেতে যাওয়া ‘বোর্ড অব পিস’-এ রাখা হচ্ছে না যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে। ইরাক যুদ্ধে তাঁর ভূমিকার কারণে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সূত্রের বরাতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস এ তথ্য জানিয়েছে।

গত ১০ অক্টোবর থেকে গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ চলছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী—যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে উপত্যকাটি অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর তদারকি করবে ‘বোর্ড অব পিস’ নামের একটি কমিটি। ট্রাম্পের পছন্দেই এই কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাওয়ার কথা ছিল ৭২ বছর বয়সী ব্লেয়ারের।

তবে এ নিয়ে আপত্তি তোলে কয়েকটি আরব দেশ। কারণ, ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল যুক্তরাজ্যও। তখন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ব্লেয়ার। এ বিষয়ে জানাশোনা আছে এমন সূত্রের বরাতে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানিয়েছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী বোর্ড অব পিসে টনি ব্লেয়ার থাকছেন। তবে তিনি অন্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন।

সূত্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ইসরায়েলও বোর্ড অব পিসে ব্লেয়ারকে চায়। তবে আরব ও মুসলিম দেশগুলোর আপত্তি রয়েছে। ওই দেশগুলোর নাম উল্লেখ করেনি সূত্র। তবে চলতি বছরের শুরুর দিকে মিসরে ব্লেয়ারের সফরের কথা উঠলে ব্যাপক প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন দেশটির সাধারণ মানুষজন ও রাজনীতিকেরা।

মিসরের সাবেক মন্ত্রী কামাল আবু এইতা সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ আরবকে বলেন, ‘ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যের সঙ্গে শক্তভাবে জড়িয়ে আছেন এমন একজন ব্যক্তি—টনি ব্লেয়ারকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমরা বিশ্বাস করি না। গাজায় যেকোনো ধরনের দখলদারির বিরুদ্ধে মিসরীয়রা। এই ভূখণ্ড শুধু স্থানীয় মানুষদের মাধ্যমেই শাসিত হবে।’

ইরাক থেকে সাদ্দাম হোসেনকে সরানোর অভিযানে যুক্তরাজ্যের অংশগ্রহণের প্রতিবাদে ২০০৩ সালে মিসরের রাজধানী কায়রো, জর্ডানের রাজধানী আম্মান ও লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছিল। যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনেও প্রতিবাদ জানাতে সড়কে নেমেছিল মানুষ। এর জেরে সে সময় ব্লেয়ারের জনপ্রিয়তায় ব্যাপক ধস নেমেছিল।

২০০৭ সালে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান টনি ব্লেয়ার। এরপর ‘কোয়ারটেট’ নামে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হন তিনি। ওই গোষ্ঠী ফিলিস্তিন-ইসরায়েল শান্তিপ্রক্রিয়া নজরদারির দায়িত্বে রয়েছে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত কোয়ারটেটের প্রতিনিধি ছিলেন ব্লেয়ার। এই কাজে তিনি ইসরায়েলের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন বলে অভিযোগ এনেছিলেন ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা।

আরও পড়ুনগাজা শাসনে ব্লেয়ারের কেন এত আগ্রহ০৯ অক্টোবর ২০২৫আরও পড়ুনইরাক যুদ্ধে 'ভুলের' জন্য ব্লেয়ারের দুঃখ প্রকাশ২৫ অক্টোবর ২০১৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ