জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশব্যাপী চলছে পলিটিক্যাল ক্যাকোফোনি (রাজনৈতিক কোলাহল), সেই সঙ্গে আছে নানা কনস্টিটিউশনাল কনানড্রামও (সাংবিধানিক ধাঁধা)। তৈরি হয়েছে নানা ধোঁয়াশা। নানা অনিশ্চয়তা এক পাশে রেখে আইন ও সংবিধানের নিবিড় পাঠ নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় পাঠকের কাছে হাজিরা দিতেন মিজানুর রহমান খান যদি বেঁচে থাকতেন। এই সময়ে বড্ড প্রয়োজন ছিল তাঁকে।  

মিজানুর রহমান খান বাংলাদেশের আইন সাংবাদিকতার এক দিকপাল। প্রায় একা হাতে প্রতিষ্ঠা  করেছিলেন দৈনিক পত্রিকায় আইন ও সংবিধানের ব্যাখ্যার নতুন বেঞ্চমার্ক। জাহিরিপনা থাকত না বরং একাডেমিক নিয়মের নিগড় পেরিয়ে অন্য মাত্রার বিশ্লেষণ নিয়ে আলোকিত করতেন সব পাঠককে, শ্রেণিনির্বিশেষে।

কঠিন কথা কঠিন করে না বলে চিনির প্রলেপ দিয়ে প্রকাশের একটা রীতি রাজনীতি সাহিত্য এবং সাংবাদিকতায় অনুশীলিত হয়। স্বৈরাচার না বলে বলা হয় কর্তৃত্ববাদী কিংবা ঘুষ না বলে স্পিডমানি—এমন আরও অনেক। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একসময় লায়ার বা মিথ্যাবাদী না বলে বলা হতো ট্রান্সলেটর অব ট্রুথ অর্থাৎ অনুবাদে মূল থেকে বিচ্যুতির অনুমোদন করাই যায়। এই চর্চাকে ইংরেজিতে বলা হয় ইউফেমিজম আর বাংলায় মঞ্জুভাষণ। কিন্তু মিজানুর রহমান খান কঠিন কথা সরল করে বলতেন এবং তা গরল ধারণ করলেও তিনি বস্তুনিষ্ঠ থাকতেন। তাই বোধ হয় তাঁর কলামের নাম ছিল ‘সরল গরল’। আইন-আদালতের নানা বিচ্যুতি–ব্যত্যয় লিখতেন অকপটে। এর জন্য নানাভাবে নিগ্রহের শিকার হলেও মানুষ সত্য জানতে পেরেছে।

নানা পত্রিকা শেষে প্রথম আলোয় শেষ পর্যন্ত ছিলেন। তাঁর শেষ ১৫ বছরের অল্প কিছু লেখা নিয়ে মনজুরুল ইসলামের সম্পাদনায় প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হয় আইন আদালত সংবিধান: নির্বাচিত লেখালেখি নামের একটি বই। বইটিতে তাঁর বিপুল কাজের অল্পই সংকলিত হয়েছে বলা যায়। আশা করি, অন্তত আইনবিষয়ক লেখার পূর্ণাঙ্গ আয়োজন দেখতে পাব।

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের হাত ধরে মিজানুর রহমান খানের পেশাগত উৎকর্ষ পেয়েছিল। মতিউর রহমান আইন আদালত সংবিধান: নির্বাচিত লেখালেখি বইয়ের মুখবন্ধে লেখেন, ‘প্রথম আলোতে সে (মিজানুর রহমান খান) এতটাই অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল যে তাকে ছাড়া আমাদের অনেক কিছুই হতো না, হতে পারত না। আমি বলতে পারি যে ভবিষ্যতেও তার অনুপস্থিতিতে অনেক কিছুই হবে না প্রথম আলোতে। অনেক কিছুই করতে পারব না আমরা।’

আইন, রাষ্ট্র, সংবিধান, কাঠামো, রাজনীতির মতো খটোমটো বিষয় নিয়ে লিখে এমন পাঠকপ্রিয়তা পাওয়া যায়, কেউ ভাবেনি আগে। একজন মিজানুর রহমান খানের সাংবাদিকতা তার প্রমাণ। মলাটবন্দী তাঁর প্রথম বই সংবিধান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্ক (মার্চ, ১৯৯৫)। তখন এ বিষয়ে ব্যবহারজীবী কিংবা রাষ্ট্র ও আইনবিজ্ঞানে বিজ্ঞ ব্যক্তি কম ছিলেন না কিন্তু তিনি অন্যতম পুরোধার দায় নিয়ে লিখেছেন এই বই। 

আমরা অনেকেই জানি না আমাদের কোনো সাংবাদিকের বই কোনো বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। মিজানুর রহমান খানের বই সংবিধান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্ক যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া রেফার করেছে বেশ কিছু বছর আগে। আরেক সংবিধানবিশেষজ্ঞ আরিফ খানের কাছ থেকে জানা যায়, ২০০৮ সালে এই বইকে ডিজিটাইজড ভার্সন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সংযোজন করে বাংলাদেশের সাংবিধানিক আইনের ওপর রেফারেন্স বইয়ের মর্যাদা প্রদান করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এর একটি সম্পূর্ণ নতুন ও বর্ধিত সংস্করণ প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। মিজানুর রহমান খান তা করতে পারেননি। 

তুলতুলে সাংবাদিকতায় ক্ষমতাবানেরা খুশি থাকেন। আর যথা সাংবাদিকতায় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানও নারাজ থাকে। মিজানুর রহমান খানের লেখার কারণে আদালত অবমাননার দায়ে দণ্ডিত হতে হয়। অথচ এই আদালতের বিচারিক স্বাধীনতার লড়াইয়ে তিনি একাই লড়েছেন, অনেকের হয়ে। এই একা লড়াইয়ের অর্জন, সংশ্লিষ্টদের ভালোবাসা। আর কী অসাধারণ এক প্রাপ্তি, বিচারপতি কিংবা আইনজীবী না হয়েও আদালত প্রাঙ্গণে তাঁর জানাজা হয়। এটি বিচার বিভাগের জন্য তাঁর অবদানের স্বীকৃতি।

‘সংবিধান বা বিচার বিভাগ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ, জটিল ও দীর্ঘ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তিনি এর বিশ্লেষণ বা সমালোচনা করতে পারতেন। আমরা প্রথম আলোতে তা ছাপাতাম। আমরা জানি, সাংবাদিকের অ্যাকটিভিজম মানায় না। কিন্তু বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, এর মান–মর্যাদা সমুন্নত রাখা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করার পক্ষে মিজান ভাইয়ের অবস্থান ছিল এতটাই দৃঢ়, যা অনেকটাই অ্যাকটিভিজমের মতো।’ প্রথম আলোর উপসম্পাদক এ কে এম জাকারিয়ার এই পর্যবেক্ষণ মার্ক্সের উক্তি মনে করিয়ে দেয়, পৃথিবীকে সবাই শুধু ব্যাখ্যা করেছেন, আসলে প্রয়োজন একে পরিবর্তন করা। মিজানুর রহমান খান লেখার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে পরিবর্তন করতে চাইতেন।

তিনি ‘সংবিধান পুনর্মুদ্রণে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি’ শিরোনামের কলামের উপসংহারে লেখেন, প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন সর্বোচ্চ পবিত্র আমানত নিয়ে সব রকম খামখেয়ালি অবিলম্বে বন্ধ হোক। অন্যথায় বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটি অভাবনীয় নৈরাজ্যের ঘূর্ণাবর্তে নিক্ষিপ্ত হতে পারে। নাগরিকেরা আইন অমান্যে আসক্ত হবে। তারা কখনো বলবে, সংবিধান নিষিদ্ধ থাকলেই কী, ওসব অমান্য করার দৃষ্টান্ত তো রাষ্ট্রই তৈরি করেছে। (সূত্র: আইন আদালত সংবিধান, ১৪৮ পৃষ্ঠা)। তাঁর এ ভাবী-কথন নস্ট্রাডামাসের প্রফেসির কথা মনে করিয়ে দেয়। কেউ কেউ ভবিষ্যৎ দেখতে পান, তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন, কিন্তু যাঁদের শোনার কথা তাঁরা শোনেননি। এখন তার দায় মেটাচ্ছে দেশ।

এম এম খালেকুজ্জামান আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট এবং দ্য কনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ সার্চ ফর আ জাস্ট সোসাইটি বইয়ের সহসম্পাদক

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

মিয়ানমারের রাখাইনে হাসপাতালে জান্তার বিমান হামলা, নিহত ৩১

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি হাসপাতালে জান্তার বিমান হামলায় অন্তত ৩১ জন নিহত হয়েছেন।

গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ম্রাউক-উতে এ হামলার ঘটনা ঘটে। স্থানীয় ত্রাণকর্মী ওয়ে হুন অং এ তথ্য জানিয়েছেন। এ বিষয়ে জান্তার মুখপাত্র কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

ওয়ে হুন অং আজ বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তিনি বলেন, ‘সেখানকার পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ। আমরা ৩১ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করতে পেরেছি। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছি। হামলায় ৬৮ জন আহত হয়েছেন, যা বাড়তে পারে।’

বুধবার রাতে কমপক্ষে ২০টি মরদেহ হাসপাতালের বাইরে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ভোরে দেখা যায় বিস্ফোরণে হাসপাতালের একটি অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হামলায় স্থানীয় কাঠমিস্ত্রি মাউং বু চে-এর স্ত্রী, পুত্রবধূ ও তাঁর বাবা নিহত হয়েছেন।

মাউং বু চে বলেন, ‘আমার গ্রাম থেকে বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছিলাম। রাতে আমি কল্পনাও করতে পারিনি বোমাগুলো কোথায় আঘাত হেনেছে। এরপর একজন আমাকে জানাল, তারা ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভবনে আছে। তখন বুঝতে পারলাম তারা বেঁচে নেই। আমার কিছু বলার নেই। আমি ভীষণ ক্ষুব্ধ।’

২০২১ সালে নোবেলজয়ী অং সান সু চির সরকারকে উৎখাত করে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করার পর থেকেই দেশটি সংঘাত-সংঘর্ষে বিপর্যস্ত।

ম্রাউক-উ এলাকাটি রাখাইনের উত্তরে অবস্থিত। গত বছর থেকে এটি আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ